Ranit Das

Fantasy Inspirational

3  

Ranit Das

Fantasy Inspirational

@ভালোবাসা.কম

@ভালোবাসা.কম

7 mins
846


"উদ‍্যমং সাহসং ধৈর্যম্ বুদ্ধিঃ শক্তিঃ পরাক্রমঃ।

ষড়েতে যত্র বর্তন্তে তত্র দেবঃ সহায়কৃত্।।"

(উদ্যম, সাহস, ধৈর্য, বুদ্ধি, শক্তি ও পরাক্রম- এই ছটি বিষয় থাকলে দেবতা আমাদের সহায় হন।)

___________________________________

সোমনাথ একেবারে সাধারণ ঘরের ছেলে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আর পড়তে পারলো না। ওর বাবা শ্রী নলিনীকান্ত সরকার তেমন চেষ্টাও করলেন না ওকে পড়ানোর। ওনার যুক্তি, "পড়াশোনা করে কি হবে? আমাদের মতন সাধারণ ঘরে পড়াশোনা না করে কাজ করলে বরঞ্চ দুটো টাকা ঘরে আসবে।" এই নিয়ে ওনাকে অনেক কথাও শুনতে হয়েছে। সোমনাথের স্কুলের হেডমাস্টার তারিণীচরণ বাবু ওর বাবাকে একান্তে ডেকে বুঝিয়েছিলেন, পাড়ার লোকেরা বুঝিয়েছিল, কিন্তু কিছুই লাভ হল না। নলিনীকান্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। সোমনাথের শিক্ষার রথ উচ্চমাধ্যমিক দিয়েই থেমে গেল।

কিন্তু যতই যাই হোক, মানুষ সংকল্প করলে কি না করতে পারে। সংকল্প করলে যেমন লেংড়া-খোঁড়াও পাহাড়ে উঠতে পারে, তেমনি সংকল্প করলে কঠিন থেকে কঠিনতর কাজ সহজ হয়ে যায়। বাবার সিদ্ধান্ত তাই সোমনাথের মনে দৃঢ় সংকল্পের উদয় ঘটিয়ে দেয়, ও ভেবে নিলো ওকে কিছু একটা করে বাবাকে দেখিয়ে দিতেই হবে।

"সোমনাথ, এই সোমনাথ, কি ভাবছিস বসে বসে", তরুণ সোমনাথের কাঁধে একটা টোকা মেরে ওকে জিজ্ঞেস করলো।

ফেলে আশা দিনগুলো, আর নিজের দৃঢ়চেতা মনোভাবের কথা ভাবছিলো সোমনাথ, তরুনের ডাকে ওর ঘর কাটলো। ওর দিকে ফিরে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো, "এই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম, কি ছিলাম আর কি হয়ে গেলাম!"

সোমনাথের পাশে একটা টুল নিয়ে বসে তরুণ বললো, "কি ছিলিস আর কি হয়েছিস আমি বলবো?"

"তুই বলবি? আচ্ছা বল, শুনি একটু।"

"ছিলিস একটা বাছুর, এখন হয়েছিস একটা গরু, হা হা হা হা হা হা হা হা হা........"

তরুনের কথায় একটুও রাগ বা উষ্মা প্রকাশ করলো না সোমনাথ। সচরাচর ও রাগে না। এটা ওর একটা গুন-ই বলা যেতে পারে। তরুণকে শুধু বললো, "ঠিকই বলেছিস, ছিলাম বাছুর আর এখন হয়েছি গরু। আসলে কি বলতো এটাই বিবর্তন কি না। বিবর্তনের ধারায় মানুষ যেমন ছোট থেকে বড়ো হয়, তেমনি সমস্ত প্রাণীও ছোট থেকে ক্রমে বৃহৎ আকার ধারণ করে, তাই এটাকে অস্বাভাবিক বলা বোধহয় সমীচীন হবে না।"

"মাইরি তোর সাথে কেউ কথায় পারবে না, সাধে কি একজন লেখক হতে পেরেছিস! যাই বলিস না কেন, আমি তো বলবো, 'গুরু তোমার এলেম আছে'।"

"আচ্ছা ঠিক আছে, এসব বাদ দে, একটা কবিতা লিখেছি, দেখতো কেমন হয়েছে।"

সোমনাথ সামনে টেবিলের উপর থেকে একটা লাল ভেলভেট কভারের ডাইরি তুলে নেয়, তার পড়ে পড়তে শুরু করে,

"কলকাতার সেই রাস্তার ধারে,

তোমাকে দেখেছিলাম,

হাতে চুরি, পায়ে নুপুর,

লাল রঙের একটা সালোয়ার কামিজ গায়ে......."

"দাঁড়া দাঁড়া, ফর সামহাও, এটা কি তুই ঝিনুককে কল্পনা করে লিখেছিস?", তরুণ কবিতার মাঝেখানে বলে উঠলো।

"কি ভাবে বুঝলি?"

"সোমনাথ আমি বিগত পাঁচ বছর ধরে তোর সাথে কাজ করছি, ঝিনুক আর তোর সম্বন্ধে আমি যতটা জানি ততটা আর কেউ জানে না।"

"সে তো বুঝলাম, কিন্তু জানলি কিভাবে?", সোমনাথের কৌতূহলী চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো তরুনের দিকে।

"সিম্পল", বলে উঠলো তরুণ।

"কিভাবে?"

"কাল তুই আর ঝিনুক ঘুরতে যখন বেড়োলি, তখন তুই একটা ব্লু শার্ট আর চিনোস প্যান্ট পড়েছিলি আর ঝিনুক পড়েছিল একটা লাল রঙের সালোয়ার, তাই দুয়ে দুয়ে চার সহজেই করে নিলাম।", তরুণ ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলে উঠলো।

"তুই নিজেকে যতটা সরল, সাধাসিধে প্রমান করতে চাস ততটা কিন্তু নোস্ তুই, সেটা কি জানিস!", ডাইরি সজোরে বন্ধ করে বললো সোমনাথ।

"একি ডাইরি বন্ধ করলি কেন? কবিতাটা শোনাবি না?"

"পরের মাসে 'যৌবনের অগ্রদূত' ম্যাগাজিনে বেড়োবে তখন দেখে নিস্", বলে সোমনাথ সামনে বইয়ের তাক থেকে 'সঞ্চয়িতা'টা এনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে কোলের উপর রেখে পড়তে থাকলো।

"তুই 'যৌবনের অগ্রদূত'-এ কবে থেকে লিখছিস?", সোমনাথের দিকে ফিরে তরুণ প্রশ্ন করলো।

"দু মাস হল"

"আমাকে বলিস নি তো"

তরুণ উঠে গিয়ে সোমনাথের কাছে বিছানায় গিয়ে বসলো, সামনে খোলা 'সঞ্চয়িতা'-য় দেখার চেষ্টা করলো ও কি পড়ছে।

"কেন তুই জানিস না? আমি তো অনেকদিন আগেই তোকে বলেছিলাম"

"মিথ্যে কথা বলিস না সোম, আমাকে বললে আমি তোকে জিজ্ঞেস করতাম নাকি?"

"ও তাহলে মনে হয় ঝিনুককে বলেছিলাম, গুলিয়ে ফেলেছি।"

কি বলবে বুঝতে পারলো না তরুণ, ক্যাবলার মতন বসে থাকলো সোমনাথের পাশে। ওর এই প্রশ্ন করা স্বভাব যে সোমনাথের পছন্দ নয় সেটা তরুণ জানে, কিন্তু তবুও ওর ভালো লাগে সোমনাথকে প্রশ্ন করতে, ওকে জ্বালাতন করতে। আসলে সোমনাথের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ওকেই নিজের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর স্থান দিয়েছে তরুণ। সবচেয়ে বড়ো কথা তরুনের গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়তে ভীষণ ভালো লাগে, আর সোমনাথ এখন নামকরা একজন লেখক, তাই ওর সঙ্গ তরুণ কিছুতেই ছাড়তে চায় না।

'সঞ্চয়িতা'য় ডুবে আছে দেখে সোমনাথকে আর বিরক্ত করলো না তরুণ। উঠে বাইরে রাস্তায় বেড়িয়ে এলো। আজ কলকাতা হলুদ চাদরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। যে দিকেই চোখ যায়, শুধু হলুদ আর হলুদ। ওর মা বলেন, এটা নাকি কনে দেখা মেঘ। কিন্তু আজ অবধি তরুণ এই কথার সারমর্ম বুঝে উঠতে পারলো না। "সত্যিই কি এই সময় কনে দেখা হয়?", ভাবলো তরুণ।

সামনে একটা রিক্সা এসে দাঁড়াতে চমক ভাঙলো তরুনের। একজন বৃদ্ধ গোছের মানুষ নেমে এসে ওকে প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা এটাই কি সোমনাথ দত্তের বাড়ি?"

কিছুটা বিস্ময় মুখে ফুটিয়ে তুলে তরুণ বললো, "হ্যাঁ, কিন্তু আপনি!"

"আমি আসলে একটু সোমনাথের সঙ্গে দেখা করতে চাই"

"আসুন ভিতরে আসুন"

ওনাকে তরুণ ভিতরে সোজা সোমনাথের কাছে নিয়ে চলে আসে। সোমনাথ এখনো ওই ভাবেই বই পড়ে যাচ্ছে, ওর সামনে এসে তরুণ ডাকলো, "সোম, এই সোম, তোর সাথে কে দেখা করতে এসেছেন"

"কে", বলে বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে ওনার দিকে তাকিয়েই চিল্লিয়ে ওঠে সোমনাথ, "স্যার আপনি, কেমন আছেন? বসুন।"

"তুই কেমন আছিস বল"

সামনে এসে প্রণাম করে ওনাকে সোফায় বসিয়ে নিজেও বসলো ওনার পাশে।

"আমি ভালো আছি স্যার, কিন্তু আপনার এ কি অবস্থা, সারা মুখে দাড়ি, চুল বড়ো, জামা-কাপড় ময়লা"

"ও অনেক কথা, ওসব বাদ দে, তোর সঙ্গে একটা দরকারি কথা ছিল আমার"

"ঠিক আছে বলবেন, কিন্তু তার আগে কি খাবেন বলুন", সোমনাথ প্রশ্ন করে।

"কিচ্ছু খাবো না, বাড়ি থেকে ভরপেট খেয়ে বেড়িয়েছি, এখন আর তেমন কিছু খাওয়ার জায়গা নেই, কিন্তু হ্যাঁ একটু চা চলতে পারে"

"ঠিক আছে", বলে সোমনাথ তরুনের দিকে ঘুরে বললো, "উমাচরণ স্যারের জন্য চা নিয়ে আয়ে তো আর বেশ ভালো দেখে চারটে বিস্কুট আনবি, এই নে টাকা।"

তরুণ চলে যেতেই সোমনাথ স্যারকে জিজ্ঞেস করলো, "বলুন স্যার, কি বলতে চান"

"আসলে সোমনাথ আমি একটা মাসিক পত্রিকা মতন খুলেছি আজ চার মাস হল, ভেবেছিলাম নতুন লেখকদেরকে সুযোগ দেবো আমার ম্যাগাজিনে, কিন্তু এমনসব লেখা পেলাম যে বলার নয়। বেছে বেছে কিছু লেখা ছাপালাম, কিন্তু পরের মাস থেকে ক্রমে কমতে থাকলো লেখা, আর এখন তো তেমন পাই ও না, পত্রিকাটা অনেক আসা নিয়ে শুরু করেছিলাম, কিন্তু যা অবস্থা তাতে খুবই তাড়াতাড়িই বন্ধ করে দিতে হবে দেখছি। ভাবলাম একবার শেষ চেষ্টা করি, তোর কাছে এলাম তাই। তুই এখন একজন নামকরা লেখক, তোর লেখা ছাপানোর জন্য পাবলিশার আর ম্যাগাজিনগুলো বসে আছে, তোর লেখা নিয়মিয় কলকাতার নানান ম্যাগাজিনে বের হয়, সেই জন্য ভাবলাম যদি তোর কাছে এলে দু-একটা লেখা পাওয়া যায়।"

সমস্তটা শুনে সোমনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর জিজ্ঞেস করলো, "আপনার ম্যাগাজিনের নামটা কি স্যার?"

"সৌর-কিরণ"

"হুম, ঠিক আছে স্যার আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে সবরকম সাহায্য করবো, আমার উপন্যাস-গল্প-কবিতা আমি 'সৌর-কিরণ'-এ দেবো, আর চেষ্টা করবো একে অন্যান্য ম্যাগাজিনের সমকক্ষে নিয়ে যেতে।"

"ধন্যবাদ সোমনাথ, তুই আজ অনেকটা ভরসা জোগালি আমাকে"

"একি বলছেন স্যার, ভরসা আমি নয়, ভরসা তো আপনি জুগিয়েছিলেন আমার মনে। ক্লাস টুয়েলভের সেই ছেলেটাকে আপনি যদি লেখার প্রেরণা না যোগাতেন তাহলে আজ সোমনাথ দত্তকে কেউ চিনতো না, আমাকে লেখক হওয়ার জন্য তো আপনিই উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, তাহলে কেন ধন্যবাদ দিচ্ছেন আমাকে! ধন্যবাদ তো আমার আপনাকে দেওয়ার কথা। আপনার অনুপ্রেরণায় আমি আজ একজন সফল লেখক", বলে আবার স্যারের পা চেয়ে প্রণাম করলো সোমনাথ।

লা অপেরার কাপে চা, আর প্লেটে দামি বিস্কুট নিয়ে ঠিক তখনই হাজির হল তরুণ। সামনের টেবিলে চা আর বিস্কুটের প্লেটটা রেখে বসলো সোমনাথের পাশে।

চা-য়ের দিকে নির্দেশ করে সোমনাথ বললো, "নিন স্যার খেয়ে নিন"

বসে বসে আয়েশ করে চা খেলেন সোমনাথের স্যার উমাচরণ গাঙ্গুলি। সোমনাথের বেশ মনে আছে, স্কুলে ওনাকে সবাই ভবঘুরে বলে ডাকতো, কিন্তু কেন জানি এই ভবঘুরেকেই সোমনাথের সবচেয়ে বেশী ভালো লাগতো। উনি যখন ক্লাসে বৈষ্ণবপদাবলী বা শ্রী কৃষ্ণকীর্তন পড়াতেন, তখন অবাক হয়ে শুনতো সোমনাথ। একটা স্বপ্নের জগতে চলে যেত ও। দেখতে পেতো শ্রীকৃষ্ণ কেমন শ্রী রাধিকার সাথে মজা করছে, কেমন অন্যান্য গোপীনিদের সাথে খেলা করে রাধিকাকে রাগাচ্ছে। সেইসব দিনগুলো আজও মনে পড়ে সোমনাথের। এই স্যারের জন্যই ও লেখার রসদ খুঁজে পেয়েছিলো। এই স্যারই ওর ডাইরিতে কবিতা লেখা দেখে একদিন পড়তে চেয়েছিলেন স্কুল ছুটির পর। সেইমত দিয়েছিলো সোমনাথ ওনাকে ডাইরিটা। মনযোগ সহকারে সবকটা কবিতা পড়ে সেদিন স্যার বলেছিলেন, "সোমনাথ এগিয়ে যা, থামবি না, তোর লেখনী খুব সুন্দর, একে যদি ধরে রাখতে পারিস, তাহলে তুই একদিন অনেক বড়ো একজন লেখক হবি, তোর মনে যদি ইচ্ছা থাকে, জেদ থাকে তাহলে তুই সমস্ত বাঁধা উপেক্ষা করতে পারবি। চাণক্য বলেছেন,"উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য", বুঝেছিস? হ্যাঁ, বুঝেছে সোমনাথ, তাইতো সংকল্প করে নিয়েছিল নিজের মনে, ওকে লেখক হতেই হবে, ও দেখিয়ে দেবে ওর বাবাকে যে ও কি পারে।

"তাহলে আসি সোমনাথ", স্যার দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন।

"আবার আসবেন স্যার, আজ তো কিছু খেলেন না, একদিন আপনাকে আমি নেমন্তন্ন করবে, সে দিন কিন্তু আসতে হবে"

"নিশ্চয়ই আসবো, এই নে আমার নম্বর", বলে একটা কার্ড সোমনাথের হাতে দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন উমাচরণ। সোমনাথ ওনাকে রিক্সায় তুলে দিলো। রিক্সায় উঠে উনি সোমনাথকে বললেন, "কিছু মনে করিস না সোমনাথ, এইভাবে তোর লেখক সত্ত্বায় আঘাত দিলাম, যতই হোক একজন লেখকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, তার যেখানে ইচ্ছা হবে সেখানে সে নিজের লেখা দেবে। এভাবে চাওয়া যায় না, কিন্তু তুই আমার ছাত্র, তোর কাছ থেকে তো চাইতেই পারি, কি বলিস!"

"নিশ্চয়ই স্যার", বলে সোমনাথ বিদায় জানালো একদা স্কুলে ওর সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষককে।

(চলবে)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy