Mustafijur Rahman

Abstract Tragedy Others

3  

Mustafijur Rahman

Abstract Tragedy Others

অনুক্ত

অনুক্ত

7 mins
192


ডিগ্রীর সংখ্যা আমার অনেক হয়েছে , কিন্তু আজ আমার আপু নেই। আমরা একই কলেজে পড়তাম।বয়সে আমার বড় কিনা জানিনা,তবে আমার এক ইয়ার উপরে পড়ত । তাই আমি আপু বলতেই ভালবাসতাম ।

আমি নিশ্চিত এখন আপুর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি না করতেন না। বড় দেরি হয়ে গেছে।আমি আপুর নামটা পর্য্যন্ত জানিনা। শুধু তাকে দেখতাম,কখনো কথা বলার সাহস হয়নি। আমার পূর্ব পুরুষের জড়তা আমাকে বাধ্য করে থাকবে। কেন যে একটু নির্লজ্জ হলাম না!  

অমন একটানা পবিত্রতা আমি কারও মধ্যে দেখিনি। তাকে দেখলে শুধুই ভাল লাগত,কখনো আসক্তি জন্মাতো না । তাকে দেখলে শুধুই দেখতে ইচ্ছে করতো। চোখাচোখি হবার পূর্বেই চোখ সরিয়ে নিতাম । চারপাশে আমার বন্ধুরাও থাকত ; খুব সাবধানে-কৃপণ যেমন তার ধন আগলে রাখে-তেমনি আমি তাকে আগলে রাখতাম।

জীবনে বড় ভুল করেছি। খুবই একাকী লাগে । কোন কিছু ভাল লাগে না।কাজে ও মন বসে না । আমি জানি এটা ঠিক না,তারপরেও কথা থেকে যায়। ঐ মুখ ,ঐ হাসি যাতে আছে সজীব প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ; ঐ দুর্ভেদ্য বর্ম ভেদকারী চাহনি,পূর্ণিমার প্রাণঢালা জ্যোৎস্নাকে হার মানানো গায়ের রঙ—কীভাবে ভুলবো ?

দিন চলে যাচ্ছে-যাচ্ছে তো যাচ্ছেই ,কিন্তু আমার কাছে প্রতিটি মুহূর্ত একেকটি বছর মনে হচ্ছে । এক দুঃসহ যন্ত্রনা, না বলতে পারা কিছু কথা,অমীমাংসিত কিছু বিষয়—জীবনটা আমার বিষিয়ে তুলছে ।

অনেক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছিলাম । কিছুক্ষণ পর মোবাইলে একটা কল আসল । যা ধারণা করেছিলাম , তাই। নেহার কণ্ঠ,বড় মিষ্টি ওর গলা । লাইনটা কাটতে গিয়েও পারলাম না । রীতিমত ঘন শ্বাস নিচ্ছিল সে--মনে হচ্ছে শ্বাসরূদ্ধকর কিছু ঘটেছে । আমি আগেও খেয়াল করেছি আমার বেলায় ও এমন করে। পরে জানালো ওর ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে সাত বছর হলো । এবারের বিবাহ বার্ষিকীতে আমার দাওয়াত । জোরাজুরি করলো অনেক । মন চায়ছিল না,না করে দিলাম ।

হঠাৎ রেখে দিল নেহা । হয়তো দুঃখ পেয়েছে । পেলে পাক , আমি পাইনি? কই তখন কোথায় ছিল নেহা ? এখন কারো দরকার নেই আমার । আমি শুধু আপুকে চাই ,শুধুমাত্র সেই নির্ভেজাল আকাশের নীল রঙের দুর্জ্ঞেয় অথচ মনোমুগ্ধকর মহিমা ।


নেহা পিছু নিয়েছে অনেকদিন থেকে । মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে । আমি পাত্তা দিতাম না । সে গায়ে পড়া স্বভাবের,যেচে কথা বলত । কথা বলতেই হতো । ভেবেছিলাম ওর একটা প্রেম হলে বাঁচি , শেষমেষ ওর প্রেম হল না । ছাত্রী হিসাবে যথেষ্ট ভাল, অমার থেকেও বোধহয় । নেহার মনটা ভাল,সরল । ওর বাবার মতোই হয়েছে । তার বাবা আমাকে ব্যাক্তিগত ভাবে স্নেহ করেন ।

শেষে জেনারেল সার্জারীতে বিশেষজ্ঞ হলাম,নেহা কার্ডিওলজিতে এমডি করে চেম্বার হাঁকাচ্ছে । ভাবলাম নেহা এবার বোধহয় বিয়ে করবে। সত্যি কথা বলতে কী আমার কেন জানি কষ্ট হচ্ছিল ।

নেহা এখনও বিয়ে করেনি ।মাঝে অনেকদিন খোঁজখবর পাইনি। একদিন ওদের বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি ,পাশে নতুন একটা হাসপাতাল আছে--দুটো রোগীর পিত্ত থলি কাটতে হবে। ওর বাসা আমি আরেকদিন চিনেছিলাম—সেকথা পরে হবে । নেহা ওদের তিন তলার ছাদে কী করছিল, জানি না । একটা মিউজিক্যাল টোন কানে আসাতে ফিরে তাকালাম।গানটা পরিচিত মনে হল। ভাল করে খেয়াল করে বুঝলাম সেটা আমার প্রিয় গানগুলোর একটা । না তাকিয়ে পারলাম না । অত উপর থেকে আমাকে তার চিনতে পারার কথা নয়। প্রায় চিৎকার করে ডাকছিল আমাকে । পাঁচ মিনিটের ভেতর নেমে আসল সে , হাঁপাচ্ছে । চিরচেনা দীর্ঘশ্বাস ।

আমাকে টানাটানি করছিল ও। বাসার ভেতরে যাবার জন্য কী অনুরোধ! আমি যাইনি শত অনুরোধেও । শুধু এই ভেবে যে হয়তো নেহার বাবা মা চাননা তার এ কাতরতা । ও খুব বিস্মিত হয়েছিল সেদিন ।

তারপর থেকে প্রতিদিন রাত বারটার পরে একবার আর ভোর পাঁচটায় আরেকবার ফোন করে। আমি শতকরা ৯৯ টা কল কেটে দিই। তারপরও প্রতিদিনই সে ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।

ফোন কেটে দিইনা শুধু একদিন।বুধবার,কারণ সেদিন আপুর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। নেহা যতক্ষণ কথা বলে মনে হয় আপুই আমার সাথে কথা বলছে।হয়তো অনেক কথাই নেহাকে আপু মনে করে বলে বসি । আর সেই আশায় সে বুক বেঁধে পরবর্তী দিনগুলোতে ফোন কেটে দিলেও হাল ছাড়েনা ।

তার দুর্বলতা আমি টের পেয়েছি অনেক আগে থেকে। কিন্তু মন বড্ড একটা সাঁয় দেয় না । এদিকে বয়স চলে যাচ্ছে । কত পাত্রীর সন্ধান আসছে। মা দিন রাত আমাকে বলছেন, এবার একটা বিয়ে কর। আমার এদিকে খেয়াল নেই , নিজের মতো চলছি । অবশ্য বাবা বলেন,তার সময় হলে সে ঠিকই করবে । 

 

মায়ের পরেও আমার অভিমান অনেক। আমি তাঁর কাছে আপুর রূপের বর্ণনা করেছিলাম একবার।প্রথমত সহজ ভাবে নিলেও পরবর্তীতে বারবার বলাতে বিরক্ত হচ্ছিলেন । আমি মানি প্রত্যেক মা চান তাঁর সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক। এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলুক।কিন্তু আপু তো কোন বাড়তি চিন্তা নয়,তাকে বাদ দিলে তো আমার অস্তিত্ব হিসাবে আলাদা করে কিছু পাওয়া যায় না। সে মিশে আছে আমার চোখে,আমার ত্বকে।

তিনি আমাকে তিরস্কারও করেছিলেন।হ্যাঁ,হতে পারে সে সামান্য,মানুষ প্রাণি হিসাবে খুব সামান্য। কিন্তু তার কাজে,সৌন্দর্যে,মহিমায়---সে অনন্য,উজ্জ্বল ও দেদীপ্যমান ।আর যে মেয়ে কারও হৃদয় দখল করে জোনাকির মতো জ্বলতে থাকে,সে সাধারণ কেউ নয়। অন্তত আমার কাছে তার জায়গা ছিল অনেক উপরে । তাকে আমি পবিত্র ভাবে ভালবাসতাম, এখনও বাসি। একইভাবে,এতটুকু ভাটা পড়েনি আমার ভালবাসার নদীতে।

তবে এখন কেন আমার মায়ের এ অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি ? বিয়ে করার ক্ষেত্রে আমি তাঁর কোন কথা রাখতে পারবো না । আমার জীবন,ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেলেও আমি তাকে বুঝিয়ে দিতে চায়---আপুকে আমি কতটা ভালবাসি।


আপু বিন্দুমাত্র জানে না,কেউ তার জন্য এত ব্যাকুল ! তার অগোচরে কেউ তাকে পাগলের মতো ভালবাসে। তার অচেনা,অজানা এমনকি একদিনও কথা হয়নি এমন কেউ তার ছবি হৃদয়ে এঁকে এখনও কষ্ট পাচ্ছে । সে শুধু নারী নয়,তার থেকেও বেশি কিছু।

বাসার ছাদে বসে আপুর কথা মনে করার চেষ্টা করছিলাম।বৃষ্টির আশঙ্ক্ষা দেখা গেল। সরলাম না । যথাসময়ে বৃষ্টি নামল। ভীষণ ভাল লাগছিল। রিমঝিম শব্দ প্রকৃতই আমাকে ব্যথিত করছিল। ভিজে চুপসে গেলাম। চোখে ভেসে আসল আপুর চোখ,সে আমার বউ হলে নিশ্চয় বলতো,এই ভিজছো কেন ? ঠাণ্ডা লেগে যাবে !

আপু বললে আমি উঠে আসতাম। তবে তাকে রাগানোর জন্য বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলে একসময় সে আসত আমাকে হাত ধরে নিয়ে যেতে। তখন ঐ হাত যা আদেশ পালন করাতে দৃঢ় অথচ কোমল তা আমার হাত বন্দী হত। তারপর আমি তাকে জোর করেই ধরে রাখতাম। হয়তো বাধা দিত, আর দিলেই বা ! সে তো আমার,একান্তই আমার।

বৃষ্টি তখন প্রায় শেষ। আমাকে ডাকল ঠিকই ; আপু নয়, আমার মা। কিছুটা চমকে উঠেছিলাম।মায়ের বকবকানি শুরু হয়ে গেল,একেবারে ভাবুক হয়েছে।মন নেই কিছুতে একদম । অনিয়ম করে শরীর খারাপ করলে বুঝবে মজা।

আমি কথাটি বললাম না। চুপ করে একতরফা,কোণঠাসা বকুনি বেশ ভালই লাগছিল। অবস্থার গুরুত্ব বোঝা গেল পরে। আমার জ্বর চলে এল।সে কী জ্বর ! ১০৪-১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট।একটু ঘাবড়ে গেলাম।জ্বর ছাড়ে না।মনের জ্বরও সারে না।

নেহা খবর পেয়েছিল কিনা জানিনা । সেই রাতে তাকে বড় মনে পড়ছিল। সে বোধহয় আমাকেও ভাবছিল।বাবা আমাকে দেখে গেলেন।কিছু বন্ধু-বান্ধব দেখে গেল আমাকে। তারা বাবাকে আশ্বস্ত করে বলে গেছে ,বিলুর জ্বর আছে ঠিকই,কিন্তু তার আসল জ্বর তার মনে।

পরদির রাতে বাবা আমার ঘরে আসলেন।বাতিটা নিভানো ছিল। তিনি জ্বালালেন না।সন্তর্পনে কাছে এসে ডাকলেন,বিলু। আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম। তিনি আমাকে অনেক কথাই বললেন যেগুলো এককথায় প্রকাশ করলে এমন দাঁড়ায় আমার পছন্দের কেউ থাকলে তাকে যেন বিয়ে করি।বাবা চলে গেলেন।আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না।

ওষুধ ঠিকমত খেয়ে যাচ্ছিলাম। জ্বরের প্রকোপ কিছুটা কমলো।বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসতে মন চাইলো।মায়ের নিষেধ সত্বেও বের হলাম।গাড়িতে নয়,রিক্সায়।


রিক্সায় চলেছি একাকী।পথঘাট নির্জন।ভেতরে ভেতরে কেমন জানি হচ্ছিল।কি জানি মনে হল, রিক্সা ওয়ালাকে নেহাদের বাসার পথটা দেখিয়ে সেদিকে যেতে বললাম । অদূরে ‘ডেড উড’ পার্ক। আশেপাশে অনেকগুলো ফুলের দোকান।অনেক গাড়ি পার্কিং করা। ক্যাডিল্যাক ব্রাণ্ডের কারটা পরিচিত মনে হল।পাশেই নেহা একটা দোকান থেকে ফুল কিনছে। কালো রঙের কামিজ পরে আছে। ফর্সা মেয়েদের কালো কামিজে অন্য রকম সুন্দর দেখায়। আমি না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলাম। আমার রিক্সাওয়ালা কেন জানি রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলছে।সামনে থেকে একটা গাড়ি জোরে একটা হর্ণ দিল। নেহা একরাশ বিরক্তি নিয়ে এদিকে তাকালো। রিক্সাওয়ালা ততক্ষণে থামিয়ে গাড়িকে যায়গা করে দিচ্ছে। নেহা চেহারার বিরক্তিটুকু মুছে কয়েকবার ডাকল আমাকে। রিক্সা থামালাম।

নেহা ছুটে আসল।জানালো দরকার আমাকে।ড্রাইভারকে ফুল দিয়ে বাসায় রেখে আসতে বলল। আজ বুধবার না হলে আমি অপেক্ষা করতাম না।

পার্কের ভেতরে গেলাম। এটার নাম ‘ডেড উড’ কারণ এখানে কোন গাছের পাতা নেই। কৃত্রিমভাবে পাতা ছেঁটে ফেলা হয়,দেখে মনে হয় সব গাছ মরা। নেহা যা বলতে চাচ্ছে তা দশ বছর আগে আমি কাউকে বলতে চেয়েছিলাম। সে আমার হাতটা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে ,যাতে তার অজান্তে পালাতে না পারি। সে আমাকে ভালভাবেই চেনে এজন্য হারানোর ভয়টাও বেশি।

জ্বর হয়ে শরীর বেশ ক্লান্ত ছিল।হাতটা ছাড়াতে গিয়েও পারলাম না। নেহা উত্তরের অপেক্ষা না করে টানতে টানতে রিক্সা ডাকল।তার সাথে পাশাপাশি কখনো বসিনি। বুধবার দেখে না করলাম না। তার কথামতো রিক্সা কাজী অফিসের সামনে থামলো।নেহা বললো,দেখ বিলু,যা বলব তাতেই সাঁয় দিবে।না হলে আমি তোমাকে বাসায় ফিরতে দিব না।

সহসাই আপুর স্মৃতি ভেসে আসল। আমি যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিলাম। শুধুমাত্র এবং কেবলই বুধবার বলে তাকে না করতে পারিনি।


কাজী অফিস থেকে যখন বের হলাম,তখন নেহার ওড়নাটা তার মাথায় ভালভাবে বিন্যস্ত।তার কোমল,ফর্সা হাত দু’টো আমার হাতকে কেবলই আঁড়াল করতে চাচ্ছে।

রিক্সা নেহার বাসার সামনে থামলো।ভেতরে সুন্দর করে সাজানো।মনে হয় কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। জানতে পারলাম তার ভাইয়ের বিবাহ বার্ষিকী আজ।

সবার সাথে পরিচয় হল।সাজগোজ সেরে তার ভাবীর আসতে দেরি হল।তার ভাইয়ের ছেলেটা ছুটাছুটি করছে।

একটু পর তার ভাবী সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছে। কপালে টিপ আছে ছোট একটা। সবুজ রঙের শাড়িতে মারাত্মক লাগছে। আরেকবার কলেজ জীবনে ফিরে যেতে হল। আমার স্বপ্নের দেবীটা এখনও তেমনি আছে। একটু মোটা হয়েছে বোধহয়।

আমি আপুর দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতে পারিনি। নেহাকে প্রথমবারের মতো আগে ডাকলাম।পাশে এসে বসলো সে। ওর হাতটা আলতো করে ধরেছিলাম।

মনের কথাগুলো কাউকে বলতে পারিনি কোনদিন। নেহাও জানবে না কখনো।

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract