ভালোবাসার স্বর্ণ লঙ্কা
ভালোবাসার স্বর্ণ লঙ্কা
জন্ম কলকাতায় হলেও আমার পুরো ছোটবেলা কেটেছে আরব দেশে। মরুভূমির মধ্যে তেল তাই দুনিয়ার সব দেশের লোকের সমাবেশ। আমাদের অভাব ছিল না ,বালিতে খেলেছি সমুদ্র স্নানের সময়ে। ছুটিতে বিদেশ বেড়াতে যেতাম;একবার দুবার কলকাতাকে ছুঁয়ে। জেঠু ,কাকাদের চিনতাম ,দাদু ঠাকুমাকে দেখেছি। কিন্তু গ্রামের মামাবাড়িতে কখনও যাওয়া হয় নি। মামাবাড়ির পরিচয় আমার মায়ের মুখের গল্পে। আমার দুই মামা ,মায়ের থেকে ছোট। বড়মামা রবিমামা ,মা পরিচিয় করিয়ে দিয়েছিলো ,"রবিমামা দেয় হামা ,গায়ে রাঙা জামা ওই " এর ছন্দে। ছোটমামা চাঁদু মামা অনেক বার দেখেছি ছাদের দোলনায় মায়ের কোলে বসে। তখন খুব ছোট ছিলাম না ,কিন্তু মা বড়ো চাঁদ দেখলেই কেমন হয়ে যেতো ,আমাকে মনের দোলনায় বসিয়ে, "আয় আয় চাঁদমামা খোকার কপালে টিপ্ দিয়ে যা " বলে একটুকরো চাঁদের আলো আঙুলে করে আমার মাথাতে ছোঁয়াতো। একটা গভীর আর্তনাদ আমার কানে লাগতো।
আমার দাদামশাই বহু ধনী ছিলেন ,কিন্তু পয়সার বাজারে নিজেকে বেচে দেননি। হাঁটু অব্দি ধুতি আর ফতুয়া পরে থাকতেন ;মা বলেছিলো দাদু নাকি একটা আমেরিকান আর্মির জন্যে একটা এয়ারপোর্ট তিন সপ্তাহে বানিয়েছিলেন আর তখন আর্মির চিফের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ওই বেশে। দাদু পুজোর সময়ে সব্বাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যেতেন ,সঙ্গে যেত গ্রামের সকালের জন্যে ধুতি,শাড়ি ,গামছা আর ইজের -বেশ কয়েক হাজার।
মা বলতো তার ছোটবেলার পুজো ভ্রমণের ইতিকথা আর আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম ,একবার নয় বারবার। গ্রামটা অখ্যাত -বর্ধমান শহর থেকে ৩২কিলোমিটার দূরে শিবতলা। রাস্তায় বাস চলতো। সেখান থেকে তিন ক্রোশ ধান খেতের মধ্যে দিয়ে গরুর গাড়ি চলবার পথ ,তারপরে পৌঁছবে মায়ের গ্রাম ,নাম ঘোষগাঁও। মায়ের ঠাকুরদা পত্তন করেছিলেন ,তাই তাঁর পদবির সম্মানে গ্রামের নাম।
সেই সময়ে কয়লার ইঞ্জিন টানা ট্রেনে হাওড়া -বর্ধমান যেতে লাগতো পাঁচ -ছ ঘন্টা। ভোরে উঠে সেদ্ধ -ভাত খেয়ে পাঁজিতে লেখা সময় মতো লাইন দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি। মুহুরী মশাইয়ের ভার সব জামা -কাপড় গুছিয়ে নেবার ; আর ট্রেনে খাবারের দায়িত্ব থাকতো মোক্ষদা পিসীর ওপরে। মোক্ষদা পিসী বাড়ির রেসিডেন্সিয়াল মিড্ ওয়াইফ ;তার জন্যে একটা আঁতুর ঘর প্রায় সবসময়ে engaged থাকতো। তিন -করতে বগি রিসার্ভ করা। ট্রেন চলতেই সবাইকার খিদে ;দিদিমা শাল পাতায় লুচি ,আলু চচ্চড়ি আর লাড্ডু পরিবেশনের কাজে লেগে পড়তেন। তাঁর আর বাইরের দৃশ্য দেখার সময় হতোনা।নিজে খেতেননা ,ছোঁয়া ছুই কারণে ,কিন্তু সবাইকে খাওয়াতেন। দাদুর সঙ্গে থাকতো একটা হুঁকো ,কিন্তু ট্রেনে খেতেন স্পেশাল অর্ডারের লম্বা বিড়ি ;দিতেন একটি মাত্র সুখটান ,তারপর সেটা অন্যদের আনন্দ বর্ধনের কাজে লাগতো। জলখাবার শেষ হতে হতে ট্রেন পৌঁছতো বর্ধমান স্টেশনে। ততক্ষনে দুপুরের খাবারের সময়। আগেই রান্নার লোক পাঠিয়ে স্টেশনেই পাত পেড়ে লাঞ্চ। প্লাটফর্ম দখল করে খাওয়াতে জনতা আপত্তি করতো না। সবাই জানতো অনেক বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে যাচ্ছে পুজোতে ,খিদে তো পাবেই।
খাওয়া সেরে ওঠো বাসে। জিনিস পত্র অন্যেরা আনবে। বিকেলের মধ্যে শিবতলা। সারি সারি গরুর গাড়ি চললো। সময়ের গাড়িতে দাদামশাই।দিদিমা সেকেন্ড গাড়িতে। গাড়ির দুদিকধরে চলেছে অনেক গ্রামের মানুষের রিসেপশন পার্টি। শেষের আগের গাড়িতে দাদামশাইয়ের ছোট ভাই। আর তার পেছনে দুজন লোক গড়গড়ার কলকে সাজাতে ব্যস্ত। শেষের দুটো গাড়িকে গাঁট ছড়া গড়গড়ার লম্বা নল। ছোটদাদু তার দাদার সামনে তো ধূম্ৰপান করতে পারে না ,তাই এ ব্যবস্থা। গাড়িদুটোর অসমান গতি ,ছোটদাদুর আয়েশে কোনো ব্যাঘাত নেই ,দুই গাড়ির মাঝে চলছে দুজনা নলটাকে সামলাতে সামলাতে।
মায়ের মুখের গল্প আমাকে কোথায় নিয়ে যেতো ;ভাবতাম কবে যাবো এই স্বপ্নগ্রামে।
অনেক দেশ দেখলাম বাবার সঙ্গে। কিন্তু অপেক্ষা করতে হলো আমার স্বপ্নের দেশ দেখার জন্যে। তখন কলকাতায় পড়ছি কলেজে ,হোস্টেলে থাকি। পুজোর ছুটি। হোস্টেল প্রায় খালি। আমরা কজন বিদেশী আছি। আমরা তিন বন্ধু ঠিক করলাম আমার মামাবাড়ি যাবো। এক বন্ধুর আত্মীয় থাকে বর্ধমানে। তিনি সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। সপ্তমীর দিন হাওড়া থেকে বর্ধমান -ইলেকট্রিক ইঞ্জিন এক ঘন্টা ২০ মিনিটে পৌঁছে দিলো। প্লাটফর্ম লোকে গিজগিজ করছে ,সেখানে বসে খাওয়া অসম্ভব। বন্ধুর কাকা স্টেশনে জীপ্ পাঠিয়ে দিয়েছেন। এক ঘন্টায় শিবতলা। ড্রাইভার বললো সাতটার মধ্যে ১ফায়ার আসতে আমাদের নিয়ে যাবে বর্ধমানে।
তিন বন্ধু গরুর গাড়ির খোঁজ করলাম,শুনলাম তারা আর নেই। হাটতে শুরু করলাম লোকেদের জিজ্ঞেস করে। ঘোষগাঁও পৌঁছতে সময় লাগলো না। .ঘোষেদের বাড়ি যেতে কোনো সমস্যা হলো না। পুজো হচ্ছে একটা উঠোনে। দূর্গা মায়ের গায়ে একটা নীল রঙের বেনারসী ,টুকরো কাপড়
নয়। নতুন মুখ দেখে অনেকে এসে গেল। একজন পেল্লায় সাইজের ছেলে প্রশ্ন করলো আমরা কোন পৃথিবী থেকে এসেছি। আমি আমতা আমতা করে বললাম যে আমি বুঁচির ছেলে ,আমার মায়ের নাম ছিল বুঁচি ,টিকোলো নাক ওলা পরিবারে আমার মায়ের নাক ছিল চ্যাপ্টা -সেইথেকে নামকরণ।
বুঁচি শব্দের এত তেজ জানতাম না। সেই গুন্ডা উল্লসিত কন্ঠে বললো ,"বুঁচিদির ছেলে !" তারপর আমাকে গলা টিপে তুললো ,নিয়ে চললো অন্দরের দিকে আর সঙ্গে সঙ্গে লোড স্পিকার ;"দ্যাখো বুঁচিদির ছেলে এসেছে। " আমাকে ঘিরে মহিলা মন্ডল। আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো। আমার নাকটা নাকি বুঁচির মতো ,কানটা বাবার মতো। অন্য বড়োরা আসলেন। অনেক প্রশ্ন করলেন ,আমরা ক ভাই -বোন ,বুঁচি এখনো দুস্টুমি করে কিনা ? বাবার কথা বেশি হলো না ,মাকে ঘিরেই তাদের কথা। কয়েক মিনিটে আমরা তিন বন্ধু বাড়ির ছেলে হয়ে গেলাম।
দিনটা কি করে কাটালাম জানিনা এত তাড়াতাড়ি পোত্ পরিবর্তন যে হিসেবে রাখতে পারিনি। সারা গ্রাম ঘুরলাম, বুঁচির ছেলে আর তার বন্ধুরা হয়ে। সব বাড়িতে আদর। শুনলাম ঠাকুরের বেনারসী আমার দাদুর ইচ্ছে ,"মা কে কী টুকরো কাপড়ে মানায় ?"দাদু বলতেন।
' উনি যাবার পর আর কী সেই জাঁকজমক আছে? ছেলেগুলো নেশা করে সব উড়িয়ে দিলো। এখন ছোট পুজো চালিয়ে যাচ্ছি। গোটা শাড়িটা নীল ,কিন্তু দামি বেনারসি নয়।' জানালেন বেশ কজন মাধ্যবয়সী। এবার বুঝলাম বাবা -মা কোনো মামাবাড়ি থেকে আমাদের দূরে রাখতো।
দুপুরের খাওয়া অনেকে মিলে। সকালের দুঃখ নবমীর দিনে একটু ভালো মাছ হতো ,আজ তো কিছুই নেই। কলাইয়ের ডাল ,পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি আর ছোট মাছের ঝাল। সবাই মাইল খাচ্ছি ,সবকিছু ভালো লাগছে।
তারপর গল্প ,শেষ আর হয় না। অনেক দিনের জমানো কথা বলতে সময় কেটে গেল কিছু বোঝবার আগে। এবার বিদায় নেবার সময়। কেউ ছাড়তে চাইছে না। একটু দেরি হয়ে গেল। কয়েকজন আধা পথ এগিয়ে দিলো। তারপর আমরা তিন বন্ধু চললাম শিবতলা। অন্ধকার হয়ে গাছে,আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি জীপ্ এর হেড লাইটে আকাশটা আলোকিত। বুঝলাম গাড়ি এসেছে নিতে। একটু বাদে আবার আলো ,গাড়িটা ঘুরলো আর চলে গেল আমাদের ফেলে। আমরা খুব চেচালাম ,কিন্তু গাড়ি চলেই গেল..পরে শুনেছি ড্রাইভারের ঘড়ি ছিল না,তাই রাত্তির দেখে ভেবেছিলো আমরা আর ফিরছি না ওই রাত্রে।
পৌঁছলাম শিবতলা। একটা বাড়িতে পুজো হচ্ছে ,ৰাতিৰ সময়ে। কাঁসর ঘন্টা বাজছে ,আমরা সেদিকে গেলাম।আরতি শেষে সকালের নজর এলো আমাদের দিকে। আমাদের অবস্থা শুনে সবাই চিন্তায় কিন্তু কোনো উপায়ে নেই ,আর তো বাস নেই সকালের আগে; আমাদের বসতে দিল বারান্দার পাশে।বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার। ট্র্যাক্টর -ট্রেলর আছে; আছে অনেক গরু,ছাগল,মুরগি। প্রসাদ দিলো ফল আর নারকোলের মিষ্টি। কথার মাঝে আমার পরিচয় বেড়োলো ;আমার মা ঘোষগাঁওয়ের ঘোষেদের বাড়ির মেয়ে ,ছোটোবেলায় নাম ছিল বুঁচি।
একটা যেন বাজ পড়লো বুঁচি শব্দের সঙ্গে। সবাই একটু চুপ ,ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসলেন দাদুর বয়সী একজন।তাঁর পেছনে কোনো উপায়ে আসলেন এক মহিলা।অবিশ্বাসের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন আমি ঘোষেদের বুঁচির ছেলে কিনা।আমাকে স্বীকার করতেই হলো যে আমি সেই। তারপর কী আদর !দুজনে আমার গলা জড়িয়ে চুমু খেলেন বারবার -আমি তো ওদের নাতি। আমি একেবারে হতভম্ব। সবাই শান্ত হলে জানলাম তাদের কথা। এই বৃদ্ধ আগে ঘোষগাঁও তে থাকতেন।সোনার গয়না করতেন।আমার দাদামশাইয়ের জন্যে দিন চলতো দুজনের।তাই ছেলেরা কাজ করতো কোলকাতারসোনার দোকানে।একবার ঘোষগাঁওতে কলেরা হয়েছিল। এদের দুজনকে দেখবার কেউ ছিল না। বুঁচি জাত -পাত মানত না ছোট থেকেই। সেই ছোট্ট মেয়ে কাউকে না মেনে লক্ষ্মী স্যাকরার বাড়িতে থেকে দুজনকে সুস্থ করেছিল। কিছুদিন পরে ছেলেরাইসে বাবাকে নিয়ে শিব্তলায় নতুন ঘর বানালো ;কেউই বুঁচিকে ভোলেনি।শুনেছে সে ভালো আছে ,ভালো বিয়ে হয়েছে। আর দেখা হয় নি। এই বাড়িতে বুঁচি একটা প্রবাদ হয়ে আছে।
সেই বুনছির ছেলে আমি ,পুরো যুগের সবাই কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না। অনেক গল্প বললাম মায়ের ,সবাই শুনলো আমি যেন লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ছি। বৃদ্ধই ব্যবস্থা করলেন আমাদের ফেরবার।সঙ্গে দিলেন অনেক নাড়ু আর সন্দেশ। ট্রাক্টরে ট্রেলর লাগানো হলো ,তাতে একটা ত্রিপল বিছানো ;সঙ্গে দিলেন গায়ের চাদর হিম লেগে ঠান্ডা যাতে না লাগে।
অনেক আওয়াজ ,ট্র্যাক্টর চলছে ,ট্রেলর চলছে দুলে দুলে,আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। আমি ভাবছি দিনের কথা। লন্ডন দেখেছি,প্যারিস দেখেছি -কোথাও কেউ আমার মায়ের নামটা মন্ত্র বানায়নি। এ এমন মন্ত্র যাকে উচ্চারণ করলেই সময়ের দূরত্ব ,স্থানের দূরত্ব ,মানের দূরত্ব সব ভেসে যায়। আমার মনে হলো গ্রামটার মাটির ঘরগুলো ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে সোনা হয়ে গেছে। আমি সেই ভালোবাসার স্বর্ণ -লঙ্কা দেখে ফিরছি।