বাংলা দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা
বাংলা দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা
খড়্গপুর থেকে হাওড়ামুখী রেললাইনের পাশে মাদপুর ও জকপুর মাঝামাঝি মাঠের মাঝখানে মায়ের মনসা দেবীর মন্দিরটি আছে ।পশ্চিম বঙ্গের মেদিনীপুর জেলার, খড়গপুর থানার , লজমাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের, গোবিন্দ নগর মৌজার মহিষা গ্রামের এই বিখ্যাত মা মনসা দেবীর মন্দির মাদপুরের মা মনসা মন্দির বলে জনপ্রিয় ৷ অনেক অলৌকিক কাহিনী আছে এই মন্দির নিয়ে।
পশ্চিমবাংলার গঙ্গাসাগর মেলার পর মাদপুরের মনসা মায়ের মেলা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা বলে বহু মানুষের দাবী।প্রায় 400 বছর আগে জবপুরের জমিদার যোগেশ্বর রায় এই মহিষা গ্রামেরও জমিদার । ভোররাতে মা মনসার স্বপ্নাদেশ পান যোগেশ্বর রায় । তিনি দেখেন যে চতুর্ভুজা মা মনসা , তাকে বলছেন মহিষা গ্রামের জঙ্গলে উই ঢিপিতে তিনি বিরাজ করছেন। তাঁকে পূর্ণ মর্যাদা পুজো করার আদেশ দেন।
জমিদার স্ত্রীকে ডেকে বলেন সব কথা । জমিদার বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধে যায়, সেই মূহুর্তের মধ্যে কাকভোরে যে যেখানে ছিল সবাই হাজির হয়ে যায় । সাপের কথা সকলের জানা ঐ জঙ্গলের ।সকলেই প্রত্যক্ষ করেছে মা মনসার থান বলে, ওই জঙ্গলে যে স্থানটিতে স্থানীয় মানুষ পুজো করে সেখানে এক মস্ত উইঢিপি আছে । তার নীচে কিলবিল করে অসংখ্য সাপ একথা সকালেই জানান। সূর্যোদয়ের পরেই সেদিন জমিদার সদলবলে ঐ স্থানে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে মায়ের নিয়মিত পুজোর ব্যবস্থা করা কথা ঘোষণা করেন । কাঠুরেরা কুঠার আর হাঁসুয়া দিয়ে ভয়ে ভয়ে জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলে । এবং মায়ের থানে আসার রাস্তাও কাটা হয় । চোখের সামনে তারা বিষধর সাপেদের রাস্তা এপার ওপার করতে দেখে সবাই । পরে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হয় উইঢিপিটিকে । উইঢিপির পাশে একটি লাল পদ্ম বানানো হয় । ঢাক, শাঁখ ও ঘন্টার ধ্বনিতে জঙ্গলের চির নীরবতাকে ভেঙে মনসার থান তৈরি হয় । এখন সেই খানেই হাজার হাজার নারীপুরুষ নিজের হাতে মায়ের পুজো দেয় ।
লোক কাহিনী অনুযায়ী এখানে রেল লাইন পাতা হবার কথা উঠেছিল তখন স্থানীয় মানুষ বৃটিশদের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি জানায় মায়ের থানের বেদীকে বাঁচিয়ে রেলের লাইন নির্মাণ করতে। সাহেবরা স্থানীয় মানুষের বাধা ও অনুরোধকে তোয়াক্কা না করে বাইরে থেকে আনা হাজার হাজার শ্রমিক দিয়ে , জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দিল । বিষধর সাপ বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার সহ আরো অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে দংশন করে তাদের প্রাণ নিল । হাজার হাজার বিষধর সাপ দেখে শ্রমিকেরা প্রাণের ভয়ে ত্রিসীমানা ছেড়ে জীবন নিয়ে দৌড়ে পালাল । নতুন শ্রমিক এনে আগুন জঙ্গলে লাগিয়ে দেওয়া হলো । সাপ গুলোর কোন ক্ষতি হলো না।
খোলা আকাশের নিচে মায়ের আরাধনা শুরু হয়েছিল ।মন্দিরটিতে প্রথম থেকেই যেভাবে ছিলো সেইভাবেই আছে কারণ মা আবদ্ধ ঘরে থাকতে নারাজ। তাই মন্দির নির্মাণ করলেও মাথায় কোন ছাদ রাখা যাবে না। মন্দির নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে অনেকবার কিন্তু মন্দির ভেঙে পড়েছে। মায়ের ভক্তরা সারা বছর ধরে প্রতিদিন মায়ের পুজো হলেও, শনি ও মঙ্গলবার ভক্তদের ভিড় বাড়ে। এখানে ভক্তরা উই ঢিপি ও পদ্মফুলে ফুল, দুধ-কলা, সিঁদুর মাখিয়ে নিজেরাই পুজো করেন। এখানে এই মন্দিরে মনসা মায়ের কোন মূর্তি।ইচ্ছামত যা খুশি দাও ।পান্ডা বা পূজারীরও উপদ্রব নেই ।পুত্রলাভের আশায়, হারানো গরুর খোঁজে,মারণ ব্যাধির নিরাময়ে, বেকারের চাকুরীর আশায়, মায়ের থানে মানত করে যায় সবাই এখানে।
মেলা ও মহাপুজোর দিন নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে পুজো কমিটি ।প্রতি বছর চৈত্র মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার মায়ের বিশেষ পূজা হয়। লক্ষ ভক্ত জমায়েত হয় এই পূজা উপলক্ষ্যে লক্ষ মায়ের কাছে। এইদিনের মেলাক ই পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা বলে মনে করা হয়। ভিড়ের দিক এক দিনের মেলা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম স্থান । এই দিনে গ্রামে অরন্ধন থাকে৷ এই দিনে প্রায় এক হাজার বেশি ছাগল বলি হয় এখানে ৷ মনসা মায়ের মন্ত্রপূতঃ জলে স্নান করিয়ে হলুদ মাখিয়ে, পায়রা উড়িয়ে দেওয়ার হয়, হাঁস ছেড়ে দেওয়া হয় এখানকার পুকুরে ৷ এইদিনে এই পুজো কমিটি স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির, বস্ত্রদান, দুঃস্থ ছাত্রদের পুস্তকদানের মত উন্নয়ন মূলক কাজও করে থাকে ।
#মাদপুরের মা #মনসা