বান্দর
বান্দর
মায়ের হাত ধরে সুনন্দ তখন স্কুলে যাচ্ছে। এই তো সেদিন জন্মালো ও, কত ঘটা করে অন্নপ্রাশন দিল ওর বাবা মা। খুব যদি কম করে বলি হাজার লোকের নিমন্তন্ন ছিল। সেই সুনন্দ এখন দেখতে দেখতে ক্লাস থ্রি তে উঠে গেছে, ভাবা যায়! সাদা হাফ শার্ট আর নীল হাফ প্যান্ট, পরিপাটি করে জুতো মোজা পরে হাঁটছে সুনন্দ।
- এই মিস্তিরি, এদিকে আয়!
তমাল সুনন্দর সাথে একই স্কুলে পড়ে। সেও সম্ভবত স্কুলেই যাচ্ছে, কিন্তু সে সুনন্দর মত মোটেই এমন যত্ন করে জামা কাপড় পরে নি। সেও সাদা শার্ট, নীল প্যান্ট সবই পরেছে বটে, কিন্তু পোশাকের আনাচে কানাচে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। জামাটা প্যান্টের ভিতর গুঁজেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল বটে, তবে অর্ধেক রাস্তা আসতে আসতে সে জামা অর্ধেক খুলে গেছে, বাকিটুকু স্কুল পৌঁছাতে পৌঁছাতে যে খুলে যাবে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ও, একটা কথা তো বলাই হয় নি, তমাল থাকে সুনন্দর পাড়াতেই, সুনন্দের বাড়ির কয়েকটা বাড়ি পরেই। আরো একটা মজার ব্যাপার আছে, তমাল কিন্তু বেশ আগেই স্কুলে যাবার জন্য বেরোয়। সুনন্দ তো সাড়ে দশটায় বেরোয় ওর মায়ের সাথে। তমাল পারলে দশটাতেই বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু পৌঁছায় সুনন্দ স্কুলে পৌঁছানোর পর। বেশীরভাগ দিন স্কুল শুরুর ঘন্টা বেজে যাবার পর তমাল পৌঁছায় স্কুলে, হাতে দুটো স্কেলের বাড়ি খায়, কিন্তু তাতেও শুধরানোর কোনো নাম-গন্ধ নেই। গন্ডারের চামড়া তো! কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। দরজার বাইরে কান ধরে দাঁড়ানো, বেঞ্চির উপর কান ধরে দাঁড়ানো, নীল ডাউন, মুরগী হওয়া, আরো কত শাস্তি পেয়ে পেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে তমালের।
কিন্তু কি করে তমাল এতক্ষন ধরে রাস্তাতে? কোনো কাজের কাজ করে না বিশ্বাস করুন। এই যেমন বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ছোট্ট পাথরকে ফুটবল রূপে জ্ঞান করে নিজেকে মারাদোনা বা পেলে ভেবে কিছুদূর নিয়ে গিয়ে নর্দমারুপী গোলপোস্টে গোল দেওয়া, তারপর নিজেকে ওয়াসিম আক্রম কিংবা ব্রেট লি রূপে কল্পনা করে বোলিং প্র্যাকটিস, এইসব করতে করতে স্কুলে যখন তমাল পৌঁছায় ততক্ষনে দেরি তো হবেই। কখনো ধ্যান চাঁদ, কখনো মাইকেল জর্ডন রূপী সেই তমালের আজ বোধহয় তেনজিং নোরগে হবার ইচ্ছে হয়েছে। সে একটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠেছে আর নীচে সুনন্দকে দেখতে পেয়ে ডাকছে
- এই মিস্তিরি, এদিকে আয়!
সুনন্দর শিশুমন এখনো বোধহয় ভালো মন্দের ফারাক করতে শেখেনি। তাই বোধহয় তমালের ডাক শুনে সেও সেই গাছটার দিকে ছুটে যেতে চাইল। অবশ্য মায়ের হাত ছড়িয়ে যেতে পারেনি কোথাও, বরং মা সুনন্দর হাতখানা শক্ত করে ধরে ওকে স্কুলের দিকেই টানতে টানতে নিয়ে চলল। দূর থেকে তমাল চিৎকার করে বলল
- মিস্তিরি, আজ তোর পাশে জায়গা রাখিস তো। তোর থেকে বাড়ি বানানো শিখব।
সুনন্দ “হ্যাঁ” বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মায়ের থমথমে মুখটার দিকে তাকিয়ে কিছু উত্তর দিল না তমালকে আর। সুনন্দর হাত ধরে টানতে টানতে বেশ কিছুদূর সুনন্দকে নিয়ে এসে দাঁড় করালো ওর মা।
- শোন, একবার বলছি, কান খোলা রেখে শুনে রাখ! ওই সব বাজে ছেলেদের সঙ্গে তুই মিশছিস আজকাল? আজ তুই বাড়ি ফের! তোর হচ্ছে। চুপচাপ গিয়ে ফার্স্ট বেঞ্চে বসবে। ক্লাস করবে।
ছোট্ট সুনন্দ কয়েকবার ঢোক গিলে উত্তর দিল
- আচ্ছা মা।
- আর শোন, ও তোকে মিস্তিরি বলে ডাকছিল না?
সুনন্দ সেই ভয় পাওয়া মুখটা নিয়েই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
- আজ প্রিন্সিপাল আসছেন তো। ছুটির সময় কমপ্লেইন করব। আর যা বললাম যেন মনে থাকে, ওইসব বাজে ছেলেদের সাথে মিশবি না একদম। ছেলে তো নয় পুরো একটা বান্দর! বাড়ির গার্জেনরাই বা কিরকম! ছি ছি!
একটু চুপ করে থমকে দাঁড়িয়ে রইল সুনন্দ। ওর মা ওর হাত ধরে হ্যাচকা টান দিতেও ও এক ইঞ্চিও না সরাতে বেশ কড়া সুরেই মা বলল
- কি হচ্ছেটা কি?
বেশ কাঁচুমাচু মুখ করে সুনন্দ জবাব দিল
- মা, ও মিস্তিরি বলে তো ডাকে আমায়, তাতে কি হয়েছে?
- মানে? তুই জানিস মিস্ত্রি কাদের বলে?
- ড্যাডি বলেছে তো যারা বাড়ি বানায় তাদের মিস্ত্রি বলে। সেদিন অপু পিসি আমায় কি সুন্দর কাগজ দিয়ে বাড়ি বানানো শিখিয়ে দিয়েছিল না! সেটা ওদেরকে দেখাচ্ছিলাম। তাই…
- শোন, তুই এখন স্কুলে চ, দেরী হচ্ছে। আর এখন যা বললাম ভালো করে মনে রাখ!
মায়ের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর একদমই ভালো লাগলো না সুনন্দর। খুব ভালো করেই সুনন্দর শিশুমন বুঝল মা যেটা বলছে সেটা না শুনলে মা খুব রাগ করবে, তাই সেটা শুনে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
আর সুনন্দ মেশে না তমালের সাথে। তমালও কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝে গেছে সুনন্দ একটা দূরত্ব তৈরি করছে ওর সাথে। না, ও-ও আর দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করেনি তেমন।
ওরা বড় হতে থাকল ক্রমশ। এখন ওরা উঁচু ক্লাসে পড়ে। ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চার আর লাস্ট বেঞ্চারদের মধ্যে দুটো আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি হল। সমাজের শেখানো ভালো খারাপের পার্থক্যটা এখন ক্লাসের সবাই খুব ভালো করেই জানে। সবাই ভালো করেই জানে কারা সোনার টুকরো ছেলে আর কারা বান্দর। ওদের মধ্যে যে খুব বেশি ভাব থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। সুনন্দর মাও পরম নিশ্চিন্তে এটা দেখে যে সুনন্দর মধ্যে অন্তত এই বোধটার উদয় হয়েছে যে কাদের সাথে মেশা উচিত আর কাদের সাথে না। তাই উঠতে বসতে আর ভালো মন্দের পার্থক্য শেখাতে হয় না সুনন্দর মাকে।
দেখতে দেখতে মাধ্যমিক পাশ করল সুনন্দরা। সব বিষয়ে খুব ভালো নাম্বার পেয়েছে সুনন্দ। সুনন্দর মায়ের হাসিতে যেন গর্ব, অহংকার প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে তখন। উৎসবের আমেজের স্রোতে ভাসতে ভাসতেই ক্লাস ইলেভেনে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হল সুনন্দ। আর তমাল? ওই যে সমাজ ঠিক করে দিয়েছে বান্দর ছেলেরা আর্টস নিয়ে পড়বে। সে আর্টস নিয়ে ভর্তি হল ইলেভেনে। এতদিন সুনন্দ আর তমালের মধ্যে বেশ বড়সড় একটা দূরত্ব ছিল। আর এখন? আর প্রয়োজন কি সম্পর্ক রাখবার। ওসব পাট চুকিয়ে দেওয়াই তো শ্রেয়।
সময়স্রোতে ভেসে সুনন্দ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বেশ ভালো একটা চাকরি জুটিয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিল। চুটিয়ে সাত আট বছর চাকরি করে এখন সুনন্দ বাড়ি ফিরেছে, নিজের শহরেই চাকরি করে এখন। বিয়ের কথাবার্তা চলছে, সুনন্দর মা সুনন্দর জন্য সুন্দরী, গুণবতী এক পাত্রীর সন্ধান করেছেন। আজ পাত্রীপক্ষ আসছে সুনন্দর বাড়িতে প্রথমবারের জন্য। খুব সুন্দর করে পরিপাটি করে ঘরদোর গোছানোর কাজ চলছে সকাল থেকেই।
সন্ধ্যে নাগাদ পাত্রীর বাবা ফোন করলেন সুনন্দকে।
- হ্যালো
- হ্যালো সুনন্দ, আমরা শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে চলে এসেছি। এবার কোন দিকে যাব?
- সোজা এগিয়ে আসুন। কাউকে জিজ্ঞেস করুন তমাল সাহার বাড়িটা কোনদিকে। যে কেউ দেখিয়ে দেবে। তমাল সাহার বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই আমাদের বাড়িটা।
- উরিব্বাস! তমাল সাহা মানে সেই তমাল সাহা যিনি কিনা এই সেদিন এভারেস্ট জয় করলেন! আমার মেয়ে এরকম বিখ্যাত মানুষের প্রতিবেশি হবে। আমার তো ভেবেই আনন্দে, উত্তেজনায় লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে!
সে যাই হোক, সুনন্দর বিয়ে হল। বিয়েতে আমাদের গল্পের সেই বান্দর ছেলেটি আমন্ত্রিত ছিল। না, না, এমন নয় যে এভারেস্ট ঠেভারেস্ট জয় করেছে বলে বান্দর ছেলেটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে না। বিয়েতে যথার্থ বন্ধুর দায়িত্ব পালন করেছে তমাল, আবার যে যে চেয়েছে তার তার সাথে সেলফিও তুলেছে। এভারেস্ট জয়ী বলে কথা, একটু তো সেলফি তোলার জন্য আবদার আসবেই। তাই না?
