Sangita Duary

Classics

4  

Sangita Duary

Classics

বান্ধবী

বান্ধবী

9 mins
678


জল ঝরানো প্রায় একবাটি ছানা মিনিট পাঁচেক ভালো করে হাতের তালু দিয়ে চেপে চেপে মাখার পরে কেমন যেন কাদা কাদা হয়ে গেল। ভিডিওতে তো এরকমটা ছিল না! দিব্যি প্লেট থেকে তেলতেলে হয়ে উঠে আসে! তাহলে? হোক গে। গোলাগুলো না ফাটলেই তো হলো!

মন্ড থেকে অল্প অল্প নিয়ে আলতো চেপে গোলা বানিয়ে নিলো মন্দিরা। নাহ! একটার গায়েও ক্র্যাক আসেনি, ইয়েস! মন্দিরার ঠোঁটের কোণে জয়ের ঝিলিক। এইবার ফুটন্ত চিনির সিরায় ছেড়ে ঢাকা দিয়ে ফোটাতে হবে তাহলেই ডাবল সাইজের তুলতুলে রসগোল্লা রেডি।

কল্পচোখে নবীন দাসের ধবধবে রসগোল্লা ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। দুরুদুরু বুকে গোলাগুলো ছেড়ে খানিক চোখ বন্ধ করে রইলো মন্দিরা। ঠিকঠাক হবে তো? 

বিশ্বাস নেই বাবা!

মন্দিরারই তো কপাল! কোন্ কালে ফার্স্ট ট্রাইএই সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে শুনি?

ঊচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, প্রিপারেশন দারুণ, শুধু প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার অপেক্ষা।

কী হলো? গুণে গুণে উনষাট জনের অ্যাডমিট কার্ড এলো, কেবল মন্দিরার এলো না।

সে কী কান্না তার!

গৌতম বাবু কত বোঝান; এইভাবে এইচ এস অ্যাপিয়ারের অ্যাডমিট কার্ড গায়েব হয়না, নিশ্চয়ই অন্য কোনো স্কুলের অন্য কোনো বান্ডিলে চলে গিয়েছে।

 কিন্তু মন্দিরার মন, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।

শেষমেষ পরীক্ষার চারদিন আগে অ্যাডমিট কার্ড এলো, মন্দিরা পরীক্ষাতেও বসতে পারলো, কিন্তু যেটা হলো, বিগত কয়দিনের প্রবল টেনশনে পরীক্ষার আগের দিনই মন্দিরাকে ইনসমনিয়ায় পেল।

সেন্টারে গিয়ে সে কী গা বমি! মাথা ঘোরা!

বাধ্য হয়ে ভূপেন কাকু নিজে ওষুধপত্র নিয়ে বসে রইলেন তিনটে ঘন্টা!

উঃ!

ছোটবেলার ঘটনা ঘেঁটে মনে মনে হাসিই পেল মন্দিরার।

এবার একবার কড়াইয়ের ঢাকনা খুলে দেখা যাক।

' রাম, রাম, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, শিব শিব, জয় গোপাল' ইত্যাদি জপ করে যেই না ঢাকনা খুললো, একি!

সব ছানা ফেটে রসে বসে চৌচির! কী হবে এবার? প্রায় পাঁচশো দুধের ছানা, কমপক্ষে পনের পিস রসগোল্লা হত, আর স্বর্ণালীকেও দেখিয়ে দেওয়া যেতে, যে...!

রাগটা গিয়ে পড়লো অরূপের ওপর, বারবার বলা সত্বেও কেন ফুলফ্যাট মিল্কের বদলে টোনড মিল্ক নিয়ে এলো!

--------------------------------


সমুদ্র নীল লিনেন জামদানিটা গুছিয়ে পরে নিচ্ছে মন্দিরা।

নতুন শাড়ির এই এক সমস্যা, বারবার গোড়ালির কাছটা উঠে উঠে যায়। শাড়ির পিছন উঠে থাকলে পুরো ব্যক্তিত্বটাই মাটি।

গোড়ালি দিয়ে টেনে টেনে ঠিক করে নেয় মন্দিরা।

অরূপ ফিরেছে। খাবারের প্যাকেট টেবিলে রেখে ভূত দেখার মতো করে একবার তাকালো,'' কোথাও যাওয়ার আছে নাকি? কলেজের বন্ধু বাড়িতে আসবে তার জন্য এত সাজতে হয়! সে বেচারি আবার তোমায় দেখে ইন্সকিউরিটিতে না ভোগে!"

টুকরো উক্তি ছুঁড়ে দিয়ে অরূপ বাথরুমে চলে গেল।

আশ্চর্য লোক! কেমন লাগছে একবারও বললোও না!

চোখ কুঁচকে নিজের মুখটা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার একেবারে সামনে নিয়ে আসে মন্দিরা, বিদ্রুপ করলো অরূপ?

ঠিকঠাক লাগছে তো ওকে?

না, সে স্বর্ণালীর মত দেখতে নয়, ওরকম স্মার্টনেস, কোনকালেই মন্দিরা আয়ত্ত করতে পারেনি।

শুধু কি তাই?

স্বর্ণালী ছিল বড়লোক বাবার একটিমাত্র রাজকন্যা।সেই তুলনায় মন্দিরা কিই বা!

খুব ছোটবেলায় বাবা মারা যান, মা আর একা একা ঐটুক মন্দিরাকে নিয়ে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে থাকতে পারলেন না।

বালুরঘাটে নিজেদের পৈতৃক ভিটেয় ফেরত এলেন। বাবার স্বল্প জমানো পুঁজি আর ফ্ল্যাটের ভাড়ায় মা মেয়ের সংসার কেটে যায়।

বাবা খুব শখ করে নাচের স্কুলে ভর্তি করেছিলেন মন্দিরাকে, সেটাও আর এগুলো না।


ড্রয়ার থেকে বিছে হারটা গলার সামনে ধরে নিজেকে দেখছে মন্দিরা; খুব বেশি সাজ হয়ে যাচ্ছে কি? এমনিতে কানে ঝুমকো, শাঁখাপলা বাঁধানো, হার্ট শেপ পেন্ডেন্ট দেওয়া সোনার চেনটা তো আছেই, তাছাড়া এইতো গেল পরশুই কড়কড়ে আড়াই হাজার দিয়ে এই মিনেকারী শাড়িটা গছিয়ে দিলো রিমা। নাহ! এই ছিমছাম অ্যারিস্ট্রোক্যাসিই ঠিক আছে।

অরূপ বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। আর তাকালো না। সোজা সোফায় বসে চৌত্রিশ ইঞ্চিতে টি টোয়েন্টি।

মন্দিরা ঘরের চারপাশে একটা সরু নজর বুলিয়ে নেয়।

স্বর্ণালীকে দেখাতে পারবে তো যে সেও বর্তমানে কোনো অংশে তার চেয়ে খারাপ লাইফ লিড করে না!


মাধ্যমিকের পর থেকেই টিউশন শুরু করেছিল মন্দিরা। বাবার জমানো পুঁজি কমে আসছিল, তাছাড়া অতো দূরে থেকে ফ্ল্যাটের ভাড়া গোনাও একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠছিল। মা বিক্রি করে দিলেন ফ্ল্যাট, প্রাপ্ত টাকা চলে গেল সেভিংয়ে, মন্দিরার বিয়ের খরচ হিসেবে।

এমনতাবস্থায় মন্দিরাকে আরও পড়াশোনা চালানোর জন্য টিউশন করতেই হত।

অনেক স্টুডেন্টস ছিল তার।

তাছাড়া স্কুলের বিমান স্যার বিনা পারিশ্রমিকে তাকে ইংরেজি পড়াতেন।

স্কুলে 'লড়াকু মেয়ে' হিসেবে বেশ একটা পরিচিতি ছিল মন্দিরার। সবার চোখেই কেমন একটা সম্ভ্রম, বিশেষ করে মায়েদের চোখে। প্রত্যেকেই যেন তাঁদের সন্তানদের কান টেনে বলছেন, "দেখ, মন্দিরাকে দেখে শেখ!"

আত্মগরিমা দারুণ উপভোগ করত মন্দিরা।


স্বর্ণালী মন্দিরার ঠিক কলেজ বন্ধু নয়, ফাইনাল ইয়ারে এস আরের কাছে পড়তে এলো স্বর্ণালী। মন্দিরা ততদিনে এস আরের বিগত দুইবছরের এক অতি-ওবিডিয়েন্ট ছাত্রী। মন্দিরার জীবন যুদ্ধের গাঁথা প্রায় সব স্থানেই তাকে অন্য সবার থেকে কয়েক কদম এগিয়ে রাখতো। এস আরের কাছেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

কিন্তু এক মাসের মাথাতেই স্বর্ণালী কেমন করে যেন মন্দিরার জায়গাটা কেড়ে নিল।

ওর মিষ্টি চেহারা, কুবলা খানের প্রায় দুই পাতা নোটের অক্লেশ মুখস্থ, সর্বোপরি সর্বদা ওর মুখে একটা সর্বজয়ী হাসি বড্ড পীড়া দিত মন্দিরাকে।

তবু বন্ধুত্বটা হলো। আসলে স্বর্ণালী মেয়েটাই যে অন্যরকম।

মন্দিরার সঙ্গে আলাপের কয়েকটা মাত্র সিটিং, হাফ ডজন নোট শেয়ার এবং মন্দিরার আত্মজীবনী অনুভব করেই, স্বর্ণালী তার বেস্ট ফ্রেন্ডের তকমাটা মন্দিরার গায়ে সেঁটে দিয়েছিল।

বড্ড বোকা ছিল স্বর্ণালী।


একদিন টিউশন সেরে সোজা তন্দুর এক্সপ্রেস।

স্বর্ণালীর সাডেন ট্রিট।

হবু হবু বয়ফ্রেন্ডটা ঠিক কেমন হতে পারে, প্রিয় বান্ধবী মন্দিরাকে না দেখিয়ে ঠিক শান্তি পাচ্ছিল না স্বর্ণালী।

মনে মনে 'ন্যাকামো' বলে, ঠিক গুটিগুটি হাজির হয়েছিল মন্দিরা।

শুভজিৎ এলো। ধবধবে ফর্সা রঙ, খয়েরি চোখ, ছিপছিপে চেহারা, মুখে সবসময় একটা হাসি, এরকম একটা ছেলে তো মন্দিরাও পেতে পারতো!

তার 'স্ট্রাগল' কি এমন একটা ছেলে ডিজার্ভ করে না?


দরজায় বেল।

 স্বর্ণালী এসে গেল? মন্দিরা নিজেকে আর একবার আয়নায় দেখে ঘর থেকে বেরোলো। ততক্ষণে অরূপ উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মন্দিরা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে।

মন্দিরার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বর্ণালী, মন্দিরার কোচিং ক্লাসের বান্ধবী, স্বর্ণালী। 

বড়লোক বাবার একপ্রকার স্পয়েল্ট মেয়ে স্বর্ণালী। সেই স্বর্ণালী, যে কিনা এক কথায় মন্দিরার সঙ্গে তমলুক রাজবাড়ি এক্সকার্শন করতে রাজি হয়েছিল। 

মন্দিরার কতকগুলো সাজানো কথায় শুভজিতের সঙ্গে যার সম্পর্কটা টলমল হয়ে গিয়েছিল, এ সেই স্বর্ণালী!

 তারপর প্রায় একযুগ দেখা না হওয়া, যোগাযোগ না থাকা সেই স্বর্ণালী আজ মন্দিরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।

মন্দিরা খুঁটিয়ে দেখছে একসময়ের নিখুঁত স্বর্ণালীকে।

ফেসবুকে যতটা গ্রেসফুল লাগে, ততটা তো নয়!

তবে চোখদুটোর ঔজ্জ্বল্য কিন্তু এতটুকুও ম্লান হয়নি।

মন্দিরাকে দেখে একটু যেন অপ্রস্তুত স্বর্ণালী," কোথাও বেরোনো আছে নাকি তোদের?''

মন্দিরা দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়," তুই আসবি, কোথায় আর যাবো বল?"

স্ত্রীকে বিব্রত হতে দেখে অরূপ বলে,"আসলে আপনার বান্ধবী একটু বেশিই শৌখিন থাকতে ভালোবাসেন। আসুন, ভিতরে আসুন, আমি অরূপ, আপনার বান্ধবীর হাজব্যান্ড।"

অরূপের সাথে প্রতি নমস্কার করে, মন্দিরার দিকে একটা বড় প্যাকেট এগিয়ে দেয় স্বর্ণালী, "কই আগে তো এত শৌখিন ছিলি না! দিব্যি বিনা টিকিট ট্রেন ধরতি! তারপর সেই ভেজিটেবল চপের কথা! মনে আছে তোর? বলছিস বরকে?"

মন্দিরা বুঝলো, প্রসঙ্গ এখানেই থামাতে হবে। না জানি কী থেকে কী বলে ফেলে মেয়েটা!

হাতের প্যাকেট দেখিয়ে বললো, "এসব আবার আনতে গেলি কেন?"

- বাহ রে! প্রথমবার তোর বাড়ি আসছি, খালি হাতে আসবো? দাদা যে কিপটে ভাববেন আমায়।

সোফায় বসতে বসতে চারপাশ দেখলো স্বর্ণালী,

"বেশ সাজিয়েছিস কিন্তু। তারপর বল, এরকম মুটিয়ে গেলি কেন?"

আজ বোধহয় অরূপের ভারী রঙ্গ এসেছে মনে, ফিচকে হেসে বললো," এ হলো হর রোজ ইউ টিউব এক্সপেরিমেন্ট, বুঝলেন ম্যাডাম! এইতো আজই, আজই রসগোল্লার ট্রাই হচ্ছিল। কী? না, এতদিন পর কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে মোলাকাত, নিজের হাতে কিছু বানিয়ে না খাওয়ালে চলে?''

- তাই নাকি! এ তো দারুণ ব্যাপার! মন্দিরার হাতে গরম রসগোল্লা! তা হ্যারে, বলছি, রসগোল্লাই হয়েছে তো নাকি অন্যকিছু?

বলেই হা হা হাসছে স্বর্ণালী, তার সাথে পাল্লা দিয়ে অরূপও।

মন্দিরার অস্বস্তি বাড়ছে। তারই বাড়িতে এসে তারই বরের সামনে স্বর্ণালী এভাবে তাকে হ্যাটা করতে পারে কি?

মৃদু হেসে প্রসঙ্গ ঘোরায় মন্দিরা," তোর খবর বল। কী করছিস এখন? প্রোফাইলে তো নিজের নাম ছাড়া কিছুই লিখিসনি। উফ! খুঁজতে যে কী বেগ পেতে হয়েছিল!"

হাসি থামায় স্বর্ণালী," সত্যি রে। আমিও কখনো ভাবিনি, তোর কাছ থেকে কখনো ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাবো। খুব অবাক হয়েছিলাম। প্রথমটায় তো চিনতেই পারিনি। যা মুটিয়েছিস!"

আবার সেই পিত্তি জ্বালানো কথা!

এবার একটা চরম ঘা দিতে হবে।

- শুভজিৎকেই বিয়ে করলি নাকি অন্য কাউকে?

খানিকটা নিভলো বোধহয় স্বর্ণালী।

চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। বুঝিবা অরূপের সামনের সহজ হতে পারছেনা।

বেশ মজা লাগছে মন্দিরার।

- কিরে!

এবার অরূপ বললো," আহা! ওঁকে আগে জল টল দাও!"

"হ্যাঁ হ্যাঁ", বলে কিচেনে গেল মন্দিরা।

মনের সেই কষাটে ভাব কেটে বেশ একটা উৎফুল্লতা এসেছে। প্যাকেট খুলে মিষ্টি, কাটলেট সাজিয়ে নিচ্ছে সিরামিক প্লেটে।

স্বর্ণালী এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে।

- আয়, আয়। তোদের কিচেনের মত রয়্যাল নয়। অসুবিধে হবে তোর।

স্বর্ণালী মুচকি হাসে," আজও একই রকম রয়ে গেলি মনি!"

'মনি!'- এই নামে স্বর্ণালীই একমাত্র ডাকতো তাকে।

স্বর্ণালী মন্দিরার মুখোমুখি দাঁড়ায়," খুব আশা নিয়ে তোর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম রে! ভেবেছিলাম পুরোনো ক্ষোভ সব মুছে দেব।

সেদিনও তুই আমার দগদগে ঘায়ে নুনের ছিঁটে দিয়েছিলি, আজও? সেদিন কি সত্যি আমি তোকে বলেছিলাম যে শুভকে আমি ফ্লার্ট করছি?

জানিস, সেদিন তোর একটা মিথ্যের জন্য আমাদের সম্পর্কটা টিকলো না। অবশ্য তাতে ভালোই হলো, যে সম্পর্ক এত ঠুনকো হয় সেটা বেশিদিন টেকেও না। তুই না হলে অন্য কারোর জন্য এই সম্পর্ক ভেঙে যেত, এ আমি নিশ্চিত।"

একটা চাপা উদ্বেগ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে মন্দিরার মন থেকে।

- ছাড়তো ওসব, চল ডাইনিংএ চল। ওখানে গিয়ে...!

স্বর্ণালী যেন শুনলো না মন্দিরার কথা। কোনো এক আবেশে সে বলে চলেছে," আমার বাবার অনেক টাকা ছিল, তাই না রে? আর আমিও বাবার স্পয়েল্ট বেবি। এটাই জানতিস তো? কিন্তু এটা বোধহয় জানতিস না, টাকাগুলোর উৎসস্থল কী ছিল।

বাবা নারী প্রাচার চক্রের সাথে যুক্ত ছিল।

একদিন আমি জেনে যাই। খুব কষ্ট হয়েছিল জানিস? নিজের বাবাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে কেমন লাগে, বুঝিস তুই? তোর তো বাবা নেই, না? বেঁচে গেছিস।

তারপর আমাদের দিনগুলো কিভাবে কেটেছে জানিস? নিজেকে প্রশ্ন কর, একজন ক্রিমিনালের মেয়ের জীবন কেমন কাটতে পারে? সেই মেয়েটা, তারই প্রেমিকের কাছে, তোর কাছ থেকে পাওয়া ইনফিরমেশনের জের টেনে ঠিক কতটা অপমানিত, ছোট হতে পারে?

পড়াশোনাটা আর শেষ করতে পারিনি।

মা'র প্রায় তিনটে মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছে। আজ মা একদম বেড রিডেন। 

তখন তো পুরো শহর চষে বেড়াচ্ছি, একটা কাজ যদি কেউ দেয়! কেউ এক্সপেরিয়েন্স ছাড়া ফ্যাকাল্টি অ্যালাও করলো না।

একদিন দেবদূতের মত শীতল দার সাথে দেখা। আরে, তোদের পাড়ার সেই শীতল দা। যোগাযোগ আছে তোর সাথে? যাঁর 'ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানো' নামে দুর্নাম ছিল? ওনারই পরিচিত একটা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে রিসেপশনিস্টের একটা কাজ পাইয়ে দিলেন। ওই আটের মত দেয় আরকি। তবে মা'র চেকআপটা ফ্রিতে হয়ে যায়।

শীতল দা'র থেকেই শুনলাম, তুই নাকি আর ওবাড়িতে যাসই না! কেন রে? মাসিমা তো আগের থেকেও একা হয়ে গেছেন আরও। মাসের শুরুতে কয়েকটা টাকা পাঠালেই কি মেয়ের কর্তব্য শেষ মনি?"

স্থির চোখে স্বর্ণালী তাকিয়ে আছে। বুঝিবা পড়ে নিচ্ছে মন্দিরার ভিতরটা।

আবার একটা চরম ইনসিকিউরিটি ধীরে ধীরে গ্রাস করছে মন্দিরাকে।

মন্দিরার এযাবৎ যাবতীয় অর্জিত সব কিছু কেমন যেন ফিকে হয়ে আসছে ধীরেধীরে।

কেন এমন হচ্ছে?

এ সংসার তার। এবাড়ি তার। অরূপ তার।

এই শাড়ি, গয়না, আধুনিক আসবাবপত্র সব সব সব তার। অনেক শ্রম দিয়ে নিজের সংসার সাজিয়েছে মন্দিরা।

সেই তুলনায় কী আছে স্বর্ণালীর বর্তমানে?

কিচ্ছু নেই। আট হাজার টাকায় কী হয় আজকাল?

মন্দিরার একমাসের পার্লার বিল! আর?

হাঃ! একটা মেয়ে কথার দৌড়ে, কতকগুলো নীতিকথা আওড়ে মন্দিরাকে পিষে দিয়ে যাবে? কক্ষনো না।

----------------------------------


স্বর্ণালী চলে গেছে। বেডরুমের আলো আঁধারিতে মন্দিরা এখন একা। অনেকগুলো ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে চারপাশে।

শীতল'দা; সারাদিন ক্লাবে পড়ে থাকতো, ভিখিরি দেখলে পরনের জামা, পাতের ভাতও দিয়ে দেয়। বাচ্চাদের প্রবাদ শোনানো হতো," পড়াশোনা না করলে শীতল দাদার মতো লক্ষ্মীছাড়া হতে হবে!"

একদিন মন্দিরার পড়তে যাওয়ার পথে এসে দাঁড়ালো শীতল'দা, মন্দিরার সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে লাজুক দৃষ্টে বলেছিল," তোর সাথে কথা আছে একটু, প্রাইভেট!"

মন্দিরার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় শীতল'দার প্রাইভেট কথার সারমর্ম বুঝেই বলেছিল," সময় নেই, সরো!"

প্যাডেল ঘুরিয়ে এগিয়ে গিয়েও মন্দিরা পিছু ফিরে দেখেছিল, কী তীব্র পরাজয় বুকে বেঁধে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শীতল'দা!

মায়া নয়, প্রচ্ছন্ন একটা আত্মগরিমায় ভরে উঠেছিল মন্দিরার অন্তরাত্মা।

ভবঘুরেটার সাহস কত, মন্দিরার মত একজন স্ট্রাগলারকে প্রেম নিবেদন করে!


আবার অন্য দৃশ্য বদলে যায়।

শুভজিৎদের বাড়ি। শুভজিতের মার কাছে গিয়ে স্বগতোক্তি করছে মন্দিরা," স্বর্ণালী আমার বন্ধু ঠিকই তবে ও কিন্তু মোটেও শুভ দা'র যোগ্য নয় কাকিমা, শুভ দাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। ওর আগে অনেক ছেলেই স্বর্ণালীর বয়ফ্রেন্ড ছিল। তাছাড়া বড়লোক বাবার মেয়ে, আপনাদের সংসারে মানিয়ে চলতে পারবে তো?'

শুভজিতের মা বলেন," মন্দিরার মত মেয়ে লাখে একটা মেলে। কী যে তুই স্বর্ণালীর মধ্যে পেলি? ওই তো শুধু রূপ! আরে রূপ দিয়ে কি সংসার হয়? চাই গুণ, ঠিক মন্দিরার মত!"


আবার অন্য দৃশ্য।

অরূপের সম্বন্ধ এলো। ছেলে ব্যবসায়ী। পাত্রীকে ঘরোয়া হতে হবে।

মন্দিরা আপত্তি করেনি। সারাজীবন কষ্ট করেছে। আজকাল চাকরি আর হচ্ছে কই! হলেও মোটা 'ব্যাকআপ' লাগে, সে ক্ষমতা মন্দিরার নেই।

তাছাড়া 'বিয়ে' নামক এমন শর্টকাট উন্নয়নের পন্থা মন্দিরার মতো মেয়েরা অন্তত হাতছাড়া করতে চাইবে না। এবার সে তার 'স্ট্রাগলিং' থেকে অবসর নিতে পারবে।


শেষ ছবি।

দুপুরবেলা ঠান্ডা ঘরে মন্দিরা শুয়ে। মোবাইল স্ক্রীনে আঙ্গুল চলছে, শাড়ির বিজ্ঞাপন, গয়নার বিজ্ঞাপন, ফেসবুক লাইভ...!

হঠাৎ একটা প্রোফাইল। বড্ড চেনা। মন্দিরা 'অ্যাবাউট' চেক করে।

নাহ! শুধু নাম ছাড়া ডিটেইলস নেই। তবে ছবিটা যে হুবহু এক! স্বর্ণালীর!

 টুক করে একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালো মন্দিরা।

মনের গহীনে চোরা উত্তেজনা। অ্যাক্সেপ্টেড হবে তো? স্বর্ণালীকে যে দেখানো দরকার ছিল, মন্দিরা এখন তার থেকে কম কিছু না!


কয়েকটা ঘন্টা বদলে দিয়ে গেল জীবনের অনেক কিছু।

অরূপ দোকানে বেরিয়ে গেছে। নিভৃত ঘরে মন্দিরা অন্যদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকে, ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে গল্প করে।

আজ ওসব ভালো লাগছে না কিছু।

ফেলে আসা একটা জীবনের কিছু স্মৃতি বারবার ধেয়ে আসছে তার মানসতটে। 

স্বর্ণালীর নিষ্পাপ মুখের হাসি, দশটা কায় কেনা দুটো ভেজিটেবল চপ তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া, বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ে পড়তে যাওয়া, শুভ'দা, এস আর, শীতলদা, মা।

কতদিন মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুময়নি মন্দিরা!

ফোনটা তুলে নিয়ে মায়ের নম্বর ডায়াল করে," আমি কাল আসছি মা। কাঁচকলার খোসাবাটা রাঁধবে আমার জন্য?"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics