Sangita Duary

Tragedy Classics Others

4  

Sangita Duary

Tragedy Classics Others

ভগ্ন আদর্শ

ভগ্ন আদর্শ

10 mins
273



বাস থেকে নেমেই চটপট একটা হিসেব কষে নিল পারমিতা।ফ্রিজে তেমন কোনো সব্জি নেই, চিকেন মাছ যা ছিল কাল শেষ হয়ে গেছে,তিনটে ডিম পড়ে রয়েছে স্রেফ,বোধহয় নুডুলসও শেষ।কাল নমিতা দি আলু ভেজে রেখেছিল,কিন্তু আজ কি খাবে বাড়ি ফিরে?

সামনের দোকানে তেলে ভাজার সুগন্ধ,ওমনি বাবার মুখটা মনে পড়ে গেল পারমিতার।অনেকদিন তেলে ভাজা খাওয়া হয়না,বাবা এত ভালোবাসে খেতে,গরম আলুর চপ দেখে নিশ্চয় খুব খুশি হবে বাবা।

চটপট চপ সিঙ্গাড়া কিনে পারমিতা পা বাড়ালো বাড়ির দিকে।

অফিসফেরত ব্যাপারটা পারমিতা বেশ উপভোগ করে।বাস থেকে নেমে চারিদিক রীতিমত পর্যবেক্ষণ করতে করতে ফেরে,ভালো লাগে ওর,চারিদিক ছড়িয়ে থাকা দোকান বাড়িগুলো নিয়ে নিজের মত ভাবনা সাজিয়ে তোলে;

আরে, মুখার্জী কাকুর চালের গোডাউনে এখনো আলো জ্বলছে,এ সময় তো কাকু আহ্নিক করেন,নিশ্চয়ই পাঁচুটা চাল সরাচ্ছে,

আরে কালিবুড়ি আজ আর চেঁচাচ্ছেনা যে?বাতের ব্যথা বাড়লো নাকি,এই শীতে বুড়ি আর ঠিকবেনা বোধহয়!!!

পারমিতাদের বাড়িটা গলির মধ্যে,বাস রাস্তা থেকে পায়ে হেঁটে তা প্রায় মিনিট দশেক।ছোটবেলায় যখন মামাবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যেত,এদিকটা একদম সুনশান হয়ে যেত,পারমিতা ছোটমামার কানে কানে বলত,"দেখো মামা, সব্বাই ঘুমিয়ে পড়েছে,আমরাই কেবল জেগে আছি!"

ছোট মামা তার চুল ঘেঁটে দিত।

হাসি পেয়ে গেল পারমিতার,ছোটবেলার টুকরো গুলো মনে পড়ে প্রায়ই।ভালো লাগে,মনে হয়,হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যাবে বেশ,চোখ রোগড়ে দেখবো,বড় হয়ে ওঠাটা স্বপ্ন ছিল,আবার মা দুধের গ্লাস হাতে তাড়া দেবে,"উঠে মুখ ধুয়ে,দুধ খেয়ে পড়তে বসো.."

মা এর ওপর রাগ হবে,সারাদিন পড়তে ভালো লাগে!

আবার যখন ছুঁ কিৎকিৎ খেলতে গিয়ে পা ছড়বে, মা দৌড়ে এসে,ডেটল দিয়ে ধুয়ে বোরোলিন লাগিয়ে দেবে,মাকে জড়িয়ে ধরবে কাঁদতে কাঁদতে,মায়ের গায়ের সেই গন্ধ!

আহঃ, সব ব্যথা দূর হয়ে যাবে,

এখন আর কাটা ছড়ায় ব্যথা লাগেনা,এখন যে ব্যথাগুলো অন্যরকম।এ ব্যথা ডেটলে ধোওয়া যায়না,বোরোলিনে সারে না,পারমিতার চোখদুটো প্রায়ই জ্বালা করে ওঠে আজকাল,জলে ভরে যায়,আজ যে তার মাকে কি ভীষণ দরকার ছিল!ছলছল চোখে পারমিতা আকাশের দিকে তাকালো, ফিরে এসো মা!


পারমিতাদের বাড়িটা একটু অন্যরকম,একসময় একান্নবর্তী ছিলো, বাবারা পাঁচভাই একসাথে।সময়ের সাথে পরিবার বেড়েছে,টুকরো হয়েছে,যে যার মতো গুছিয়ে নিয়েছে একতরফা,ব্যতীত এই বাড়িটা।তিনবিঘে জমির ওপর বেশ পেল্লায় তিনতলার কঙ্কাল।প্রমোটারদের কোনো প্রলোভনে সাড়া দেননি পরিমল বসু।নিজের বাবাকাকার ভিটেবাড়ি,মায়া কাটানো এতই সোজা!এ বাড়িতে জন্ম ,বেড়ে ওঠা,বিয়ে,বাবা হওয়া,আবার এবাড়িতেই তো ,মিতুর মার..তাকে একা করে দিয়ে চলে যাওয়া,এখন সারা বাড়িতে স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকা ছাড়া কিই বা করতে পারেন ষাটোর্ধ্ব পরিমল বসু?তবু যাইহোক মেয়েটা তো আছে,তবে তা আর কতদিন?মেয়ে যখন,পরের বাড়ি পাঠাতে তো হবেই,কতদিনই বা মেয়েকে আঁকড়ে থাকবেন?না আজ মিতু ফিরলেই কথা বলতে হবে,ওর যদি কাওকে ঠিক করা থাকে,ভালোলাগা থেকে থাকে...পরিমল বাবু পায়ে চটি গলিয়ে রান্নাঘরে এলেন,নমিতা রাতের রান্না করে দিয়ে গেছে,পরিমল ফ্রিজ খুলে দেখে নিলেন একঝলক।ডাল আর পোস্ত,সারাদিন বেচারির ভাত জোটেনা তাই রাতে মিতু ভাতটাই খায়,এহে, সবজি মাছ মাংস কিছুই তো নেই যে,তাছাড়া ফিরেই তো আর মিতু ভাতে বসবে না,টুকিটাকি তেমন তো কিছুই নেই রান্নাঘরে।বাজারটা একবার ঘুরে এলে হয়,সবে সাড়ে সাতটা,এমন কিছু রাত হয়ে যায়নি এখনও।পরিমল পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে পার্সটা দেখে নিলেন,ঘরে পরার চটি ছেড়ে জুতোটা পায়ে গলিয়ে বেরোতে যাবেন,এমনি সময় দরজায় বেল।মিতু এলো?এক্ষুনি?পরিমল দরজা খুলতেই মুখার্জির দোকানের পাঁচু হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো,পরিমল কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পাঁচুর আর্তনাদ,"আমার বোনকে বাঁচান কাকু,"।


**********


কি ব্যাপার?সদরদরজা ভেজানো,বসারঘর অন্ধকার,বাবা গেল কোথায়?পারমিতা বেশ কয়েকবার ডাকলো বাবাকে,এই সময় আবার কোথায় বেরোলো বাবা?তেলেভাজা গুলো যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!

একি, বাবার মোবাইলটাও তো টেবিলে পড়ে।তাহলে নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছে,এক্ষুনি চলে আসবে,পারমিতা জুতো খুলল,কাঁধের ঢাউস ব্যাগটা টেবিলে রেখেই সটান বাথরুমে ঢুকলো,শাওয়ার খুলে দিলো,সারাদিনের ক্লান্তি,অবসাদ ধুয়ে যাচ্ছে,তাজা হচ্ছে শরীর মন।আজ সারাদিন অফিসে হেব্বি খাটুনি গেছে।কুহেলী বিয়ে করে দিন সাতেকের ছুটিতে আছে,কিন্তু ওর কাজ তো আর বসে থাকবেনা,পত্রিকার অফিস,প্রতিনিয়তই ঘটনা ঘটছে,আর ঘটনা গুলো খবর হচ্ছে,তা একটা স্টাফ ঘরে বসে বিয়ের লাড্ডু খাচ্ছে বলে অফিস তো আর পস্তাবেনা, দুজনের কাজ একজনের ঘাড়ে এসে উঠবে,অগত্যা কুহেলির পক্সিটা পারমিতাকেই দিতে হচ্ছে।ছুটতে হচ্ছে,একবার স্পটে যায়,নিউজ কভার করো,লেআউটের ঝামেলা সামলাও,গ্রাফিক্সে বসে থাকো অন্তহীন,গোদের ওপর বিষফোঁড়া আবার ওই চশমখোর তমালটা।ইনসিডেন্টের থরো কপি চাই,হ্যান্ডরিটেন।পারমিতা আজকে ঝেড়েই দিত,টানা দুটো ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখলো,কি না আগের ইস্যুটা আগে শেষ হোক,আরে ভাই পারমিতার ও তো কাজ আছে,এক্ষুনি এডিটিংয়ে বসতে হবে তাকে।ইচ্ছে করছিল কুহেলীর ঘেঁটি ধরে টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিতে, একে তো নিজের কাজ নিয়ে জেরবার,তার ওপর উনি চারটে ফাইল পেন্ডিং ছেড়ে গেছেন।নিজে বিয়ে করে "কতো না ভাগ্যে আমার"করছে,এদিকে পারমিতার কালঘাম ছুটছে।বসটাও কম যাননা।চোখ বন্ধ করতেই আহুজার মুখটা ভেসে উঠলো পারমিতার।সবে মনিটর বন্ধ করে চেয়ারটা ছাড়বে,বস হাজির,"মিস বাসু, কাল মর্নিং আওয়ারেই কিন্তু আমার কপিটা চাই,ওম্যান ডে টাকে আপনারা যখন নিজেদের এক্তিয়ারেই ধরে নিয়েছেন তখন ওই দিনটার কথা মাথায় রেখেই আমার একটা সিনসিয়ার আর্টিকেল চাই,ডোন্ট বি কেয়ারলেস"।উফফ যেন যমদূত,বছর পঞ্চাশের সৌম্য ভারিক্কি চেহারার বিমল আহুজা কাজের বেলা একশ দিয়ে দুশো নিংড়ে নেবেন।পারমিতার মেজাজ টঙে উঠে গেল।"কেয়ারলেস"সে?ইচ্ছে করছিল,এক্ষুনি রেজিগনেশন দিয়ে দেয়।নিজেকে বুঝিয়ে মাথা ঠান্ডা করলো।সব ওই কুহেলির জন্য।শাঁকচুন্নিটা অফিসে ফিরুক একবার!

রোমকূপ জলে ভিজে ঠান্ডা হয়েছে খানিকটা।উত্তেজনাটাও কমেছে কিছুটা।

পারমিতা নাইটি চাপিয়ে বসারঘরে এলো,এখোনো বাবা এখনো ফিরলোনা?মনটা চা চা করছে,পারমিতা ল্যাপটপ টানলো,যাক গে বাবা এলেই না হয় জল চড়াবে, অনেকদিন পর বেরিয়েছে মানুষটা,একটু ঘুরুক না,তাতে মনটা যদি একটু ভালো হয়,সারাদিনটা তো ঘরেই কাটে,ততক্ষণ আহুজার আর্টিকেলটা নিয়ে বসা যাক।

*******

কাজের মধ্যে ডুবে গেলে পারমিতার বাহ্যজ্ঞান থাকেনা।প্রায় দুটি ঘন্টা খরচ করে আর্টিকেলটা দাঁড় করলো,মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে,কাজ মনের মতো হওয়ার পরিতৃপ্তিটাই আলাদা।পারমিতার ঠোঁটের কোনে চিলতে হাসি,গ্রাফিক্সের তমালটা প্রত্যেকবার তার একটা না একটা ভুল ধরে,"পারো,এই জায়গায় একটা কমা হতো না?,"কিংবা,"যতিচিহ্ন এখানে থাকার কথা নয়",আরে,কাকা লেখার মধ্যে সেন্টিমেন্টটা দেখো আগে,এবার পারমিতা কোনোরকম ফাঁক রাখবেনা, বারবার চেক করেছে লেখাটা।চিহ্ন তো দূর ,যা সব রেফারেন্স দিয়েছে না,আশির দশকে রাজস্থানের রূপ কানোয়ার থেকে একুশ শতকের উত্তরপ্রদেশের সাতপুরওয়ার চরণদেবীর স্বামীর চিতায় সহমরণ...খবর রাখে তমাল এসবের?ব্যাকরণ শর্মা!..."গ্রামাটিক্যালি কারেক্ট চাই পারো.."

গ্রামারের তুই কি বুঝিস রে?যত্ত সব!

জান লড়িয়ে লিখেছে পারমিতা...ধর্ষণ থেকে ইভটিজিং,পণ থেকে খোরপোষ,ব্রেকআপ থেকে ডিভোর্স,তমালের চেয়ার উল্টে যাবে,আরে এ যে সে নয় খোদ নারীদিবসের ইয়ে,কি যেন বলে,হ্যা হ্যা, তাৎপর্য,পারমিতা পুরো ঠুসে দিয়েছে।

ল্যাপটপ টেবিলে রেখে আড় ভাঙলো একটা,আহঃ কি স্বস্তি,এককাপ কফি খেলে হয়,কটা বাজে,পারমিতা বসারঘরের ঘড়ির দিকে তাকালো,সাড়ে নটা,মুহূর্তে সম্বিৎ ফিরল,আরে বাবা এখনো ফিরলোনা!ঘরেই কোথাও আছে নাকি?পারমিতা সারা বাড়ি খুঁজে এলো একবার,না,কোথাও নেই।বুকটা হঠাৎ যেন ধড়াস করে উঠলো,এমন তো কখনো হয়না,মা মারা যাওয়ার পর থেকে,বাবা তো প্রায় বাইরেই বেরোয় না।

তাও এত রাতে ?

পারমিতা একা একা এখন কোথায় খুঁজবে বাবাকে?পাড়ার কারোর সাথে সেভাবে মেশেওনা,যে কাউকে একটা ডেকে নেবে,আর তাছাড়া এত রাতে কেই বা তার সাথে যাবে।পারমিতার হাতপা কাঁপছে, কোথায় না কোথায় যেতে হবে,একা একা বেরোতে সাহসেও কুলোচ্ছে না।

প্রয়োজন পড়লেই বোধহয় ভালোবাসার মানুষটিকে মনে পড়ে সব চেয়ে বেশি।সমর...সমরকে একটা ফোন করবে?কিন্তু সমর তো...পারমিতা নিজেকে বোঝালো, বিচ্ছেদের শেষবেলায় ও তো বলেছিল যখন প্রয়োজন পড়বে কোনো কিছু না ভেবে যেন সবার আগে ওকে প্রথম ফোন করে পারমিতা...কোনো উৎকণ্ঠা নয়...সমরের খুব ভালো লাগবে যদি সে সত্যিই পারমিতার কোনো প্রয়োজনে লাগে....

বিপদের সময় অহম নিজের উপস্থিতি জাহির করেনা, উচিত অনুচিত কার্য ভুলে প্রয়োজনটা-ই অগ্রাধিকার দাবি করে।

সমরকে একটা ফোন করতে হবে,আর কোনো ভাবভাবি নয়।পারমিতা মোবাইলটা কানে চেপে ধরল,এক একটা রিং যেন সাইরেনের মতো বাজছে।আগেও তো কত লক্ষ কোটিবার সমরের সাথে কথা হয়েছে ফোনে,এরকম অনুভূতি,এই প্রথমবার।

ওপ্রান্তে আওয়াজ আসতেই পারমিতা কেঁদে ফেলল,"আমি বাবাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা সমর,বাবা এখনো বাড়ি ফেরেনি,তুমি এক্ষুনি একবার আসবে?"

ফোন রেখে পোশাক বদলে নিলো পারমিতা,মাসির বাড়ি একবার ফোন করে দেখবে?না না ওখানে গেলে তো মাসিই এতক্ষনে জানিয়ে দিত।,তাহলে মুখার্জি কাকুর কাছে?না,মুখার্জি কাকু তো চারদিনের জন্য মেদিনীপুর গেছেন,কালই তো বাবাই বলল সে কথা।পাড়ার আর কারোর কাছে তো বাবা যাবেনা!

একটু পরই সমর এলো,তাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার বন্ধ লাইব্রেরি,হারু দার বন্ধ চায়ের দোকান,আশেপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ি এমনকি কাছেপিঠের কয়েকটা নার্সিংহোমে হানা দিয়েও কোনো লাভ হলোনা,বাবা কাছেপিঠে কোত্থাও নেই।

কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখলো সমর,এগারোটা বাজতে দশ, "এত রাতে থানায় গিয়েও কোনো লাভ হবেনা,চলো তোমায় বাড়ি ছেড়ে দিই ,এতক্ষনে যদি উনি বাড়ি ফিরে এসে থাকেন,নাহলে কাল সকালে..."

সময় বড় নিষ্ঠুর,সুখের সময় কত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়,গাছের পাতা থেকে একবিন্দু শিশির ঝরে পড়ার মতো,কিন্তু অপেক্ষার সময় যে অন্তহীন,এক একটা মিনিটও বড্ড কঠিন লাগে তখন,অফিস থেকে ফিরে পরেরদিন অফিস যাওয়া পর্যন্ত পারমিতা টেরও পায়না ঘড়িটা আরো বারো ঘন্টা এগিয়ে এলো।নিজের বয়সের সাথে আরো বারো ঘন্টা যোগ হলো।আজকের অপেক্ষা বাবার জন্য...অপেক্ষা একসময় সমরের জন্যও ছিল।আজ প্রায় দেড় ঘণ্টা সমর সঙ্গে ছিল,অথচ,এককালের ভালোবাসার মানুষটিকে এতদিন পর সামনে পেয়েও স্রেফ একটা মানবশরীর ব্যতীত পারমিতার আর কিছুই মনে হয়নি,সমর চলে যাওয়ার সময়ও একবারও পিছু ফিরে দেখার ইচ্ছে হয়নি মানুষটা সত্যিই চলে যাচ্ছে কিনা..ভালোবাসা কি সত্যিই সময়ের সাথে এভাবেই মলিন হয়ে যায়?নাকি প্রাপ্যটুকু থেকে বঞ্চিত হলে সেই অপেক্ষাটাও,প্রত্যাশাটাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ধীরেধীরে?

ছোটবেলায় বাবাকে বিশেষ কাছে পায়নি পারমিতা,সংসারটা কতটুকুই বা বাবা করলো?দশটা পাঁচটা অফিস, বাড়ি ফিরে পাড়ার লাইব্রেরি,ছুটছে কখন কার কি বিপদ, তার পাশে দাঁড়াতে।ফিরত অনেক রাত করে,ছোট্ট পারমিতা তখন ঘুমিয়ে কাদা।আবার সকালে উঠে টিউশানি,মাস গেলে মায়ের হাতে টাকা তুলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো দায়ই ছিলনা বাবার,তখন মাই ছিল সব,একদম কাছের মানুষ,ছুটির দিনে,বন্ধুরা বাবার সাথে বেড়াতে যেত, পরিমল বসু যেতেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়,বন্ধুদের বাড়ি,সব্বার প্রয়োজনে কাজে আসতেন পরিমল বসু, একমাত্র নিজের সংসারটুকুর প্রয়োজন ছাড়া,নিজের স্ত্রী কন্যার প্রয়োজন ছাড়া।


মা কিন্তু কোনোদিন প্রতিবাদ করেননি,কোনো অভিযোগ করেননি,মানুষের জন্য স্বামী কাজ করছেন,এটাই তো সব চেয়ে গর্বের,তুচ্ছ সাংসারিক ঝামেলায় কেন তাঁকে আর জর্জরিত করা?পারমিতার যখন কলেজ ফাইনাল মার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ল,এডভান্স স্টেজ, মা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে ধীরে ধীরে,বাবার হয়ত সুমতি এসেছিল তখন,আজীবন অবহেলায় বাঁচিয়ে রাখা স্ত্রীর শেষ সময়ে সারাক্ষণ মাথার কাছে বসে থাকতেন পরিমল।তখন থেকেই লোকটা কেমন যেন গুম হয়ে গেলেন।সারাদিন বাড়িতে,বাইরে বেরোননা, কারোর সাথে কথা বলেননা, মার ছবির সামনে নির্বাক বসে থাকেন সারাদিন।সমরের সাথে সম্পর্কটাও তখন নয় নয় করে তিনটি বছর কাটিয়ে ফেলেছে পারমিতা।চাকরি পেতেই সমরের বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ,কিন্তু মিতু এই অবস্থায় বাবা ছেড়ে কি করে ...

সমরের বিয়ে হয়ে গেল,কাছের মানুষ বলতে মিতুর আর কেউ রইলনা।এরমধ্যে একটা পত্রিকার অফিসে পারমিতা চাকরি পেল,একাকিত্ব থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি,বাবাও ধীরে ধীরে ধাতস্ত হচ্ছে,আড্ডা বলতে মুখার্জিকাকু আর লাইব্রেরি।হোক গে সুখের চেয়ে স্বস্তি তো ভালো।কিন্তু আজ,কোথায় চলে গেল বাবা...

বসার ঘরে মার একটা অয়েল পেন্টিং,ঘোমটা মাথায় নিস্পলক থাকিয়ে আছেন,সেভাবে কোনোদিন স্বামী সুখ পাননি,শখ আহ্লাদও মেটেনি কিছুই,অথচ মার মুখের হাসিটা লেগে থাকতো সর্বক্ষণ,বাবার জন্য অনেক বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়েছে মাকে,কোনোদিন এতটুকু অভিযোগ করেননি,শুধু কি বাবাকে ভালোবাসতেন বলেই?

তবে কি পারমিতা বাবাকে ভালোবাসতে পারেনি কোনোদিন,নাহলে এখনো তার মনে বাবার জন্য এত অভিযোগ জমে উঠেছে কেন?

মাথাটা ভারী হয়ে আসছে পারমিতার,এই বিশাল পৃথিবীতে সে যে বড্ড একা...

হঠাৎ দরজায় ধাক্কা,দরজা খুলতেই বাবা ঢুকল হুড়মুড়িয়ে।একি অবস্থা বাবার?চুল উস্কো খুস্কো,পাঞ্জাবির হাতা টা ভেজা,পাজামার তলা কাদায় মাখামাখি।পারমিতা কিছু বলার আগেই পরিমল এগিয়ে গেলেন মেয়ের কাছে,চোখদুটি অস্বাভাবিক জ্বলছে।

"পাঁচুর বোনটাকে বাঁচাতে পারলামনা মিতু,মেয়েটা লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল জানিস,আজ সকালে কলেজ যাওয়ার পথে কয়েকটা ছেলে মিলে ওকে রেপ করে,ওই যে দাসপাড়ার পোড়ো মন্দিরটায়,

বিকেলে ও পড়ার কয়েকজন ওকে চিনতে পেরে পাঁচুকে খবর দেয়...

ওদের তো অভিভাবক বলতে কেও নেই,হাসপাতালে ভর্তি নিতে চায়নি প্রথমে...

পাঁচু আমায় ডেকে নিয়ে গেল...

জানিস মিতু,মেয়েটা মৃত্যুকালীন ছেলেগুলোর নাম বলে গেছে,তাদের একজন এমএল এর ছেলে...

আমি থানায় যেতে চেয়েছিলাম,পাঁচুটা যেতে দিলোনা;থানা পুলিশ করলে তো ও আর ওর বোনকে ফিরে পাবেনা, উল্টে আমি নাকি বিপদে পড়বো, তুই নাকি বিপদে পড়বি...

জানিস মিতু,আমি দেখলাম,ঘন্টাখানেক পর একটা গুন্ডা মতো লোক পাঁচুর হাতে টাকা গুঁজে দিচ্ছে আর আঙুল উঁচিয়ে কি যেন বলছে...

আমি পাঁচুকে অনেক বোঝালাম,...ওদের ছেড়ে দিসনা...অপরাধীদের শাস্তি হওয়া উচিত...ও শুনলোনা..."

শুকনো চোখে পরিমল মেয়ের দিকে তাকালেন,"

তুই পারবিনা কিছু করতে?ছেলেগুলোকে উচিত শিক্ষা দিতে?তোদের পত্রিকা তো নারী সংগ্রামের কথা বলে..."

বুকের ভিতরটা তোলপাড় করছে পারমিতার।হাজার অভিযোগ,সেই এক স্বভাব,আজও রয়ে গেল,স্ত্রীর মৃত্যুও একটুও স্বভাববিরুদ্ধ করতে পারলোনা লোকটাকে।পারমিতার গলা উঁচিয়ে বলল,"সবার উপকার করে নিজে কি পেয়েছ?যার বোন সে যখন টাকা গুনে থেমে গেল,তখন তুমি কেন পাগড়ি এঁটে মাতব্বরি করতে চাইছো?দেখাতে চাইছো তুমি কত মহান?সবার তো ভালো করতে চাও,মার মৃত্যুর সময় কটা শুভাকাঙ্খী তোমার পাশে ছিল?বাঁচাতে পেরেছ মাকে?নিজের মেয়ের জন্য কোন কর্তব্য করেছ?শুধু তোমার জন্য বাবা,আমি সমরকে হারিয়েছি(পারমিতার গলা কেঁপে উঠলো,জলে ভোরে উঠলো দুচোখ),তোমার খোঁজে কটা লোক পাশে ছিল আমার?লির্জজ্জের মতো সমরকে ডেকে ফেলেছিলাম,তোমার একবারও মনে হয়নি,বাড়ি ফিরে মিতু খোঁজ করবে তোমার?একবারও মনে হয়নি তোমার অন্যের বোনের জন্য সুবিচার চাইতে গিয়ে তুমি নিজের মেয়ের প্রতি অবিচার করে ফেলছ?...হ্যা,পাঁচু ঠিক বলেছে,আমি কিছু স্টেপ নিলে,আমি বিপদে পড়বো, বাবা,আমিও একটা মেয়ে,রাতবিরেতে আমাকেও বাড়ি ফিরতে হয়,আমার কিছু হলে,পাঁচু ছুটে আসবেনা তোমার পাশে দাঁড়াতে...সরি বাবা আমি তোমার মত ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়াতে পারবোনা..."।


ভেজা হাতে ইলেকট্রিক বোর্ড ছুঁলে কি এতটাই শক লাগে?হুহু করে উঠলো বুকের বাঁ পাশটা, পরিমল হেরে যাওয়া চোখে মেয়ের চলে যাওয়া দেখলেন।এ কি তাঁর মেয়ে?

সালটা ছিল সাতানববই,সেপ্টেম্বরের ছয়।মা টেরেসা যেদিন প্রয়াত হলেন তার পরের দিন।হাসপাতালের বিছানায় সদ্যজাত মিতুকে কোলে নিয়ে রোমিতা বলেছিল,"আমার কোলে মা টেরেসা ফিরে এসেছেন গো, আমি স্বপ্নে দেখেছি।তোমার মেয়েকে আমি ঠিক ওনার মতো করে গড়ে তুলবো,দেখো!সবার জন্য ভাববে,সবার উপকার করবে,এই আত্মকেন্দ্রিক পৃথিবীতে তোমার মেয়ে হবে তোমার গর্ব,অমূল্য রতন,মা দুর্গার মত তেজস্বিনী।ওর কাজে অবালবৃদ্ধ নির্বিশেষে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করবে ওকে,সম্মান করবে।"

পরিমলের চোখের সামনে ভেসে উঠলো টুকরো কিছু ছবি...

রাতে মিতু কাঁদতো খুব।সারারাত কোলে নিয়ে বসে থাকতে হত।

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে পরিমল নিয়ম করে রাত জাগতেন।মিতুর কাঁথা বদলাতেন...স্ত্রীর বিশ্রাম প্রয়োজন,একমাত্র খাওয়ানোর সময় টুকু ছাড়া ঠাঁয়ে মিতুকে কোলে নিয়ে দোলনা দিলেন সারা রাত,যাতে মেয়ে না কাঁদে আর রোমিতারও না ঘুম ভেঙে যায়... ভোরের দিকে মিতু ঘুমাত, রোমিতা স্বামীকে ঘুমোতে যেতে বলতেন,পরিমল যেতেননা, ঘুমন্ত মেয়েকে দেখতেন পাশে শুয়ে,কি নিষ্পাপ ফুলের মতন ছিল তাঁর টেরেসা...

স্বল্প রোজগারে মেয়ের ভবিষ্যৎ দাঁড়াবে না,তাই সকালে টিউশানি করতেন পরিমল,উঠে নাকেমুখে একটুকিছু গুঁজেই ছুট,অফিসে।

আজীবন লোকের উপকার করেছেন,পরিমলকে তাই প্রয়োজনে সবাই মনে করতো,কারোর ডাক অবহেলা করেননি।মেয়ের জন্য ছটপট করতো মনটা।

রাতে বাড়ি ফিরে সটান মেয়ের কাছে,কিন্তু মিতু তখন ঘুমিয়ে কাদা।ঘুমন্ত ফুলের কপালে চুমো এঁকে দিতেন আদরে,একটা মশা আসতে দিতেন না মেয়ের কাছে,সদা সতর্ক মেয়ের কাছে থাকতেন বাকি সময়।

সেই মিতুটা আজ কেমন বড় হয়ে গেল...এত দিন টের পাননি,কিন্তু আজ মেয়ের বড় হয়ে ওঠাটা বড্ড বেশি করে বুকে বাজছে।

গুটিগুটি পায়ে স্ত্রীর ছবির সামনে এলেন পরিমল,দুচোখ মেলে ধরলেন স্ত্রীর দিকে,"মেয়েকে মানুষ করতে কার খামতি ছিল রুমি...তবে কি মেয়ের মতো তোমার মনেও আমার জন্য এতো অভিযোগ জমেছিল...এত বছর একসাথে থেকেও তা ঘুনাক্ষরেও টের পেতে দাওনি...কেন?"

কেঁদে ফেললেন পরিমল।অভিমান জমে গিয়ে যখন বিচ্ছেদের হিমশৈল তৈরি হয় তার আঘাত যে অনেক যন্ত্রণার,হয়তো বা মৃত্যুর চেয়েও শীতল!!!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy