Sourya Chatterjee

Tragedy Classics Inspirational

4.5  

Sourya Chatterjee

Tragedy Classics Inspirational

বাজলো ছুটির ঘন্টা

বাজলো ছুটির ঘন্টা

5 mins
394


তখন বেলা এগারোটা মত হবে। ফোনটা বেজে উঠল তমালের। তনুশ্রী, এই সময়! বাড়িতে কিছু হল নাকি! এই সময় তো সাধারণত তনুশ্রী ফোন করে না। ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে যায় এসময়! নাকি ছেলের আবার গার্জিয়ান কল হল! কি জানি বাপু! জীবনে শান্তি বলে আর কিছু রইল না। ধরতে তো হবেই। বউয়ের ফোন বলে কথা! 

-   হ্যালো

-   হ্যালো, বলছি, আজ পুজোর শপিংটা করে নেব। তুতানের স্কুল আজ ছুটি হয়ে গেছে। 

-   মানে? কেন? কি হলো?

-   আঃ! ওসব পরে বলব। তুমি এক কাজ কোরো। দুপুর দুটো নাগাদ নিউ মার্কেট চলে এসো। ওকে?

-   একটু আগে বলবে তো। আচ্ছা, দেখছি।

-   দেখছি ফেকছি না। আমি তুতানকে নিয়ে দুটোয় নিউ মার্কেট পৌঁছে যাব। দেন লাঞ্চ করে শপিং করব। হাফ ছুটি নিয়ে ফটাফট বেরিয়ে পড়।

-   শোনো না...

আর শোনো না! ফোনে কেটে দিয়েছে তনুশ্রী ইতিমধ্যে। অফিসটা যেন ওর বাবার! যখন তখন নাকি হাফ ছুটি নিয়ে নেওয়া যায়। বলা নেই, কওয়া নেই আজ-ই পুজোর শপিংয়ে যেতে হবে। নেহাত কাজের চাপ একটু কম বলে ম্যানেজ দেওয়া যেতে পারে।

-   স্যার, আজ একটু হাফ ছুটি পাওয়া যাবে?

-   কেন গো তমাল? কিছু হয়েছে ঠোয়ছে নাকি?

-   না স্যার, ছেলের স্কুল আজ ছুটি হয়ে গেছে কোনো কারণে। তনুশ্রী একটু বেরোবে বলছিল তাই। তেমন কাজও তো নেই। যদি একটা হাফ ছুটি দেন আর কি! 

-   আজ কি আছে? ছুটি কেন স্কুল?

-   জানি না। আমিও তাই ভাবছি। 

-   স্কুলের ফাউন্ডেশন ডে ঠে হবে মনে হয়।

-   না! আমিও তো সেম স্কুলেরই স্টুডেন্ট ছিলাম। ফাউন্ডেশন ডে তো নয়।

-   আচ্ছা, ঘুরে এসো, ঘুরে এসো। কাজ যখন নেই। রাতে মেইলটা একটু চেক করে নিও। যদি ইম্পরট্যান্ট কিছু থাকে আমি মেইল করে দেব না হয়।

-   শিওর স্যার। আসি তবে?

-   ওকে, এসো। 

দুপুর দুটোর কিছু মিনিট আগেই যথাস্থানে পৌঁছে গেল তমাল। পাশের ভদ্রলোক এক গাল হাসি হাসল তমালকে দেখে। এনাকে তমাল চেনে, কিন্তু কোথায় দেখেছে তা মনে করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো ওর। স্বর্ণেন্দুর বাবা, ছেলের ক্লাসমেট স্বর্ণেন্দু, ওর বাবা। উনি এখানে কি করছেন! তার মানে তো শুধু তনুশ্রী আর তুতান-ই নয়, পুরো স্কুলের তনুশ্রীদের তিন-চার জনের মায়েদের গ্রূপটাই আসবে। আবার হইহল্লা, চিৎকার চেঁচামেচি হবে, কি আর করা যাবে! এত হই-হল্লা পছন্দ নয় তমালের। যতক্ষন না আসছে ওরা ততক্ষণ স্বর্ণেন্দুর বাবার সাথেই কথা বলা সমীচীন মনে করলো তমাল।

-   কেমন আছেন?

-   একদম। আপনার সব খবর ঠিক?

-   একদম, একদম। আরে তনুশ্রী হঠাৎ করেই ফোন করে আসতে বলল। এবার অফিস ছুটি নিয়ে আসা, ওই ম্যানেজ করে আসতে হল।

-   হা! হা! আমায় ও শম্পা ওই এগারোটা নাগাদই ফোন করল। 

-   ওরাই আসছে শুধু?

-   হ্যাঁ, তনুশ্রী বৌদি আর শম্পাই ছেলেদের নিয়ে আসছে বলল শুধু।

-   ও, বাই দ্য ওয়ে, কেন ছুটি হল জানেন?

-   আপনি জানেন না?

-   না তো।

-   আরে, স্কুলের যে দারোয়ান ছিল, কিছুদিন আগে শরীর খারাপ বলে গ্রামের বাড়ি চলে গেল! সমীরবাবু।

-   হ্যাঁ, সমীরদা।

-   আজ সকালে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে! তো, ওই আর কি! একটু নীরবতা পালন ফালন হয়ে ছুটি হয়ে গেছে মনে হয়।

তুতান যে স্কুলে পড়ে, সেই স্কুলেরই স্টুডেন্ট ছিল তমাল নিজেও। তখন তমালের ক্লাস সিক্স! সমীরদা এল স্কুলে। এতই বাচ্ছা বাচ্ছা চেহারা আর ভাবভঙ্গি সমীর কাকা বা সমীর আঙ্কেল বলতে ইচ্ছে হত না। সমীর দাদা হিসেবেই রয়ে গেল স্কুলের স্টুডেন্টদের কাছে। কত আড্ডা মারত তমালরা সমীরদার সাথে। গেটের ফাঁক দিয়ে হজমি আর চানাচুর কিনেও ভাগ করে নিয়েছে কতবার সমীরদার সাথে। এই তো গতবার যখন তুতানের অ্যানুয়াল এক্সামের রেজাল্ট বেরোলো তখনও তমাল গিয়ে কত কথা বলল সমীরদার সাথে। সমীরদা বলল “বাবার বাঁদরামির গল্প ছেলে জানে? কতবার বাবা পাঁচিল টপকে পালিয়েছে তার হিসেব বলে দেব নাকি?” তমাল হেসে বলেছে “ধ্যাৎ! কি যে বলো না!” বলে আবার একসাথে চানাচুর কিনে খেয়েছে তমাল আর সমীরদা।

সেই সমীরদা আর নেই, ভাবতেই পারছে না তমাল! তমালকে খুব ভালোবাসত সমীরদা। কতবার লাস্ট পিরিয়ডের আগে তমালরা কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে সমীরদার কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছে “একটু আগে ছুটির ঘন্টা বাজাবে সমীরদা? ভালো লাগে না এতক্ষণ ক্লাস।” সমীরদা বেশ কড়া করে জবাব দিয়েছে “মন দিয়ে ক্লাস কর। পড়াশুনায় ভালো হতে হবে। ছুটির ঘন্টা সময় মতোই বাজবে। আগেও বাজবে না, পরেও বাজবে না”। সেই সমীরদা নিজের জীবনের ছুটির ঘন্টা এত তাড়াতাড়ি বাজিয়ে দিল। তমালের খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। এটা ঠিক হল না সমীরদার সাথে!

-   দাদা, আড়াইটা তো বেজে গেল। রাস্তায় জ্যাম মনে হয়। ওরা এত লেট করছে কেন কে জানে? 

স্বর্ণেন্দুর বাবার গলার স্বরে বেশ খানিকটা চমকেই গেল তমাল। কোনোরকমে একটু হেসে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল 

-   ইয়ে মানে, সত্যিই তো।

-   ফোন করলাম। ধরল না। আপনি একবার তনুশ্রীকে করবেন নাকি? কাছাকাছি এসে গেলে আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে অর্ডারটা দেই বরং। বাচ্ছা দুটোর তো খিদেও পেয়েছে।

-   হ্যাঁ, ঠিক।

কিছুক্ষনের মধ্যে এসেও গেল ওরা। ওদের মুখ থেকে হাসি ঠিকরে বেরোচ্ছে। এই হাসি যেন অনেকটা হঠাৎ করেই অনাকাঙ্খিত কোনো উপহার পাবার হাসি। তনুশ্রী হেসে বলল

-   উফফ, ভাগ্যিস ছুটিটা পাওয়া গেল। তা না হলে সেই আবার উইকএন্ডে শপিং করতে আসতে হত। ভিড়ভাট্টা! তার থেকে এখন ফাঁকায় ফাঁকায় শপিং করা যাবে। 

একটু মুখটা হাসি হাসি করে তমাল উত্তর দিল 

-   হ্যাঁ।

-   কতগুলো কথা বললাম, শুধু হ্যাঁ! ধুৎ! তোমার সাথে কথা বলাই বেকার।

-   না, না। ফাঁকাই আছে। ভালোই হবে। 

-   আরে তাও তো শোক সভা, একের পর এক বক্তৃতা দিতে দিতে একটা বাজিয়ে দিল। 

-   বডি এনেছিল স্কুলে?

-   কি যে বল না! সে তো গ্রামের বাড়িতে মরেছে। শুধু বক্তব্যতেই এত টাইম! শুধু হেডস্যার বলবে তা তো নয়, এই স্যার, ওই স্যার একের পর এক বলেই যাচ্ছে। 

একটু সবার আড়ালে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তমাল। সমীরদার দাম তনুশ্রীরা যে বুঝতে পারবে না তা স্বাভাবিক এবং অনুমেয়, কিন্তু তনুশ্রী যেভাবে কথা বলছে তা যথেষ্ট ব্যথিত করল তমালকে। সমীরদা স্কুলটাকে খুব ভালোবাসত। তার মৃত্যুর পর মাত্র দেড় দু ঘন্টার বক্তব্যে তাকে সম্মান জানানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তিনি হয়তো আরো সম্মান পাবার যোগ্য ছিলেন, আরো অনেকটা সম্মান পাবার যোগ্য ছিলেন। তার মৃত্যুর দিন স্কুল ছুটি পেয়ে হাসতে হাসতে পুজো মার্কেটিং করতে চলে এল সবাই, এটা তো মন থেকে আরোই মেনে নিতে পারছে না তমাল। না! থাক! এখন কিছু বললে আবার সিন-ক্রিয়েট হবে। কিছু বলার দরকার নেই। কিছু অনুভূতি অন্যকে বোঝানো যায় না, নিজের কাছেই রাখতে হয়।

-   এই, খাবার দিয়ে দিয়েছে তো। এস। ওখানে কি করছো?

-   হ্যাঁ, আসছি। 

প্লেট ভর্তি বিরিয়ানি, চিকেন চাপ সুন্দর ভাবে সাজানো রয়েছে। তমালের ইচ্ছে করছে না সেসব খেতে, বরং ওর ইচ্ছে করছে স্কুলের গাছতলাটায় বসে শেষবারের মত হলেও একটু চানাচুর কিনে ভাগ করে খেতে সমীরদার সাথে।

সবাই কত আনন্দ সহকারে কেনাকাটায় মন দিয়েছে। তমাল এমনিতেই একটু চুপচাপ, আজ সমীরদার জন্য আরো একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে গেছে। রাস্তার পাশে প্লাস্টিকের খেলনা বিক্রি হচ্ছিল। তুতান বায়না ধরল হঠাৎ “বাবা, ওই ড্রামটা কিনে দেবে?”

-   ওই ড্রামগুলো কত করে?

-   একশো টাকা বাবু।

কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না আর তমালের। দুশো টাকা ভদ্রলোকের হাতে ধরিয়ে তুতান আর স্বর্ণেন্দুর জন্য দুটো প্লাস্টিকের ড্রাম কিনল তমাল। তনুশ্রী রেগে কটমট করে তমালের দিকে তাকালো।

-   জানো তো এখানে বেশি দাম চায়। যা চাইল তাই দিয়ে দিলে?

-   ছাড় না!

-   কিছু বলার নেই তোমাকে।

তুতান আর স্বর্ণেন্দু প্লাস্টিকের ড্রামদুটো বাজাচ্ছে। স্বর্ণেন্দুর বাবা ওদেরকে হেসে হেসে পায়ে তাল দিতে দিতে বলছে

-   বাজাও দেখি, ড্যাডাঙ ড্যাডাঙ ড্যাঙ

তমালের কানে সেই “ড্যাডাঙ ড্যাঙ” প্লাস্টিকের ড্রামের শব্দ যেন সমীরদার “ঢং ঢং ঢং ঢং” ছুটির ঘন্টার শব্দরূপে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তমাল হাতে ঘড়ি দেখল। চারটে বাজে, এইসময়-ই তো স্কুলে ছুটির ঘন্টা বাজাত সমীরদা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy