Ananya Podder

Tragedy Classics Others

4  

Ananya Podder

Tragedy Classics Others

বেলাশেষের গান

বেলাশেষের গান

5 mins
345


সমুদ্র আজ খুব অন্যমনস্ক | মায়ের ফোনটা আসার পর থেকেই কেমন যেন মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছে | সে এখন একজন রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থার উচ্চ পদস্থ কর্মচারী | আসামে পোস্টিং, সদ্য মাস ছয়েক হয়েছে বিয়ে করেছে | সমুদ্রর বউ রুচিরা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কলকাতাতেই তার অফিস | বিয়ের পরে অনেকেরই পরামর্শ ছিল যে, রুচিরা চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রর সাথে সেটল হয়ে যাক | কিন্তু সমুদ্রর মা অর্পিতার বক্তব্য ছিল, "রুচিরা যদি চায় চাকরি ছাড়তেই পারে | কিন্তু পড়াশুনা শিখেছে কী নিজের সাবলম্বীতাকে নষ্ট করবে বলে?? .... বাবানও তো চাকরি ছাড়ছে না নিজেরদের বিয়েকে ভালো ভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য?? ... তাহলে রুচিরাই বা ছাড়বে কেন?? .... অবশ্য এটা আমার বক্তব্য, বাকি সিদ্ধান্ত বাবান আর রুচিরাই নেবে | "


এ হেনো কথায় সেদিন থেকেই অর্পিতা ছেলে বউয়ের শাশুড়ি পদটা হারিয়েছিল | না, না, মায়ের মতন বা একেবারে সত্যিকারের মা কিছুই হয়নি | শাশুড়ি থেকে একদম সোজা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল সে রুচিরার |


রুচিরা বিয়ে করে সমুদ্রের চেয়ে শাশুড়ির জন্যই যেন বেশি সুখলাভ করেছে | অন্য ছেলেদের যে রকম চিন্তা থাকে মা আর বিবাহিত স্ত্রীএর মধ্যবর্তী সম্পর্ক নিয়ে, সে রকম কোনো দুশ্চিন্তা তার নেই | তবুও কেন আজ.....


রাতে রুচিরার সাথে স্কাইপিতে কথা বলার সময় মায়ের কথাটা বলল সমুদ্র | "তুমি কী কিছু জানো রুচিরা?? "


রুচিরার জবাব এলো, " তুমি বাড়িতে আসো আগে | মা যখন তোমাকে ডেকেছেন তখন কারণ তো নিশ্চয়ই কিছু আছে যা তিনি তোমাকে উনার সামনেই বলতে চান | "


সমুদ্র বুঝলো রুচিরার কাছ থেকে কোনো কিছু জানা যাবে না |


দুদিনের ছুটি আর শনি রবিবার মিলিয়ে দিন পাঁচেকের জন্য কলকাতার বাড়িতে ফিরে এলো সে | দরজা খুলে মা একগাল হাসি দিয়ে বলে, "তোর জন্য জিলিপি ভেজে রেখেছি রে | ফ্রেশ হয়ে আগে জিলিপি খাবি | ডায়েটিং এর অজুহাত দিলে আমি কিন্তু শুনবো না | "


মায়ের আচরণ তো একদম স্বাভাবিক !! তবে সেদিন মায়ের গলায় এত উদাসীনতা ছিল কেন?? তবে কী মা তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতেই এই নাটক করলো ??


রাত্রে খাবার টেবিলে খেতে খেতে মা বলল, " বাবান তোকে একটা কথা বলতে চাই | "


"বলো মা, কী বলবে?? "


"আমি তোর বাবাকে ডিভোর্স দিচ্ছি | এ ব্যাপারে তোর কাছ থেকে অনুমতি চাইছি না, তোকে আমার সিদ্ধান্তটা জানাচ্ছি শুধু | "


"তুমি এসব কী পাগলের মতো বলছো মা?? বাবা, তুমি কিছু বলোনি মাকে?? .... কী এমন হোলো তোমাদের মধ্যে যে আজ তোমাদের মধ্যে ডিভোর্সের প্রয়োজন পড়ছে?? "


সমুদ্র বাবা সাগর দত্ত একদম চুপ, কোনো কথা নেই তার মুখে |


অর্পিতা বলে চলে, " তোর বাবাকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে পাবি না বাবান | সিদ্ধান্তটা আমার | অন্যান্য আর পাঁচটা বিয়ের মতো আমাদের বিয়েটা সুখের, ভালোবাসা, বিশ্বাস আর বোঝাপড়ার ছিল না | কিন্তু আমি সবটুকু চুপচাপ মেনে নিয়ে ছিলাম কারণ তোর বাবা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি রাখেনি কোনোদিন | তিনি তার সব ভূমিকায় উত্তীর্ণ হলেও স্বামীর ভূমিকায় পুরোপুরি অসফল | তিনি আমাকে ভালোবাসতে পারেননি | আমি তার প্রয়োজন ছিলাম এবং তিনি আমাকে তার প্রয়োজনের মতো করেই ব্যবহার করে গিয়েছেন | তার আচরণের প্রতিবাদ সেদিনও করতে পারতাম, কিন্তু সন্তানের সুন্দর লালন পালনের জন্য যে সুস্থ পরিবেশের প্রয়োজন হয়, স্বামী স্ত্রীয়ের যে স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রয়োজন হয় সেটাকে নষ্ট করে স্বার্থপর হয়ে উঠতে পারিনি | কিন্তু নিজের আত্মসম্মানটা কেও ভুলতে পারিনি কোনোদিন | আমার ভালোবাসার যে অবমাননা হয়েছে, আমি তার বিরোধ করে শুধু তোর বাবার পরিচয় থেকে বেরোতে চাই | তাই এই ডিভোর্সের প্রয়োজন আছে আজ | "


অর্পিতার কথায় সাগরের উত্তর, " যা হয়েছে তাকে কী ভুলে যাওয়া যায় না অর্পিতা?? .... তোমাকে কী শুধু খারাপটাই দিয়েছি আমি?? .... ভালো কী কিছুই দিইনি কোনোদিন?? "


"তুমি আমায় অনেক কিছু দিয়েছো | তোমার জন্যই তো আজও একা পথ চলার সাহস রাখি বুকে | কিন্তু স্বামী স্ত্রীয়ের বিশ্বাসের বাঁধনটাকে নষ্ট করে তুমি আমার আত্মসম্মান, আমার ভালোবাসাকে যে আঘাত দিয়েছো, সে আঘাত আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না |আমৃত্যু সে যাতনা আমাকে দংশাবে | তোমার সাথে থাকা মানে তোমার অন্যায়ের সাথে আপোষ করা | তাই সেই অন্যায়ের প্রতিবাদেই আমি তোমার থেকে দূরে যেতে চাই, মুক্ত করতে চাই নিজেকে তোমার নামের থেকে | "


"আর ক বছর বাঁচবো অর্পিতা?? .... তখন না হয় থেকো একা একা | "


"কিন্তু তখনও তো আমার পরিচয় হবে তোমার বিধবা স্ত্রী রূপে | তুমি আমায় ত্যাগ দিয়েছিলে আমার বিনা অপরাধে | আমি যদি তোমাকে ত্যাগ করতে না পারি তবে আমার অভিমানের লড়াইটা জিতবে না যে !! "


"আমাদের সুখের সংসার এভাবে ভেঙে দেবে তুমি মা?? "


"সংসার সুখের করে রাখার দায়িত্ব আমার একার নয় বাবান | আমি আমার সমস্ত অপমান বুকে চেপে হাসি মুখে এত গুলি বছর পার করলাম শুধু তোর জন্য | তোকে নিজেরা নিয়ে এসেছিলাম, তাই তোর প্রতি কোনো দায়িত্ব যেন কম না হয়ে যায়, সেটাও ছিল আমার লক্ষ্য | তোর মন, তোর জীবনকে সুস্থ পরিবেশ দেওয়াটাও ছিল তারই একটা অঙ্গ |.... কিন্তু এখন তুমি প্রতিষ্ঠিত তোমার কর্ম জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনে | আজ তোমার প্রতি আমার কোনো দায়িত্ব নেই | আমি মুক্ত | আমার অপমানের ইতিহাস তুলে ধরে তোর বাবাকে আর নিজেকে আর নাই বা ছোটো করলাম | কিন্তু প্রকাশ না করলে অপমানের অনুভূতিটা তো আর ফুরিয়ে যায় না | সে সারা জীবন দগ্ধ হয়েই রয়ে যায় মরমে | যা মিথ্যে তাকে বোঝার মতোই বহন করে যেতে হয় আর সেই কারণেই কিছু মিথ্যে সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই আমি | "


"কিন্তু তবুও মা... "


"ওকে যেতে দে বাবান | সংসারের শিকলে বেঁধে ওর মনের উপরে আমি অনেক অত্যাচার করেছি | ওর প্রেমকে অপমান করেছি | ওর বিশ্বাসের সাথে করেছি বিস্বাসঘাতকতা | আমার এই শাস্তি টুকু তো সত্যিই প্রাপ্য ছিল | জীবনের শেষ অধ্যায়টুকু তোর মা নিজের মতো করে বাঁচুক | আমি তোমায় মুক্ত করলাম অর্পিতা | "


"এখানেও পৌরুষ তোমার !! ... তুমি আমায় মুক্ত করলে না সাগর, আমি মুক্ত হলাম নিজে | "


ডিভোর্সের পাতায় সাগর দত্তের সইয়ের পরে অর্পিতা তার বেলাশেষের আত্মসম্মানটুকুকে ফিরে পেলো | হোক না সে সন্ধ্যাকাল, তবুও জীবনের পুরো দিবস টা তো ফুরোয়নি এখনও |সম্পর্কের জটিল সমীকরণের এর চেয়ে বেশী ভালো সমাধান বোধহয় আর হয় না | প্রতিটা বিস্বাসঘাতকতা মুহূর্তের পর মুহুর্ত যখন দংশাতো তাকে, তখন এই দিনটার অপেক্ষাতেই তো সে বসে থাকতো !! .... একদিন আসবে জীবনের চরম প্রবঞ্চনার মোক্ষম জবাব দেওয়ার সুযোগ | মন পাবে মুক্তির ছোঁয়া, মেয়েমানুষের তকমা থেকে বেরিয়ে মানুষ হওয়ার পরিচয়ে সে হবে সমৃদ্ধ | তাই মুক্তির হাতছানিতে তার মন আজ অনুভব করলো, "এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয় | "... আজ তার জীবন আকাশ সত্যিই তো মুক্তিআলোয় ভরা !!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy