জ্যোৎস্নাকুমারী
জ্যোৎস্নাকুমারী
মাঝরাতে জানালার সার্সিতে সজোরে শব্দ হলো । এমন শব্দ যাতে ঘুম ভেঙে যায় । কিন্তু অবাক হইনা আমি । কারণ এরকম শব্দ আগেও শুনেছি ।
ঘুম ভেঙে গেল । আড়ামোড়া ভাঙছি । বাইরে কোন বাতাস নেই । কোন প্রকার ঝড়ও নেই । না উঠেই তাকালাম । বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার । অন্ধকার হবারই কথা । আমি দিন তারিখ সব সময় হিসেব করে রাখি , রাখতে হয় ।
চাঁদের প্রথম পনের দিন ভাল থাকি, মানে একটু হলেও আরামে থাকি---বিছানা ছাড়তে হয় না । দ্বিতীয় পনের দিন দুঃসহ কাটে প্রতিটা রাত । পূর্ণিমার রাত থেকে শুরু করে পরপর আমাকে তাড়া করে ।
জানালা খুলে যাওয়াটা প্রতিদিনের রুটিন বলা যায় । ঘটনাটার উৎপত্তি বেশ আগে । সাত বছর আগে, স্পষ্ট মনে আছে প্রতিটা মুহূর্ত । কিছু কিছু ঘটনা, শুধু ঘটনা বললে ভুল হবে----ঘটনাবহুল স্মৃতি মানুষ কখনো ভোলে না । গরমের মৌসুম । এপ্রিল মাসের কথা । সন্ধ্যার পরই আমি বাড়ি থেকে বের হলাম ।ছোটকাল থেকে আমার একটা অভ্যাস ছিল , বদাভ্যাস কিনা জানিনা, বনে বাদাড়ে ও নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো । ব্যাপারটা আমার পরিচিত মহল সবাই জানত ।
আমি অভ্যাসমতো বের হলাম । একটু একটু আলো ফুটেছে , চাঁদের আলো । প্রথমটায় জঙ্গলের দিকে ঢুকলাম । ঘন জঙ্গল । সারি সারি সুপারি গাছ । উত্তর দিক থেকে মুকুলের একরকম গন্ধ এল । নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছি । উপরের দিক থেকে আলো এসে পড়ছে ।ছায়া গাছের জন্য দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে ।
নদীর দিক থেকে শেয়ালের ডাক শোনা গেল । আমি এগিয়ে যাচ্ছি । জ্যোৎস্না গাঢ় হচ্ছে, স্পষ্ট হচ্ছে চারপাশ । বাঁশঝাড়ের জোনাকি জ্বলছে মিটিমিটি । অনেকটা আগুন জ্বলে ওঠা, নিভে যাওয়ার মতো । নদীর ধার ঘেষে হেঁটে যাচ্ছি । নদীতে জল এখন কম, জায়গায় জায়গায় শুকিয়ে গেছে ।
কোর্টে আজ হাজিরা দিয়ে এলাম । অনেক দিন ধরে শুনানি বন্ধ ছিল । আবার চালু হয়েছে । শুনেছি মেয়ের ভাই ও,সি হয়ে এসেছে হরিপুরে । সে চাঁপা পড়া ফাইল পত্র ঘেঁটে বের করছে প্রমাণাদি । আমার বাড়িতেও এসেছিল কয়েক দফা । বিভিন্ন কোণা থেকে প্রশ্ন করেছে । উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হতে পারেনি । না পারারই কথা । আমি সোজা করে উত্তর দিতে পারব না । কারণ নিশিকে আমি ভালবাসতাম, এখনো বাসি । ভালবাসার মানুষকে ছোট যে কোন স্তরের প্রেমিক মাত্রই করবে না ।
নিশির সাথে আমার একরকম ভাব- ভালবাসা হয়ে গেছিল । দিনে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, শহরে-নগরে । রাতে আমি একা, ঘুরে বেড়াই একা, খাই একা ।
সেই রাতের ঘটনায় ফিরে যাওয়া যাক । হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম । বসে পড়লাম এক ঝোপের ধারঘেঁষে । নদীর ওপাশে নৌকা ও ডিঙি বেঁধে রাখা আছে । চাঁদ ধীরে ধীরে নদীর জলে উঁকি দিচ্ছে । খলখল করে হাসির শব্দ ভেসে আসল , কাছেই কোথাও । জ্যোৎস্নার মাঝে তন্ময় হয়ে ছিলাম । এই সময় যে বা যারা হাসতে পারে সে বা তারা আমার পরিচিতা হবে না ।
দু’ জন এদিকে এগিয়ে আসছে গুটিগুটি পায়ে । কিছুদূর এসে তারা আড়াআড়ি নদী পার হবার চেষ্টা করছে, অবশ্য শুকানো জায়গা দিয়ে । মেয়েটি নানা কথা বলে যাচ্ছে । নিশিও এভাবে কথা বলে । শুকনো জায়গাটা আসলে পুরোপুরি শুকনো নয়, অল্প অল্প জল আছে । মেয়েটি কুমারী কিনা জানিনা, তবে সে নীলাভ শাড়িটা আলতো উঁচু করলো । আমার চোখ মিথ্যা দেখেনি । মেয়েটি নিশি ছিল । ভরাট জ্যোৎস্নায় তার ধবধবে ফর্সা পা……. এতটুকু চিনতে ভুল হয়নি আমার । ছেলেটি কে ? হয়তো কোন জেঠাত,খুড়তুতো দাদা । আবার কোন খলনায়কও হতে পারে । তবে অমন নিটোল কোমল পা পৃথিবীতে শুধু নিশিরই আছে, শুধু আমার নিশির আছে ।
পরের দিন আমার জীবনের দুঃসহ দিনগুলোর একটা । নিশির মা চলে আসলেন আমাদের বাড়িতে । ভদ্র হিন্দু পরিবার । মান – সম্মানের ভয় বেশি । সারারাত ধরে মেয়ের সন্ধান না পেয়ে ভোর বেলাতে আলু থালু বেশে আমার কাছে ছুটে এসেছেন । আমি বসতে বললাম, তাঁর মাথায় আসলে কোন হিতাহিত বিষয় ছিল না । তিনি আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন,নিশিকে বলো যা হবার হয়েছে, ও যেন ভোর থাকতেই বাড়ি চলে যায় ।
এক ব্যথিত মাকে আমি কি বা বলবো । আমি কিছুই বলতে পারিনি । আমি বলতে পারিনি নিশি আমার কাছে নেই , গতরাতে তাকে আমি নদীর ধারে কোন এক খুড়তুতো দাদার সাথে দেখেছিলাম।নিশি আমার সাথে যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে সেই যে বেরিয়েছে-----এটা ছিল তার সবচেয়ে বড় এবং শেষ মিথ্যা ।
তার মা চলে যেতেই আমি পাগলের মতো নদীর পাড়ে ছুটে গেলাম । সেই শুকনো জায়গাতে এখনো পায়ের ছাপ পড়ে আছে । শুধু দু’ একটি হাঁস ঠোঁট দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরার চেষ্টা করছে । আমি এগিয়ে গেলাম । ঘন ঝোপের মধ্যেই রাতের ঘটনা গুলো ঘটে । আমি প্রতিটি ঝোপ তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছি । বেশি খুঁজতে হলো না---- কাছাকাছি একটাতেই পাওয়া গেল নিশিকে । অসাড় হয়ে পড়ে আছে,পা দু’টো এখনো ধবধব করছে । সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত ।
তুলকালাম হয়ে গেল, নিশি হত্যা মামলা জোরে সোরে চলতে লাগল । তার দাদা তখন বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ধন্যা দিচ্ছে । তার মা আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, মেয়েটা তো ভালবেসে তোমাকে সবই দিয়েছিল, তাহলে মেরে ফেললে কেন ?
আমার কাছ কোন সদুত্তর ছিল না । আমি এতদিনে ফাঁসিতে ঝুলতাম, শুধু বেঁচে গেলাম বেধহয় দু’টি কারণে ----এক, বাবার পয়সা ; দুই, সত্যিটা জানার অপেক্ষায় ।
পরপর কয়েক রাত আমি নদীর পাড়ে গেলাম । তিন দিনের দিন এক দল লোক কে ওখান দিয়ে নদী পার হতে দেখলাম । আমি পিছু নিলাম ।
ওদের কথা বার্তাও শুনলাম । ওরা আসলে ডাকাত দল । ওদের মানবতা বলে কিছু নেই । সেই রাতে নিশিকে ওভাবে দেখে ওরা লোভ সামলাতে পারেনি । আর জেঠাত বা খুড়তুতো দাদাকে এক ধাওয়া দিতেই ও বেটা লেজ তুলে পালিয়ে যায় ।
ওদিকে আমি লজ্জায় হোক বা ঘৃণায় সেদিকে আর পা বাড়ায়নি । তাহলে হয়তো নিশির অন্তিম মুহূর্তে তার মুখে জলটুকু ঢেলে দিতে পারতাম ।
এখন জমজমাট জ্যোৎস্না । ঠিক মাঝরাতে জানালায় শব্দ হল । আমি জেগেই ছিলাম । আমাকে কে যেন টানে, চুম্বকের মতো টানে । আমি ছুটে যায় । ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে , নদীর পাড়ে ।
নদীতে ভরা জল । চাঁদের আলো চিকচিক করছে । একটু পরে নিশি আসে, সেই নীলাভ শাড়ি, দু’হাতে চুড়ি । কিছুক্ষণ পরে সে শাড়িটা অল্প উঁচু করে । তখনই অনিন্দ্য সুন্দর , অদ্বিতীয় পা দু’খানি সাদা দুধের মতো পবিত্র হয়ে ওঠে ।
০৭/০৭/২০০৭
শনিবার,রাজশাহী
