অনাদৃতা (পর্ব ৬)
অনাদৃতা (পর্ব ৬)
"শরৎ আকাশের পেঁজা তুলো, বসন্তের ঝরা পাতা,
মেঘ সরিয়ে রৌদ্র হাসে, এক সুরে দিন বাঁধা...
দমকা হাওয়া বইবে যখন, পাড় ভাঙবে ঢেউ,
সময় যেন গড়ে আবার, থেমে নেই তো কেউ"
(সংগৃহীত, দলছুটের কলম)
বিশ্বভারতী :
------------------
সবে তখন অঝোরধারায় বৃষ্টি থেমেছে... ধীরে ধীরে দিনের আলো মিলিয়ে মেঘাচ্ছন্ন গোধুলিও সবে নেমেছে... মৈথিলী তখনও তার অন্তরের সমস্ত ক্ষতের ক্লান্তি বিছিয়ে আদ্বানের সস্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ... আদ্বান তাকে পরম যত্নে আগলে রেখেছে, আগলে রেখেছে ঠিক রূপকথার মতো এই মূহুর্তটাকেও... বাইরে মেঘ আবার বৃষ্টিকে ডেকে আনে... দম বন্ধ হয়ে আসছে মৈথিলীর... হঠাৎই সে অনুভব করে সে আদ্বানের বাহুলগ্না... চমকে উঠে আদ্বানের বাঁধন ছিন্ন করে সে দূরে সরে আসে... তবুও আদ্বান একপ্রকার জোর করেই মৈথিলীর হাতটা শক্ত করে নিজের অঞ্জলিবদ্ধ করে... আজ মৈথিলীর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত... প্রবল বর্ষণে অন্তরের সংযমের একের পর এক পাড় ভাঙছে... কিন্তু কোথাও ভাঙার খেলা চললে, কোথাও তো গড়ার কাজও চলে... আজ আদ্বানের মনে তার এতদিনের সিন্দুকবন্দী আবেগের যেন এক আপসহীন লুকোচুরি খেলা চলছে, তার ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস যে মৈথিলীকে তার অন্তরের প্রগাঢ় শূন্যতার কথা বারংবার বলতে চাইছে... ঠিক যেমন খুব সন্তর্পনে আমরা পরম প্রিয় কিছুর মোড়ক খুলি, ভয় হয় পাছে খোলার সময় অসাবধনতাবশতঃ তা হারিয়ে না যায় পাহাড়ি পথের পাশে অতল খাদে... কিন্তু মৈথিলী যে আজ ক্লান্ত, বড্ড ক্লান্ত... বা বলা ভালো মানসিকভাবে বিধ্বস্ত... তাই দূর থেকে ভাবের আদানপ্রদান হলো শুধু, মনের কথা বলা হলো না... মৈথিলীর নত হয়ে থাকা সিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আদ্বান নরম স্বরে বলে,
আদ্বান : কখনো কখনো আমাদের তাকে ছেড়ে আসতে হয়, যাকে ছেড়ে আসার কথা আমরা কখনো চিন্তাই করি না... আবার কখনো কখনো তার হাতটা শক্ত করে ধরতে হয়, যার হাত ধরার কথা আমরা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারি না... নয়তো কাকতাড়ুয়া কখনো মেথি পাতার হাত ধরতো !!!
মৈথিলী মৃদু হেসে আলতো করে আদ্বানের হাতের মুষ্টির বাঁধন থেকে নিজের হাতটাকে ছাড়িয়ে নিতে চায়, কিন্তু আদ্বান তা উপলব্ধি করে মৈথিলীর হাত আরো শক্ত করে ধরে নিজের বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে... মৈথিলীর বিস্মিত দৃষ্টির বিনিময়ে মৈথিলীকে এক অন্তর্ভেদী তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়...
আদ্বান : আসলে বাস্তব খুব কষ্টকর হয়... আর তার চেয়েও কষ্টকর আর কঠিন হলো সেই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া... কিন্তু সামনে যদি কেউ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে বোধহয় জীবনের বন্ধুরতাগুলো একটু সহজে পেরনো যায়... একসাথে নিঃস্ব, রিক্ত হওয়া যায়... মৈথিলী, আমরা কি বন্ধুত্বের হাত ধরে সামনের বন্ধুরতাগুলো পার হতে পারি না !!!
মৈথিলী : পারতাম হয়তো... হাতে সময় থাকলে হয়তো নিশ্চয়ই পারতাম... কিন্তু আজ উপায় নেই... বিশ্বাস কর, আমি তোর বন্ধুত্বের হাত ধরে তোকে ঠকাতে পারব না... বাইরে বৃষ্টি ধরেছে, আমাদের যেতে হবে... আমাদের যেতে হবে আদ্বান...
মৈথিলীর হাটতে শুরু করলে আদ্বান সাইকেল নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ওর পেছনে আসে...
আদ্বান : এই মেথি পাতা... মেথি পাতা দাঁড়া বলছি... এই... দৌড় লাগাচ্ছিস কেন তুই !!!
মৈথিলী : আরে দেখ, সাতটা বাজে... আটটায় আমার হোস্টেল বন্ধ হয়... মানছি, এখান থেকে পনেরো মিনিট লাগে যেতে... কিন্তু কোথায় কি হয়ে আছে !!!
আদ্বান : শোন ঘুর্ণিঝড় এসেছিল হ্যাঁ... আমরা ওই পোড়োবাড়িটাতে পাক্কা তিনঘন্টা আটকে ছিলাম... এইসময় হোস্টেলে অত কড়াকড়ি করে না...
মৈথিলী : ওহহ !!! কাকতাড়ুয়া তো আবার Absolute Local, তুই সবইইইই জানবি... আমি তো আবার Relative Local কি না !!!
আদ্বান : এই... এইসব ভাট বকার সময় তোর সময় নষ্ট হয় না, তাই না !!! চুপচাপ আমার সাইকেলে ওঠ...
মৈথিলী : সাইকেলে !!! আমি যে কোনোদিনই সাইকেলে চাপি নি...
আদ্বান : তা চাপবে কেন !! বড় গাড়ি আছে নিশ্চয়ই...
মৈথিলী : না রে... আমার বাবা ছোট্ট একটা Scooter আছে... আমি তো ওটাতেই চেপে বড় হয়েছি... বড় গাড়ি কেনার মতো স্বাচ্ছন্দ্য নেই অতো আমাদের রে ... আমরা তো ওই ছোট্ট Scooter-এই খুশি...
আদ্বান একটা অদ্ভূত চোখে মৈথিলীর দিকে তাকিয়ে বলে,
আদ্বান : তুই খুব অল্পে সুখী হোস, বল !!!
মৈথিলী : হ্যাঁ... আমার একটু ভালোবাসা হলেই চলে...
সেদিন ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমা... হঠাৎই মেঘের চাদর সরিয়ে এক ফালি চাঁদের জ্যোৎসা এসে পড়লো ওদের দু'জনের উপর... মৈথিলী আদ্বানের হাতটা সরিয়ে ওর ওর সাইকেলের সামনে বসার চেষ্টা করে... প্রথমে মৈথিলী বসতে গিয়ে একটু টালমাটাল হলে আদ্বান হাত দিয়ে ওকে আগলে নেয়... তারপর মৈথিলীর বসে গেলে আদ্বান খুব আস্তে আস্তে সাইকেল চালাতে শুরু করে... কিন্তু কিছুদূর যেতেই হঠাৎই আদ্বানের সাইকেল কিছু একটার সাথে ধাক্কা খায়... আর দু'জনেই উল্টে পড়ে মাটিতে.... আসলে মৈথিলীর উপস্থিতি কেন না জানি আদ্বানকে বারংবার আনমনা করে দিচ্ছিল... কিন্তু পড়ে যাবার মূহুর্তে আদ্বান মৈথিলীকে নিজের হাত দিয়ে আগলে নেয়, আর মৈথিলী গিয়ে পড়ে আদ্বানের উপর... তবুও মৈথিলীর পায়ে রাস্তার কিছু একটা বিঁধে যায়... মূহুর্তের জন্য আর্তনাদ করে ওঠে মৈথিলী....
মৈথিলী : আহহহহ... মা গো...
আদ্বান : (উদ্বেগের সাথে) কি হলো !! মেথি পাতা !!!
মৈথিলী : কিছু না... কিছু না... তুই সাইকেলটা তোল...
আদ্বান সাইকেল তুলতে গিয়ে চাঁদের আলোতেও দেখে মৈথিলীর পা রক্তে ভিজে যাচ্ছে, তবুও তার ঠোঁটের কোণায় একটু চিলতে হাসি খেলে যাচ্ছে... সাইকেল দ্রুত সরিয়ে রেখে আদ্বান মৈথিলীর সামনে বসে...
আদ্বান : মৈথিলী !!! তোর পায়ে তো !!
মৈথিলী : কিছু হয় নি... কিছু হয় নি...
আদ্বান : কি কিছু হয় নি !!! পা তো রক্তে ভেসে যাচ্ছে... (ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে) পায়ে বোধহয় কিছু বিঁধে গেছে... দেখি...
মৈথিলী : (আৎকে একটু দূরে সরে গিয়ে) নাহহহ... না আদ্বান... লাগবে আমার...
আদ্বান : ওটা বিঁধে থাকলে আরো বেশি ক্ষতি হবে তোর... যা বিঁধে থাকলে ক্ষতি হয়, তা সমূলে উপড়ে ফেলাই ভালো... তা শরীরে হোক বা স্মৃতিতে...
'ঋক... ঋক... নাহহহ... নাহহহ... এক... একদম এগোবি না তুই... একদম এগোবি না তুই আমার দিকে... Please... Please save me... কেউ আছো !!! আমাকে এখান থেকে বের করো... Please.... দিব্যান্ত....
দিব্যান্ত !!! না সোনা... দিব্যান্ত এখন দিব্যার সাথে প্রেমের হোলি খেলছে... আর আমি এখন তোমার সাথে খেলব... আদরের....
খবরদার... এক... একদম এগোবি না... একদম ছুঁবি না আমাকে...
কেন রে !!! দিব্যান্ত এখনও চেখে দেখে নি তোকে !!
ছিঃ !!! ছিঃ ঋক !!!
ওহহহ... তাহলে আমিই ফিতে কাটব... দিব্যাকে বলতে হবে, ওর সব সন্দেহই মিথ্যে...
দিব্যা... দিব্যা তোকে এইসব করতে বলেছে !!!
নাহহহ... Exactly এইসব করতে বলে নি... বলেছে আমি যেন তোকে আদরে ভরিয়ে রাখি, যাতে তোর চোখ ওর দিব্যান্তর দিকে না যায়... তাই আমি ভাবলাম, তোর সাথে ফুলসজ্জাটাই...
ঠাসসস....
তোর এতবড় সাহস তুই আমার গালে চড় মারিস... ঋকের গালে... এবার তুই দেখ, আমি তোর কি অবস্থা করি... দিব্যান্ত কেন !!! কারুর ভালোবাসার যোগ্য থাকবি না তুই...
না... না... ঋক... ছেড়ে দে আমাকে... আহহহ.... ছেড়ে দে... ছেড়ে দে... আহহহ'
মৈথিলী : আহহহ...
আদ্বান : দেখুন মেথি পাতা... কত্ত বড় কাঁচে বিঁধেছিল পায়ে... এইটা পায়ে বিঁধে থাকলে কি হতো বল তো !!! দাঁড়া...
সিক্ত চোখে মৈথিলী আদ্বানকে দেখতে থাকে... আদ্বান ব্যাগ থেকে জল বার করে মৈথিলীর পায়ের রক্ত ধুয়ে দিতে থাকে... এরপর নিজের রুমাল বের করে মৈথিলীর পায়ে শক্ত করে বেঁধে দেয়...
মৈথিলী : সব স্মৃতি যদি এইভাবে উপড়ে ফেলা যেত, কত ভালো হতো বল, আদ্বান... এমন কত ক্ষত আছে, যা মানুষ কোনোদিন কাউকেই বলতে পারে না... শুধু মৃত্যুই পারে, সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে....
আদ্বান : (ধমকে) মৈথিলী, আজ প্রথমবার বলেছিস... বলেছিস... আর কোনোদিন তোর মৃত্যুর কথা মুখে আনবি না... বলে দিলাম...
মৈথিলী : তুইও সবটা জানলে আমাকে ঘেন্নাই করবি...
আদ্বান : তোর আজ কি হয়েছে, মেথি পাতা !!! কি সব বলে যাচ্ছিস !!! নে ওঠ... চল...
আদ্বান উঠে মৈথিলীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়... মৈথিলী আর আদ্বান উঠে দেখে সামনে একটা বড় গাছের ডাল পড়ে, যাতে ধাক্কা খেয়েই এই বিপত্তি...
আদ্বান : ওহহহ... ইনিই তাহলে যত নষ্টের গোড়া.... দেখ, আমাদের চিৎপটাং করে নিজে কি সুন্দর পড়ে আছে...
মৈথিলী : এবার আমরা কি করে যাব !!
আদ্বান : আপকে লিয়ে আদ্বান হে না !!!
আদ্বান প্রথমে মৈথিলীকে পার করে... তারপর সাইকেলটা একটু একটু করে পার করে... মৈথিলীও এগিয়ে এসে হাত লাগায়... পার হয়ে যাবার পর আদ্বান মনখারাপের সুরে বলে,
আদ্বান : তোর তো পায়ে ব্যাথা... কিন্তু আমি যেভাবে তোকে ফেললাম, তুই আর আমার সাইকেলে কোনোদিন চাপবি না, আমি জানি...
মৈথিলী : ওটা দুর্ঘটনা ছিল আদ্বান... আর দুর্ঘটনা Just ঘটে যায়... আমাদের কোনো হাত থাকে না তাতে... তাই...
মৈথিলী আবার আদ্বানের সাইকেলে চড়ে বসে... আরো একবার একফালি চাঁদের আলোয় মৈথিলীকে দেখে আদ্বান... তারপর সাইকেলে চড়ে বসে... দূরে কোথাও তখন বেজে ওঠে...
Baadal pe chalta hoon main
girta sambhalta hoon main
Khwaishein karta hoon main
khone se darta hoon main
Jaaga na soya hoon main
musafir khoya hoon main
Kuch sarfira sa hoon main
budhu zara sa hoon main
Baadal pe chalta hoon main...
Dil kya kare Dil kya kare
Tere bina... Itna bas mujhe bataa hai
I am in love, I am in love
Tu hi bataa jaane kya mujhe hua hai...
Ho aaj kal tanha main kahan hoon
saath chalta koi
Uski hame aadat hone ki aadat ho gayi
Woh jo mila hai jab se uski sauhbat ho gayi
Ik zara masoom se ke dil ki aafat ho gayi
Sun le zara, sun le zara
Dil ne kaha, itna byaas mujhe pata hai...
I am in Love, I am in Love
Tu hi bata, jaane kya mujhe hua hya...
'বন্ধু শব্দটির ব্যাপ্তি সমুদ্রের অধিক অনুপাতে,
আবহমান কাল ধরে বয়ে চলেছে স্নিগ্ধ ধারাপাতে...
জীবন মানেই অবচেতন মন ঘিরে স্বপ্নের ধারাভাষ্য,
দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলা, যদিও গন্তব্য অপ্রকাশ্য..'
বিশ্বভারতী :
-------------------
মৈথিলী আর আদ্বানের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে... নিখাদ বন্ধুত্ব... দু'জনে মিলে উপভোগ করে দু'জনের সান্নিধ্য... মন দিয়ে শোনে একে অপরের কথা... যদিও আদ্বানের কথা বলার থেকে মৈথিলীর কথা শোনার দিকে বেশি মন, কারন সে চায় মৈথিলী কথা বলে একটু হাল্কা হোক... আদ্বান মনের দিক থেকে হয়তো অনেকটাই মৈথিলীর কাছে চলে এসেছে... কিন্তু ও মৈথিলীকে সেটা বুঝতে দেয় না, কোনোদিন মুখ ফুটে নিজের মনের কথা বলারও চেষ্টা করে না... কিন্তু মনের মিল ও টান বোঝা যায় প্রতি মূহুর্তেই... আজ আদ্বান মৈথিলীর হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে... কাল সারারাত মৈথিলী ঘুমাতে পারে নি পায়ের যন্ত্রণাতে... আজ আদ্বান ওকে নিয়ে যাবে ডক্টরের কাছে... সবাই থাকায় মৈথিলী আজ আর আদ্বানের সাইকেলে চাপে নি... ব্যাথা পায়েই আস্তে আস্তে আদ্বানের পাশে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে....
আদ্বান : কি হয়েছে মৈথিলী তোর !! আজ এত চুপচাপ !!
মৈথিলী : আমাদের সম্পর্কটার নাম কি আদ্বান !!!
আদ্বান : প্রশ্নটা তুই করলি না আঁখি !!!
মৈথিলী : সমাজ আমাদের এই সম্পর্কটাকে কি নাম দেবে !!! যদিও আমার এই শেষবেলার সময়টাতে তোর সান্নিধ্য দেবার জন্য, আমি তোর কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব !!!
আদ্বান : শেষবেলা !!! আবার !!! মৈথিলী, তোকে মাঝে মাঝেই খুব অচেনা লাগে... কিছুটা তো একটা আছে, যেটা তুই আমাকে এখনো বলিস নি... মৈথিলী !!!
আদ্বান বোঝে, মৈথিলী উথলে আসা কান্নাটা গলার্ধকরনের আপ্রাণ চেষ্টা করছে... তাই কিছু না বলে নিজের হাতটা আলতো করে একবার ছুঁয়ে যায় মৈথিলীর হাতে... এরকম করেই চলে ওদের বন্ধুত্ব, ওদের অপ্রকাশিত ভালোবাসা... বেলাশেষে ভালোবেসে ওদের একসাথে থাকার গল্প....
হসপিটাল :
-----------------
আদ্বান : তুই এখানে বোস... আমি ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থাটা করে আসছি...
মৈথিলী : আচ্ছা...
আদ্বান চলে যাবার পর মৈথিলীর শরীরের অস্বস্তি বাড়তে থাকে... কাল পড়ে যাবার পর থেকেই পেটে যন্ত্রণাটা শুরু হয়েছিল... Pain Killer, আর Sedative খেয়ে একটু কমেছিল... এখন আবার পেটের যন্ত্রণাটা বাড়তে থাকে... ধীরে ধীরে তা অসহ্য হয়ে উঠতে থাকে.... মৈথিলী এবার কি বলবে আদ্বানকে !!! কি বলবে এই যন্ত্রণার পেছনের ইতিহাস !!! কিন্তু যন্ত্রণাটা খুব বাড়ছে... শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর... চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে... হঠাৎই এক পরিচিত বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন ওকে আগলে ধরে...
আদ্বান : মৈথিলী !!! কি হয়েছে তোর !!!
মৈথিলী : ব্যা... ব্যাথাআআআ... খু... খুব যন্ত্রণা করছে পেটে... শ্বা...শ্বাস নি... নিতে পারছি না... খুউউ... খুব কষ... কষ্ট হচ... হচ্ছে...
আদ্বান : কাল পড়ে গিয়ে লেগেছে !!!
মৈথিলী : নাহহহ... আহহহ... আদ... আদ্বান... আমা... আমাকে একা ফে... ফেলে চলে যাবি না তো...
আদ্বান : কক্ষনো না... কোনোদিন যাব না... নার্স... নার্স.... Emergency... Stretcher.... Stracher Please...
আদ্বান বেশ কিছুক্ষণ পর মৈথিলীর বেডের পাশে এসে দাঁড়ায়... মেয়েটার মুখে Oxygen Musk, হাত ক্ষতবিক্ষত করেছে IV Saline-এর Channel... এতক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করে মেয়েটা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে... চোখের নীচে এখনও জলধারা ছাপ স্পষ্ট... আদ্বান মৈথিলীর মাথায় হাত রাখে... ঠোঁটটা একবার নড়ে ওঠে মৈথিলীর... কিছু বলার চেষ্টা করছে হয়তো... আদ্বান ওর কানটা নামায় মৈথিলীর মুখের কাছে....
মৈথিলী : হো... হো... হোলি... ঋ... ঋ... ঋক...
নার্স : আপনাদের USG Report এসে গেছে... আপনাকে একবার ডক্টর ডাকছেন...
আদ্বান : যাচ্ছি...
ডক্টরের ঘরের দরজা ঠেলে ঢোকে আদ্বান...
আদ্বান : আসব ডক্টর...
ডক্টর বর্মন : আসুন, বসুন... আপনি Patient-এর বাড়ির লোক...
আদ্বান : আমি ওর বন্ধু... ও আমার সাথে এখানে টিটেনাশ ইঞ্জেকশন নিতে এসেছিল... হঠাৎই প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়... ডক... ডক্টর, সব ঠিক আছে তো !!!
ডক্টর বর্মন : নাহহহ... ওনার Uterus ভয়ঙ্করভাবে Injured... আচ্ছা, ওনার সাথে কি কোনো Accident হয়েছিল !!!
আদ্বান : মানে !!!
ডক্টর বর্মন : মানে... Physical Abuse বা Molestation বা...
ডক্টরের অব্যক্ত কথার ইঙ্গিতে আদ্বান চমকে ওঠে... এইজন্যই কি মৈথিলীর বারবার ওকে ঘৃণা করার কথা বলতো !!! এই জন্যই ও নিজেকে সরিয়ে রাখে !!! এই জন্য !! এত যন্ত্রণা নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখে ও... চোখের কোলটা যেন মূহুর্তের মধ্যে আর্দ্র হয়ে ওঠে আদ্বানের...
ডক্টর বর্মন : ওনার অবস্থা কিন্তু seriously ভালো না... দেখুন, ওনার কিন্তু Internal Bleeding-এর ফলে Uterus-এ প্রচুর Blood Clod বেঁধে আছে... Uterus-ও কিন্তু... হয়তো উনি Pain Killer খেয়ে খেয়ে ব্যাথা দমিয়ে রাখতেন... কিন্তু একটা সময় তো শরীর বিদ্রোহ করবেই... মেয়েরা সাধারনত এইসব ঘটনা চেপে রাখতে চায়... কিন্তু চেপে রাখাটা তো কোনো সমাধান নয়... এতে হয়তো ওনার জীবন সংশয়...
আদ্বান : আপনি treatment শুরু করুন ডক্টর... মৈথিলীকে সামলানোর দায়িত্ব আমার...
ডক্টর বর্মন : আপনি Sure !!! এই Treatment-এ কিন্তু মৈথিলীকে দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে... আপনি পারবেন তো ওর পাশে থাকতে !!
আদ্বান : পারব... পারতে আমাকে হবেই...
ডক্টর বর্মন : আর এই নিন, Psychiatrist-এর নম্বর... এইটা পরে আপনার দরকার লাগতে পারে...
আদ্বান : Thank You Doctor... আমি হয়তো নিজেই আপনার কাছে চেয়ে নিতাম... আসলে আমরা সবাই শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, আমাদের ক্ষতবিক্ষত মনটারও যে চিকিৎসা লাগে, সেটা বোধহয় আমরা ভুলে যাই...
ডক্টর বর্মন : একটা কথা জিজ্ঞেস করব !! যদিও এটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার... আপনি নিজেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আপনি ঠিক কোন ধরনের Case deal করতে যাচ্ছেন... উনি আপনার কে হন !!! বাগদত্তা !!
আদ্বান : সব সম্পর্কের কি নাম হয় !!! দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় তার সম্মান কে বাঁচিয়ে ছিল ডক্টর !!! কিছু সম্পর্ক হয় নিখাদ বিশ্বাসের, ভরসার, সাহচর্যের... নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের... মৈথিলী আমার বন্ধু... আর আমার বন্ধুর এই অসময়ে ওকে একা ফেলে আমি কোথাও যাব না... আমার মৈথিলী বাঁচবে ডক্টর... এই সমাজের লোলুপতার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে... এই ঘটনায় ওর কোনো দোষ নেই... ওকে জীবনের মূল স্রোতে ওর এই বন্ধু ফিরিয়ে নিয়ে আসবে... আসবেই...
ডক্টর বর্মন : আমি চাই আপনি সফল হোন... নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আপনার এই দৃষ্টিভঙ্গি এই সমাজের বুকে বপন করা না গেলে আমাদের সমাজের এই নোংরা মানসিকতার বিরুদ্ধে কোনোদিনই যুদ্ধ ঘোষনা করা যাবে না...
নার্স : ডাক্তারবাবু, তাড়াতাড়ি আসুন... মৈথিলী চক্রবর্তীর আবার Pain উঠেছে... উনি ভীষন কাতরাচ্ছেন... আমরা Sedative দিতে পারছি না...
ডক্টর বর্মন ছুটে বেরিয়ে যান কেবিন থেকে... আদ্বান ওনার পেছন পেছন গিয়ে দূর থেকে দেখতে থাকে তার মেথি পাতাকে... এইভাবে যন্ত্রণাতে কাতরাতে থাকা মেয়েটাই কি সেই মেয়েটা- যে তার জন্য যত্ন করে খাবার নিয়ে আসতো, বৃষ্টির মধ্যে ভিজে হোস্টেল থেকে বই এনে দিত যাতে আদ্বানের পড়ার ক্ষতি না হয়, আদ্বানের জীবন সংগ্রাম সঙ্গী হয়ে নোটের পর নোট বানিয়ে দিত... আদ্বানের শত দুষ্টুমি হাসিমুখে সহ্য করে নিত, আবার কখনো কোমর বেঁধে 'কাকতাড়ুয়া' বলে ঝগড়া করতো...
মৈথিলীকে ডক্টর, নার্স সবাই মিলে যখন বোঝাতে অক্ষম, হঠাৎই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে মৈথিলীর Channel করা হাত শক্ত করে ধরে নেয়... মূহুর্তের জন্য মৈথিলী চোখ খুলে সেই বলিষ্ঠ হাতের অধিকারীর দিকে যন্ত্রণাক্লিষ্ট কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে... দু'জোড়া চোখেই আবার যেন অকাল শ্রাবণ নামে... ডক্টর বর্মনের চোখের ইশারায় নার্স IV Channel-এ Sedative Injection push করে... ইঞ্জেকশন হাতে এসে পৌছাতেই মৈথিলী একবার কাতরে ওঠে... সেই বলিষ্ঠ হাতটি নরমভাবে মৈথিলী ওই Channel করা অংশে আঙুল বুলিয়ে পরম মমতায় মালিশ করে দেয়... ওষুধের প্রভাবে ধীরে ধীরে চোখের পাতা মুদে আসতে থাকে মৈথিলীর... বিকেলের সূর্যকে সাক্ষী রেখেই আজ আবার নতুন করে দুজন দুজনের বন্ধুত্বের সাথে আলাপ, যার অলিখিত সেতু ছিল ভালোবাসায় মোড়া... তাই সেই বলিষ্ঠ হাতটিকে আঁকড়ে ধরেই ঘুমের দেশে পাড়ি দেয় মৈথিলী... দূর থেকে ভেসে আসে,
আজি মম মন চাহে জীবনবন্ধুরে,
সেই জনমে মরণে নিত্যসঙ্গী নিশিদিন সুখে শোকে,
সেই চির-আনন্দ, বিমল চিরসুধা,
যুগে যুগে কত নব নব লোকে নিয়তশরণ ।।
পরাশান্তি, পরমপ্রেম, পরামুক্তি, পরমক্ষেম,
সেই অন্তরতম চিরসুন্দর প্রভু, চিত্তসখা,
ধর্ম-অর্থ-কাম-ভরণ রাজা হৃদয়হরণ ।।

