উপহার
উপহার


' তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে'- প্রার্থনা শেষে উপস্থিত সকলের হাতে একটি করে গোলাপ আর লজেন্স দিয়ে প্রত্যেককে ক্লাসে পাঠিয়ে দিল ঈশানী-আজ প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই এক রুটিনে চলছে সে। তিরিশ বছরের লম্বা পথ অতিক্রম করতে করতে কখন যে কর্পোরেটে চাকুরীরতা ঈশানীর চুলে পাক ধরেছে,চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা লেগেছে সেই হিসেব বোধহয় তার নিজের কাছেও নেই। চাকুরী থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়েছে প্রায় বছর ৫ হয়ে গেল,আসলে সব দিক সামলে চাকরী করাটা তার পক্ষে খানিক দু:সাধ্য হয়ে উঠছিল,বয়সটাও বাড়ছিল, তাই সব ভেবেচিন্তেই অবসরের সিদ্ধান্ত।তার ছোট্ট বাবুই টাও আজ অনেক বড় হয়ে গেছে,পুণের এক নামকরা কলেজে এম.বি.এ পাঠরত,তবুও ঈশানীর জীবনে কিন্তু অবসর নেই।তার দিনের প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে রয়ে আছে তার এই আশ্রম-'আনন্দময়ী আশ্রম' ও তার আবাসিক সমস্ত ছেলেমেয়েরা।৫ জন বস্তির দীন দরিদ্র শিশুকে নিয়ে তার বাবা যে পথ চলা শুরু করেছিল আজ তাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে ঈশানী নিজের চেষ্টায় ও পরিশ্রমে।বীরভূম,বাঁকুড়া,পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অভাব ও দারিদ্রের সাথে লড়াই করা এই শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তোলার এই পথ সহজ ছিল না মোটেই-কোথাও মদ্যপ বাবার প্রতিরোধ, কোথাও শ্রমিক হিসেবে কাজ করা এই শিশুদের মালিকদের ষড়যন্ত্র,কোথাও আবার এদের নিজেদেরই অনিচ্ছা সব কিছুর বিরুদ্ধে লড়ে তাদের জীবনকে এক নতুন দিশা দেখানোর কাজে ঈশানী আজ অনেক্টাই সফল-আজ তার এই আশ্রমে ২০০ জন আবাসিক,নিরক্ষরতার অন্ধকার দূর করে জীবনকে এক নতুন পথে চালিত করেছে তারা-কেও পড়াশুনায় তুখোর,কেও ফুটবলে,কেও অপূর্ব গান গায়,কারোর হাতের কাজ অসাধারন,এখানে সুধা ফতিমা এক সাথে দূর্গাপুজোর ফল কাটে,মহিম রহিম এক সাথে ঈদের দিন কোলাকুলি করে-জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এ যেন কিছু সরল প্রাণের মহামিলন কেন্দ্র।তবু প্রচারের আলো থেকে নিজেকে সবসময় দূরে রেখেছে ঈশানী,তার বাবা বলত প্রচারের আলোর ঝলকানি এই সরল প্রাণ গুলো সহ্য করতে পারবে না,তাই বাবার ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে সমস্ত রকম প্রচার থেকে দূরে থেকেছে সে এতদিন।বাবা ছাড়াও আরেকজন না থাকলেও এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সে এগিয়ে জেতে পারত না-শুভ ঈশানীর স্বামী,প্রকৃত জীবন সঙ্গীর মত প্রতিটি ঘাত প্রতিঘাতে পাশে থেকেছে তার,হয়ত আশ্রমের কাজের জন্য অনেক সময় ঘরকে সময় দিতে পারেনি ঈশানী ,শুভ সব মেনে নিয়েছে হাসিমুখে-কারন সে জানে যে কিছু কিছু মানুষ নিজেদের বাইরে বৃহত্তর সমাজের জন্য বাঁচে,ঈশানী তেমনই একজন। তাই আর্থিক,মানসিক যে কোন প্রয়োজনে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সে এক প্রকৃত বন্ধুর মত এই বন্ধুর পথকে অতিক্রম করতে। তবে এই ভালবাসা,আত্ম্যত্যাগ এর বিনিময়ে কি ঈশানী কিছুই পায়নি?পেয়েছে-পেয়েছে স্নেহের বাঁধন,কারোর দিদি,কারোর মা,কারোর বড়মা হয়ে।তাই ছোট্ট মনোজ যখন চাকরী পেয়ে শাড়ী কিনে প্রণাম করে বলে-দিদি ছোটবেলায় জ্বর হলে যে কাপড় দিয়ে আমাকে জল পট্টি দিতে সেটার মূল্য এই সামান্য শাড়ির থেকে অনেক বেশি'।আবার যে স্নেহাকে খাইয়ে না দিলে ভাত মুখেই তুলতো না,বিয়ের সময় সে যখন বলে-'বড়মা মায়ের ঋণ কনকাঞ্জলি দিয়ে শোধ করা যায়,কিন্তু তোমার ঋণ কি দিয়ে শোধ করব'?-এই পাওয়া গুলোই তো তার জীবনের সবথেকে বড় উপহার যা বাহ্যিক যে কোন উপহারের থেকে অনেক দামী-তবু তাকে আজকে যেতে হচ্ছে উপহার নিতে-হ্যাঁ,এক নামি সংবাদ মাধ্যমের পক্ষ থেকে 'অনন্য সম্মান ' সম্মানে ভুষিত করা হচ্ছে তাকে-এ সব তার বাবুই এর কাজ।পুণে তে থাকতেই কোন এক বন্ধুর মাধ্যমে এই সংবাদ মাধ্যমের সাথে যোগাযোগ করে তার মায়ের এই কর্মকান্ড সম্পর্কে জানায় আর তারপরে এই পুরস্কার।যদিও প্রথমে একেবারেই রাজি ছিল না ঈশানী ,তবু বাবুই এর কথা ফেলতে পারে নি।শুভ গাড়ি নিয়ে চলে আসবে এখুনি, যাওয়ার আগে একবার বাচ্চাগুলোর সাথে দেখা করে যাই ভেবে ঈশানী ক্লাসে ঢুকল-দাঁড়িয়ে আছে সবাই লাইন দিয়ে ,প্রত্যেকের হাতে একটা করে গোলাপ তাদের প্রিয় বড়মার জন্য-'বড়মা তুমি তো প্রত্যেকদিন আমাদের গোলাপ দাও,আজ এই বিশেষ দিনে আমরা তোমার জন্য গোলাপ নিয়ে এসেছি,তুমি নেবে তো বড়মা?'-ঈশানীর দু চোখে তখন জলের ধারা,সবাই আবার বলে উঠল বড়মা-'তোমার জন্য একটা গান গাইতে চাই আমরা।আমরা যে প্রার্থনা সঙ্গীত রোজ গাই,তা সেই ঈশ্বরের জন্য যাকে আমরা চোখে দেখিনি,আজ আমরা সেই ঈশ্বরের জন্য গান গাইব যে প্রতিদিন আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর করার লক্ষ্যে নিজের সমস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছে-আমাদের ঈশ্বর,আমাদের বড়মা।
'চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে
জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে' ।-আজ যেন পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে এক ছোট্ট স্বর্গ-সেই স্বর্গে অমরাবতীর ঝর্ণার মত বয়ে চলেছে সেই দেবীর আনন্দাশ্রু-আর কোন সম্মানের দরকার নেই তার, জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার অসংখ্য সন্তান।