Krishna Banerjee

Classics

4  

Krishna Banerjee

Classics

বেইমান

বেইমান

5 mins
18


                             বেইমান 

                   কলমে - কৃষ্ণ ব্যানার্জী

                          10 /04/2024

           পরনে একটা ছেঁড়া ফতুয়া , একরাশ ময়লা জমেছে তাতে । বহুদিন হয়তো ওটাকে কাচা - ধোয়া হয়নি । পায়ের দিকে একটা সাদা পাজামা , এদিক ওদিক ফুটো হয়ে গিয়েছে । রংটা যে সাদা ছিলো সেটা খুব কষ্ট করেই বুঝতে হোল। এক মাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল , চুল গোলোতে চিটে ধরে গিয়েছে । দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন ধরে তাতে তেল , সাবান , শ্যাম্পু কিছুই পড়েনি । দাড়ি গোঁফ এই বড় বড় অযত্নের ফলে জট পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছে সেগুলোতে । পাশে একটা ময়লা পোটলা, বৈশেখের কাঠফাটা রোদ্দুরে চুপ করে বসে রয়েছে ফুটপাথের উপর । চোখ দুটোতে কতো খোভ, কত অভিমান । পথ চলতি মানুষেরা দুর থেকে 2 টাকা 5 টাকা যে যেমন পারছে ছুঁড়ে দিচ্ছে তার দিকে । টাকার দিকে কোন খেয়াল নেই । এক মহিলা এসে সাল পাতার থালাতে করে কিছু খাবার দিতেই , লোকটা ঝাপিয়ে পড়ে খাবারের উপর । 

                        আমি দশ বছর পর দিল্লি থেকে কোলকাতা ফিরছি । আমাদের বাড়িতে ঢোকার কিছুটা আগেই চোখে পড়ল এই ঘটনা । ভদ্র মহিলা লোকটিকে খাবার দিয়ে আমার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন , ওনাকে দেখে আমি চিনতে পারলাম উনি আমার বন্ধু প্রতিমের মা । আমি ওনাকে ডাক দিলাম । আসে পাশে কাউকে দেখতে না পারে উনি বুঝলেন আমি ওনাকেই ডাকছি । কাকিমা এগিয়ে এসে আমাকে ভালো করে দেখে বললেন তুমি শুভ না । আমি ওনাকে একটা প্রণাম ঠুকতে যাচ্ছিলাম , উনি আমাকে বাধা দিয়ে বললেন থাক বাবা রাস্তায় আর পায়ে হাত দিতে হবেনা । তুমিতো দিল্লিতে ছিলে তাইনা ? আমি বললাম হ্যাঁ কাকিমা । কবে ফিরলে? আমি বললাম এইতো ট্রেন থেকে নেবে বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম , আপনাকে দেখতে পেয়েই দাঁড়িয়ে পড়লাম । বেশ করেছো বাবা , শুনেছিলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছিলে তোমার বৌ কেতো দেখছিনা । আমি জানালাম ওরা দিন সাতেক পড়ে আসবে । হঠাৎ আমার এখানে ট্যান্সপার হয়ে গেলো তাই চলে আসতে হোল। বারিটাতো অগোছালো হয়ে পরে আছে , এই কয়েকদিনের মধ্যে গোছ গাছ সেরে ফেলতে হবে —--------- এটুকু থেমে বললাম , কাকিমা কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞাস করবো । উনি বললেন কি কথা ? আমি ওনাকে বললাম কাকিমা আপনি যে লোকটাকে খাবার দিলেন উনি কে ? কাকিমা একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে বললেন -! ওনাকে তুমিও চিনতে পারলে না ? তুমিও দেখছি সকলের মতো আমার ছেলের মতো বেইমান যার দৌলতে তোমরা করে খাচ্ছ আজ তোমরা কেউ তাকে চিনতে পারোনা , আমি আকাশ থেকে পড়লাম অমর কাকা —---? এটা কি করে হলো কাকিমা । এবার কাকিমা বলতে লাগলেন এর আগে যারা এই রাজ্যের স্বাসন চালাতেন তাদের সাথে অমর বাবুর বেশ দহরাম মহরাম ছিলো । সেই যোগ সূত্র কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলের বহু মানুষকে অন্যের জোগাড় দিয়ে গিয়েছেন , ওনার এক একটা সুপারিশে তোমাদের মত শিক্ষিত বেকারের দল ভালো ভালো চাকরি পেয়ে বেশ আনন্দেই রয়েছে , সেই বেইমানদের মধ্যে একজন হলো আমার ছেলে । যে মানুষটা স্বামীজির ব্রত পালন করতে গিয়ে এই সরীসৃপ গুলোর সেবা করে গেছেন , উনি ভেবেছিলেন জীবে সেবা করলেই শিব কে পাওয়া যায় কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন নি এই দুই পা বিশিষ্ট জীব সেবাতে শিব নয় বেইমানি , অপমান এইসব জোটে কপালে , রাজপাট পরিবর্তন হতেই সকলে বদলে গেলো অতগুল মানুষ যাদের জন্য লোকটা সংসার করলনা , যাদের অন্যের ব্যাবস্থা করতে নিজের গচ্ছিত অর্থ ব্যয় করলো সেই লোকটাকেই পালটি খেয়ে কালোটাকার কারবারি হিসাবে পুলিশের হাতে তুলে দিলো । অথচ এই লোকটা একদিনের জন্যেও সরাসরি কোন রাজনীতি করেনি । পড়ে শুনেছিলাম এখন যারা ক্ষমতায় আছে তারা নাকি ওনাকে ওদের দলে যোগ দিতে বলেছিলেন । মিথ্যা প্রমাণ দাখিল করে দেওয়া হলো ওনারা বিরুদ্ধে । আদালত ওনাকে তিন বছরের সাজা সোনালেন । বাসভবন বাদ দিয়ে বাঁকি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হলো । শুনেছিলাম জেলের ভিতরেই ওনার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে । তারপর তাকে কিছুদিন মেন্টাল আসাইলামে রাখা হয় । সুস্থ হতে হতে তার সাজা প্রায় শেষ হয়েই এসেছিলো, জেল থেকে বেরিয়ে বাড়িতে এসে দেখলেন বাড়িটা পার্টি অফিস হয়ে গিয়েছে , অনেক অনুরোধ করেও কিছু হয়নি , একদিন যাদের জন্য তিনি মাথার ঘাম মাটিতে ফেলেছিলেন তারাই তাকে ঘর থেকে রাস্তায় এনে ফেলল । আবার মানসিক ভারসাম্য হারালেন তিনি । তার পর থেকে শীত , গ্রীষ্ম , বর্ষা মানুষটা এখানেই পরে থাকে । আর আমি আমার ছেলের পাপ খন্ডন করতে দুবেলা দুমুঠো খেতে দেই । কাকিমার কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো । আমি কাকিমাকে কথা দিলাম আজ থেকে আমার অন্য দাতার সকল দায়িত্ব আমার ।

                              আমি অমর কাকার কাছে গেলাম , তার পাশে গিয়ে বসে বললাম অমর কাকা চলুন বাড়িতে চলুন । মাটি থেকে কুড়িয়ে কয়েকটা টাকা আমার হাতে দিয়ে বলতে লাগলেন , নে ধর আগুলো , অগুলো তোর কাজে লাগবে । আমি কি করবো বল এসব দিয়ে ? তার পর বলতে লাগলো আমার কোন বাড়ি নেই , এটাই আমার ঘর , এটাই আমার বাড়ি ।তুই যা পালা এখান থেকে । ওনার এই অবস্থা চোখে দেখা যাচ্ছিলো না । আমি জোরকরে তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম । ওনার জন্যে একজন ভালো ডাক্তারের ব্যাবস্থা করলাম । আমার ছেলে আর বৌ এখানে এসে পৌঁছাতেই তাদের সকোল কথা জানালাম । আমার মধ্যে হয়তো মানুষটাকে নিয়ে একটু কনফিউশন ছিলো কিন্তু আমার স্ত্রী - পুত্রের আত্মবিশ্বাস আমার মধ্যে একটা আলাদা শক্তির সঞ্চার করলো ।

                                  দেখতে দেখতে চার মাস কেটে গেলো ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট আর আমার স্ত্রীর সেবাতে অমর কাকা এখন আগের মোতো সুস্থ । সুস্থ হয়ে অমর কাকা আমার বাড়ি থেকে চলে যেতে চাইলেন , আমার স্ত্রী হাত জোরকরে ওনাকে বললেন আমাদের বাবা - মা নেই , আপনি যদি আমাদের অভিভাবক হয়ে একসাথে থাকেন তাহলে আমরা খুশি হবো। আর আমদের ছোট্ট ছেলেটা তার দাদুকেও পেয়ে যাবে । আমার স্ত্রীর কথাতে অবশেষে রাজি হয়ে গেলেন অমর কাকা । আমি ওনার সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার জন্য হাইকোর্টে আপিল করেছি , আশাকরি সঠিক বিচার মিলবে । আমিও ওনার পাশে থাকতে পারে নিজেকে বেইমান হওয়ার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি । এখন আমরা একসাথেই বেশ ভালই আছি । এখন অপেক্ষা শুধু আদালতের রায়ের । আমি যদি ওনাকে ওনার বাড়িটা পাইয়ে দিতে পারি তাহলে হয়তো ওনার ঋণের বিন্দু মাত্র পরিশোধ করতে পারবো। আমাদের ছেলের সাথে বেশ ঘুলে মিলে গিয়েছে , অরা এখন একে অপরকে বন্ধু বলে ডাকে ।

                             সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics