SABYASACHI BHATTACHARYA

Tragedy Classics Inspirational

5.0  

SABYASACHI BHATTACHARYA

Tragedy Classics Inspirational

অর্ঘ্য

অর্ঘ্য

7 mins
654


'মিতু ওঠ মা কত বেলা হয়ে গেল- যেতে হবে তো আমাদের? রোজ এই এক কাজ হয়েছে ।এত বড় হয়ে গেল এখনও ঘুম থেকে না ডেকে দিলে মেয়ে উঠবে না'।তবু এই ডেকে দেওয়ার মধ্যেও কোথাও যেন একটা সুখ লুকিয়ে আছে। সে তো এরমটাই চেয়েছিল এই ২২ বছর ধরে । সন্তানের প্রতি সমস্ত স্নেহ উজাড় করে এই মাতৃত্বের সুখটুকুই তো সে চেয়েছিল। এতদিনে বোধহয় ভগবান তার মনের ইচ্ছে পূর্ণ করছেন। এই ২২ বছরে একটু একটু করে মিতু যেন তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল । প্রথম যখন মিতুর মুখে মা ডাক শুনেছিল সেই দিনটা আজও মনে আছে তিথির। মনে হয়েছিল এর থেকে বেশি আনন্দ বোধহয় আর কিছু নেই, নিজেকে এই পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ মনে হয়েছিল তার ।কিন্তু আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগল সব । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগল মিতু। কিন্তু এর জন্য তো শুধু তাকে দায়ী করা যায় না। মিতুর জায়গায় অন্য যে কেও থাকলে সেও হয়ত একই আচরণ করত।

 পার্থ তিথিকে অনেক বুঝিয়েছে, সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু সময় যেন তার করাল গ্রাসে মিতুকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে তিথির থেকে।এক না শেষ হওয়া দূরত্ব ,এক অজানা গণ্ডি যেন একটু একটু করে তিথিকে আরও একা করে দিয়েছে, মা হয়েও এক অপূর্ণ মাতৃত্ব যেন একটু একটু করে তাকে ঠেলে দিয়েছে একাকিত্ত্বের গভীর খাদে। আর পাঁচজনের মার মত তো সে নয়, আর পাঁচজনের স্ত্রীর মত সে নয়, সমাজের আর পাঁচজনের মত হেসে খেলে বেড়ানো জীবন তার নয় । তবু ইশ্বর যার সবকিছু কেঁড়ে নেন তাকে বোধহয় বাঁচার একটা শেষ অবলম্বন দিয়ে রাখেন । তিথির জীবনের সেই অবলম্বন পার্থ ।পার্থ না থাকলে হয়ত জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকতো তিথি , হয়ত বা বাঁচতই না। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা তো সে করেছে, কিন্তু পার্থ শিখিয়েছে তাকে নতুন করে বাঁচা ,সমস্ত অসম্মান ভুলে এক নতুন উদ্দমে জীবন কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। শুধু সে নয় তার মত আরো অনেক তিথি কে বাঁচার নতুন মানে বুঝিয়েছে পার্থ । তবু কোথাও একটা সঙ্কোচ , একটা দ্বিধা থেকেই গেছে ,অনেক চেষ্টা করেও তা থেকে বেরোতে পারেনি তিথি, আয়নায় নিজের মুখ দেখলে এখনও বীভৎসতায় শিউরে ওঠে সে, ঘৃণা লজ্জায় কতবার সে ভেঙ্গে ফেলেছে আয়নার কাঁচ , ধিক্কৃত করেছে নিজেকেই। সে তো আর পাঁচজনের মতই এক সুস্থ স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিল, কিন্তু সব ওলট পালট করে দিল ওই শয়তানটা ।যেদিন প্রথম ২২ বছরের তিথির হাত ধরে রাস্তার মোড়ে টেনেছিল ওই শ্যামল ,সেদিন আত্মসম্মানে দৃপ্ত তিথি সজোরে একটা চড় মেরেছিল তার গালে ,ভেবেছিল আর এই ভুল করার সাহস তার হবে না ।কিন্তু সেই চড়ের মূল্য যে এভাবে তিথিকে দিতে হবে তা সে ভাবেনি। সেদিনও বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল সে কলেজ যাবে বলে , হঠাৎ পাশ দিয়ে এক চলন্ত মোটরবাইক থেকে গরম কি যেন এসে পড়ল তার মুখে, যন্ত্রণা জ্বালায় ছটফট করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেল তিথি। যখন জ্ঞান ফিরল তখন বুঝল তার জীবনটাই পালটে গেছে ।নার্সিংহোম, মিডিয়া, পুলিশ স্টেশন এসবের মধ্যেই তিথির পরিচয় হয়ে উঠল এক - Acid Attack victim। কারোর দয়া ,কারোর ঘৃণা, কারোর বিদ্রুপ - শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে উঠেছিল তিথির জীবন ।মা বাবা পাশে থাকা সত্ত্বেও নিজের এই জীবন তার কাছে সর্পবিষের দংশনের মত অসহ্য হয়ে উঠল, নিজের মুখের দিকে তাকালে তীব্র ঘৃণায় ভরে উঠত তার মন ,যখন বাঁচার সমস্ত ইচ্ছে হারিয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে, সেই সময় পরিচয় পার্থর সাথে। পার্থর একটি NGO আছে যেখানে তিথির মত আরও অনেক তিথি, শিল্পা, আয়ুশি বাঁচার এক নতুন স্বপ্ন দেখে। পার্থর সাথে পরিচয় যেন একটু একটু করে বদলে দিল তিথির জীবন , সে বুঝল তার রূপটুকু নষ্ট হয়েছে মাত্র , তার জীবন নয়। তারপর যখন পার্থ তাকে বলল তার সাথে পথ চলার কথা, তিথি খুঁজে পেয়েছিল বাঁচার এক নতুন স্বপ্ন । সেই তাদের পথ চলার শুধু । পার্থর ভালোবাসা যেন একটু একটু করে আরও সমৃদ্ধ করে তুলল তিথিকে ।দুজনে মিলে একটা ছোট্ট ক্যাফে খুলল । নাম দিল -"The Fighters". যেখানে Acid Attack victim রা নিজেদের এক নতুন স্বপ্নের সন্ধান পাবে। তারা যে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা নয় এই ভাবনাটাই যেন তাদের বাঁচার এক নতুন সঞ্জীবনী। সেই দিনটা আজও ভোলেনি তিথি। সেদিন প্রথম পার্থর চোখে জল দেখেছিল সে। সে আনন্দ অশ্রু ভেজা চোখ গুলো দেখে তিথির মনে হয়েছিল পার্থ নাম হলেও আসলে সে তিথি র মত সমাজের অনেক তিথির পার্থসারথি , জীবনকে এক নতুন পথের দিশা দেখানো কোনও দেবদূত যেন । তারপর মিতু এল তাদের জীবনে , পার্থর ভালবাসায় যে তার রূপের বীভৎসতা সে ভুলে গেছিল ,মিতু কে পেয়ে মনে হল মাতৃত্বের এই স্পর্শ যেন এক নতুন বসন্তের ছোঁওয়া দিয়ে গেল তার জীবনে- সেই জীবন যাকে একদিন সে অভিশাপ মনে করেছিল ,আজকে তার মনে হল এর থেকে আশীর্বাদ হয়ত আর কিছুই নেই।


কিন্তু একটু একটু করে সব যেন বদলে গেল। তিথি চাইতো বাকী মা দের মত মিতু কে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে , ছুটির দিনে মিতুকে নিয়ে পার্কে যেতে ,মোড়ের মাথায় আইসক্রিম এর দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে খেতে ।কিন্তু মিতু তা চাইত না । আস্তে আস্তে সে যেন নিজেকে আর দূরে সরিয়ে নিল তিথির থেকে । সময়ের সাথে সাথে মিতু আরও অজানা হয়ে উঠল তিথির কাছে । একদিন রাগের মাথায় মিতু বলল যে সে তার মায়ের এই রূপটা কে ঘেন্না করে , সে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় এই ঝলসে যাওয়া বিকৃত চেহারার মানুষটি তার মা । সেদিন যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ল তিথির মাথায় ,পার্থর ভালবাসায় যে অতীত কে সে পিছনে ফেলে এক নতুন বাঁচার সন্ধান পেয়েছিল ,সেই অতীতের গভীর অন্ধকার যেন আবার গ্রাস করল তাকে। মনে হল এক প্রবল ভুমিকম্পে কেঁপে উঠেছে তার সমস্ত শরীর ,বন্ধ ঘরে পার্থর বুকে মাথা রেখে সেদিন হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল তিথি। পার্থ শুধু বলেছিল একটু সময় দাও ।কিন্তু মন মানেনি তিথির , নিজের সন্তানের কাছে ঘৃণ্য হয়ে বেঁচে থাকার থেকে যন্ত্রণাদায়ক যে আর কিছু হয় না । আবার একটু একটু করে যেন তলিয়ে যেতে লাগল তিথি ।The Fighters এর কাজকর্ম থেকেও একটু একটু করে গুটিয়ে নিল নিজেকে । যে জীবনে এক নতুন সূর্যের সন্ধান পেয়েছিল সে সেই জীবনটাকেই আবার অন্ধকারে ঢাকা মনে হল তার ।সময় চলতে লাগলো এইভাবেই । মিতুর কলেজ জীবনের সঙ্গে সঙ্গেই তিথির জীবন হলে উঠলো আরো একাকীত্ব ঘেরা, যেন ঘরের কোণে পড়ে থাকা নিষ্প্রয়োজন কোনো পুরনো আসবাব।


সেই দিনটা ছিল কালীপূজো ।পার্থ NGO এর কাজে কলকাতার বাইরে । রাত্রি প্রায় ৯ টা । চারদিকে বাজির আওয়াজ । মিতু বন্ধুর বাড়ি থেকে এখনও ফেরেনি । যদিও তিথিকে কোনকিছুই বলার প্রয়োজন মনে করে না সে, তবু তিথি মা তো , মিতুর মোবাইল এ ফোন বেজে গেল, তিথি ভাবল একবার মোড়ের মাথায় গিয়ে দেখে আসবে । মোড়ের মাথায় ক্লাব তার কাছে গিয়ে এদিক ওদিক দেখছে সে, এমন সময় ক্লাব এর ভেতর থেকে একটা গোঙানির শব্দ । যদিও চারিদিকে বাজির আওয়াজে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না ,তবুও সেই অস্ফুট গোঙানির শব্দ যেন খুব চেনা মনে হল তিথির, ক্লাব এর দরজায় একটু ঠেলা মারতেই দরজাটা খুলে গেল, তারপর সে যা দেখল তাতে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল তিথির । নেকড়ের মত ঝাঁপিয়ে পরেছে ৩ জন তাদের মদ্যপ শরীরের সমস্ত খিদে নিয়ে তার আদরের মিতুর ওপর , আর মিতু তাদের সেই লালসার করাল গ্রাস থেকে বাঁচার প্রানপন চেষ্টা করে চলেছে । দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না তিথি, ক্লাব ঘরের দরজার সামনে পরে থাকা লোহার রড তা দিয়ে সজোরে মারল সেই নরখাদক দের মাথায়। একদিন যে হাত শ্যামল এর গালে চর মেরেছিল নির্ভয়ে ,আজ এত বছর পর সেই হাত আবার এই পশুগুলোকে আঘাত করতে একটুও কাঁপল না । আজ তার মেয়ের ওপর দৃষ্টি পড়েছে এই শয়তানগুলোর , মা হয়ে সে কেমন করে সহ্য করবে । আজ সে তিথি নয় ,আজ সে অ্যাসিড এ পুড়ে যাওয়া কোনও মুখ নয় ,আজ সে সমাজের প্রশ্নবানে জর্জরিত কোনও মেয়ে নয় ,আজ সে হতাশাগ্রস্ত বিবর্ণ জীবনের রূপ বহনকারী কোনও অনুকম্পার পাত্রি নয়, আজ সে মা, শুধুই মা। তাই চণ্ডীর মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে এই রক্তবীজদের রক্ত পান করতে। আজ যেন কোনও অজানা শক্তির বলে বলীয়ান সে, সমস্ত ভয়, লজ্জা ,ঘৃণা কে সরিয়ে সে আজ সত্যি রণরঙ্গিণী । মা কে এভাবে দেখে মিতুও হতবাক ।যে মায়ের বাইরের রুপের অসুন্দরতার জন্য প্রতি পদে দুঃখ দিয়েছে তাকে, সেই মায়ের জন্যই আজ এই চরম বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পেল সে । মা না থাকলে এই শয়তানগুলো- ভেবেই শিউরে ওঠে মিতু। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসায় ভরে ওঠে তার মন , আর নিজের প্রতি রাগে বিরক্তি তে বার বার মনে হতে থাকে যে সে এত গুলো বছর ধরে কত বড় অন্যায় করে এসেছে । মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে মিতু-এই ২২ বছরের সমস্ত কান্না আজ সে উজার করে দেবে মা কে।


'এই দেখ এখন উঠলি না- এরপর তো দেরি হয়ে যাবে মা । তুই তো নিজেই বললি আমার সাথে The Fighters এ যাবি । তোর বাবাও তো আজকে সন্ধ্যে বেলায় এসে পড়বে । ফিরে এসে বাড়ির কাজও আছে । উঠে পর মা ।' মিতু তিথির হাতটা ধরে বলল -' মা আজকে একটা কথা তোমায় বলতে চাই' । 'কি বলবি বল না? কিন্তু এখন বিছানা ছেড়ে ওঠ মা। তারপর সব কথা শুনবো' । 'না মা ,আমি এখুনি বলব তোমাকে ,আমি অনেকবার তোমাকে বাবার কাছে বলতে শুনেছি যে বাবা তোমার জীবনে দেবদূত । সেদিন আমি এর মানে বুঝিনি ,কিন্তু আজ আমি জানি মা দেবদূত মানে কি।তাই আজকে আমি তোমাকে বলতে চাই মা আমার জীবনে তুমিই আমার দেবদূত' ।


সামনের মন্দিরে ঘণ্টাটা বেজে উঠল , মায়ের আরতি শুরু হল যে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy