@ভালোবাসা.কম ২
@ভালোবাসা.কম ২


২
"আত্মমাতা গুরোঃ পত্নী ব্রাহ্মণী রাজপত্নিকা।
ধেনুর্ধাত্রী তথা পৃথ্বী সপ্তৈতা মাতরঃ স্মৃতাঃ।।"
(গর্ভধারিনী, গুরুপত্নী, ব্রাহ্মণী, রানি, গাভী, ধাত্রীমা এবং পৃথিবী- এই সাতজন ধর্মশাস্ত্র মতে মাতৃস্থানীয়া, প্রণম্য।)
_____________________________________
এমনিতেই একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে সোমনাথ, তার উপর আজ আবার রবিবার, কিন্তু ওর ঘুম ভেঙে গেল ফোনের আওয়াজে। ঘুম চোখে মাথার কাছে রাখা ফোনটা তুলে নিলো ও, দেখলো ঝিনুক ফোন করেছে।
ফোনটা ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ও পাশ থেকে ঝাঁজালো গলায় ঝিনুক বললো, "কি ব্যাপার কি সোম, কটা বাজে? তুমি উঠবে কখন?"
ঘুম জড়ানো গলায় সোমনাথ বললো, "কেন! কটা বাজে?"
"নয়টা বাজে, তাড়াতাড়ি ওঠো, ফ্রেশ হয়ে লেক মলের কাছে চলে আসবে দশটার নাগাদ, আমি অপেক্ষা করবো।"
"কেন আজ কি আছে?"
"আজ কি তুমি ভুলে গেছো?"
সোমনাথ মহা সমস্যায় পড়লো, ওর সত্যিই মনে পড়ছে না আজ কি বিশেষ দিন। কিন্তু কিন্তু করে বললো, "না মানে আমি আসলে............"
"থাক বুঝতে পেরেছি তোমার কত মনে আছে, যাই হোক ফ্রেশ হয়ে চলে এসো, আমি ওয়েট করবো..... শার্প দশটা কিন্তু।"
"ওকে", বলে ফোন রেখে দিলো সোমনাথ।
বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ করে, ফ্রেশ হয়ে যখন বেরোলো, তখন ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুয়ি ছুয়ি। তাড়াতাড়ি একটা জিন্সের উপর ব্ল্যাক কালারের জামা পড়ে, মুখে দুটো বিস্কুট গুঁজে বাইক নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো সোমনাথ। ওর বাড়ি থেকে লেক মল পৌঁছাতে কম করে তিরিশ মিনিট সময় লাগে। তারাতলা, নিউ আলিপুর, টালিগঞ্জ, রাসবিহারী পেড়িয়ে তারপর লেক মল পৌঁছাতে হয়, তার উপর ট্রাফিক তো আছেই। "আজ মনে হয় আবার ঝিনুকের কাছে ঝাড় খেতে হবে", মনে মনে ভাবলো সোমনাথ। "যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছেতে হবে", ওর মন বলে উঠলো।
এক্সেলেটর ঘুরিয়ে তীব্র গতিবেগে এগিয়ে গেল লেক মলের দিকে।
"পাক্কা কুঁড়ি মিনিট লেট, তোমার যে কবে আক্কেল হবে জানি না", সোমনাথ বাইক নিয়ে ঝিনুকের সামনে দাঁড়াতেই ও বলে উঠলো।
"সরি, আসলে বাথরুমে একটু লেট হয়ে গেল", সোমনাথ অনুতপ্ত গলায় বললো ঝিনুককে।
"ঠিক আছে বাইকটা পার্কে করে এসো, আমি অপেক্ষা করছি।"
পাসের গলিতে বাইকটাকে পার্কে করে আসার পর সোমনাথ আর ঝিনুক একসাথে লেক মলের ভিতরে প্রবেশ করলো।
এস্কেলেটরে ওঠার সময় ভয়তে ঝিনুক সোমনাথের হাতটা চেপে ধরলো। এই হাতের স্পর্শ সোমনাথ সবসময় পেতে চায়। এই স্পর্শে একটা মাদকতা আছে, একটা রোমান্স আছে, যেটা প্রকাশ করা খুবই কঠিন। এটা মানুষের অন্তরের মনোরম আবেগ, এটা শুধু তারাই বুঝবে যাঁরা প্রেম করে।
"সাবধানে ওঠো", ঝিনুকের হাতটা শক্ত করে ধরে সোমনাথ বললো।
"উঠছি তো, দাঁড়াও না, ভয় লাগে আমার।"
দোতলায় এসে সোমনাথকে নিয়ে সোজা বিগবাজারের শোরুমে ঢুকে গেল ঝিনুক।
"কি ব্যাপার বলো তো, বিগবাজারে কার জন্য জামা কিনতে এলে?", সোমনাথ প্রশ্ন করলো ঝিনুককে।
ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সামনের কাউন্টারে একটা ছেলেকে ঝিনুক জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, মেন'স কর্নারটা কোন দিকে?"
"সামনে গিয়ে ডান দিকে ম্যাম"
"ওকে থ্যাংক ইউ", বলে সোজা মেন'স কর্নারের দিকে হাঁটা লাগলো ঝিনুক। বাধ্য হয়ে সোমনাথকে অনুসরণ করতেই হল।
নিজের গন্তব্য জায়গায় এসে নানা রকমের জামা দেখতে শুরু করে দিলো ঝিনুক। তিন-চারটে জামা চয়েস করে, সামনে দাঁড়ানো সোমনাথের গায়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো, "এটা কেমন লাগছে?"
এবার একটু মাথাটা গরম-ই হয়ে গেল সোমনাথের। এতক্ষন ধরে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছে, একবারও উত্তর পেলো না, উল্টে পাত্তা না দিয়ে নিজের ইচ্ছা মতন এটা-ওটা করে যাচ্ছে ঝিনুক! একটু ঝাঁজালো গলায় বললো, "কি হচ্ছে ঝিনুক এসব! তোমাকে কখন থেকে জিজ্ঞেস করছি, কোনো উত্তর দিচ্ছ না কেন? কিসের জন্য আর কার জন্য জামা কিনছো?"
সোমনাথের রাগের কারণ বুঝতে পেরে ঝিনুক একটু মোলায়েম গলায় বললো, "আজ রাতে তোমার যে আমার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করার কথা, সেটা ভুলে গেছো? জামাটা তো তোমার জন্যই কিনছি। আমি চাই বাবা-মায়ের সামনে তুমি যেন একেবারে ফিটফাটা হয়ে যাও।"
একটু নরম হল সোমনাথের মন, সাথে সাথে নিজের ভুলো মনের উপর ভীষণ রাগ হল। আজ যে ঝিনুকের বাবা-মায়ের সাথে দেখা করার কথা সেটা একেবারে ভুলেই গেছিল। অনুশোচনা গলায় ফুটিয়ে তুলে তাই বললো, "সরি ঝিনুক একেবারে ভুলে গেছিলাম, আসলে কাল স্যার এসে সব ঘেটে দিলো আমার।"
আরও কয়েকটা জামা দেখতে দেখতে ঝিনুক প্রশ্ন করলো, "তোমার স্যার এসেছিলো কাল? কই আমাকে বলোনি তো!"
"তোমাকে বলিনি? দেখেছো, এটাও ভুলে মেরে দিয়েছি, কেন যে এতো ভুলে যাই ভগবানের জানেন।"
অ্যাশ কালারের একটা জামা বের করে সোমনাথের গায়ের উপর ফেলে ঝিনুক বললো, "ভগবানের জানেন কিনা জানি না কিন্তু আমি জানি কেন তুমি এতো ভুলে যাও।"
কিছুটা অবাক হয়ে সোমনাথ প্রশ্ন করলো, "তুমি জানো?"
"হ্যাঁ জানি, আসলে কবি! আপনি সারাদিন এতো কবিতা, গল্প নিয়ে চিন্তা করেন যে বাস্তব জগতের যাবতীয় কথা ভুলে যান, কি ঠিক বললাম তো?"
"হবে হয় তো"
"আচ্ছা চলো কাউন্টারে যাওয়া যাক, ব্লু আর গ্রীন এই দুটো জামা আমার পছন্দ হয়েছে, ব্লু টা তুমি আজ পড়ে আসবে আর গ্রীনটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য প্রেজেন্ট।"
"তার মানে ব্লু শার্টটার টাকা আমাকে দিতে হবে?", সোমনাথ কাউন্টারের দিকে যেতে যেতে ঝিনুককে প্রশ্ন করলো।
"দুটোর টাকাই তোমাকে দিতে হবে, আমি কোনো টাকাই আনিনি বাড়ি থেকে"
সোমনাথ বুঝতে পারলো আজ তোর পকেট খালি হওয়ার দিন। ঝিনুক এমনিতে খুবই ভালো আর কেয়ারিং কিন্তু খরচের দিক থেকে একটু বেশীই সোমনাথের উপর ডিপেন্ডেবেল। ওর উপর সোমনাথের মাসে একটা মোটা টাকা খরচ হয়। কিন্তু সোমনাথ কিছু মনে করে না, কারণ ও জানে ঝিনুক ইচ্ছে করেই করে এটা। বরাবরই সোমনাথ একটু কিপটে প্রকৃতির, সচরাচর টাকা বের করতে চায় না। এর জন্য স্কুল জীবনে এবং দৈনন্দিন জীবনে ও অনেকের কাছে অনেক কথাও শুনেছে, কিন্তু কেউ অনেক টলাতে পারেনি। ঝিনুক পেরেছে। এইজন্যই বোধহয় বলে, "ভালোবাসা কি না করতে পারে! পঙ্গু মানুষকে যেমন হাঁটাতে পারে তেমন সোমনাথের মতন কিপটে মানুষের পকেট থেকে টাকাও সাবলীলভাবে বের করতে পারে।"
কথা বলতে বলতে ওরা ক্যাশ কাউন্টারে চলে এলো। ঝিনুক জামা দুটো কাউন্টারে বসা ছেলেটার হাতে দিয়ে পাশে দাঁড়ানো সোমনাথকে বললো, "কার্ডটা দাও।"
মুখে একটা অনিচ্ছার ভাব ফুটিয়ে তুলে ওয়ালেট থেকে ক্রেডিট কার্ডটা বের করে ঝিনুকের হাতে তুলে দিলো সোমনাথ। ও জানে কার্ড না দিলে ঝিনুক সবার সামনেই তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে, তাই অযথা বাক্য ব্যায় না করে ঝিনুকের কথাটা শোনাই শ্রেয় মনে করলো সোমনাথ।
একনিমেষে কেটে গেল তিন হাজার টাকা। একটা ব্যাগের মধ্যে জামা দুটো নিয়ে সোমনাথ আর ঝিনুক বেড়িয়ে এলো বিগবাজার থেকে। সোমনাথ ভাবলো এবার হয়তো বাড়ি যেতে যেতে পারবে, কিন্তু ওর ভাবনায় সম্পূর্ণ জল ঢেলে ঝিনুক বললো, "চলো লাঞ্চটা আমরা সি.সি.ডি তেই করে নি, আর বাড়ি গিয়ে খাবো না, একেবারে এখন থেকেই তোমাকে নিয়ে আমার বাড়ি চলে যাবো।"
সোমনাথ আকাশ থেকে পড়ার ভাব করে বললো, "আমি এই জামাকাপড় পড়ে তোমার বাড়ি যাবো নাকি?"
"হ্যাঁ যাবে, বাবা তো তোমাকে ডিনারে ডেকেছে, তার আগে একটা পার্লারে গিয়ে তুমি একটু মেকআপ করে, ড্রেস চেঞ্জ করে নেবে, তারপরে আমার বাড়ি তোমাকে আমিই নিয়ে যাবো।
"কোনো দরকার নেই ঝিনুক, আমি নিজের বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, জামা-প্যান্ট পড়ে তোমার বাড়ি ঠিক টাইমলি চলে যাবো", সোমনাথ হাসি হাসি মুখ করে বললো।
"ঠিক আছে, তাহলে আমিও তোমার সাথে যাবো তোমার বাড়ি, তারপর একসাথে বেরোবো আমরা, কিন্তু তার আগে চলে কিছু খেয়েনি, খুবই খিদে পেয়েছে।"
"আচ্ছা চলো।"
ওরা দুজনে চারতলায় ক্যাফে কফি ডে-র দোকানে এসে দুটো আফগানি চিকেন বিরিয়ানি, দুটো চিলি চিজ টোস্টিজ্জা আর দুটো চকোলেটে ডাবল স্কুপ ফ্লেভার্ড আইসক্রিম অর্ডার করলো। গল্প করতে করতে একঘন্টার মধ্যে খাওয়া শেষ করে, বিল মিটিয়ে ওরা দুজনে বেড়িয়ে এলো বাইরের কোলাহলপূর্ণ কলকাতার রাস্তায়। গলিতে রাখা বাইকটাকে নিয়ে এসে ঝিনুককে পিছনে উঠতে বললো সোমনাথ।
"হেলমেটটা পড়ে নে, আর সাবধানে উঠিস, আগের বার উঠতে গিয়ে পায়ে লাগিয়েছিলিস।"
কিছু বললো না ঝিনুক। হেলমেট পড়ে, সোমনাথের বাইকে উঠে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখলো।
"ঠিক ভাবে বসেছিস তো?", বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো সোমনাথ।
"হ্যাঁ রে বাবা চল এবার, চারটে বাজে, তাড়াতাড়ি করতে হবে।"
কে.টি.এম-এ স্টার্ট দিলো সোমনাথ। সোমনাথকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতে আচমকাই ঝিনুকের মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো, "শান্তির জায়গা, স্বর্গ"।
কথাটা কানে গেল সোমনাথের কিন্তু কিছু বললো না, শুধু মুখে একটা হালকা হাসির রেখে ফুটে উঠলো ওর। কোনো কথা না বলে ঝিনুককে নিয়ে সোমনাথ এগিয়ে গেল নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
(চলবে)