Anishri's Epilogue

Romance Tragedy

3.4  

Anishri's Epilogue

Romance Tragedy

অনাদৃতা (পর্ব ৪)

অনাদৃতা (পর্ব ৪)

21 mins
227


তীর বেঁধা পাখি আর গাইবে না গান

-----------------------------------------------------

প্রিয় মানুষের অবহেলা, অযথা হঠাৎই ছেড়ে চলে যাওয়া বা কোনো অদৃশ্য কারনে প্রিয় মানুষটাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়া, পারিপার্শ্বিক চাপ, চারপাশের মানুষের ধিক্কার, সবকিছু একটা মানুষকে আস্তে আস্তে চার দেওয়ালের ভেতর আটকে ফেলে... সেই সময় মানুষটার কান্না আর প্রতিটা আর্তনাদের সাক্ষী হয় ঘরের চার দেওয়াল আর... আর একটা সময় তারাও ধিক্কার আর ছিঃ ছিঃ করে ওঠে... আয়নায় নিজের মুখটাও দেখতে লজ্জা আর ঘৃণা কাজ করে... আর ঠিক এমনিভাবেই একটা মানুষ তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে ফেলে...

Pune :

------------

থেমে নেই এগিয়েছি তবু সূঁচের মতো মনে হুল বিঁধানো,

বুকের মাঝে প্রশ্নরেখা, মানুষ মানুষকে ঠকায় কেন !!!

 

                          Hello Deb....

দিব্যান্ত পেছনে তাকিয়েই চমকে ওঠে... মৈথিলীর জায়গায় Western Trench Dress পরিহিতা দিব্যা দাড়িয়ে, হাতে লাল গোলাপের Bouquet আর চকলেট... দিব্যান্তর হাতে ধরা বিভিন্ন রঙের গোলাপ, চকলেট আর একটা ছোট্ট সাদা Teddy Bear-এর ছোট্ট ঝুড়িটা হাত গলে পড়ে গেল... ঝাপসা চোখে দিব্যান্ত দেখতে পায় না, দিব্যার ঠোঁটের কোণায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে যায়... সে মনে মনে বলে,

দিব্যা : (স্বগতোক্তি) একেই বলে 'জোর কা ঝটকা, ধীরে সে লগে'...

দিব্যান্ত : (অতি কষ্টে নিজেকে সামলে) ত্তু... তুই !!!

দিব্যা : হ্যাঁ... আমি... আমি ছাড়া অন্য কারোর আসার কথা ছিল না কি !!! আর এটা কি করলি দেব, সব Gift-গুলো ফেলে দিলি !!

দিব্যান্ত : সত্যিই আর কেউ আসে নি !!

দিব্যা : (Giftগুলো তুলতে তুলতে) নাহহহহ.... মৈথিলী তো আমাকে বললো, তুই আমাকে এখানে আসতে বলেছিস...

দিব্যান্ত : (আর্তনাদ করে) কিইইই !!!

দিব্যা : হ্যাঁ... ওই তো আমাকে বললো তোদের কালকের এখানে আসার কথাটা...

দিব্যান্ত : মৈথিলী !!!

দিব্যা : হ্যাঁ... নয়তো আমি কি করে জানব যে তোরা এখানে Meet করেছিস !!! তুই তো আর আমাকে বলিস নি... দেখ, আমরা দু'জন কত Time Spend করেছি বল তো !!!

দিব্যান্ত : তিনজন... তিনজন দিব্যা...

দিব্যা : হ্যাঁ... ওই মৈথিলীর থাকা বা না থাকা একই ব্যাপার... দেখ, সবাই আমাদের দু'জনকে একসাথে দেখতে চায়... মৈথিলীও চায়... মৈথিলী কাল বলছিলো, তোদের দুটোকে দেখলে আমার চোখ জুড়ায়...

দিব্যান্ত : (অভিমানী কন্ঠে) তাই বলছিলো বুঝি !!!

দিব্যা : হ্যাঁ রে... আমাদের তো উচিত বল সবার কথা ভাবা... নয় তো মন ভেঙে যাবে সবার...

দিব্যান্ত দিব্যার থেকে খানিকটা সরে আসে... দূরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে অভিমানী স্বরে মনে মনে বলে,

দিব্যান্ত : এইভাবে ঠকালি আমাকে মৈথিলী !! সেই... সেই দিব্যাকে পাঠালি... ঠিক আছে... তাহলে তোর ইচ্ছেই পূর্ণ হোক... আমিও দেখি, তুই ঠিক কতটা সহ্য করতে পারিস... আজ থেকে যেমন আমার পরীক্ষা শুরু হলো, ঠিক তেমনই তোর পরীক্ষাও শুরু হলো... হ্যাঁ মৈথিলী... এবার তুই দেখবি, দিব্যান্ত খারাপ হলে, অমানুষ হলে ঠিক কতটা নীচে নামতে পারে... দিব্যান্ত আসছে তোকে বিরহের আগুনে পোড়াতে... তৈরি থাক তুই...

'মনে পড়ে আজ সে কোন জনমের বিদায় সন্ধ্যাবেলা,

আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এপারে, তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা...'                        (কাজী নজরুল ইসলাম)

দিব্যান্ত যখন দিব্যাকে ওদের PG-তে ছাড়তে আসে, তখন হঠাৎই একটা সাইকেল এসে পাশে দাঁড়ায়... আর তার সাথে এষণাও এসে দাঁড়ায়

আহন : তুই কি রে দিব্যা, এত বড় কথাটা তুই একবারও University-তে বললি না !!!

দিব্যা : কোন কথা !!! কি হয়েছে !!

এষণা : তুই কেমন Roommate রে দিব্যা !!! মেয়েটার গায়ে এত জ্বর, আর তুই আমাদের University-তে কিছুই বললি না... আর এতক্ষণে তোরা ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরছিস...

দিব্যা : (মনে মনে) এই মেরেছে... ওর আবার কখন জ্বর এলো !!! কালকের ঘটনায় Traumatized হয়ে জ্বর আসে নি তো... জ্বরের ঘোরে যদি কিছু বলে দেয় !!! না... না... আমাকে ওর কাছে যেতে হবে... কিন্তু তার আগে এই দুটোকে শান্ত করতে হবে...

(গলায় দুশ্চিন্তার ভাব এনে) মানে !! কার কি হয়েছে !! মৈথিলীর !!! কিন্তু ও তো সকালে আমাকে খেতে দিয়ে University পাঠালো... হ্যাঁ, তবে বলেছিল মাথাটা একটু ধরে আছে...

এষণা : মৈথিলী Hospitalized... University শেষ হবার পর আমি যখন তোদের এখানে এলাম, মৈথিলী তখন Senseless হয়ে আছে জ্বরের ঘোরে... কোনোরকমে আমরা ওকে Hospitalized করি...

দিব্যা : আজ রাতে কি ও হসপিটালেই থাকবে !!!

আহন : হ্যাঁ... কাল যদি জ্বর নামে, তাহলে বাড়ি আসবে...

দিব্যা : তাহলে আমি আজ রাতে একা কি করে থাকব !! আমি একা থাকতে পারি না...

আহন : হাসালি দিব্যা... যাই হোক, মৈথিলীই এষণাকে পাঠালো তোর কাছে থাকার জন্য... ও থাকবে তোর কাছে...

দিব্যান্ত : ডক্টর কি বলছে !!!

আহন : Nerval Breakdown... কোনো কারনে প্রচন্ড Mental Stress গেছে ওর উপর দিয়ে... আর ও সেটা ভেতরেই চেপে রেখে দিচ্ছে...

দিব্যান্ত : কিন্তু কালও তো ও ঠিক ছিল... এক রাতের মধ্যে কি হলো !!!

এষণা : পৃথিবী সুন্দর, সুন্দর তুমি,

সুন্দরতমেষু তোমায় ভালোবাসি আমি।

আমি পারি নি কথাটি বলতে তোমায়,

জানি তবু তুমি ভালোবাসো আমায়...

সরিয়ে নিয়েছি নিজেকে চিরদিন

তুমি ভালোবেসেছো আমায়,

খুঁজেছো সারাবেলা সারাদিন...

মন চায় তোমায় কাছে পেতে, পারি নি কাছে টানতে...

বাড়ছে রাতের গভীরতা,বাড়ছে নিরবতা,

দু চোখে ঘুম নেই, নির্ঘুম সরলতা...

মলিন হচ্ছে চাঁদের আলো, নিভে যাচ্ছে তারা,

একটু পরে ভোর হবে, পাখিরা দেবে সাড়া...

এ রকম প্রতিটি রাত নির্ঘুম আমার,

সাথে নিয়ে ভালোবাসা তোমার....

                      (নির্ঘুম রাত, অনুপ কুমার কর্মকার)

দিব্যা : (রাগত স্বরে) কি বলছিস এইসব তুই !!! মৈথিলী তোকে এইসব বলেছে !!

এষণা : দিব্যা, সব কথায় এইভাবে React করিস না... লোকে ভাববে- পড়লো কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে... আমি তো just একটা কবিতা বললাম... তা দু'জনের হাতেই এত্ত Gift... তোরা কি Propose-টা সেরেই ফেললি !!!

দিব্যা : (গদগদ স্বরে) হ্যাঁ রে... মানে আজ দিব্যান্ত....

আহন : অবশেষে মৈথিলীর আজ তাহলে মুক্তি হলো !! কি বল !!

দিব্যান্ত : মানে !!! কি বলছিস !!!

আহন : নাহহহ... তোর চলে যাবার সব দায় তো ওই মেয়েটার উপরেই এসে পড়েছিল... তাই বললাম আর কি !! এষণা আমি এলাম রে... আজ সারারাত হসপিটালেই থাকব... তোরা সাবধানে থাকিস...

নিজের হাতে, নিজে বাঁধা- ঘরে আধা, বাইরে আধা

এবার ভাসাই সন্ধ্যে হাওয়ায় আপনারে....

অশ্রুনদীর সুদূর পারে, ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে...

তখন গভীর রাত... আহন বাইরের Waiting Zone-এ অপেক্ষা করছে... ধীরে ধীরে চোখ মেলে চায় মৈথিলী... চোখের পাতাগুলো বড্ড ভারী লাগছে... খুলে রাখতে পারছে না, কিন্তু কানে যে রবিঠাকুরের গান বাজছে... এই মানুষটার জন্যই আজ তার মরা হলো না বোধহয়... মৈথিলীকে তার কাছে যেতে হবে যে, তার প্রাণের 'কবিনগর'-এ... কি এক অদৃশ্য বাঁধন আছে ওখানে... মৈথিলীকে খালি টানে, খালি টানে... যেন কিছু কাজ বাকি আছে ওর ওই কবিনগরে... সেটা শেষ না করলে ওর মুক্তি নেই... হঠাৎই মাথায় একটা সুপ্ত কিন্তু কাঙ্খিত উষ্ণ হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে তাকায় মৈথিলী....

মৈথিলী : তু... তুই !!!

দিব্যান্ত : না এসে থাকতে পারতাম !!! তুই পারিস প্রতিশোধ নিতে, আমি পারি না...

মৈথিলী : (অপার বিস্ময়ে) পপ... প্রতিশোধ !!

দিব্যান্ত : সেটাই তো নিলি আজ তুই... যাই হোক, আমি আজ তোকে Permanently মুক্তি দিলাম... তোর ইচ্ছে মতো, আমি দিব্যাকে Propose করেছি... খুশি তুই !!!

মৈথিলী একবার খুব জোরে একটা শ্বাস নেয়... কোনোপ্রকারে চোখের জল আড়াল করে মুখে হাসি টেনে বলে,

মৈথিলী : ভী... ভীষণ... ভীষণ খুশি আমি... সস... সত্যিই অবশেষে আমি মুক্তি পেলাম...

দিব্যান্ত : যদি মুক্তিই চেয়েছিলিস, তাহলে আমাকে আসতে বলেছিলিস কেন !!! কেন এই খেলাটা খেললি আমার সাথে !!!

মৈথিলীর বোধহয় কষ্ট বাড়ে... সাথে শ্বাসকষ্টও... ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে বলে,

মৈথিলী : দি... দিব্যা.... দিব্যা কক... কষ্ট সহ... সহ্য কর... করতে পারে... নাআআআ... আহহহ... জ... জল... জল....

দিব্যান্ত : (উদ্বেগের সাথে) মৈথিলী !!! কষ্ট হচ্ছে তোর !!! নার... নার্স... নার্স... জল... এই তো জল... আমাকে ধরে একটু ওঠ মৈথিলী... একটু জলটা খেয়ে নে...

দিব্যান্ত মৈথিলী জল খাওয়াতে না খাওয়াতেই নার্স চলে আসে... মৈথিলীকে Saline-এর মাধ্যমে একটা Antibiotics দিতেই একবার যন্ত্রণাতে কঁকিয়ে ওঠে মৈথিলী... তারপর নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে...

বাঁধতেই থাকবো, হৃদয়ে হৃদয়ে :

---------------------------------------------

সেদিনের পর থেকে মৈথিলী একপ্রকার পাথরে পরিণত হয়েছে... সে হাসে না, কাঁদেও না অবশ্য... ফুচকা খায় না, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে না... যন্ত্রচালিতের মতো University যায়, আর ঘরে ফিরে আসে... আসলে কিছু কিছু অনুভূতি প্রকাশ করা কঠিন, কোনোভাবেই সেই অনুভূতিগুলোর ব্যাপ্তি বোঝানো যায় না... কয়েকটা শব্দ দিয়ে সেগুলোর গভীরতা বোঝানো বোকামো ছাড়া আর কিছুই নয়, এমনকি চোখের ভাষাও যথেষ্ট নয়... অনুভূতিদের নিজস্ব ভাষা থাকে, সেই ভাষা যে পড়তে শিখে যায়, সে বাকিটা বুঝে নেয়... দিব্যান্ত কোনোদিনই মৈথিলীর অনুভূতি বোঝে নি, পড়তে পারে নি তার অন্তরের ভাষা... দিব্যান্ত কেবল যত মৈথিলীকে পাথরে পরিণত হতে দেখে, তত নিজেকে জর্জরিত করার জন্য দিব্যার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নেয়... এ এক অদ্ভুত সমীকরণ... আর দিব্যা !!! সে কি নিজেও ভালো আছে !! আজ অব্দি দিব্যান্ত ওকে ছোঁয় নি... মৈথিলী হেরে গিয়েও কি ভীষণভাবে জিতে গেল দিব্যান্তর কাছে... আর দিব্যা, সে জিতে গিয়েও প্রতি মূহুর্তে হেরে যায় ওই আপাত সাধারণ মেয়েটার কাছে... হারজিতটা বোধ হয় খুবই আপেক্ষিক... কেউ জিতে গিয়েও হেরে যায়, আবার কেউ হেরে গিয়েও জিতে যায়... ভালোবাসা বড্ড বোকা, সে বিশুদ্ধতায় বিশ্বাস করে এখনও.. তথাকথিত আধুনিক হতে পারে নি কি না !! তাই বাহ্যিক আকর্ষণে সাময়িক মজলেও অন্তরের টানটা অস্বীকার করার ক্ষমতা অর্জন করতেই পারেনি এখনও... তাই তো দিব্যাকেও কখনো সাধারণত্ব-এর কাছে হার মানতে হয়... হাত ধরে টেনে নামিয়ে দেয় বাস্তবের কঠিন রাস্তায়.. বুঝিয়ে দেয় প্রকৃত অধিকারটা ঠিক কার !!! কিন্তু মৈথিলী !! মৈথিলী যেন এখন ভুলেও আর কখনো দিব্যান্তর দিকে তাকায় না... আর দিব্যান্ত !!! প্রতি মূহুর্তে যেন ওর চোখ চলে যায় মৈথিলীর দিকে... ভালো নেই, ওরা কেউ ভালো নেই... কাল University বন্ধ, রাখী উৎসব আছে তাই....

দিব্যা : মৈথি, আমার না তোর কাছে কিছু চাই... Please, 'না' বলিস না...

মৈথিলী : (বই থেকে চোখ না সরিয়েই) তোকে আমার আর কিছু দেবার নেই দিব্যা... Please, আমাকে একটু একা থাকতে দে...

দিব্যা : আছে আছে... কাল তুই দিব্যান্তকে রাখী পরাবি...

মৈথিলী : (চাপা আর্তনাদ করে) কিইইই !!! তুই কি পাগল হয়ে গেলি !!! আমি পারব না...

দিব্যা : দিব্যান্ত এখন তোকে ভালোবাসে না... এখন ও আমাকে ভালোবাসে... তাহলে তোর সমস্যা কোথায় হচ্ছে !!! ও এখন আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে... আমাকে পেলে আদরে আদরে একেবারে... কি বলবো তোকে !!! তুই দেখবি ওর আদরের চিহ্ন !!

মৈথিলী : (ভৎসনার সুরে) ছিঃ দিব্যা... ছিঃ... এত Insecurity কেন তোর !! আমি তো দিব্যান্তর সাথে কোনো সম্পর্কই রাখি না....

দিব্যা : (ধমকের সুরে) তাহলে তোর অসুবিধাটা কোথায় !! যেখানে দিব্যান্ত তোকে ভুলে রাখি পরাতে রাজি হয়ে গেল... বল... কিসের অসুবিধা তোর !!! না কি এখনো মনে মনে !!!

মৈথিলী : আমি শুধু আমার ভাগ্যটাকে তোর হাতে তুলে দিয়েছি দিব্যা, আমার অন্তরটাকে তোর হাতে তুলে দিই নি... তাই ওইটা নিয়ে কথা বলিস না...আর দিব্যান্তকে রাখী পরালেই তোর শান্তি তো !! (দীর্ঘশ্বাস চেপে) ঠিক আছে... তাহলে সেটাও আমি করে দেব... কাল আমি দিব্যান্তকে রাখী পরিয়ে দেব...

দিব্যা : বেশ... আহন সব ব্যবস্থা করে রেখে দিয়েছে... কাল ওর মেসে রাখীটা হবে...

মৈথিলী : এটাই কিন্তু Last... আমি আর পারছি না...

দিব্যা : Okkk... এটাই Last...

মৈথিলী উঠে ওকে ডক্টরের Prescribe করা সাময়িক ঘুমের ওষুধের Strip থেকে তিন-চারটে Sleeping Pills বার করে খেয়ে নেয়... হ্যাঁ, এখন মৈথিলী রীতিমত নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে... তার গহীন বুকের যন্ত্রণা একটা ঘুমের ওষুধে কমে না... তিন চারটে ওষুধ খেতে হয় তাকে... রাত আটটার মধ্যে খেয়ে নিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে... তারপর সারাদিন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায় মৈথিলীর... যন্ত্রণা ভুলতে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করার এই পন্থাই বেছে নিয়েছে সে... সবার অজান্তে... কারুর চোখে পড়ে না, কেউ খবর রাখে না... কিন্তু মৈথিলী ভালো থাকে...

            চলেছে ছুটিয়া অশান্ত বায়,

         ক্রন্দন কার তার গানে ধ্বনিছে,

       করে কে সে বিরহী বিফল সাধনা....

আহনের ঘরের দরজা ঠেলে ক্লান্ত পায়ে ঢোকে মৈথিলী... সদ্যস্নাতা মৈথিলীর দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারে না দিব্যান্ত... কিচ্ছু শৃঙ্গার করে নি মেয়েটা, একটা সাদা ঢাকাই পড়েছে আর ছোট্ট একটা কালো টিপ... কিন্তু তবুও দিব্যান্ত যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে... হঠাৎই আহন বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়, চমকে ওঠে মৈথিলী...

মৈথিলী : এ... এ কি !!! আহন দরজা বন্ধ করলো কেন !!! (দরজা ধাক্কা দিয়ে) আহন... আহন... দরজা খোল... দরজা খোল Please....

দিব্যান্ত : খুলবে না... আমি না বললে খুলবে না...

মৈথিলী : (আকুলভাবে) কেন !! কেন এমনি করছিস দিব্যান্ত !!!

দিব্যান্ত : Checkmate... তোর আর আমার দেখা হওয়াটা Due ছিল... তবে আজ আমি বেশ খুশি জানিস... কি সুন্দর সাইয়াকে ভাইয়া বানাতে এসেছিস...

মৈথিলী : রাখীর অন্য প্রদেশে যাই Essence থাক দিব্যান্ত, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু রাখী মানবতার বাঁধন... যে কোনো বন্ধনের দৃঢ়তার প্রতীক....

দিব্যান্ত : ওহহহ... 'বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার, সে রাখী খুলো না... খুলো না... খুলো না..' Right !!!

মৈথিলী : এই তুই তাড়াতাড়ি রাখী পরে আমাকে মুক্তি দে তো....

দিব্যান্ত : আমি তো তোকে মুক্তি দিতে চাই নি... আমি তো তোকে বাঁধতে চেয়েছিলাম... তুই তো বিশ্বাসঘাতকতা করলি !!! একজন বিশ্বাসঘাতকের কাছ থেকে আমি রাখী পরব বল !!! কোন বন্ধন দৃঢ় হবে আমাদের মধ্যে !!! বিশ্বাসঘাতকতার সম্পর্ক !!!

মৈথিলী : (চাপা গলায় চিৎকার করে) তাহলে তুই রাজী কেন হলি !! কেন হলি বল !!

দিব্যান্ত হঠাৎই মৈথিলীকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে একেবারে নিজের বুকের কাছে টেনে নেয়... তারপর দুই চোখে আগুন জ্বেলে একইরকম চাপা স্বরে বলে,

দিব্যান্ত : জবাব চাই আমার... জবাব চাই সেই রাতের... জবাব চাই সেই সন্ধ্যেটার... আমি উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না... হিসেব মেলাতে পাচ্ছি না...

মৈথিলী : তাই বুঝি দিব্যাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিস... ভালোবাসার চিহ্ন রেখে যাস ওর শরীরে...

দিব্যান্ত : (ভৎসনার সুরে) ছিঃ মৈথিলী !!! এত নোংরা ভাবিস তুই আমাকে !!

মৈথিলী : আমি ভাববো কেন !!! তোর দিব্যার মুখেই শুনেছি...

দিব্যান্ত : না রে...আমি ওর হাতটা আজ পর্যন্ত ভালোবাসে ধরতে পারি নি... শুধু তুই চাস বলে, ওর সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি... তুই আমাকে একবার বল, কেন তুই ওই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলিস...

মৈথিলী : আসলে কি বল তো... (ঢোক গিলে) আমি ভীষন Self Centric, মানে Selfish আর কি !! আমি আমার পড়াতেই নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই... এইসব আমি চাই না...

দিব্যান্ত : সত্যিই !!! মৈথি, তুই আগে ভালো করে মিথ্যে কথাটা বলতে শেখ... তারপর ঢপ দেবার চেষ্টা করিস...

মৈথিলী এবার চোখ তোলে তাকায়... চোখের কোনটা একটু যেন ভিজে গেছে, চোখ ভিজেছে দিব্যান্তর-ও... হঠাৎই দিব্যান্ত অধর নেমে এসে পরশ করে মৈথিলীর কপাল... এক অদ্ভুত অনুভবে সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে মৈথিলীর... অনুক্ষণ তার তনুমন কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে...

দিব্যান্ত : (আবেগঘন স্বরে) বল না মৈথি, কেন হাসতে ভুলে গেলি তুই !!! বল Please... সব... সবকিছুর উত্তর লুকিয়ে আছে ওই একটা রাতে... বল না মৈথিলী, কি হয়েছিল সেই রাতে !!! বল না...

এমনসময় বেশ জোরে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে আহন... হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

আহন : দিব... দিব্যা আসছে... তোদের কথা হয়ে গেছে তো !!! মৈথিলী তুই তাড়াতাড়িই আমাদের হাতে রাখী পরা...

নাহহহ... মৈথিলী আর কাউকেই রাখী পরাতে পারে না... আহনকে ঠেলে সরিয়ে ঘর থেকে টলমল পায়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়... আহন, দিব্যান্ত চেয়েও ওকে ধরতে পারে না....

আহন : দিব্যান্ত, আমাদের নিজেদেরই রাখী দু'টো পরে নিতে হবে...

দিব্যান্ত : ঠিক আছে... কিন্তু তারপর ভাই তুই ওকে একটু দেখ... কোথায় দৌড়ে পালিয়ে গেল !!! কখন যে কি করে, তার নাই ঠিক....

আহন আর দিব্যান্ত পরষ্পরকে রাখী পরিয়ে আহন মৈথিলীকে খুঁজতে বেরোয়... যেহেতু আহনদের মেসে রাখী উৎসব হচ্ছে, তাই সবাই আজ ওদের মেসেই থাকবে... সবার খাবার প্রায় শেষের পথে, দিব্যান্ত আর দিব্যা মৈথিলীর জন্য অপেক্ষা করছে... এমনসময় আহন হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে বলে,

আহন : দিব্যান্ত, মৈথিলীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না... কোথাও... কোথাও নেই ও.... কি করব এখন !!!

মৈথিলী তখন কোথায় !!! সে তখন টলমল পায়ে এক পা, এক পা করে তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি খাদের দিকে... পাহাড়ি খাদের প্রান্তে এসে খাদের দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু হাসে মৈথিলী... তারপর পা বাড়াতে গেলেই একটা বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন তাকে খাদের প্রান্ত থেকে টেনে সরিয়ে আনে... দু'জনেই হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে পাথরের উপরে... মৈথিলীকে আড়াল করতে গিয়ে পাথরে সেই আগন্তুকের হাত কেটে যায়... মৈথিলী ঘোর লাগা চোখে একবার সেই আগন্তুককে দেখার চেষ্টা করে... কিন্তু তাকে দেখার আগেই আঁধার নামে মৈথিলীর চোখে... সে লুটিয়ে পড়ে আগন্তুকের বুকের উপর...


'হঠাৎ কোনো নতুন গলির মোড়ে,

নতুন কোনো আলতো গলির শেষে,

শুরুর গল্প তোমার আমার ভিড়ে,

যদি মিলে যায় গল্প লেখার দেশে'

মনের আকাশে অন্ধকার নামার পর চেনা সবকিছু অচেনার ভিড়ে হারায়... সেই অন্ধকারে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় যাচাই করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়... কত নীরব কাহিনী এই অন্ধকারে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়... নিঃশব্দে... নির্জনতায়...

Pune :

------------

আজ তার সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেছে... সেই অন্ধকারে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে সে... সামনে আরো অন্ধকার... নিকষ কালো অন্ধকার... ক্ষণিক দাঁড়ায় সে... বহুদিন সে হাসে নি... মুখে একটু হাসি টেনে নিল... চোখ বন্ধ করে সে... এবার সে অন্ধকারে ডুব দেবে...

গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।

আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা ॥

হয়তো সে তুমি শোন নাই, সহজে বিদায় দিলে তাই,

আকাশ মুখর ছিল যে তখন, ঝরোঝরো বারিধারা ॥

চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি,

আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি।

আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে

 জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা ॥

গানটা শেষ করে আদ্বান সবে গিটারটা পাশে নামিয়ে রেখেছে, এমনসময় তার চোখে পড়ে একটা মেয়ে কেমন যেন অগোছালো টলমল পায়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে... আঁচলটা যে অবিন্যস্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, সেদিকে খেয়াল নেই... ইশশশ !!! এই সমাজে চারপাশে যা সব মনুষ্যরূপী শ্বাপদরা ঘুরে বেড়ায়, এই অবস্থায় দেখলে তো আর রক্ষে থাকবে না... আর ওই মেয়েটা খাদের দিকেই বা যাচ্ছে কেন !!! মেয়েটা কোনো অঘটন ঘটাতে যাচ্ছে না তো !!! বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে আদ্বানের...

আদ্বান : ওইইইই.... Hellooooo... Silllllyyyyy Girlll... Can you hear meeee ???? ওইইইই...

নাহহহ, মেয়েটার কানে তো কিছুই যাচ্ছে না... কিন্তু আর দেরী করা যাবে না... দৌড়তে শুরু করে আদ্বান... মেয়েটা ততক্ষণে একেবারে খাদের কিনারে পৌছে গেছে... আদ্বান তখনও খানিকটা দূরে... মেয়েটা যেন একটু থমকে দাড়ালো... এই সুযোগে আদ্বান নিজের গতি বাড়ায়... খাদে পা বাড়ানোর মূহুর্তেই মেয়েটার হাত ধরে টেনে খাদের কিনারা থেকে টেনে আনে আদ্বান...গতিজাড্যের জন্য দু'জনেই গিয়ে একটু দূরের পাথরের উপরে পড়ে... মেয়েটাকে আগলাতে আদ্বানের হাত পাথরে লেগে কেটে যায়... মেয়েটারও কপালে আঘাত লেগে রক্ত বেরোতে শুরু করে... মেয়েটা বোধহয় একবার মাথা তোলার চেষ্টা করে... কিন্তু পরক্ষণেই আদ্বানের বুকে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারায়...

আদ্বান : Ohhh Shitt !!! এই উটকো ঝামেলাটা আবার কোথা থেকে এসে জুটলো... এ তো মনে হচ্ছে, জ্ঞান হারিয়েছে... কি করব এবার !! আমার ব্যাগ... আমার গিটারটা ওদিকে বেঞ্চটায় একা পড়ে আছে... একে ওই বেঞ্চটাতেই নিয়ে যাই...

আদ্বান মেয়েটাকে কোলে তুলে এনে নিজের বেঞ্চে শোয়ায়... শাড়ির আঁচলটা ভালো করে টেনে মৈথিলীর সব লজ্জা ভালো করে আবৃত করে দেয়...

আদ্বান : ইসসস... মাথাটা কতটা কেটে গেছে... আমার আবার রক্ত দেখলেই মাথা ঘোরে... ওই সামনের দোকানটা থেকে জল আর ওষুধ কিছু নিয়ে আসি... যদি পাওয়া যায়...

দোকান থেকে জল আর ব্যান্ডেজ নিয়ে এসে আদ্বান মেয়েটার চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দেয়... মেয়েটার গালে আলতো করে চাপড় মেরে ডাকে,

আদ্বান : Hello... Miss Silly Girl... Hello... Can you hear me !!!

মেয়েটা ঘোরের মধ্যেই অস্ফুটে বলতে থাকে,

আম... আমি... কাউকে... কাউকে কি... কিছু বলি নি... কি... কিছু বলি নি আমি...

আদ্বান : বাঙালি !! এই যে... শুনতে পাচ্ছেন !! চোখটা খুলুন একটু... শুনতে পাচ্ছেন !!!

মেয়েটা অতি কষ্টে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়... কিন্তু তখনও যেন আচ্ছন্নই আছে...

আদ্বান : কি নাম !!! কি নামে ডাকব আপনাকে !!!

মেয়েটি : মৈ... মৈথিলী...

আদ্বান : মৈথিলী, আপনি উঠে বসতে পারবেন !!!

মৈথিলী : ব্যা... ব্যাথা...

আদ্বান : কোথায় !!! কপালে !!!

মৈথিলী : কো... কোথাও না...

আদ্বান : পাগল না কি !!!

মৈথিলী : আম... আমি কো... কোথায় !!

আদ্বান : আপনি একটু উঠে বসুন... একটু জল খান... আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে যাবে...

মৈথিলী উঠতে গিয়েও উঠতে পারে না... মাথাটা বড্ড ভারী লাগছে... আদ্বান ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়... আদ্বানের হাত ধরেই মৈথিলী উঠে বসে... আদ্বান ওর দিকে জলটা এগিয়ে দিতেই ওর হাতের ক্ষতটা চোখে পড়ে মৈথিলীর... নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর ক্ষতটা বেঁধে দিয়েই উদ্বেগের বলে ওঠে,

মৈথিলী : (কাঁপা স্বরে) এএ... কিইইই !!! আপ... আপনার তো হা... হাত থেকে রক... রক্ত পড়ছে... লা... লাগলো ক্কি... কি করে !!!

আদ্বান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মৈথিলীর দিকে... এই যুগের মেয়ে হয়েও এত্ত আবেগী মন... এইরকম বোকা মেয়েও আছে এখনো... একে তো যে কেউ একজন ঘাটে কিনে অন্য ঘাটে বিক্রি করে দেবে...

মৈথিলী : কি হলো বললেন না !!! কি করে লাগলো !!

আদ্বান : আপনার কিচ্ছু মনে নেই !!

মৈথিলী : নাহহ... কিছু মনে নেই... আরেএএ... ওই তো ব্যান্ডেজ...

মৈথিলী নিচ থেকে ব্যান্ডেজটা তুলে আদ্বানের জলেই ওর ক্ষত ধুয়ে ওর হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়...

আদ্বান : আচ্ছা, আপনি কি বরাবরই এমনই !! কোনোকিছুই না ভেবে কাজকর্ম করেন... আমার তো ক্ষত ঢেকে গেল, কিন্তু আপনার যে ওই সাদা শাড়িতে যে লাল রঙ দাগ লেগে গেল... ওটা তো আর উঠবে না... নিজের দিকটা বোধহয় ভাবতে পারেন না, তাই না !!!

মৈথিলী কোনো কথা না বলে আদ্বানের থেকে চোখ সরায়, কিন্তু আদ্বান কঠিন দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে... মৈথিলী এবার একটু উঠতে গেলে মাথার যন্ত্রণায় আবার ধপ করে বেঞ্চে বসে পড়ে... আদ্বান ওর কাঁধে হাত রাখলে ও ব্যথিত চোখে আদ্বানের দিকে তাকায়... আদ্বান ধীরে ধীরে ওর কপালে ব্যান্ডেজ করে দেয়... তারপর আস্তে আস্তে কিন্তু ঋজু স্বরে বলে,

আদ্বান : আজ যেটা করতে যাচ্ছিলেন, ওটা আর করার চেষ্টা করবেন না তো !!!

মৈথিলী : কি করেছি আমি !!

আদ্বান : ওই খাদে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলেন...

মৈথিলী : আমিইইই !! কিন্তু আমার তো খাদে খুব ভয়... মাথা ঘোরে আমার...

আদ্বান : আপনি তখন নিজের মধ্যে ছিলেন না... কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন... আপনাকে ওই খাদ থেকে সরাতে গিয়েই তো...

আদ্বান বাকি কথাগুলো না বলেই ইশারায় নিজের আর মৈথিলীর ক্ষতগুলো দেখায়... মুহূর্তেই মৈথিলীর চোখ জলে ভরে ওঠে, নীরবে একবার ফুঁপিয়ে উঠলেও তা আদ্বানের চোখ এড়ায় না...

আদ্বান : আপনি বোধহয় নিজেকে দোষারোপ করছেন এই ঘটনার জন্য, Specially আমার আঘাতের জন্য... করবেন না Please... বরং চেষ্টা করুন নিজেকে নিজের এই যন্ত্রণা থেকে বের করে আনতে... জীবনটা বড্ড সুন্দর... জীবনটা বাঁচার চেষ্টা করুন...

আদ্বান দেখে মৈথিলী কোনো কথা না বলে শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে... এ যেন আদ্বানের প্রতিচ্ছবি... এদিকে সন্ধ্যে নামছে... আদ্বানকে যেন বলে দিতে হয় না, আজ কতটা ক্ষতবিক্ষত মৈথিলীর অন্তর... আজ ধারালো, শক্ত পাথরে আঘাত পাওয়া তাদের ক্ষত সবাই দেখতে পাবে, হয়তো অনুভবও করতে পারবে কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে... কিন্তু অন্যের মিথ্যে অপবাদের ক্ষত তো কেউ দেখতে পায়না, কিন্তু অন্যের জন্য হৃদয়টা কতটা রক্তাক্ত হতে হতে আজ মৈথিলী একেবারেই ভাষাহীন হয়ে গেছে, সেটা যেন আদ্বান একটু হলেও অনুভব করতে পারছে... আদ্বানের মতো এই অপরিচিতার হাসিখুশি জীবনটাও কারোর জন্য ফিকে হয়ে গেছে... কিন্তু আদ্বান আর মৈথিলী জানে না, সেই মূহুর্তে দরকার একটা বন্ধুত্বের হাত, যার বিশ্বাস আর ভরসার হাত ধরে তারা আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারবে...

আদ্বান : এবার কিন্তু আমাদের ফিরতে হবে...

মৈথিলী : কোথায় ফিরব !!!

আদ্বান : মানে !! যেখান থেকে এসেছিলেন, সেখানে...

মৈথিলী : জানেন, কিছু মানুষ থাকে যারা একটা গোটা আকাশ পেলেও সন্তুষ্ট হতে পারে না, আবার কিছু মানুষ থাকে যারা এক চিলতে মাটিতেই নিজেদের সুখের পৃথিবী খুঁজে পায়... অবশ্য এই অল্পে খুশি হওয়া মানুষগুলোর জীবনে কখনোই ওই এক চিলতে জমিটুকুই জোটে না... তাহলে আমি কোথায় যাব, বলুন তো !!!

আদ্বান : চলুন, আপনার Rest-এর দরকার... আমাকেও তো ফিরতে হবে..

আদ্বানের কথায় মৈথিলীর ঘোর কাটে...

মৈথিলী : আমার জন্য বোধহয় আপনার দুপুরে কিছুই খাওয়া হলো না... আপনি... আপনি আমার সাথে চলুন... আজ আমাদের ওখানে রাখী উৎসব হচ্ছে... আপনি ওখানেই খেয়ে নেবেন...

মৈথিলী উঠতে গেলে মাথার যন্ত্রণাতে আবার দু'হাতে মাথা চেপে বসে যায়...

আদ্বান : দেখুন, আপনি আজ একা পারবেন না... আপনি একটু দাঁড়ান...

গিটারটা পিঠে ঝুলিয়ে মৈথিলীর দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় আদ্বান... মৈথিলী অবাক অপলক চোখে আদ্বানের দিকে তাকিয়ে থাকে... আদ্বান চোখের ইশারায় আবার ওকে হাত ধরতে বললে মৈথিলী কাঁপা কাঁপা হাতে ইতস্ততঃভাবে আদ্বানের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়... আদ্বান এক হাতে ওকে আগলে বাচ্চার মতো চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে,

আদ্বান : আচ্ছা, আপনাদের ওখানে বাঙালি খাবার হবে তো !!!

মৈথিলী : হ্যাঁ...

আদ্বান : পোস্ত হবে !!!

এবার মৈথিলী অনেকদিন পর প্রাণখোলা হাসিতে ভেঙ্গে পরে, হাসতে হাসতেই বলে...

মৈথিলী : ওদের ওখানে হবে কি না, জানি না... তবে আমার কাছে পোস্ত আছে... আমি আপনাকে পোস্তবাটা করে দেব 'খন...

আদ্বান : এই শরীরে !!!

মৈথিলী : পোস্তবাটা করতে আর কতক্ষণ লাগে !! আর আমি বাড়ি থেকে শুকনো পোস্ত Paste করেই এনেছি... শুধু জল, তেল, নুন দিয়ে গুলে দেব... দুধের স্বাদ ঘোলে পাবেন আর কি !! চলবে !!

আদ্বান : আচ্ছা !! আরেএএএ দৌড়বে...

আদ্বান মৈথিলীকে নিয়ে আহনদের মেসে আসতেই সবাই ওদের ঘিরে ধরে... আহন দৌড়ে এসে মৈথিলীকে টেনে কান্নাভেজা গলায় বলতে থাকে,

আহন : কি রে !! তুই না কি বলিস আমরা ভাই বোন !! এই রাখীটাও তো তুই-ই পরালি... তাহলে... সেই যে হঠাৎই বেরিয়ে গেলি, আর পাত্তাই নেই... তারপর এই... এই মাথা ফাটিয়ে এলি...

আদ্বান আহনের কাঁধে হাত রাখে... মৈথিলী যদিও আগেই আদ্বানকে বারন করে দিয়েছিল, আজকের ঘটনা কাউকে বলতে...

আদ্বান : ওনার কিছু তেমন হয় নি... তুমি ভয় পেয় না...

আহন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাই... কিন্তু তোর সাথে আমার বোঝাপড়া বাকি রইলো...

দিব্যা : আচ্ছা, তোর জ্বালায় কি আমরা একটা দিন ভালো করে Enjoy করতে পারব না... কি ভেবেছিস কি তুই !!! তোর জন্য আমার সব Special দিন এইভাবেই Spoil হয়ে যাবে !!!

মৈথিলী : তোর কাজ তো আমি করে দিয়েই গিয়েছিলাম দিব্যা...

দিব্যা : আমার কাজ... My Foot... মনে হচ্ছে না, তোকে ধরে একটা...

নাহহহ... দিব্যার হাত মৈথিলীর গাল অব্দি পৌছায় না... এই প্রথম দিব্যাকে কেউ শক্ত হাতে আটকায়... আদ্বান এমনিতে শান্ত, মার্জিত, পরিণত, উদার মানসিকতার হলেও ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হলে তাকে যে রুদ্রের অবতার বলেই মনে হয়... দিব্যা মেয়ে না হলে হয়তো আদ্বান সেই মূহুর্তে ওর হাতটা মুচড়েই দিত...

আদ্বান : আপনার সাহস কি করে হয় ওনার গায়ে হাত তোলার কথা ভাবার !!! আপনাকে কেউ কখনো শাসন করে নি, তাই না !!! বাধা পান নি কখনো কিছুতেই !!! তাই এইরকম বাঁদর তৈরি হয়েছেন...

আহন : অন্য কারুর কথা ছেড়ে দিন ভাই... আমাদের মৈথিলীই ওকে এই সাহসটা দিয়েছে...

দিব্যা : আর এতক্ষণ ধরে আমি আর দিব্যান্ত যে Tension-টা সহ্য করছিলাম...

আহন : তুই তো বলম পিকচারী নাচছিলিস... টেনশন কোথায় ছিল তোর !! মৈথিকে খুঁজছিলাম তো আমরা, মানে আমি আর দিব্যান্ত...

আদ্বান : দেখুন, আপনি যাই করুন না কেন, তাতেও আপনার এই অধিকারটা জন্মায় না... আর যদি এতই ভালোবাসেন, তাহলে আপনি ওকে হারিয়ে যেতেই দিতেন না...

মৈথিলী : আহন, আমার জন্য ওনার খাওয়া হয়ে ওঠে নি রে... ওনার খিদে পেয়েছে তো... ওনাকে একটু কিছু খেতে দে তোরা... আমি আমার ঘর থেকে পোস্তটা একটু নিয়ে আসি...

আহন : আপনি আমার সাথে আসুন, একটু Fresh হয়ে নেবেন...

আদ্বান : আমি ওনার সাথে যাই, পোস্তটা নিয়ে আসি...

মৈথিলীর PG-তে এলে মৈথিলী আদ্বানকে তোয়ালে দিয়ে বাথরুমে একটু Fresh হতে পাঠায়...

দিব্যান্ত : ছেলেটা কে মৈথি !!!

মৈথিলী : তোদের জানার কি খুব প্রয়োজন আছে !!! তোরা তোদের মতো সময় কাটা না...

দিব্যা : Are you Jealous Deb !!!

হ্যাঁ, আদ্বান আসা অবধি মৈথিলীর সাথে ওকে দেখে দিব্যান্ত-র ভেতরটা জ্বলেই যাচ্ছে... সবচেয়ে খারাপ লাগছে এইটা ভেবে যে, একটা অচেনা ছেলে যেভাবে শক্ত করে মৈথিলীর হাত ধরে ওকে আগলে রেখেছে, ও কোনোদিন দিব্যার সামনে সেই সাহসটা পায় নি... ওদিকে আদ্বান Washroom থেকে বেরোতেই তার কানে আসে, 

দিব্যা : Give me a break Deb... যে ছেলে দিব্যাকে দেখে মুগ্ধ হয় না, সেই ছেলে মৈথিলীকে দেখে পাগল হবে...

আদ্বান : কখনো খুব সকালের মিঠে রোদ্দুর দেখেছেন, যে রোদটা মুখে পড়লেই মনটা একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে ওঠে, ওনার রূপটা ঠিক তেমনই... অমলিন, স্নিগ্ধ, নিজস্বতা আছে তাতে... আপনার মতো ঘষামাজা নয়... আমি এইটুকু সময়ে ওনাকে যতটুকু চিনেছি, উনি নিজের সম্পর্কে অবহিত নন... কিন্তু আপনার ওনার প্রতি এই অবহেলার প্রত্যুত্তর বোধহয় কেউ কোনোদিন দেয় নি... তাই আপনার এত সাহস বেড়েছে...

দিব্যা : আচ্ছা... আপনার সবকিছুই এত গায়ে লাগছে কেন বলুন তো !!! কি সম্পর্ক আপনার ওর সাথে !!!

আদ্বান : মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক... যেটা অমানুষরা ঠিক বুঝবে না...

দিব্যা : What !!! How Rude !!

দিব্যা দিব্যান্তকে টেনে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়... মৈথিলী কিছুক্ষণ ওদের চলে যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে... তারপর দেখে আদ্বান একমনে চুল আঁচড়াচ্ছে... মৈথিলীর চোখে পড়ে আদ্বানের হাতের Bandage-টা Loose হয়ে গেছে... সে আদ্বানের হাত ধরে ওর বিছানায় এসে বসায়... তারপর Bandage করতে করতে বলে,

মৈথিলী : আপনি আমার হয়ে এতগুলো কথা বললেন !!! আমার হয়ে !! মানে আগে আমার হয়ে কেউ কখনো এত কথা বলে নি... তাই আপনিও...

আদ্বান : আচ্ছা, আপনি আপনার কথা কখনো মুখ ফুটে বলেন !! বলেন না... বললে আপনার ওই বান্ধবী এত বাড় বাড়ত না... ওকে আমার হাতে সাতদিন ছেড়ে দিন, মানুষ করে দিতাম ওকে... আপনি কাঁদছেন !!! মৈথিলী !!!

মৈথিলী ভাবতেই পারে নি, তার চোখের জল কারোর চোখে পড়বে.... জলভরা বড় বড় চোখ নিয়ে সে বিহ্বল দৃষ্টিতে একবার আদ্বানের দিকে তাকায়... তারপরেই দ্রুত চোখ মুছে দ্রুত আদ্বানের Bandage করে দিতে দিতে বলে,

মৈথিলী : আপনার খিদে পেয়েছে তো !! চলুন...

আদ্বান : আপনি Fresh হবেন না !!! ওহহহ আমি থাকলে বোধহয় আপনার অসুবিধা হবে তাই না !!!

মৈথিলী : নাহহহ... নাহহহ... আচ্ছা, আমি Fresh হয়ে আসছি...

মৈথিলী Fresh হয়ে এলে আদ্বান ওর কপালের Bandage খুলে দেয়, মৈথিলী একটু চুল ঠিক করে বেঁধে নিলে আবার Bandage বেঁধে দেয়... তারপর ওরা উৎসবে যোগ দেয়... একসাথে খেতে বসে... আদ্বানকে পোস্তর বাটি এগিয়ে দিল শিশুসুলভ সারল্যে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে সে...

আহন : আপনি এখানে পড়েন !!

আদ্বান : না... না... এখানে দিন সাতেকের একটা ছোট্ট Course করতে এসেছিলাম...

আহন : খাবার পর কিন্তু আপনার গান শুনব... গাইবেন তো ভাই !!!

আদ্বান : একদম....

খাওয়ার শেষে চারিদিকে আদ্বানের গানের সুর ভাসে... মৈথিলী মুগ্ধ হয়ে ওর গান শোনে,

একদিন দেখব আলো, আঁধারের শেষ যেখানে

আসবে দখিন বাতাস আকাশের বার্তা নিয়ে

একঝাঁক ইচ্ছে ডানা, যাদের আজ উড়তে মানা

মিলবে তাদের অবাধ স্বাধীনতা

যেখানে তোমার আমার কোন কথা নেই

কথা নেই কোথাও থামার ঠিক নেই ঘরের হদিস

শুধু আছে পথ, কতদূর নেই তা জানা

দুঃখ নেই কিছু সেখানে, নেই সুখ খোঁজবার কোন দায়

প্রয়োজন নেই কারো একা বসে

ভাববার একটু বাঁচার উপায়

কেঁদো না বন্ধু আমার, গাও গান নিয়ম ভাঙার

এ গানের শেষে আছে ভোরের আকাশ....

অবশেষে আসে আদ্বানকে বিদায় জানানোর পালা... অনেকরই আদ্বানকে বিদায় জানাতে চোখ ভিজে যায়... আদ্বান যাবার আগে শুধু মৈথিলীর গালটা টিপে একটু আলতো আদর করে যায়... পথের শেষ বাঁকে আদ্বান একবার পেছন ফিরে মৈথিলীকে দেখে... মৈথিলীও দেখে... তারপর পথের বাঁক বেঁকে যায় জীবনের পথে...

এরপর গল্প এগিয়ে যায় তিন বছর... মাঝে কেটে যায় তিন তিনটে বছর... কেমন আছে মৈথিলী, দিব্যান্ত !!! আর আদ্বান !!! ওদের জীবনে কি ভালোবাসা এসেছে !! না কি জীবন ওদের আরও রুক্ষ্মতার পথে ঠেলে দিয়েছে... ওদের কি মনে আছে একে অপরকে !!! কেমন হবে তিন বছর পরের গল্প !!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance