বাবা বলতো আকাশ ছেলেটা ভালোনা
বাবা বলতো আকাশ ছেলেটা ভালোনা
*এক*
ছেলেবেলা থেকে সেইরকম কারুর সাথে মিশতোনা পলাশ। তবে বন্ধু বলতে একটাই ছিলো আকাশ। ওদের মধ্যে এইভাব, এই বন্ধুত্ব। পলাশ ছিলো খুব উদার মনের, আর আকাশ ছিলো সৎ তবে একগুঁয়ে প্রকৃতির ছেলে। দিনটি ছিলো মঙ্গলবার। অফিস থেকে ফিরছিলো পলাশ, ট্রেনের গেটে দাঁড়িয়ে ভাবছে আজ খুব দেরী হয়ে গেলো। প্রতিদিন সে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যায়, বাড়ি গিয়েই আকাশের সাথে বেড়িয়ে যায় কাজে। ওরা দুইজন পার্ট-টাইমে কাজ করতো। ওটা একপ্রকার আকাশের-ই ব্যবসা ছিলো। ফাস্টফুডের। আকাশ খুব ভালো রাঁধতো..প্রতিদিন রাত ৯ টা থেকে ১১.০০ টা, একটি আদিবাসী এলাকার মিলের সামনে ভ্যান নিয়ে দাঁড়াতো দুইজনে। খাসীর ছাট, ফ্যাপড়া চোস্তা এইসব বিক্রি করতো মিলের শ্রমিকদের কাছে। কাস্টমার বেশী হওয়ায় কম টাকায় বিক্রি করতো। পলাশ আকাশের কাছে অনেকদিন ধরে একটা রিকুয়েষ্ট করছে যাতে ওইখানে তারও একটা ভ্যান দাঁড় করানোর অনুমতি স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের কাছ থেকে এপ্রুভ করিয়ে দেয়। কারন আকাশের সাথে ওনার খুব চেনাজানা। শুধু পঞ্চায়েত না, মিলের যে বাবুরা আছেন তাদেরও খুশী করতে হবে, মানে ওদের ফ্রি'তে খাবার দিতে হবে মাঝেমধ্যে তাহলেই ব্যাস যতোখুশী ব্যবসা করো।
*দুই*
আজকাল পলাশ একাই আকাশের ব্যবসা দেখছে, কারন ইদানীং রোজ রাতে আকাশ অন্য কাজে বাইরে থাকে। এর আগে পলাশ দেরী করে ফিরলে বাড়ি আসতোনা সোজা আকাশের বাড়ি গিয়ে ভ্যান নিয়ে মিলের উদ্দেশ্য চলতো। তবে আজ হঠাৎ কি হলো কে জানে? না মানে আজ পলাশ নিজের অফিস থেকে বেশকিছু ডোকোমেন্টস নিয়ে এসেছে, সেগুলোর ভেরিফিকেশন করবে যাতে পরেরদিন অফিসে লাঞ্চ টাইমের আগেই Tl (Team leader) এর কাছে ডোকোমেন্টস গুলো জমাদিতে পারে। এইকারনে সে বাড়ির দিকে যাচ্ছে ডোকোমেন্টস রাখতে। ফাঁকা বাঁশবন। মাঝখানে রাস্তা, শীতের রাত গ্রামের মেঠোপথ। ধীরেধীরে এগিয়ে চলছে পলাশ নিজের বাড়ির দিকে।
'বাড়ি যাচ্ছিস পলাশ'?
কথাটি শুনে পলাশ থমকে দাঁড়িয়ে যায়। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকার বাগানের মাঝে যেটুকু চাঁদের আলো আসছে সেই আলোয় পলাশ দেখলো ওই লোকটি তার-ই বাবা। পলাশের তখনি মনে পড়ে গেলো বছর ১০ এক আগেকার ঘটনা। যখন সে ১৮ বছরের যুবক ছিলো। একবার বাড়িতে পলাশ ও তার দাদার সাথে মারপিট হয়েছিলো, সেইসময়ে পলাশের বাবা যখন ভাইয়ে ভাইয়ে ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করছিলো, পলাশ বেশ জোড়ে জোড়ে নিজের দাদার নামে উল্টোপাল্টা কথা বলছিলো। এইকারনে পলাশের বাবা, পলাশ'কে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারে। পলাশ সেইদিন প্রথম বাবার মুখে মুখে কথা বলেছিলো।
- গায়ে হাত তুললি কেন? আমার গায়ে হাত দিবিনা। এইবলে পলাশ বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যায়৷ পলাশের বাড়ির লোকেরা ভেবেছিলো পলাশ হয়তো এমনি পাশের পাড়ায় গেছে চলে আসবে। কিন্তু রাত ১২.০০ টা বেজে যায় ঘড়িতে ছেলের খবর নেই। তখন পলাশের বাবা-মায়ের চিন্তা বাড়তে থাকে। তারা এদিক ওদিক খুঁজতে শুরু করে। বছর ৭১ এর সতীশবাবু ছেলে হারানোর চিন্তায় ওইরাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন পাড়ার কিছু ছেলের সাহায্যে হাসপাতালে পাঠানো হয়, সাথে ছিলেন পলাশের দাদা। পলাশের মা তখনো ছেলেকে খুঁজে যাচ্ছে। শেষে ভোর ৬.০০ টায় এক রিক্সা চালকের থেকে খবর পায় পলাশের মা..পলাশ হচ্ছে পলাশের মাসি বাড়িতে আছে। পলাশের মা খবর পাঠায় ছেলেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার জন্য। পলাশ যখন শুনতে পায় বাবা হাসপাতালে ভরতি, পলাশ দৌঁড়ে হাসপাতালে যায়৷ না..কাল খুব সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে পলাশের। বাবার সাথে ওইভাবে কথা বলাটা উচিৎ হয়নি। হাসপাতালে গিয়ে বাবা যেই ওয়ার্ডে ছিলেন সেই ওয়ার্ডে যাওয়া মাত্র খবর পায়..পলাশের বাবা কিছুক্ষণ আগেই মারা গেছেন।
পলাশ একটা সরি অবধি বলতে পারিনি।
শুধু একটা 'সরি' যার ভার সে ১০ টা বছর ভয়ে বেড়াচ্ছে। আজ সেই ১০ বছর পর বাবাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পলাশ নিজের উপর রাগ,ঘেন্নায় ও বাবা হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাতে ককিয়ে উঠছে। কিন্তু পলাশের গলা থেকে কোনো আওয়াজ বেড়োচ্ছেনা যে। সে যে ১০ বছর পর বাবাকে দেখছে..মুখ থেকে তো 'বাবা' ডাকটি বেড়িয়ে আসছেনা। কিন্তু এদিকে পলাশ প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাবাকে একটিবার বাবা বলে ডাকার।
'বাবা বলতো আকাশ ছেলেটা ভালোনা'
মলয় বিশ্বাসের গল্পসমগ্র
পরবর্তী অংশ পরের পর্বে