Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

4  

Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

অন্তরালে (পর্ব ৬)

অন্তরালে (পর্ব ৬)

13 mins
238


(সমাপ্তি থেকে যেখানে ভালোবাসার সূচনা)


এক সপ্তাহ পর :

-------------------------

শ্রদ্ধাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসে আদর্শ... এই এক সপ্তাহে শ্রদ্ধা আদর্শের সাথে একটা কথাও বলে নি... যতবারই আদর্শ শ্রদ্ধার কাছে গেছে, তীব্র অভিমানে শ্রদ্ধা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে... তার শুষ্ক চোখের আড়ালে সিক্ত অন্তর আদর্শ অনুভব করতে পারলেও শ্রদ্ধার শরীরের কথা ভেবে কোনো কথা সে বাড়ায় নি... শ্রেষ্ঠা শ্রদ্ধাকে খাটে বসাতেই নন্দিতা ঘরে ঢোকে...

নন্দিতা : তা বড় বৌমা, পনেরো দিন তো বেশ শুয়ে বসে শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালের সেবা খেয়ে এলে... আর কতদিন এইভাবে চলবে !!!

শ্রদ্ধা : (নিস্পৃহ গলায়) আপনি চিন্তা করবেন না... আমি খুব তাড়াতাড়িই...

আদর্শ : না শ্রদ্ধা... তুমি আমার কথার একদম অমান্য করবে না... আর কাম্মা First of All, শ্রদ্ধা যে শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল- ওকে ভর্তিও করেছিলাম আমি আর Bill Paid-ও করেছি আমি... কথাটা ওকে না বলে আমাকেই বলো না !!! নাকি নরম মাটিতে আঁচড় কাটতে খুব ভালো লাগে

নন্দিতা : বাবা !! বউ ঘরে আসতে না আসতেই ছেলের মুখে বুলি ফুটেছে দেখছি... অবশ্য Pedigree বলে তো কিছু থাকবেই আর আশ্রিতরাও নিজেদের রূপ দেখাবেই...

কথাটা ঠিক তপ্ত গুলির মতোই শ্রদ্ধার বুকে এসে বিঁধলো... শাড়ির আঁচল আঁকড়ে ধরে যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে যন্ত্রণাটা সহ্য করে নেবার চেষ্টা করে শ্রদ্ধা... কিন্তু, শ্রদ্ধার রাগ, অভিমানের আড়ালে যে আদর্শের কষ্ট, অপমানগুলোকে আপন করে নিয়েছে- সেটা আদর্শের চোখ এড়ায় না...

আদর্শ : সেক্ষেত্রেও কথাটা আমার ক্ষেত্রেই খাটে, শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে নয়... তবে হ্যাঁ, শ্রদ্ধা শুয়ে বসে থাকলে যে তোমার ঠিক কি অসুবিধাটা হয় সেটা যদিও আমি বুঝতে পারছি... কিন্তু, শ্রদ্ধা যে এখন কোনোরকম কাজ করবে না...

শ্রদ্ধা : কাম্মা... কথাটা আপনি আমাকে বলেছিলেন, উত্তরটা বরং আমিই দিই... আমি এখানে শুধু শুয়ে বসে থাকব না... কাম্মা...

শ্রদ্ধা যেন একটু ক্লান্তবোধ করে কথা বলতে, হাঁপিয়ে উঠে একটু জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে... আদর্শ বুঝতে পেরে ওর দিকে জল এগিয়ে দিতেই শ্রদ্ধা সেটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে,

শ্রদ্ধা : বাবিন, আমার তোর একটা Help লাগবে... আমার একজন Lawyer লাগবে...

আদর্শ চমকে শ্রদ্ধার দিকে তাকায়, সে তো শ্রদ্ধার সব অব্যক্ত কথা বোঝে... শ্রদ্ধা কি তাকে মুক্ত করতে চাইছে না কি !!! একদিন সে সত্যিই কাউকেই নিজের সাথে জড়াতে চায় নি, কিন্তু আজ তো সে শ্রদ্ধার কাছ থেকে মুক্তি চায় না !!! যদিও শ্রদ্ধাকে অদেয় তার কিছুই নেই... শ্রদ্ধা যদি চায়, সে শ্রদ্ধাকে দূর থেকেই ভালোবাসবে... তবে, এখন তার আর নিজেকে দেশের কাজে বলিপ্রদত্ত করতে আর কোনো পিছুটান থাকবে না... একদিক থেকে ভালোই হলো বরং... সে অনাথ ছিলই, এখন না হয় নিঃস্ব হয়ে গেল... ক্ষতি কি !! তার মতো ছেলের জন্য কেই বা অপেক্ষা করবে !!! বরং উপেক্ষাটাই তার চিরকালের প্রাপ্য... মাঝখানে একজনের জন্য নিয়ম একটু শিথিল হয়েছিল বটে, তবে তা নিতান্তই সাময়িক... কিছুক্ষণের জন্য... তাই সবার অজান্তেই দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধাকে চিরকালের জন্য মুক্ত করে যাবে সে...

সংস্কার : ক্কে... কেন !!! Lawyer কেন লাগবে !!!

শ্রদ্ধা : আমি তোর দাভাই-কে মুক্ত করে দিতে চাই... উনি হয়তো দয়া করার যোগ্য... তাই তো উনি আমাকে দয়া করে সেদিন বিয়ে করেছিলেন... কিন্তু....কিন্তু আমি... আমি তো সবসময় নাও নিতে পারি সেই... সেই দয়া... আর উনি বারবার... (আবার হাঁপিয়ে ওঠে শ্রদ্ধা, তাই ক্ষণিক থেমে) বারবার এই পিছুটান ছাড়িয়ে মুক্ত হতে চাইছেন... তাই তার একজন স্ত্রী হয়ে...

শ্রদ্ধা নিজের বুকটা চেপে একটু জোরে শ্বাস নেবার চেষ্টা করে... একটুতেই বড্ড ক্লান্তবোধ করছে সে... আদর্শ শ্রদ্ধার জেদ দেখে জোরে ঠক করে টেবিলে জলের গ্লাসটা নামিয়ে রাখে, কিছুটা জল ওদের জীবনের মতোই উত্তাল হয়ে টেবিলে ছলকে পড়ে যায়... আদর্শ নিজেকে সংযত এবং আড়াল করতে জানলার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকায়... আজও সেদিনের মতো পূর্ণিমা, জ্যোৎস্নাস্নাত রাতের অন্ধকার... কেবল আদর্শের জীবনের অভিমানিনী জোনাকি তার জীবনকে আঁধার করে সব ভালোবাসা আর শান্তি কেড়ে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দেবার জন্য উতলা হচ্ছে...

সংস্কার নিরুপায় হয়ে একবার দাভাই-এর দিকে, আর একবার শ্রদ্ধার দিকে তাকায়... আজ বড্ড অসহায় সে... সে জানে তার শান্ত দাভাই রেগে গেলে ঠিক কতটা রেগে যায়, আর এই মেয়েটাও হয়েছে ঠিক তেমনই অভিমানিনী... এই রাগ আর অভিমানের সম্বন্বয় যে সে কিভাবে সামাল দেবে, বুঝেই উঠতে পারছে না... তার উপর শ্রেষ্ঠা এখনও এইসব কথা জানে না... জানলে সে নিজেই না রেগে সংস্কারকে Divorce দিয়ে দেয়...

সংস্কার : (মনে মনে) হে রঘুবীর, রক্কে করো... আরে ধুরররর... এটা তো কাম্মার সিরিয়ালের Dialogue... আজ এইসব কিছু কাম্মার জন্য হচ্ছে... হে গোপাল, তুমি কিছু করো Please...

নন্দিতা : (মনে মনে) এই রে... ডোজটা কি কড়া হয়ে গিয়েছিল না কি !! এই মেয়ে যদি চলে যায়, আমার আরামের কি হবে !!! আর আমার সিরিয়াল !! হায় রে !!!

শ্রদ্ধা : আমি... আমি তেমন মেয়ে নই যে নিজের স্বামীকে বে... বেঁধে রাখতে পারি... যে মেয়ে নিজের বৌভাতের পরের দিন, নিজের মৃত্যুসজ্জায় নিজের স্বামীকে আটকে রাখতে পারে না... সে তো সত্যিই স্ত্রী হবার অযোগ্য... কিন্তু আমার নিজের লড়াইটা... এতদিন... এত... দিন... আমি একাই লড়ে... ছি... আবারও লড়ব...

আদর্শর আর শ্রদ্ধার এই কষ্টটা সহ্য করতে পারে না... চোখে ছাইচাপা আগুন জ্বেলে চাপা গলায় ধমক দিয়ে ওঠে,

আদর্শ : তুমি আমার কাছ থেকে মুক্তি চাও তো রাহী... আমি দিয়ে দেব... কিন্তু, এখন আমাকে দয়া করো... একটু চুপ করো... একটু চুপ করো তুমি, এইটুকু দয়া করো আমাকে... কষ্ট পাচ্ছো... কথা বলতে পারছ না... আর তখন থেকে...

হঠাৎই আদর্শ এত জোরে জানলাতে ঘুসি মারে যে বাড়ির সবাই আৎকে ওঠে... শ্রদ্ধা এতদিন আদর্শ রাগ সম্পর্কে শুধু শুনেইছিল, আজ তার বহর দেখে বেশ ভয়ই পেয়ে যায়....

নেপথ্যে :

এক মুঠো শিশির ভেজা শিউলি তুলে,

যদি পায়ের তলায় রেখে বলি,

'প্রিয়ে ভালোবাসি, দাও স্থান হৃদয়ে...'

যদি বলি,

'স্মরগরল খন্ডনাং, মম শিরসি খন্ডনাং,

বধুঁ দেহি পদপল্লব মুদারম'

তোমার পদতলে বিরহ দূর করো,

ভালোবাসবে কি আমায় !!

                                       (রচয়িতা : রাজ চ্যাটার্জি)

ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে সম্প্রীতি হাসিমুখে কথাগুলো বলতে বলতে ঘরে ঢোকে.... সংস্কার এবার একটু হাফ ছেড়ে বাঁচে... যাক, অন্ততঃ কেউ একজন তার পাশে থাকার জন্য এলো...

ঠাম্মি : এ কি শুনছি দাদুভাই-দিদিভাই !! তোমরা না কি ছাড়াছাড়ির কথা বলছো !!!

শ্রদ্ধা : ঠাম্মি, তুমি আগে বসো...

ঠাম্মি : সে নয় বসলুম... কিন্তু এই শরীরে এইসব কি কথা বলছো তুমি !!!

শ্রদ্ধা ঠাম্মির মুখের উপর কথা বলতে না পেরে মুখ নীচু করে চুপ করে থাকে, আদর্শ আবার জানলার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে নেয়... ঠাম্মি হঠাৎই সেই সুযোগে সম্প্রীতি আর সংস্কারকে চোখ টিপে কিছু একটা ইশারা করে...দু'জনে না বুঝে অবাক হয়ে ঠাম্মির দিকে হতভম্বের তাকিয়ে থাকে...

ঠাম্মি : শোন দিদিভাই, আমাদের পরিবারের একটা অভিশাপের কথা তোকে বলি...

নন্দিতা : অভিশাপ !! কোন অভিশাপ মা !! আমি তো কিছু জানি না...

ঠাম্মি : তুমি ভয় পেয়ো না... তোমার কথা আমি বলছি না...

নন্দিতা : মানে !!!

সংস্কার হাসি সংযম করতে না পেরে ফিক করে হেসে ফেলে, আর সম্প্রীতি কিছুটা ঘেন্নাতেই মায়ের থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নেয়...

শ্রদ্ধা : কোন অভিশাপ ঠাম্মি !!!

ঠাম্মি : বিয়ের এক বছরের মধ্যেই যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়... তাহলে স্বামীর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী...

শ্রদ্ধা : (আৎকে উঠে) কিইইই !!!

আদর্শ : (বিরক্ত হয়ে) কি ঠাম্মি !!! কেন ওকে ভয় পাইয়ে আটকে রাখতে চাইছো !!!

ঠাম্মি : এই ছোড়া, তুই চুপ কর... মেয়েটার এই শরীরে ওকে ভয় কেন দেখাতে যাব আমি !!! আর তুই সব জেনে বসে আছিস না কি !!!

শ্রদ্ধা : ঠাম... ঠাম্মি, তুমি ওর কথা ছাড়... তুমি আমাকে বলো... কি বললে তুমি !!

ঠাম্মি : হ্যাঁ রে মা !!! একটা কাগজ কি আর কোনো সম্পর্ক ভাঙতে-গড়তে পারে !!! তবে যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, স্বামীর তো...

শ্রদ্ধা : নাহহহ... নাহহহ... উনি তো এমনিতেই অধিকাংশ সময় ঘরে থাকেন না.... আমি... আমি এক বছর কাটিয়ে নেব ঠিক...

ঠাম্মি : সেই তো মা !!! তুমি যতই অভিমান করে থাকো মা, তুমি তো দাদুভাইকে নিজের সবটুকু উজার করেই ভালোবাসো তাই না !!!

শ্রদ্ধা : (বেশ জোরে) হ্যাঁআআআ... (তারপরেই জিভ কেটে) না... না... তেমন নয়...

ঠাম্মি : সত্যিই !!

সবার অলক্ষ্যেই আদর্শ সরু সরু চোখে একবার শ্রদ্ধার দিকে তাকিয়ে এত কষ্টের মধ্যেও মৃদু হেসে আবার মুখ ঘুরিয়ে নেয়...

শ্রদ্ধা : উনি আমাকে দয়া করে বিয়ে করে উদ্ধার করেছিলেন... কিন্তু আমি তো আর অ... অ... অকৃতজ্ঞ...

শ্রদ্ধার আবার কষ্ট শুরু হয়... আদর্শ আড় চোখে শ্রদ্ধার দিকে তাকিয়ে সম্প্রীতিকে ইশারা করে ওকে একটু জল খাওয়াতে... সম্প্রীতি শ্রদ্ধাকে জল খাইয়ে ঠাম্মিকে বলে,

সম্প্রীতি : ঠাম্মি, আমরা বরং এখন যাই... রাহীর একটু বিশ্রাম দরকার... আমি ওর খাবারটা নিয়ে আসি...

ঠাম্মি : হ্যাঁ চল দিদিভাই... আমিও এবার শোবো... আর নাতবউ, তুই যতোই সম্পর্কে আমার নাতবউ হোস না কেন, আমি তো তোকে সেই ছোট্ট থেকেই মেয়ের মতোই দেখি রাহী দিদিভাই... আর আদি দাদুভাই তো আমার প্রাণ... তাই আমার যেটুকু দায়িত্ব, সেইটুকুই আমি তোকে বলে দিলাম... এবার তুই দেখ, তুই কি করবি !!! আমি অবশ্য তোকে বাধা দিতে পারি না... এটা তোদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার... যাই হোক, আসি রে... তুই বিশ্রাম নে...

শ্রদ্ধা : ঠাম্মি, আমি গোপালকে ঘুম পাড়িয়ে আসি...

ঠাম্মি : গোপাল আজ তোমার ঘরেই আছে মা... তুমি তাকেই সামলাও...

শ্রদ্ধা লজ্জায় রাঙা হয়ে মুখ নামিয়ে নেয়... ঠাম্মিরা ঘর থেকে বেরতেই আদর্শ নন্দিতার মুখের উপর ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়... সংস্কার আর সম্প্রীতি ঠাম্মির নির্দেশে দরজায় গিয়ে কান পাতে...

শ্রদ্ধা : আপনি দরজা ওমনি করে বন্ধ করলেন কেন !!!

আদর্শ : (আঙুল নেড়ে ধমক দিয়ে) আর একটাও কথা বলবে না... চুপচাপ Dress change করে Rest নাও...

শ্রদ্ধা : আগে আপনি ঘরের বাইরে যান...

আদর্শ : আমি এখনো Legally তোমার Husband আছি...

শ্রদ্ধা : তো কি !!!

আদর্শ : তুমি একা একা Dress Change করতে পারবে !!!

শ্রদ্ধা আদর্শের কথাটা শুনে চমকে ওঠে... বলতে কি চাইছে লোকটা !!!

শ্রদ্ধা : আপনি দিদিভাইকে ডেকে দিন...

আদর্শ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে শ্রদ্ধার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে শ্রদ্ধার হাতের উপর হাত রাখে, কিন্তু শ্রদ্ধা নিজেই আদর্শের ঘুসি মারা হাতটা নিজের অঞ্জলিবদ্ধ করে হাতের কালশিটের উপর হাত বুলিয়ে দিতে থাকে... কয়েক ফোঁটা শিশিরের মুক্ত ঝরে পড়ে আদর্শের হাতের উপর... শ্রদ্ধা ফুঁপিয়ে ওঠে... টলটল করা দিঘিভরা জল চোখে আদর্শের দিকে তাকিয়ে বলে,

শ্রদ্ধা : কেন করলেন এমন !!! কেমন কালসিটে পড়ে গেল !! এত রাগ আপনার !!!

আদর্শ : তুমি তো চলে যাবে... আমার লাগল কি না লাগল, আমি মরলাম কি বাঁচলাম - এইসব নিয়ে এত ভাবছো কেন !!!

শ্রদ্ধা : জানি না... কিচ্ছু জানি না আমি...

আদর্শ : আমি শ্রী-কে ডেকে দিচ্ছি... তুমি Fresh হয়ে নাও..

শ্রদ্ধা : না থাক... আমিই Change করে নিচ্ছি... আপনি একটু Help করে দিন... কিন্তু চোখ বন্ধ করে... Please...

আদর্শ খিলখিলিয়ে না হেসে আর থাকতে পারে না....


নেপথ্যে (ক্রুর স্বরে) :

----------------------------

অশোক চক্র প্রাপ্ত RAW Officer স্বাত্ত্বিক ব্যানার্জি... সত্যিই কি সেদিনের ঘটনায় স্বাত্ত্বিক ব্যানার্জির গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে... সত্যিই কি গর্ভেই মৃত্যু ঘটেছে তার একমাত্র সন্তানের... যদি না ঘটে থাকে, তাহলে সে কোথায় !! কেন !!! কেন মেঘদূত ব্যানার্জিকে দেখে বারবার আমার মনে হয় স্বাত্ত্বিক ব্যানার্জি নবরূপে, নব পরিচয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে... এই মেঘদূত ব্যানার্জির সম্পর্কে খবর নাও... সব খবর নাও... কেন সে অনাথ !!! দিব্য ব্যানার্জির পরিবার কোথা থেকে তাকে পেয়েছে !!! আরো একটা কাজ... শ্রদ্ধা ব্যানার্জি... মেঘদূত ব্যানার্জির স্ত্রী, ওর ছোট্টবেলার ভালোবাসা... মেঘদূত ব্যানার্জির একমাত্র আপন, একমাত্র দুর্বলতা... যদি স্বাত্ত্বিক ব্যানার্জির সাথে মেঘদূত ব্যানার্জির কোনো যোগসূত্র থাকে, তাহলে মেঘদূত ব্যানার্জির সাথে আমার বহু পুরনো হিসেব মেটাতে হবে... মেঘদূত ব্যানার্জিকে ভাঙতে গেলে ওর ভালোবাসাকে তো মরতেই হবে... খোঁজ নাও ওর সম্পর্কে... পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর চাই আমার... তারপর সময় সুযোগ বুঝে... মরতে তো ওকে হবেই...

একটা ক্রুর হাসিতে অন্ধকার ঘরটা ভরে ওঠে....


জলজোছনা :

---------------------

সংকল্প : ভাবো... ভাবো ঠাম্মি... তুমি তো এক বছরের জন্য রাহীকে আটকেছো... তার মধ্যে সাড়ে চার মাস ইতিমধ্যেই পার হয়ে গেছে...

ঠাম্মি : (ধমক দিয়ে) চুপ কর হতভাগা... এই জন্য বউ-এর কাছে দিনরাত গালমন্দ খাস তুই... বেশ করে তোকে গালমন্দ করে... হ.. ত.. ভা.. গা..

শ্রেষ্ঠা : আমিও তোমার দলে আছি ঠাম্মি...

সংকল্প : এই ঠাম্মি... এত্তগুলো বকা কিন্তু আমি খাব না বলে দিলাম... খেলব না আমি... আমার বউকে তুলে কথা !!!

ঠাম্মি : শোন দাদা, কি নেই তার হিসেব করিস না কখনো... কি আছে, সেটায় মনোসংযোগ কর... আমাদের হাতে সাড়ে সাত মাস আছে... সামনে সরস্বতী পুজো আছে... বাঙালির বসন্তের দিন... ওইদিন এই দুটো পাগল আর পাগলীকে বাসন্তিক রঙে রাঙিয়ে দিতে হবে... আর সেদিন যদি ওরা দুটো একে অপরকে মনের কথা বলে দিতে পারে, ওই যাকে এখন কি বলিস !!

সম্প্রীতি : Propose ঠাম্মি... Propose...

ঠাম্মি : হ্যাঁ... ওটাই যদি করে ফেলে, তাহলে তো !!!

সংস্কার : দাভাই করবে Propose !!! (জোরে হেঁচকি তুলে) ওরে বাবা !!!

শ্রেষ্ঠা : অকম্মা একটা... ধ্যাত !!

ঠাম্মি : বাচ্চাদের দল, আমাদের হাতে কিন্তু সময় খুব কম... তাই কোনোরকম ঝগড়াতে সময় নষ্ট করা নয়... সময় কখনোই আমাদের মনের ব্যাথা-বেদনা ভুলতে সাহায্য করে না, সময় কখনোই মনের ক্ষত সারিয়ে দেয় না... সময় শুধু ভগ্ন হৃদয়ের সাথে হাসি মুখে বাঁচতে শেখার কৌশল শেখায় মাত্র... মনের ব্যাথা, মনের বেদনা, মনের ক্ষত যদি কেউ সারাতে পারে, যদি তার উপর কেউ প্রলেপ দিতে পারে- তা হলো 'ভালোবাসা'... নিঃস্বার্থ, শুদ্ধ ভালোবাসা... আদি আর রাহী কিন্তু ছোট্ট থেকে পরষ্পরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে... দু'জন দু'জনের জন্য মরতেও দু'বার ভাববে না... তাই, একটা কাগজের সই ওদের আলাদা করতে পারবে না... কখনোই নয়...

সম্প্রীতি : আমাদের শুধু ওদের ভালোবাসায় অনুঘটকের মতো কাজ করতে হবে... আমাদের 'মিশন সরস্বতী পুজো' সফল করতেই হবে... হাত মেলাও সবাই....

চার জোড়া হাত এক হয়... Fresh হয়ে বেরিয়ে এসে আদর্শ দেখে শ্রদ্ধা জানলার থেকে বাইরে দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে... হঠাৎই পিছন থেকে শ্রদ্ধার পিঠ ছুঁয়ে স্পর্শ করে আদর্শ... চমকে ওঠে শ্রদ্ধা... এই স্পর্শ তার অচেনা নয়, এই স্পর্শের উষ্ণতা সে আগেও পেয়েছে... আদর্শকে একান্তে পেয়ে নিজের অন্তরের ভাঙনটা আর আড়াল করতে পারে না শ্রদ্ধা... শ্রদ্ধা অন্তরের সব যন্ত্রণা, বেদনা চোখের জল হয়ে বয়ে যায়... আদর্শ ওর পাশে এসে দাঁড়ালেও জানলা থেকে বাইরের দিকে তাকিয়েই কান্নাভেজা গলায় বলে ওঠে শ্রদ্ধা...

শ্রদ্ধা : কিছু বলবে !!

আদর্শ : কি হয়েছে তোমার রাহী !!! তখন Divorce চাইলে কেন !! তুমি কি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও !!! দেখো, ঠাম্মি তখন তোমাকে যা বললো...

শ্রদ্ধা : সব মিথ্যে কথা, এটাই বলতে চাও তো !!!

আদর্শ : তুমি সব বুঝতে পেরেছিলে !!!

শ্রদ্ধা : না... কিন্তু মনে হলো, তুমি আমাকে এটাই বলতে চাও...আমি জানি, তুমি আমার থেকে মুক্তি চাও...

আদর্শ : (অভিমানের সুরে) বাহহহ !!! আমাকে দারুন চিনেছো তো তুমি !!!

শ্রদ্ধা : জানো আদি, ছোট্ট থেকে বড় হয়েছি এইটা জেনে যে, আমিই নাকি আমার মাকে খেয়েছি...

আদর্শ : রাহীইইইই !!!

আদর্শ শ্রদ্ধার কাঁধে হাত রাখলে শ্রদ্ধা বলে ওঠে,

শ্রদ্ধা : Please আদি, আজ আমাকে একটু বলতে দাও... মামী পান থেকে চুন খসলেই কথাটা বলতো আমাকে... কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গেল কথাটা... তুমি যখন আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এলে, যদিও খুব স্বাভাবিক পরিবেশে আমাদের বিয়েটা হয় নি... তাই আর পাঁচটা বিয়ের মতো এর সবকিছু স্বাভাবিক হবে না, সেটা সবার জানা কথাই ছিল... (চোখের জল মুছে একটু হেসে) তাও বৌভাতের দিন যখন তুমি আমাকে বই আর Form-টা দিলে, আমার মনে হয়েছিল- হয়তো আমাদের ভালোবাসা পাহাড়ী নদীর মতো উশৃঙ্খল বেপরোয়া নয়, কিছু গুরুগম্ভীর ধারার... ফল্গুনদীর মতো ভালোবাসার ধারা চোরা খরস্রোত...

শ্রদ্ধা বুকে হাত রেখে অল্প কাশতে শুরু করলে আদর্শের মুখে উদ্বেগের একটা কালো ছায়া পড়ে যায়... কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে শ্রদ্ধা বলে ওঠে,

শ্রদ্ধা : ফল্গুনদীর মতো ভালোবাসার ধারা চোরা খরস্রোতের মতো বয়ে যাবে আমাদের অন্তরে, যা বাইরে সবার সামনে কোনোদিনও প্রকাশ পাবে না... তার পরের দিনই তুমি চলে গেলে... কাম্মা বললো, আমি তোমাকে ধরে রাখতে পারি নি, আমার জন্যই তুমি...

আদর্শ : কিন্তু রাহী !!!

শ্রদ্ধা হাতের ইশারায় আদর্শকে থামতে অনুরোধ করে...

শ্রদ্ধা : আমার রাতগুলো তোমার অপেক্ষায় কাটতে লাগল... যে আমি কখনোই একা শুতেই পারতাম না, সেই আমি রাতের পর রাত শুধু তোমার ওই ক্ষণিকের স্মৃতি আঁকড়ে শুধু তোমার অপেক্ষায় থাকতাম... তারপর একদিন তুমি ফিরলে... সেই রাতে চাইলেই তুমি আমাকে নিজের করে পেতে পারতে, আমার গায়ের গন্ধ নিজের গায়ে মাখতে পারতে... তুমি নিজেও জানতে, সেই রাতে তোমাকে অদেয় হয়তো আমার কাছে কিছুই ছিল না... কিন্তু আমি বোধহয় তার যোগ্য ছিলাম না...

আদর্শ : নাহহ রাহী... তু...

শ্রদ্ধা : আমি তখন সেই কথাটা বুঝতে পারি নি, জানো তো... আমি বোকার মতো ভেবেছিলাম, তোমার কাছে হয়তো ভালোবাসার শুরু এবং শেষ মন আর মন... সে প্রেম শরীরী ভালোবাসা নিশ্চয়ই বোঝে, কিন্তু ভালোবাসার প্রতিক্ষাতে তার অনেক বেশি আস্থা... যে মূহুর্তে আমার গুলি লেগেছিল, তোমার ওই আকুল চোখের চাহনিটুকু আমার দুই চোখে ভরে জ্ঞান ফেরার পর আমি তোমাকে খুঁজেছিলাম... ভেবেছিলাম, হয়তো হাসপাতালেই তুমি কোনো কাজে ব্যস্ত আছো... কিন্তু, কাম্মা আমাকে আবার আমার অক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করে দিল- তোমার স্ত্রী হয়েও মৃত্যুসজ্জাতেও আমার অধিকার নেই তোমাকে আটকে রাখার... সেই মূহুর্ত থেকে না আমার নিজের উপর ঘেন্না ধরে গেছে...

                           রাহীইইইই

আদর্শ শ্রদ্ধার অসুস্থতা ভুলে তাকে জোরে টেনে নিজের বুকের উপর আঁকড়ে ধরে... শ্রদ্ধার মনে হয়, ক্রুদ্ধ আদর্শের সরু সরু আঙুলগুলো যেন ওর কাঁধে গেঁথে বসে যাচ্ছে... কিন্তু আজ যেন তাকে কথায় পেয়েছে... তাই যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে সে বলতেই থাকে,

শ্রদ্ধা : সেদিন মনে হয়েছিল, আমার জ্ঞানটা কেন ফিরল !!! সারাজীবনের মতো... (আদর্শের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে) মৃত্যুও আমাকে ঘেন্নাতে না ছুঁয়েই চলে গেল... আমি তোমার জীবনে আর কোনো...

আর বলতে পারে না সে, মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে কান্নাতে ভেঙ্গে পড়ে শ্রদ্ধা... আদর্শ ধীরে ধীরে শ্রদ্ধাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে দু'হাতে করে আঁকড়ে ধরে নেয়... ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

আদর্শ : থামো... থামো রাহী... মনখারাপ কাটিয়ে ওঠো Please... তোমার ভালোবাসায় কোনো খাত নেই... কোনোদিনও ছিল না... সব ভুল আমি করেছি, পারলে ক্ষমা করে দিও... আমার সব সুখে-দুখে আমি তোমাকেই... শুধু তোমাকেই পাশে চাই বিশ্বাস করো... আর ওই মিষ্টি মুখে চোখের জল শোভা পায় না, শুধু মিষ্টি হাসি আর কলকলানিটাই শোভা পায়... এই কষ্ট ভুলে আমার কাছে, আমার পাশে থাকতে পারবে সারাজীবনের জন্য... অপেক্ষা করতে পারবে আমার জন্য...

আদর্শের বুক থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় শ্রদ্ধা... মাটিতে বসে খাটে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে...

আদর্শ শ্রদ্ধার পাশে এসে বসে... শ্রদ্ধা ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলে,

শ্রদ্ধা : এই ঘরে শুধু তোমার খোলসটা পড়ে থাকে আদি, তোমার অন্তরটা নয়... আমি আর তোমার বুকের ওমে কোনো ভালোবাসা খুঁজতে যাব না... আমার সব অন্বেষণ সেদিন... ও... ওই... চোখ খোলার সা.. সাথে সাথেই... শষষ...

আদর্শ : (উদ্বেগের সাথে) রাহী !!! কি হলো তোমার !!! কষ্ট হচ্ছে !! কথা শোনো না একদম...

শ্রদ্ধা : আম... আমি ঠিক আছি... মাথাটা কেমন করে... করে গেল যেন...

আদর্শ : এত অভিমান তোমার !!!

শ্রদ্ধা : না... অভিমান করার মতো সম্পর্কের গভীরতা আমাদের মধ্যে নেই... গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলে অপেক্ষার গভীরতা নেই আমাদের... কথা দিলাম, শত কষ্টেও আর কোনোদিন মুখ ফুটে বলব না, 'একটু সময় পাশে থাকো, আদি... আজ আর যেও না'... জানি, তুমি থামবে না... কাজের ভিড়ের বোঝাতলে আমি অদৃশ্য হয়ে গেছি...


আদর্শের বুকে বা'দিকটা হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল, বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সে.... আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধার অভিমান আজ গগনচুম্বী, আজ সে কোনো কথাই শুনবে না... আর এত সহজে সেই অভিমানও মুছবে না !!! বুদ্ধিমান আদর্শ আর কোনো কথা না বলে শ্রদ্ধাকে একপ্রকার জোর করেই কোলে তুলে খাটে বসায়... তারপর শ্রদ্ধাকে ওষুধ দিয়ে শ্রদ্ধার কোলে নিজে শুয়ে পড়ে... সে জানে- শ্রদ্ধা যতই অভিমান করে থাকুক না কেন, আদর্শকে সরিয়ে দিতে পারবে না... আদর্শের ভাবনা মতোই আদর্শের মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধের প্রভাবে শ্রদ্ধা বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে... শ্রদ্ধাকে পরম যত্নে খাটে শুইয়ে শ্রদ্ধার সিক্ত চোখে অধর ছুঁইয়ে বলে, 'Sorry' ...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance