Ananya Podder

Tragedy Classics

3  

Ananya Podder

Tragedy Classics

অথ গৃহবধূ কথা

অথ গৃহবধূ কথা

10 mins
466



আমার নাম আদৃতা | নামের সাথে তাল মিলিয়েই আমি আমার বাড়ির খুব আদরের মেয়ে | আমার বাবা জ্যাঠারা বনেদী বড়োলোক | কিন্তু আমার বাবা জ্যাঠাদের সবার ঘরেই ছেলে| পুরো পরিবারে মেয়ে বলতে আমি একা | তাই বলতে গেলে, আমি সবারই চোখের মণি !!


সেই আমি, জুয়েলারী ডিজাইনিং পড়তে সিডনি গেলাম | উদ্দেশ্য, ফিরে এসে বাবা জ্যাঠাদের জুয়েলারী ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করবো | কিন্তু সব উদ্দেশ্য আর পরিকল্পনা ভেস্তে গেল, কারণ আমার জীবনে তথাগত এলো | তথাগত পেশায় একজন ডাক্তার , সিডনিতে পড়াশুনা করতে এসে আর দেশে ফেরেনি | এদেশেই একজন ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েক বছর হোলো | দেশের প্রতি, বাড়ির প্রতি খুব একটা টান যে ওর নেই, সেটা আমি প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম |


বিয়ের প্রায় বছর দেড়েক পরে দেশে ফিরি , অবশ্যই আমি একা | ঠিক হয়, আমি মাস খানেক থাকবো | আমার সিডনি ফেরত যাওয়ার দিন কয়েক আগে তথাগত দেশে আসলেও আসতে পারে, তবে সেটা ফাইনাল কিছু নয় |


দেশে ফেরার আগেই আমি ঠিক করি যে, আমি দেশে ফিরে তথাগতদের বাড়িতে উঠবো | কারণ, ছোটো বেলা থেকেই আমার শ্বশুরবাড়ির ঘর করার খুব ইচ্ছে !! বাড়িতে থাকলে কেমন যেন সেই আদুরে মেয়ে হয়েই কাটিয়ে দিতে হবে | তার চাইতে শ্বশুরবাড়িতে থাকাতেই আমার বেশী আগ্রহ, কারণ, ওখানে বেশ একটা এডভেঞ্চার ফিলিংস হয় !! তাছাড়াও, আরও একটা কারণ আছে |


বিয়ের পরে স্কাইপিতে আমার শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে আমার মাঝে মধ্যে কথা হতো | আগেই বলেছি, তথাগত নিজের পরিবারের সাথে একেবারেই অ্যাটাচড নয় | ওকে কথা বলার জন্য জোর করলে বলবে, " আমি না, আদ্রি, এত পারিবারিক ইমোশনস ক্যারি করতে পারি না | কখনো হাসছে, কখনো কাঁদছে, কখনো একে অপরের নামে কাঁদা ছিটোচ্ছে | আই জাস্ট কান্ট টলেরেট দৌস অল থিংগস | শুধু বৌদিটার জন্যই মন খারাপ হয় মাঝে মাঝে | আমার দাদাটা তো চিরকালই মা ভক্ত হনুমান !! "


সেই তথাগতর মুখে ওর নাটুকে পরিবারের গল্প শুনে আমার থাকতে ইচ্ছে করলো ওদের সঙ্গে |


এয়ারপোর্টে আমাকে ওয়েলকাম করতে আমার দুই পরিবারের লোকই দাঁড়িয়ে ছিল সেদিন | বিয়েটা আমি আর তথাগত সিডনিতেই সেরেছিলাম | কিন্তু এত গুলো মাস পরেও আমি সবার কাছে নব্য বিবাহিত মেয়ে ও বউয়ের মতন আচরণ পেলাম |


শ্বশুরবাড়িতে পা দেওয়ার আগে যার অভ্যর্থনায় আমি মোহিত হয়ে গেলাম, তিনি আমার বড়ো জা, সুমেধা | আমার আসার দিনটা এতটাই নাকি বিশেষ, যে, তাকে তার স্কুল থেকে ছুটি নিতে হয়েছে | আমার যখন বিয়ে হয়, তখনও সুমেধা বৌদি একটি স্কুলের প্যারা টিচার ছিল, মাস ছয়েক হয়েছে, এস. এস. সি. পরীক্ষা দিয়ে একটি স্কুলের অর্থনীতির শিক্ষিকা হয়েছেন |


কিন্তু আমার শাশুড়িমাকে দেখলাম, যে, তাঁর বড়ো ছেলের বউয়ের প্রতি তিনি খুব একটা সদয় নন | আমার সাথে সুমেধা বৌদির পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, " ওহ একটা স্কুলে চাকরি করে | তোমার মতো মোটেই বিলেত ফেরত নয় | "


সুমেধা বৌদি শাশুড়িমায়ের কথায় সাময়িক চুপসে গেলেও কিছু মুহূর্ত পরেই হাসি মুখে আমায় বললেন, " ওই আর কি আদৃতা | ধরে নাও গৃহবধূই আমি | চলো, ঘরে গিয়ে তোমার সাথে একটু গল্প করি | "


শাশুড়িমা বৌদির কথায় বেশ অবাক হয়ে বললেন, " গল্প করবে কি?? বিরিয়ানি কে রান্না করবে, শুনি ?? তারপর তো দুটোর আগে খেতে দিতে পারবে না কাউকে | "


কাজের জায়গা থেকে ছুটি নিয়ে বিরিয়ানি রান্না করার হুকুম শোনায় ব্যস্ত আমার বড়ো জা শাশুড়িকে জবাব দিলেন, " আপনি কিছু ভাববেন না মা | আমি সময়ে সব করে দেবো | "


সেদিন বৌদির ঘরে মেরে কেটে মিনিট পনেরো বসার সুযোগ পেয়েছিলাম | আমাদের শাশুড়িমা আমার প্রতি অপত্যস্নেহে আমাকে বিশ্রাম দেওয়ার অছিলায় নিয়ে যান বৌদির ঘর থেকে | কারণ, তখনও যে, বিরিয়ানি রান্নাটা বাকি আছে !!


রাতের বেলায় দেখলাম, বৌদি রসগোল্লা বানালেন| কোনো একসময় তথাগতর কাছে শুনে থাকবেন বোধহয় যে আমি রসগোল্লা খেতে খুব ভালোবাসি, তাই... |


পরেরদিন আমার ঘুম ভাঙলো আমার দরজায় বৌদির ধাক্কা দেওয়ার শব্দে ও আমার শাশুড়িমায়ের বকুনির আওয়াজে | বকুনিটা অবশ্য আমার জন্য ছিল না | কারণ, আমি তো এত দায়িত্বশীলই নই.!!


সকালবেলা নটার মধ্যে বাড়ির দশটা লোকের সকালের টিফিন, দুপুরের রান্না করে বৌদি ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাবিন আর টুকাইকে স্কুলের জন্য তৈরী করতে | বাবিন বয়সে বড়ো , টুকাই ছোটো | বাবিনকে বড়ো বললাম বটে, তবে তার বয়স সাত , আর টুকাইয়ের বয়স চার | ওদের দুজন তখনও সোফায় বসে ঢুলছে | বৌদি দুটো জলের গ্লাস নিয়ে ছুটলো ওদের দেওয়ার জন্য |


রান্নাঘর থেকে শাশুড়িমা চিৎকার করলেন, " নটা তো বেজে গেল মেধা| বাড়ির সবাইকে সকালের টিফিন খেতে দেবে কখন ?? "


বৌদি ছেলে মেয়ের হাতে জলের গ্লাসদুটো ধরাতে ধরাতে বলল, " আজ আপনি একটু খেতে দিননা মা | আমার দেরী হয়ে গেছে | "


"তুমি আমাকে হুকুম করছ ?? ... সাহস তো মন্দ নয় তোমার !! "


"হুকুম করিনি মা, অনুরোধ করেছি | আজ স্কুলে ইন্সপেকশন হতে পারে | তাই একটু আগে বেরোতে হবে | বাবিন, টুকাইকেও তো আমাকেই তৈরী করে দিতে হবে | "


"তুমি তৈরী করে দেবে না তো কে তৈরী করে দেবে??... আর কেউ তো মা হয় না, আর কেউ তো চাকরিও করে না!! একা তুমিই শুধু চাকরি করো তো মা | "


আমি বৌদির বেগতিক অবস্থা দেখে রান্নাঘরে ঢুকে বললাম, " আমি দিয়ে দিচ্ছি মা, আমাকে বলুন, কি করতে হবে , আমি করে দিচ্ছি | "


ধোওয়া থালা গুলিতে আমি যখন বৌদির বানানো আলুর পরোটা গুলি শুধু বেড়ে দিচ্ছিলাম, তখন আমার শাশুড়িমা সগর্বে বললেন, " দেখো মেধা, ছোটো জা টা কে দেখে কিছু শেখো !! অত বড়োলোক ঘরের মেয়ে, তার উপর আবার নতুন বউ, অথচ কি সুন্দর করে সবাইকে খেতে দিচ্ছে !! "


আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, যে, তিনি ব্যঙ্গটা কাকে করলেন ... আমাকে নাকি বৌদিকে ??.... অবশ্য, বৌদি তো বড়োলোকের মেয়ে নন |


বৌদি শাশুড়ির কথায় বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ছেলে মেয়েকে এক এক করে স্নান করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল | আমার খুব ইচ্ছে করলো, যে, আমি বৌদিকে গিয়ে একটু সাহায্য করি, কিন্তু পারলাম না, শাশুড়িমায়ের স্নেহজালে আটকা পড়ে গেলাম|


কিছুক্ষন বাদে ঘর থেকে দাদার আওয়াজ পেলাম, " মেধা, আমার রুমাল খুঁজে পাচ্ছি না | খুঁজে দিয়ে যাও | "


দাদার আওয়াজে বৌদি ভেজা পায়ে দৌড়ে বেরোতে গিয়ে একবার সামান্য পিছলে গেল, কিন্তু পড়ে গেল না | বৌদির দৌড় দেখে বুঝলাম, এই সংসার অলিম্পিকে বৌদি বেশ একজন পোক্ত খেলোয়াড় | ঘরের ভিতরে ঢুকে দাদার রুমাল খুঁজে দিতে দিতে বৌদিকে বলতে শুনলাম, " ওষুধ খেয়েছো তুমি?? "


"এই যাঃ, একদম ভুলে গেছি | একটু দাও না বার করে | "


"মেয়েটা এখনও বাথরুমেই দাঁড়িয়ে আছে, জল নিয়ে খেলেই যাচ্ছে বোধহয় | নিজের ওষুধটা তো একটু নিজেও নিয়ে নিতে পারো ?? "


"আমার বউ থাকতে এসবের চিন্তা কিসের??.... তুমি আছো তো !! "


পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, বৌদি ওষুধগুলি স্ট্রিপ থেকে খুলে, জলের বোতলের ঢাকনা খুলে দাদার দিকে এগিয়ে দিলেন |


এদিকে, বাবিন স্নানের পরে চিৎকার শুরু করেছে, "মা.... গা মুছিয়ে দিয়ে যাও | "


বাবিনের চিৎকার শুনে বৌদি দাদাকে বলে, " তুমি বেরিয়ে যেও না যেন | তোমার টিফিনটা গুছিয়ে উঠতে পারিনি এখনও | "


বৌদির কথায় দাদার উত্তর, " কি যে করোনা মেধা !! আমার দেরী হয়ে যাবে তো !! ... সকাল থেকে কি করো বলো তো ?? "


বৌদি কাচুমুচু ভাবে বলল, " একটু অপেক্ষা করে যাও লক্ষ্মীটি | মেয়েটা ভিজে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে | "


বাবিনকে স্কুলের ড্রেস পরিয়ে বৌদি ছুটলো রান্না ঘরে, দাদার টিফিন গুছাতে | আমি বললাম, " আমাকে দাও বৌদি, আমি পরোটা গুছিয়ে দিচ্ছি দাদাকে | কটা পরোটা দেবো বলো?? "


"না, আদৃতা, তোমার দাদা পরোটা নেবে না | ওর জন্য রুটি আর সালসা সোয়াবিন বানিয়েছি | ওটাই নিয়ে যাবে ও আজকে | "


দাদার টিফিন রেডি করে দেওয়ার সময় বৌদি আমার মুখে এক চামচ সালসা সোয়াবিন পুরে দিলো | আমি সাত সকালে চোখ বন্ধ করে যেন রেস্টুরেন্ট এর স্বাদ নিলাম |


দাদা, বেরিয়ে যাওয়ার পরেই উমাদি ঢুকল বাড়িতে | উমাদি এ বাড়িতে রান্না করে | সঠিক ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, অর্ধেক রান্না করে| কারণ, দিনের বাকি অর্ধেকটা তো বৌদিই করে দেখলাম |


আমার ননদিনী তখন সবে ঘুম থেকে উঠে ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রাশ করতে উদ্যত | হাই তুলতে তুলতে আমাদের শাশুড়িমায়ের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রশ্নবাণ, " মা, তোয়া, রিয়াকে খেতে দিয়েছো ?? "


তোয়া আর রিয়ার একজন ক্লাস সেভেনে পড়ে, আরেক জন ক্লাস ফাইভে | দুই বোন তখন দাদুর ঘরে বসে টিভির রিমোট নিয়ে লড়াইয়ে ব্যস্ত, সামনে দুটো থালায় আলুর পরোটাগুলি তখনও উদর পূর্তির কাজে ব্যবহৃত হতে তৎপর |


শাশুড়ি মা আমার, আমার ননদের আর নিজের থালা সাজিয়ে টিফিন খাওয়ার জন্য টেবিলে ডাকলেন আমাদের দুই জনকে |


আমার খুব অস্বস্তি হোলো বৌদিকে এভাবে ফেলে রেখে খেতে বসতে | আমার অস্বস্তির আঁচ পেয়ে বৌদি নিজেই বলল, " তুমি বসে পড়ো মেধা | আমি বাবিন, টুকাইকে খাওয়াতে খাওয়াতেই খেয়ে নেবো | "


কথাগুলি বৌদি যে দাঁড়িয়ে বলবে, সেই সময়ও বৌদির নেই, দৌড়ে স্নানে চলে গেল | স্নান থেকে বেরিয়ে এলো স্কুলে যাবার জন্য একটা চুড়িদার পরে | ভেজা চুলেই রান্নাঘরে ছুটলো ছেলেমেয়ের খাবার আনতে | একই থালায় দুই ভাইবোনের ভাত বাড়ার জন্য শাশুড়িমায়ের কাছে দুটো কটু কথাও শুনলেন | পাক্কা কুড়ি মিনিট লাগলো বৌদির এই অসাধ্য সাধন করতে | তখন ঘড়িতে দশটা বেজে পনেরো | সাড়ে দশটায় বেরোতে না পারলে বাচ্চাদুটোর স্কুল বাস মিস হয়ে যাবে | তাই ওই পনেরো মিনিটের মধ্যে বৌদি হাতে ভাতের থালা নিয়ে খেতে খেতে উমাদির কাছে দৌড়ে গেল, খেতে খেতেই বলে দিলো কি রান্না হয়ে গেছে আর কি রান্না করতে হবে| কোন পদটা কিভাবে হবে | তারপর চার মিনিটে ভাত গুলি গিলে চুলটা কোনোরকম বেঁধে তাড়া দিতে থাকে ছেলেমেয়েদেরকে | ছেলের পায়ে জুতো পরাতে পরাতে মেয়েকে ইংলিশ গ্রামারের কিছু জিনিস ঝালিয়েও দেয়| আমি বৌদির দিকে তাকিয়ে আছি দেখে হেসে বলল, " আজ বাবিনের ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ পরীক্ষা আছে স্কুলে | তাই.... "


বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল, " বিকেলে এসে অনেক গল্প করবো | "


বিকেল সাড়ে চারটের সময় বৌদি ফিরলো টুকাইকে নিয়ে | বাড়ি ফিরে টুকাইয়ের হাত মুখ ধুইয়ে ভাত খাইয়ে দিলো | এদিকে পাঁচটা বেজে যাচ্ছে দেখে শাশুড়িমা হাঁক দিলেন, " কি মেধা, আজ চা করবে না?? "


"এই করি মা| "


আমি বৌদির হাতটা ধরে বললাম, " তুমি কিছু খাবে না?? "


বৌদি হেসে বলল, " এই যে, চা বানাতে যাচ্ছি | এর বেশি কিছু খাওয়ার সময় আমার নেই গো| সাড়ে পাঁচটায় বেরোবো বাবিনকে আনতে | ওর বাসটা তো পৌনে ছটার মধ্যে ঢুকে যায় আবার | "


বাবিনকে বাড়িতে নিয়ে এসে সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি | বাচ্চাগুলি খেলতে গেলে আমি হাত ধরে বৌদিকে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজায় খিল দিয়ে বলি, " একটু সবুর করে বসো তো তুমি | তোমাকে আমি কি বলবো -- ওয়ার্কিং লেডি নাকি হোম মেকার ?? "


বৌদি একটু হেসে বলল, " তোমার যেটা ইচ্ছে হয় | আমি দুটো চাকরিই করি | "


আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, " হোম মেকিং আবার চাকরি হোলো নাকি?? "


"চাকরি হোলো না!! সারাদিনের পরিশ্রম দিয়ে আমরা বাড়িটাকে তৈরী করি বলেই তো বাড়িটা একটা সংসার হয়ে উঠতে পারে | তবে যারা বাইরে কাজে বেরোন, তাঁদের একটু ডবল ডিউটি করতে হয় আর কি !! "


আমি একটু রাগের সুরে বললাম, " তাও তো নাম পাও না | সারাদিন তো উঁনি তোমার গালমন্দ করতেই ব্যস্ত !! দাদাকে কিছু বলো না তুমি ?? "


"না গো, কিছু বলি না| তোমার দাদা হাই প্রেসারের রুগী | অনেক কড়া কড়া ওষুধ খায় , হাইপার টেনশনের ওষুধ খায় | এমনিই মনের উপর খুব চাপ ওর| ছোটো ভাইটা অত মেধাবী, আর ও সেখানে একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার | বাবা মায়ের সামনে প্রতি নিয়তই লজ্জিত হতে হয় ওকে| বড়াই করে বলার মতো কিছুই তো নেই ওর | তাই ভালোবেসে বাবা মায়ের সেই অভাবটুকু পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় ও | ও সব বোঝে, আমি বুঝতে পারি | কিন্তু কাউকে কিছু বলতে চায়না, পাছে সবাইকে হারিয়ে ফেলে | "


"কিন্তু, তুমি কেন পড়ে আছো এখানে?? একজন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের টিচারের মাইনে তো কম নয় !! আমি জানি, আমার এক বন্ধুর দিদিও টিচার | "


বৌদি আমার কথায় হেসে বলল, " যা মাইনে পাই, তাতে বাবিন টুকাইয়ের লেখা পড়া চালিয়ে ওদের খাইয়ে পরিয়ে বড়ো করে তুলতে অসুবিধা হবে না আমার | তবে কি জানো আদৃতা , জীবনের সব অঙ্ক টাকার অঙ্ক দিয়ে মেলানো যায় না | তোমার দাদা একটু ভালোবাসার কাঙাল, অর্থে - সামর্থে ও একটু দুর্বল তো, তাই বোধহয় ওর ভালোবাসার কোনো দাম নেই, আর ওকে ভালোবাসার জন্যও কারোর হাতে সময় নেই | তবে, আমি যে দুর্বলের হাত ছাড়তে পারি না গো | তোমার দাদাকে যে আমি বড্ড ভালোবাসি| ও বেঁচে আছে, ভালো আছে বলেই তো আমি এত ভালো আছি | তাই, নিজের জন্য এটুকু তো করাই যায়, বলো?? "


আমি হেসে বললাম, " আজ একজন গৃহবধূর রোজনামচা দেখলাম বৌদি | "


বৌদি কাব্যিক ভঙ্গিতে বলল, " পৃথিবীর সব গৃহবধূর মধ্যে যে "বধূ " লুকিয়ে আছে গো | তাই তুমি যতক্ষণ কাউকে ভালোবেসে তাঁর বউয়ের পদটা গ্রহণ করে আছো, ততক্ষন তোমার বছরের সাতদিনের চব্বিশ ঘন্টার এই কাজটা পাকা | বাকি, বাইরে কাজে বেরোলে সেটা তোমার নিজের যেচে নেওয়া চাপ !! "


আমি শুধু একটা প্রশ্ন করলাম, " তোমার বাপের বাড়ির অবস্থা কেমন বৌদি?? "


বৌদি হেসে বলল, " আমার বাড়িতে অর্থবলের অভাব নেই, অভাব আছে লোকবলের | তাই বয়স্ক বিপত্নীক বাবার জন্য আমাকে এদের ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করতে হয় | "


আমাদের এই বাক্যালাপের মাঝেই আমাদের শাশুড়িমায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, " কি গো মেধা, সকালে বললে যে, রাত্রে মোগলাই পরোটা বানাবে | তো তার ব্যবস্থা কিছু করলে?? "


বৌদি আমার ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, " এই যাই মা| বাবিন, অঙ্ক বই আর খাতাটা নিয়ে ডাইনিংয়ে আমার পাশে বোস| যে অঙ্ক গুলি বুঝবি না, আমি সব্জি কাটতে কাটতে দেখিয়ে দেবো | টুকাই সোনা, তুমি আমার কাছে এসো তো ... আমরা একটু মুখে মুখে ভাওয়াল ওয়ার্ড গুলি বলি | "


আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে বৌদিকে দেখে ভাবি, "এই কারণেই তথাগতর বাড়ির প্রতি টান নেই | "


শ্বশুর বাড়ির এডভেঞ্চার ফিলিংস নেওয়া শেষ আমার | কারণ, এখানে আরও কিছুদিন থেকে বৌদির উপরে হওয়া এই অত্যাচার আমি বোবা দর্শকের মতো দেখতে পারবো না| প্রতিবাদ তো করতে পারবো না, কারণ বৌদি তো স্বামীর মন ভালো রাখতে এই সংসার রঙ্গমঞ্চের কাঠপুতলি নিজেই হয়ে বসে আছে | দুদিনের জন্য এসে বৌদির মিথ্যে সাজানো সংসারকে নাই বা ভেঙে দিলাম !! এমন গৃহবধূ কথা তো প্রত্যেক ঘরে ঘরে হয়, প্রত্যেক ঘরের সুমেধারা হাসি মুখে ধিকি ধিকি করে এইভাবেই রোজ মরে!! এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি নেই সুমেধাদের, যতক্ষণ তাঁরা নিজেরা না প্রতিবাদী হয়ে উঠছে | তাই আমি কালই চলে যাব এই বন্য পরিবার থেকে | ফিরবো সেদিন, যেদিন এই ঘুণ ধরা সমাজের বুকে গর্জে উঠবেন আমার সুমেধা বৌদি | নাহলে তথাগতর মতো হয়ে থাকাই ভালো | 




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy