STORYMIRROR

SHUBHAMOY MONDAL

Tragedy Classics

4  

SHUBHAMOY MONDAL

Tragedy Classics

বাবুদের তালপুকুরে

বাবুদের তালপুকুরে

4 mins
318

বাবুদের তালপুকুরে

(বিবর্তন সাহিত্য পত্রিকার শারদীয়া ১৪২৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)

শুভময় মণ্ডল

১১-০৭-২০২০


অনেক বছর আগেকার কথা। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। মানুষের জীবনযাত্রা তখন এতটা উন্নতও ছিল না। পানীয় জলের প্রয়োজনে ধনী জমিদার বা বাবুশ্রেণীর ব্যক্তিরা কাটিয়ে দিতেন বড় বড় পুকুর। সেইসব পুকুরের ভিতরে জলের উৎস হিসাবে খোঁড়া হতো গভীর কূপ, গোদা বাংলায় কুয়ো আর কি। 


সেই কুয়োর জল জমে ভরে থাকত পুকুরগুলো। পানীয় হিসাবে সেই জল ছিল অতি উৎকৃষ্ট মানের। স্বাভাবিকভাবেই ঐ সমস্ত পুকুরে পানীয় জল সংগ্রহ ভিন্ন, স্নানাদি অন্যান্য কাজকর্ম সাধারণত করা হতো না। নির্ভরশীল জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে তখন ছোট বা বড় আকারে পুকুরগুলো খোঁড়া হত।


সেই সময়, রীতি মেনে পুকুর প্রতিষ্ঠা করারও প্রচলন ছিল। মনে করা হতো, ঐসব প্রতিষ্ঠা করা পুকুরের জল গঙ্গাজলসম পবিত্র। তাই পুজো আর্চাতে গঙ্গাজলের পরিপূরক হিসেবে সেই জল ব্যবহৃতও হতো। আমাদের কাহিনীর পুকুরটিতে শুনেছি সাত-সাতটি কুয়ো খোঁড়া হয়েছিল। বালিগঞ্জের অর্ধেক লোক নাকি তাদের খাবার জল নিতো সেখান থেকে!


ঐ পুকুরটি নিয়ে একটি কাহিনী শোনা যায়। পুকুরে কুয়ো খোঁড়ার কাজ শেষ হলে, নিয়ম মেনে পুজো করে প্রতিটি কুয়োর জন্য একটি করে মোট সাতটি উৎসর্গকৃত মঙ্গল ঘট স্থাপন করা হচ্ছিল। সেই ঘটগুলো ছিল তামার তৈরি, তাদের গায়ে নানা রকমের মাঙ্গলিক নকশা কাটা ছিল। আর যাতে হারিয়ে না যায়, তাই তাদের সবার গলা একটাই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা ছিল। যাই হোক, সেই অনুষ্ঠানের সময় একটি নির্বোধ লোকের বোকামির জন্য, সেই উৎসর্গকৃত ঘটগুলো রীতি মেনে স্থাপন করার আগেই পুকুরে পড়ে যায়। স্বভাবতই উপস্থিত লোকজন সবাই সেই নির্বোধ লোকটিকে খুব অপমান করে। সে তখন ঐ ঘটগুলোকে উদ্ধার করার জন্য জলে ঝাঁপ দেয়, কিন্তু আর সেখান থেকে উঠে আসেনি। বহু খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও পুকুর থেকে সেই লোকটাকে উদ্ধার করা যায়নি, আর সেই ঘটগুলোকেও না। 


ঘটনাটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং অমঙ্গল সূচক বলে পুরোহিতরা ঘোষণা করেন। কিন্তু সেই এলাকায় তখন পানীয় জলের আকাল। তাই সব জেনেও, লোকে সেই জলকেই পান করার জন্য ব্যবহার করত। প্রসঙ্গত বলে রাখি, সেই পুকুরের জল খেয়ে কারোর কোনো রোগ ব্যাধি বা অসুস্থতার সৃষ্টি হয়েছে শোনা যায়নি। স্বভাবতই, সেদিনের ঘটনাকে লোকে সাধারণ দুর্ঘটনা মনে করে ভুলে যায়।


এর কয়েকমাস পর, খাবার জল আনতে গিয়ে এলাকার এক গৃহবধূ দেখে, পুকুরঘাটের সিঁড়িতে সেই শিকলবদ্ধ ঘটগুলো রাখা। তার থেকেও চমকপ্রদ ঘটনা হল, সে ঐ ঘাটের কাছে যেতেই নাকি ঘটগুলো আপনার থেকেই পুকুরের জলে নেমে যায়! ভয়ে সেই গৃহবধূটি ঐ পুকুর থেকে আর জল নিতে সাহস পায়নি। ঘটনাটা সে বাড়ি ফিরে সবাইকে বললেও, প্রথমে কেউই বিশ্বাস করেনি তার কথা। কিন্তু কয়েকদিন পরেই, ঐ একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন পাড়ারই এক বয়স্ক ব্যক্তি। তারপর আরও বেশ কিছু এলাকাবাসীরও চোখে পড়ল ঘটনাটা। প্রতিবারই ঘটগুলো নিজের থেকেই নাকি নেমে যেত পুকুরের জলে!


যা হয় আর কি, পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের তখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলো ঐ ঘটগুলো, সবাই উঠে পড়ে লাগলো তাদের ধরার জন্য। পাড়ায় এক পণ্ডিত মশাই ছিলেন, তিনিই শুধু বিচার করে বললেন - এটা অশুভ লক্ষণ, ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটতে চলেছে। এইভাবে ঘটগুলোর ডাঙায় উঠে আসার পিছনে নাকি একটাই উদ্দেশ্য হতে পারে, তারা কাউকে নিয়ে যেতে এসেছে। কাউকে না কাউকে তাদের সঙ্গে করে জলে না টেনে নিয়ে যাওয়া অবধি, ঐ ঘটগুলো থামবে না। বারণ করলেন তিনি সবাইকে, ঐ ঘটগুলোর কাছে না যেতে। 


কিন্তু তাঁর সেই সতর্কবার্তায় এলাকার কেউই বিশেষ পাত্তা দেয়নি তখন। খুব শীঘ্রই তার ফলও ভোগ করতে হল ঐ ছেলেদের দলেরই একজনকে। ঘটগুলোকে অনুসরণ করে ওই পুকুরের জলে লাফ দিয়েছিল সে, কিন্তু আর উঠে আসেনি সেখান থেকে। আগের ঘটনাটির মতই, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে উদ্ধার করা যায়নি। প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে একদিন তার নিথর দেহটিকে ভাসতে দেখা যায় সেই পুকুরের জলে। ঘটনাটি সেই পুকুর স্থাপনের এক বছরের মাথায় ঘটেছিল। 


সেই থেকে এখনও সেই ঘটগুলোর একইভাবে জল থেকে ডাঙায় আনাগোনা চলছেই। আর এতদসত্ত্বেও তাদের আকর্ষণ থেকে যেন মুক্তি পায়নি আজও এলাকার ছেলে-ছোকরাদের দল। আর তখন থেকে আজও প্রতিবছর, মূলতঃ সেই ঘটগুলোরই আকর্ষণে ঐ পুকুরে নেমে আর উঠে আসতে না পারার একটা না একটা ঘটনা ঠিক ঘটেও চলেছে।


কি যে তাদের আকর্ষণ, আর কেনই বা তাদের এমন আচরণ, জানা নেই। প্রাণ হারানো ঐসব মানুষগুলোরই বা কি অপরাধ, তা'ও আজও জানা যায়নি। বেঘোরে প্রাণ হারানো সেই মানুষদের তালিকায়, শিশু থেকে বৃদ্ধ, পুরুষ থেকে নারী, সব বয়সের সব লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন। 


এইতো সেদিনও ঐ পুকুরে স্নান করা বা জলে নামা নিষিদ্ধ ছিল। যদিও এখন না আছে তার সেই গভীরতা, না আছে সেই জলের পবিত্রতা, তবুও এলাকায় আজও ভয়ের প্রতিভূ বাবুদের ঐ তাল-পুকুর। কারণ, ঘটি ডুবুক বা না ডুবুক সে তালপুকুর, আর প্রতিবছর তার সেবায় ঠিক উৎসর্গকৃত হয় একটি নরদেহ, আজও!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy