Anishri's Epilogue

Romance Tragedy

3  

Anishri's Epilogue

Romance Tragedy

উপগমণ

উপগমণ

35 mins
343


(উৎসর্গ : সমাজের অবহেলিত তৃতীয় লিঙ্গ বা Common Gender-দের উদ্দেশ্যে)

"এপারের ভার ঢের হলো জানাশোনা,

ওপারের কিছু হয় নি তো মোর জানা...

হে প্রিয় রাত্রি এসো ঘোরতর গরিমায়,

তুলে নিয়ে যাও অজানা অকূল দরিয়ায়...."

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 

Operation Theatre, Wishywave Hospital :

----------------------------------------------------------------

 

Cardiac Temponade এর এক Case নিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছেন বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত Cardiologist প্রত্যুষ ব্যানার্জী... ওনার Patients-এর Cardiological Problem- এর সাথে Uterine Fibroids- এর সমস্যাও আছে... ডাক পড়ে অন্যতম সফল Gynaecologists দাক্ষ্যায়নী চ্যাটার্জির... বয়স কম হলেও দীর্ঘ বেশ কিছু বছরের Medical Career-এ বহু কঠিন রোগের সমাধান করে এখন মহিলা ধন্বন্তরি সে মানুষের কাছে... আসলে চিকিৎসা করাটা তার রক্তের কণিকায় নিমজ্জিত, কারণটা রোগীর প্রতি তার যত্ন এবং ব্যবহার... সে এতটাই বন্ধু হয়ে ওঠে রোগীর, যে অর্ধেক রোগ সেই বন্ধুত্বেই সেরে যায়... তাই তো প্রত্যুষ মজা করে বলে, Patients-দের 'Lady Crush'... অবশ্য প্রত্যুষ-দাক্ষ্যায়নীর যুগলবন্দী আপাতত চিকিৎসক মহলে বিখ্যাত... সবাই বলে, ওরা একসাথে ছুঁলেই নাকি মৃত মানুষও জীবনের স্পর্শ পায়... এ যেন এক অদ্ভুত দ্বৈত তাল লয় ছন্দ... তাই তো দুজনে মিলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবশেষে সফল হয় তমসা দেবীর প্রাণ বাঁচাতে... সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে...

 

প্রত্যুষ : Congratulations.... We have another Successful Operation....

 

দাক্ষ্যায়নী : Congratulations to all Crew Members of this Operation... Congratulations Dr. Protyush...

 

দাক্ষ্যায়নী আর কথা না বাড়িয়ে O.T. থেকে বেরিয়ে যায়... দাক্ষ্যায়নীর এই ব্যবহার সবার চোখে পড়ে, বিশেষ করে প্রত্যুষের... পায়রার মতো অবিরত বকমবকম করে চলা মেয়েটা ভীষণরকমভাবে চুপ করে গেছে... কারণটা যে একেবারেই প্রত্যুষ জানে না, তা নয়... বরং একটু বেশি মাত্রাতেই বুঝছে ক'দিন ধরে... শুধু মুখে প্রকাশ করতে চায় না কিছুতেই... আর এইটাই সবচেয়ে বড়ো সমস্যা... তাই প্রকাশ্যে মনের ভাব মনেই চেপে রেখে প্রত্যুষ হাসিমুখে সবাইকে বলে,

 

প্রত্যুষ : Close the Operation....

 

 

দাক্ষ্যায়নীর কেবিন :

-------------------------------

 

প্রত্যুষ : আসছি রে পঞ্ছি...

 

দাক্ষ্যায়নী : আয়...

 

প্রত্যুষ : ব্যস্ত আছিস !!!

 

দাক্ষ্যায়নী : নাহহহ... Canteen-এ Dinner করতে যাব...

 

প্রত্যুষ : একা !!!

 

দাক্ষ্যায়নী : হ্যাঁ...

প্রত্যুষ বোঝে, আবহাওয়া সুবিধের নয়... বড্ড শান্ত, ঠিক যেন ঝড়ের পূর্বাভাস... আসলে পঞ্ছিকে ও ছোট্টবেলা থেকে হাতের তালুর মতো চেনে... ওর হাসি, কান্না, প্রত্যেকটা মুখের রেখা সব প্রত্যুষের চেনা ও জানা, কোনটাই অজানা নয়... তাই এই অসময়ে শান্ত হয়ে যাওয়াটা ভীষণ ভাবাচ্ছে তাকে... ভাবে একবার জিজ্ঞাসা করবে, 'কি হয়েছে?' কিন্তু মুখ দেখে আর সাহস হয় না আর তাছাড়া ওর সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই তার... বলা ভালো সেই মুখও নেই... এই নিস্তব্ধতার পেছনের কারণটা আন্দাজ করতে না পারার মত মূর্খ সে নয়... শুধু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই কথাটা বুঝিয়ে বলার মত স্পর্ধা তার নেই... যতই হোক পঞ্ছিই তার সব... তাই যদি ভুল বুঝে সরে যায় ও, এই চিন্তাটা তাকে বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে... এদিকে বাইরে অকাল শ্রাবণ নেমেছে, আর নীরব শ্রাবণে ভিজছে প্রত্যুষ আর দাক্ষ্যায়নীর গোপন ঘর... মনের আড়ালে লুকিয়ে রাখা প্রকোষ্ঠ ছুঁয়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস, দুজনেরই... কত কথা বলার ছিল, কত ঝগড়া, মান অভিমানের পালা এখনও বাকি আছে... তবে তারা এখনও কেন নিশ্চুপ... সত্যিই কি কথা ফুরালো অবশেষে ওদের মাঝে !!! মনে মনে ভাবে দাক্ষ্যায়নী... একসময় দেখা হলেই ফুলঝুরি ফুটতো দুজনের কথার, সেটা পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে হলেও... আজ প্রেম কি তবে বন্ধুত্বকেও হারিয়ে দিল !! অবশ্য প্রত্যাশা তো দাক্ষ্যায়নীর একার ছিল, এখনও আছে... সেটা পূরণের দায় কি প্রত্যুষের ওপর বর্তায় ?? একজন ভালোবাসে মানেই যে অপরজনকেও তার প্রতিপুরণ করতেই হবে, এমন তো কোনো মানে নেই... জীবনটা তার... তাই পচ্ছন্দটাও তার নিজের... এদিকে সে ভাবনায় ডুবে থাকলেও দাক্ষ্যায়নীর চুলগুলো হালকা উড়ছে... প্রত্যুষ আড় চোখে মুগ্ধ হয়ে দেখছে... প্রত্যুষের চোখে তার পঞ্ছি চিরকালই শ্রেষ্ঠ সুন্দরী... ওই লম্বা চুল আর হালকা বাদামি চোখের মণিতে সে বরাবরই আকৃষ্ট... তাই একবার ওর দিকে তাকালে চোখটা সরিয়ে নিতে প্রত্যুষকে সত্যিই একটু বেগ পেতে হয়... হঠাৎই দাক্ষ্যায়নী প্রত্যুষের সামনে ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়... প্রত্যুষের হৃদস্পন্দন তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে... ভালোবাসার মানুষ এভাবে কাছে এলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক... প্রত্যুষের খুব ইচ্ছে করছে তার ভালোবাসার মানুষটাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে... কিন্তু বিধি বাম !! তা যে সম্ভব নয়, ফুলন দেবী যা রেগে আছেন... হয়তো হাতটাই ঝটকায় সরিয়েই দিলো... খুব শান্ত মেয়ে তো আর নয়... এমন সময় দাক্ষ্যায়নীই প্রত্যুষের হাত ধরে একটা খাম ওর হাতে ধরায়...

 

প্রত্যুষ : এটা কি !!

 

দাক্ষ্যায়নী : Resignation Letter...

 

প্রত্যুষ : তুই হসপিটাল ছেড়ে চলে যাচ্ছিস !!! Are you Crazy !!! তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস পঞ্ছি !!! কেন নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছিস !!!

 

দাক্ষ্যায়নী : কোন অধিকারে কাছে থাকব তোর, সায়র !!! কেন তুই বারবার নিজের থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিস !!! কেন প্রকাশ করিস না তোর ভালোবাসা !!

 

প্রত্যুষ : দেখো, আমাদের সম্পর্কটা কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক নয়... আমি ভালোবাসি না তোকে... আমি ভালোবাসতে পারব না তোকে... আর অধিকারের কথা বলছিস, বন্ধুত্বের চেয়ে বড়ো অধিকার আর কি আছে রে !! সব সম্পর্কের উর্ধ্বে শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে ওই তো প্রথম...

 

দাক্ষ্যায়নী : কিন্তু আমি তো তোকে ভালোবাসি... আমার প্রথম ভালোবাসা তুই সায়র, আর অন্তিমও... আমি জানি, তুই না পারছিস নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে, না পারছিস আমার ভালোবাসা গ্রহণ করতে... আর আমিও না তোর কাছ থেকে বারবার প্রত্যাখ্যাত হতে পারছি না.. তাই তোর সামনে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়... তোর ভালোবাসা, তোর স্বত্ত্বা, তোর অস্তিত্বটুকু নিয়ে আমি এই হসপিটাল ছেড়ে চলে যাচ্ছি... আসি রে...

 

প্রত্যুষ : কোথায় যাচ্ছিস তুই !!! এই হসপিটাল ছেড়ে, আম... (ক্ষণিক থেমে যায় প্রত্যুষ)... এই হসপিটালের Director হিসেবে আমি তোর Resignation accept করলাম না...

 

হাত বাড়িয়ে দাক্ষ্যায়নীকে আটকায় প্রত্যুষ... দাক্ষ্যায়নী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রত্যুষের দিকে তাকায়, সেই দৃষ্টি সহ্য করার ক্ষমতা প্রত্যুষের নেই... সে চোখ নামিয়ে নেয়... তারা একদম ছোটোবেলা থেকে বন্ধু... বলা ভালো, প্রত্যুষ-এর একমাত্র বন্ধু দাক্ষ্যায়নী... যখন থেকে প্রত্যুষ নিজের স্বত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে নি, বা বলা ভালো সচেতন হয়ে ওঠার মতো বোধ আসে নি- সেই তখন থেকে দাক্ষ্যায়নী তার বন্ধু... দাক্ষ্যায়নী বরাবরই খুব ডাকাবুকো, তেজদীপ্ত চরিত্রের... একটু বোধ হবার পর থেকে প্রত্যুষকে কেউ আঘাত করলে সবসময়ই দাক্ষ্যায়নীই ঝাঁপিয়ে পড়ত প্রতিবাদ করতে... ধীরে ধীরে তারা একে অপরের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যেন দুটি শরীরের এক অবিচ্ছেদ্য আত্মা... সময়ের সাথে সাথে বসন্ত আসে তাদের জীবনে ভালোবাসার রঙ নিয়ে.... ততদিনে সমাজ প্রত্যুষকে তার স্বত্ত্বা সম্পর্কে অবহিত করে দিয়েছে... তাই তার হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনে স্পন্দিত হওয়া দাক্ষ্যায়নীর থেকে নিজেকে অবিরত আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রত্যুষ... কিন্তু দাক্ষ্যায়নী তো দাক্ষ্যায়নী... সার্থকনামা... স্বয়ং নটরাজ যার জেদের কাছে হার স্বীকার করেছে, সেখানে এই তুচ্ছ সমাজ কি করবে !!!

 

দাক্ষ্যায়নী : তুই কি ভাবছিস, তুই এইভাবে আমাকে আটকাতে পারবি !!!

 

প্রত্যুষ : পাগলের মতো কথা বলিস না পঞ্ছি... এই হসপিটালের Vision-টা তোর ছিল- Long Lasting and Trust Based Relationship.. তুই চেয়েছিলিস Cardiology Department আর Gynaecology Department একসাথে মিলে কাজ করুক... তুই বুঝিয়েছিলিস, এই দেশের মেয়েরা underdiagnosed আর undertreated... Pregnancy, Menopause, PCOS-এ মেয়েরা শুধুই Gynaecologist-এর কাছেই যায়... তুই চাস নি, Preeclampsia-র রোগীরা Gynaecologist-এর সাথে সাথে Cardiologist-কেও দেখাক... তুই চাস নি, Pregnancy আর Menopause-এর সময় মেয়েদের Cardiovascular Risk Factors-টাও Evaluated হোক !!! এই হাসপাতালটা Cardiology আর Gynaecology মধ্যে একটা Bridge গড়ে তোলার জন্যই এই হসপিটালটা আমি আর তুই তৈরি করেছিলাম... Please... থেকে যা না !!!

 

দাক্ষ্যায়নী : শুধু এইটুকুর জন্যই তুই আমাকে আটকে রাখতে চাইছিস !!! এই ভূ-ভারতে আমার থেকেও অনেক ভালো ডক্টর তুই পেয়ে যাবি... কিন্তু আমি আর এই হসপিটালে থাকব না...

 

কথাগুলো বলেই দাক্ষ্যায়নী প্রত্যুষকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়...

 

প্রত্যুষ : তোকে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না রে পঞ্ছি... আর আজীবন তোর নিষ্পাপ মুখটা আর মায়াভরা চোখ দুটো অচেনা ঘোরে টানতে থাকবে... তাই স্পর্শ ছাড়াই তোকে আমি আজীবন অনুভব করে যাব.... কিন্তু আমার জীবনের সাথে তোর জীবন আমি কখনোই মেলাতে পারব না... ক্ষমা করিস আমাকে... ক্ষ...

 

          দা... ক্ষ্যা... য়... নী...   ম্যা... ম....

 

Hall, Wishywave Hospital

-----------------------------------------

বাইরে মেট্রণের চিৎকারে বাইরে বেরিয়ে প্রত্যুষ দেখে দাক্ষ্যায়নী সিঁড়ি থেকে পিছলে পড়ে মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে... ওই অবস্থায় দাক্ষ্যায়নীকে দেখে মূহুর্তের জন্য যেন প্রত্যুষের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায়... তারপর দৌড়ে উপর থেকে নেমে দাক্ষ্যায়নীকে নিজের কোলে তুলে নেয়...

প্রত্যুষ : পঞ্ছি... পঞ্ছি... চোখ খোল... কি হলো তোর !!! পড়ে গেলি কি করে !!! কপালটা কতটা কেটে গেছে !! Stracher... Stracher....

প্রত্যুষের কেবিন (প্রায় ১২ঘন্টা পর) :

--------------------------------------------------

প্রায় ১২ঘন্টা পর জ্ঞান ফেরে দাক্ষ্যায়নীর... চোখ মেলে দেখে দেখে প্রত্যুষ তার দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে... প্রত্যুষের থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে... প্রত্যুষ দাক্ষ্যায়নীর মাথায় হাত রাখে... ঈষৎ জড়ানো আর ক্লান্ত গলায় সে বলে ওঠে,

দাক্ষ্যায়নী : চিন... চিন্তা করছিলিস !!!

প্রত্যুষ : দুশ্চিন্তা...

দাক্ষ্যায়নী : কে... কেন !!

প্রত্যুষ : কেন মানে !!! প্রায় ১২ঘন্টা পর তোর জ্ঞান ফিরলো... আর আমি চিন্তা করব না !!! কপালে কতগুলো Stitch পড়েছে, জানিস !!! ডান পা-টা ভেঙ্গে গেছে... সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলি কি করে !!! পা পিছলে !!

দাক্ষ্যায়নী : আমা... আমার বাড়ি... বাড়িতে জানে !! কেউ এসেছে !!!

প্রত্যুষ : নাহহহ... খবর দেওয়া হয়েছে... কিন্তু...

দাক্ষ্যায়নী : আআ... আসবে না....

প্রত্যুষ : এর জন্যও তো তুই-ই দায়ী পঞ্ছি... তুই যদি আমার প্রতি তোর অনুভূতির কথাটা বাড়িতে না জানাতিস, তাহলে তো ওনারা তোকে ত্যাজ্য করতো না...

দাক্ষ্যায়নী : আমার... আমার কপালটা দেবী সতীর থেকেও খারাপ জানিস তো সায়র... সতী.. সতীর পাশে তো তাও ওনার ভালোবাসা, মহাদেব ছিলো... কিন্তু আমার পাশে !!!

প্রত্যুষ দাক্ষ্যায়নীর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখে... দাক্ষ্যায়নী চাইলেও প্রত্যুষকে সরাতে পারছে না... মুখে স্বীকার না করে আজীবন প্রত্যুষের অন্তর তো নীরবে শুধু আর শুধুমাত্র দাক্ষ্যায়নীকেই চেয়ে এসেছে... আজ জীবনে প্রথমবার দাক্ষ্যায়নীকে জড়িয়ে ধরে এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে, শান্তিতে ভরে গেল প্রত্যুষের মন প্রাণ... ভালোবাসার অনুভূতি বোধহয় এমনই হয়, প্রিয়জন কাছে এলে এক স্বর্গীয় শান্তিতে ভরে যায় মন-প্রাণ... প্রত্যুষ শত চেষ্টা করেও পারে নি দাক্ষ্যায়নীকে নিজের থেকে দূরে সরাতে... দাক্ষ্যায়নীর বন্ধুত্ব, ভালোবাসা তাকে প্রতি মূহুর্তে চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে আগলে রাখে... গোটা কেবিন জুড়ে তখন দুই ভালোবাসার মানুষের নীরব কান্না গুঞ্জরিত হতে থাকে...

প্রত্যুষ : কেন তুই বুঝিস না, আমি চাই না আমার জন্য তোর সারা জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক... তুই সবটা জানিস... আমার স্বত্বার সবটা জানিস তুই... আমার অন্তর্নিহিত পুরুষ স্বত্বা অনুভব করে তুই হরমোন treatment করালি... তবুও আমি তোকে কখনোই স্ত্রীর সুখ দিতে পারব না, পারব না সন্তান সুখ দিতে... তুই কত সুন্দর, কত স্নিগ্ধ, কত নির্মল !! আমি যে কত কষ্টে তোকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখি তুই বুঝিস !!! সবাই নিজের মনের কথা বলতে পারে.. আমি আমার মনের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারি না, বোঝাতে পারি না...

দাক্ষ্যায়নী মুখ ঘোরায় প্রত্যুষের দিকে... আজ প্রথমবার প্রত্যুষ এত কাছ থেকে দাক্ষ্যায়নীকে দেখছে... প্রত্যুষ দাক্ষ্যায়নীর কপালে হাত বুলিয়ে দেয়... দাক্ষ্যায়নীও নিবিড় গভীর চোখে প্রত্যুষকে দেখতে থাকে... প্রত্যুষ যেন আর নিজের মধ্যে থাকতে পারে না, তার সব অনুভূতি সমস্ত বাঁধার আগল খুলে দেয়... প্রত্যুষ দাক্ষ্যায়নীর কপালে আলতো করে তার প্রথম ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়... সাথে সাথে দাক্ষ্যায়নীর সারা শরীর কেঁপে ওঠে, দাক্ষ্যায়নীর চোখের কোলে অভিমানের অশ্রু জন্মে.... প্রত্যুষ দেখে এক জোড়া কোমল চোখ ভালোবাসার আকাঙ্খা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে... পরম আদরে প্রত্যুষ মুখ ডোবায় দাক্ষ্যায়নীর গলায়, দাক্ষ্যায়নী প্রত্যুষকে ভালোবাসার ডোরে জড়িয়ে ধরে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে...

প্রত্যুষ : ভালোবাসি... ভালোবাসি.... তোকেই ভালোবাসি... তোকে ছেড়ে থাকার সাধ্য আমার নেই, কারন তোকে আমি আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি... তোকে ধরে রাখার কোনো উপায় আমার কাছে জানা নেই, কারণ বাস্তবতার কাছে আমি বড়ই অসহায়...

দাক্ষ্যায়নী : সব শর্ত, সব প্রতিজ্ঞার উর্ধ্বে একটু স্বপ্ন ছুঁয়ে থাকার বাসনায় একগুচ্ছ মনখারাপের মেঘ থেকে বেরিয়ে আসা বিদ্যুতের আলোয় স্নান করে নতুনভাবে মুখোমুখি দুটি হৃদয় যদি কথা বলে, তাই তো 'ভালোবাসা'...

দাক্ষ্যায়নীর শরীরের উষ্ণতা যেন প্রত্যুষের বুকের স্পন্দন শতগুন বাড়িয়ে দেয়... না পারছে না... প্রত্যুষ আর পারছে না... প্রত্যুষ দাক্ষ্যায়নীর থেকে আর দূরে সরে যেতে পারছে না... প্রত্যুষের অধর ডুব দেয় দাক্ষ্যায়নীর অধর পল্লবে... আদরে, সোহাগে প্রত্যুষ ভরিয়ে দিতে থাকে দাক্ষ্যায়নীকে... আর দু'জনের চোখ দিয়েই ঝরতে থাকে আনন্দাশ্রু... এই অশ্রু এত বছরের ভালোবাসার ফল, এই অশ্রু ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ...

পরের দিন ভোর :

------------------------

প্রত্যুষের হাত আঁকড়ে ধরে দাক্ষ্যায়নী তখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছে... ওষুধের প্রভাবে গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন দাক্ষ্যায়নী... প্রত্যুষ সারারাত দাক্ষ্যায়নীর পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে দাক্ষ্যায়নীর মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে বসেছিল...এমনসময় মেট্রণ দাক্ষ্যায়নীর Report নিয়ে ঘরে ঢোকে... প্রত্যুষ খুব যত্নে দাক্ষ্যায়নীর ঘুম না ভাঙিয়ে দাক্ষ্যায়নীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ওর Report-টা হাতে নেয়... দাক্ষ্যায়নীর Echocardiogram হয়ে গেছে... প্রত্যুষের মুখে উদ্বেগের মেঘ জমেছে... তার কারনও আছে অবশ্য... দাক্ষ্যায়নীর প্রায় 75% heart blockage আছে, যেটা Severe Coronary Artery Disease-এর লক্ষণ... খুব তাড়াতাড়ি surgery করতে হবে, কিন্তু এই অবস্থায় অপারেট করাটাও ভীষণ Risk-এর... প্রত্যুষ দাক্ষ্যায়নীর মাথায় হাত রাখে... কত বছর সে দাক্ষ্যায়নীকে নিজের থেকে সযত্নে দূরে রাখতে চেয়েছিল... কিন্তু দাক্ষ্যায়নী তার ভালোবাসার আঁচল সরিয়ে বন্ধুত্বের বাঁধন ছেড়ে কোথাও কখনো যায় নি... আজ সেই অবহেলাকে ভ্রূকূটি করেই যেন মৃত্যু এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে... প্রত্যয়ে কঠিন হয় প্রত্যুষ-এর মুখ...

প্রত্যুষ : মেট্রণ, যখন দাক্ষ্যায়নী অজ্ঞান হয় আপনি দেখেছিলেন ওকে !!! ও কি পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল !!

মেট্রণ : নাহহহ স্যার, সিঁড়ি থেকে নামার সময় উনি প্রথমে একবার টলে গেলেন... তারপর সম্ভবতঃ মাথা ঘুরে গিয়েছিল ওনার...

প্রত্যুষ : হুমমম... সেটাই স্বাভাবিক... ও Heart-এ oxygen flow কম হয়ে যাবার দরুন Drowsiness, Senseless হয়ে যাচ্ছে... মেট্রণ ওকে একটু খেয়াল রাখবেন... ভীষন শান্ত মেয়ে তো... দেখবেন যেন এদিক ওদিক কোথাও Ward Visit-এ না বেরিয়ে যায়...

মেট্রণ : Okkk Sir....

সকালবেলা :

--------------------

কপালে একটা কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভাঙে দাক্ষ্যায়নীর... গোটা মুখে ছড়িয়ে পড়ে মিঠে রোদ্দুরের মতো এক ফালি হাসি... চোখ বন্ধ করেই বলে ওঠে,

দাক্ষ্যায়নী : মিষ্টি মা, তুমি খবর পেয়ে গেছো !!!

ধরিত্রী : কি রকম বিপদ ঘটালি, বল তো পঞ্ছি !!!

চোখ খুলেই দাক্ষ্যায়নী দেখে ধরিত্রীর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে... ধরিত্রীর হাতটা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে রিনরিনিয়ে হেসে উঠে বলে,

দাক্ষ্যায়নী : ও কি তোমার চোখের কোলে জল কেন মিষ্টি মা !!! আরে আমার শুধু কপাল ফেটেছে আর পা ভেঙেছে... মরে যাই নি আমি....

ধরিত্রী : (আৎকে উঠে) প.... ন.... ছি....

দাক্ষ্যায়নী : আরে ভয় পেও না... তোমার ওই লাডলার কাঁধ থেকে এই শাকচুন্নি এত তাড়াতাড়ি না... নামবে না...

কথাগুলো বলতে বলতে দাক্ষ্যায়নী একটু হাঁপিয়ে ওঠে... প্রত্যুষ বারবার ধরিত্রীকে বারন করে দিয়েছে যেন দাক্ষ্যায়নীকে তার রোগের খবর জানানো না হয়... খুব কম বয়সে ধরিত্রীর স্বামী প্রভাত চলে যাবার পর থেকে এই দুটো ছেলে-মেয়েকে আঁকড়ে ধরেই তিনি বেঁচে আছেন... তার মুখচোরা ছেলের তো এই দস্যি মেয়েটা ছাড়া কোনো বন্ধুই ছিল না... একদিন তার ছেলেকে ভালোবেসে এই মেয়ে ঘর থেকে ত্যাজ্য হলো...

ধরিত্রী দেবী তাকে বুকে টেনে নিলেন, তার স্নেহের ছায়ায় আশ্রয় দিল... মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়... প্রত্যুষ বড় হবার পর একা একা শুতে তার বুকটা বড় খালি খালি লাগতো... এখন মেয়েটার গায়ের গন্ধ না পেলে তার ঠিক ঘুম আসে না... মেয়েটা তার বুকের ওমে ঘুমিয়ে পড়লে একটা অদ্ভুত শান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন... দুষ্টু হাসিভরা মুখে দাক্ষ্যায়নীর গলার স্বরে ওনার স্মৃতির জাল ছিন্ন হলো,

দাক্ষ্যায়নী : দেখছো মিষ্টি মা... কেমন... কেমন বয়েস হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে !! একটু কথা বলতেই হাঁপিয়ে উঠছি... ধরো...

ধরিত্রী : অ্যাঁআআআআআ... কি করবি তুই !!

দাক্ষ্যায়নী : ওই Wheel Chair-টায় বসে একটু Visit-এ বেরবো...

ধরিত্রী : তুই কি ভুলে যাচ্ছিস পঞ্ছি আমি সায়রের মা, সায়র নই !!

দাক্ষ্যায়নী : (আদুরে গলায়) আর তুমিও কেন ভুলে যাচ্ছ যে তুমি ডক্টর ধরিত্রী ব্যানার্জী !!!! আমার শিক্ষাগুরু... শোনো না মিষ্টি মা, কাল একটা অপারেশন করেছি Uterine Fibroids-এর... চলো না একবার দু'জনে মিলে একবার দেখে আসি ওনাকে... দেখো, তুমি Retire করলেও তোমার মতো Gynaecologists এই শহরে আর কতজন আছেন বলো !! তুমি তো আমাকে সবকিছু হাতে ধরে শিখিয়েছো... চলো না মিষ্টি মা... Please....

তমসার কেবিন :

---------------------------

দাক্ষ্যায়নী : Good Morning Mam... কেমন আছেন আপনি !!!

তমসা : ভা... এ কি !! আপনি ডক্টর ধরিত্রী ব্যানার্জী না !!!

ধরিত্রী : তমসা !!! কেমন আছেন এখন !!!

তমসা : আজো মনে পড়ে সেই দিনের কথা, মনে হয় এই তো কালকের কথা... আপনি আমাকে বেডে দিলেন... একটু আগেই আমার একমাত্র মৃত সন্তানের জন্ম হয়েছিল...

ধরিত্রী : হ্যাঁ, সেদিন অপারেশনের পর চোখে-মুখে একটু জল দিয়েই আপনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নার্সকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে এসে বসলাম নিজের চেম্বারে... সামনে যে একপ্রস্থ যুদ্ধ বাকি... আপনার স্বামী জানতে চাইলেন- 'ওটা কি !!' আপনার স্বামীকে জানালাম, আপনাদের প্রথম সন্তান তৃতীয় লিঙ্গের... কথাটা শুনেই ঘেন্নায় মুখটা তিক্ত হয়ে উঠল ওনার... মূহুর্তের মধ্যেই উনি কেমন যেন সেই ক্ষণিকের অতিথি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়লেন... বন্ধ করে দিলেন সব বোধের আগল... হতভাগিনী অসহায় সেই মাকে জানানো হলো মৃত সন্তানের জন্মের কথা....

তমসা : মানে !! আমার সন্তান জীবিত ছিল !! O.T. তে আচ্ছন্ন অবস্থায় আমি ওর কান্না শুনেছিলাম, বিশ্বাস করুন... ওর ভাগ্যাকাশের কান্না কি আর কেউ শুনতে পায় নি !!! শুধু না নর, না নারী- তৃতীয় লিঙ্গ বলে !!

ধরিত্রী : জানেন, আপনার স্বামীকে আমি সেদিন জানালাম আরো এক নিদারুণ সত্যি কথা- 'আপনি আর কোনোদিনও মা হতে পারবেন না'...

তমসা : কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল সে !!! তাকে রক্ষা করতে পারলাম না বলেই হয়তো ভগবান আমার কাছ থেকে আমার মা হবার অধিকারটা কেড়ে নিল... একদিন শিউলি ভেজা শরতের নীল-সাদা আকাশের বর্ষা শেষে ছুটি পাওয়া পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলোকে ভীষণ ভালোবাসতাম... কিন্তু অকাল কালবৈশাখীর ঝড়ঝঞ্ছায় আমার জীবনটা ঢেকে গেল, সেটা আমার জীবনে আগত ক্ষণিকের ওই ছোট্ট প্রাণটাকে হারানোর অব্যক্ত যন্ত্রণায়... মনের না বলতে পারা কথাগুলোই চিরকাল চোখের জল হয়ে বয়ে গেল... আচ্ছা... আচ্ছা, আপনি জানেন- কোথায় আছে সে !!!

ধরিত্রী : সন্তানের সাহচর্চে আমাদের জীবন তখনও পূর্ণ হয় নি... আপনার স্বামী আমাকে জানিয়ে দিলেন, ওকে কোনো আস্তাকুড়ে ফেলে দিতে... আমি পারি নি... নিষ্পাপ ওইটুকু দুধের শিশু কি জানে সমাজের বিধানের মারপ্যাচ... তখনো মায়ের বুকের ওম না পেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল... আমি কোলে নিতেই আমার বুকের ওমে কি নিশ্চিতে ঘুমিয়ে পড়লো... গোটা হাত দিয়ে শুধুমাত্র আমার একটা আঙুল জড়িয়ে ধরে... আমি ওকে কোলে নিয়েই আমার স্বামী Cardiologist প্রভাত ব্যানার্জীকে ফোন করি... উনি তখন Conference-এ ঢুকছিলেন... ওনাকে জানাই, আমি একটি তৃতীয় লিঙ্গের সন্তান Adopt করতে চাই... উনি আমাকে জানান, ওনার ফিরতে এক সপ্তাহ লাগবে , আর তারমধ্যে আমি যেন Adoption-এর Primary Formality-গুলো করে ওকে বাড়ি নিয়ে আসি...

তমসা : উনি একেবারেই মেনে নিয়েছিলেন !!!

ধরিত্রী : ফোন রাখার আগে উনি বলেন, উনি আমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে ধন্য...

তমসা : আর সমাজ !!! আপনাদের পরিবার !!!

ধরিত্রী : প্রভাতের বাবা মা উত্তরাধিকারী না পাবার জন্য বরাবরই আমাকেই দায়ী করে এসেছেন... কিন্তু সমস্যাটা ছিল প্রভাতের... প্রভাত বহুবার চেয়েছিল, সত্যিটা সামনে আনতে, আমি চাই নি কেউ ওকে নিচু চোখে দেখুক... প্রভাতের বাবা মা মেনে নিলো না... তাদের মতে, 'আধুনিক হওয়া মানে একটা হিজড়ে সন্তানকে বড় করা নয়... নিজের জন্ম দেওয়া বাবা-মা যাকে ঘেন্নায় ফেলে দিল, তাকে তোরা কি করে কোলে তুলে নিলি !!!'

প্রভাত পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, 'ওর বাবা-মা ওকে সামান্য কিছু জীবনকোষ দিয়েছে, আর আমরা দেব প্রাণের দিশা ... আমরা এই নতুন জন্মানো ফুলকে আমাদের সন্তান হিসেবেই মানুষ করব... আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ও হবে এই সমাজের বুকে এক নতুন প্রতিবাদ... শুধু অর্ধনারীশ্বর হিসেবে প্রকৃতি আর পুরুষকে পূজো করলেই হয় না, তাকে আপন করে নেবার দক্ষতাও রাখতে হয়... না হলে সেই পূজো শুধু 'ভন্ডামি' হয়েই থেকে যায়... তোমরা মানলে ভালো... না হলে...'

সমাজ মেনে নিতে অপারগ, পরিবারও... সেইদিনই দুই পরিবারই আমাদের ত্যাজ্য করলো... যদিও আমাদের পাঠানো টাকা নিতে তাদের কখনোই আটকায় নি...প্রতিবেশীরা আড়ালে আবডালে নানান কটু কথা বলতে শুরু করলো...

কিন্তু সময় থেমে থাকে না, জীবন থমকে যায় না... ছোট্ট প্রাণটার আধো আধো আওয়াজে আমাদের জীবন রামধনুর সাত রঙে সেজে উঠলো... নতুন করে বাঁচার তাগিদ যুগিয়ে রাতের পরে ভোরের উষা হয়ে আমাদের জীবনে এলো - 'প্রত্যুষ' ...

শুরু হলো আমাদের লড়াই- সমানাধিকারের পরিসর হতে বহু দূরের অধিবাসী 'না নর, না নারী' সেই ছোট্ট প্রাণটাকে সামাজিক পরিচিতি দেবার... সেই ছোট্ট প্রাণ হয়ে উঠলো আমার আকাশ, আমার মুক্তি, আমার আলো... ছোটবেলায় তাকে প্রথম শেখালাম রবি ঠাকুরের গান, আমাদের জীবনের গান....

আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,

আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥

দেহ মনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে,

গানের সুরে আমার মুক্তি উর্ধ্বে ভাসে॥

আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,

দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে।

বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা, আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা

জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি আসে॥

তমসা : ওকে ওর জীবনের ধ্রুব সত্যটা কি করে বললেন !!

ধরিত্রী : বলেছিলাম- 'তুমি 'না নারী, না পুরুষ', তুমি হলে 'তুমি', তুমি হলে 'নিজস্বতা', তুমি হলে 'স্বতন্ত্রতা', তুমি হলে 'সত্ত্বা, উপলব্ধি'...

তমসা : ওর বড় হবার আরো গল্প বলুন না !!! ওর পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব...

দাক্ষ্যায়নী : স্কুলেও ওকে একটু আলাদা করেই রাখা হতো... স্কুল থেকে কলেজ, ওর তেমন বন্ধু ছিল না, হয়তো বা ও হতেও চায় নি... এটাও যেমন সত্যি, তেমনই এটাও বাস্তব যে ওর সাথে সবাইকে মিশতে দেওয়া হতো না... সেখানেও সরিয়ে দেবার, ফেলে দেবার চক্রান্ত চলতো অহরহ... তবে পড়াশোনায় ভীষণ ভালো... বরাবরই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চোখের মনি ছিল ও... তবে বন্ধু না থাকায় ওর তেমন অসুবিধা হয় নি, ও নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত... আপন খেয়াল নিজেকে বারবার ভাঙতো, নিজের স্বত্বাকে নতুন করে গড়ার আঙ্গিকে...

ধরিত্রী : বন্ধু ছিল না বলা ভুল হবে... প্রত্যুষের জন্য স্বর্গের পারিজাত ধরায় অবতীর্ণ হয়েছে- প্রত্যুষের একমাত্র আত্মার বন্ধু- এই দাক্ষ্যায়নী... ও প্রত্যুষের জীবনে এলো বিধাতার আর্শীবাদ হয়ে, ওর স্বপ্নপূরণের রূপকার হয়ে... সমাজ, পরিবার ওকেও ত্যাজ্য করেছে... কিন্তু ও দমে নি... বরং আরো শক্ত করে ধরেছে প্রত্যুষের হাত... প্রত্যুষের পুরুষ স্বত্ত্বা উপলব্ধি করে ওর চিকিৎসা করিয়েছে... প্রত্যুষের প্রত্যেক পদক্ষেপে শক্তি হয়ে ওর পাশে থেকেছে....

তমসা : আপনারা আমার প্রণাম নেবেন... আপনাদের অন্তর আত্মা যে হিমালয়ের থেকে উঁচু.... আপনাদের ছায়ায় কি আমার একটুও ঠাঁই হবে না... আমার যে ওই সন্তান ছাড়া আর কেউ নেই !!!

দাক্ষ্যায়নী এতক্ষণ মন দিয়ে ওদের কথা শুনছিল... হঠাৎই বুকে একটা চাপ অনুভব করে... দম নিতে কষ্ট শুরু হয় ওর... সামনের সবকিছুই অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে... ওদের কথার ছন্দ নষ্ট করতে চায় না দাক্ষ্যায়নী... Wheel Chairটা কোনোক্রমে ঠেলে কেবিনের বাইরে আসে সে... কষ্টটা তীব্রতর হচ্ছে... দুটো চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো...

নেপথ্যে : কি রে !! তুই নিজের কেবিন ছেড়ে এখানে কি করছিস !!!

প্রত্যুষের গলা পেয়ে আৎকে ওঠে দাক্ষ্যায়নী... আজকে আর বকা খাওয়া থেকে তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না... প্রত্যুষ দাক্ষ্যায়নীর সামনে এগিয়ে আসে,

প্রত্যুষ : পঞ্ছি, কথাটা আমি তোকে বল... (আৎকে উঠে, মৈথিলীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওকে দু'হাতে শক্ত করে ধরে) এ কিইই !!! কি রে !!! শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তোর !!! তুই আমার একটা কথা শুনিস না...

ধরিত্রী : পঞ্ছি, ওইভাবে বেরিয়ে এলি কেন রে মা !!! এ কিইইই !!! কি হয়েছে সায়র ওর !!!

প্রত্যুষ : আমি তোমাকে বারণ করেছিলাম মা... ওকে এত মাথায় তুলো না... ও শুধু মাথায় বেড়েছে, নইলে এতটুকু বড় হয় নি ও...

দাক্ষ্যায়নী : সা... সায়র...

প্রত্যুষ : (ধমক দিয়ে) চুপ... পচা মেয়ে একটা... Stretcher...

একমাস পর

~~~~~~~~~

ICU :

--------

তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে।

আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে।।

আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমনির হারে,

বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে।।

সেদিন ছিলো পয়লা শ্রাবণ... বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে, সাথে ভারী বৃষ্টি, যে বর্ষার বারিধারা নেমেছে আজ কারোর অন্তরেও... দাক্ষ্যায়নী... আপাত চঞ্চল, ছটফটে প্রাণপ্রাচুর্য্যে পরিপূর্ণ নারীটি আজ নিশ্চুপ, শব্দরা যেন ছুটি ঘোষণা করেছে... এক নিরন্তর ভাঙ্গা গড়ার কাজ চলছে মননের জীবন দরিয়ায় আর সেই ভাঙনের সাক্ষী হতে চলেছে দাক্ষায়নী নিজে... জীবন এক অদ্ভূত প্রহসনে নামিয়েছে তাকে... মন চাইছে না এতদিনের স্বপ্নভঙ্গ করে দূর দেশে পাড়ি দিতে, কিন্তু শরীর ?? সে যে সংগ্রাম ঘোষণা করেছে.. তাই তো যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিরতি চাইছে... মুক্তি, সব টানাপোড়েন, দ্বিধাদ্বন্দ থেকে চিরকালীন মুক্তি... কারোর কাছে নিজেকে প্রমাণ করার নেই, কারোর ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেকে নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে ধ্বংস রচনা করার নেই... এ যেন এক অপার শান্তি... শুধু একটাই পিছুটান- ওই মানুষগুলো, যারা ভালোমন্দে, আপদে-বিপদে পাশে থেকেছে, ভেঙে পড়া অন্তরাত্মাকে প্রতিনিয়ত সাহস যুগিয়েছে উঠে দাঁড়ানোর... কিন্তু তাও এত লড়াই যার জন্য, সেই মানুষটা কি পাশে এসে দাঁড়াল !!! কাছে আছে, আগলে রেখেছে... দিনরাত্রি এক করে দাক্ষ্যায়নীর সেবা করে চলেছে, কখনো প্রকাশ্যে বা কখন চোখের অগোচরে... এইটাও হয়তো নরনারীর সম্পর্কের এক ভিন্ন রূপ... কিন্তু কিছু সময় ভালোবাসার প্রকাশটা জরুরি, বিপরীতের মানুষটার জন্য... বলা যায় না, একটা 'ভালোবাসি' হয়তো অনেককিছু বদলে দিল... হতাশাকে রূপান্তরিত করলো লাগামহীন ইচ্ছেডানায় আর ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবতে চলা একজন মানুষ খোঁজ পেলো একটা বৈঠার যাকে শক্ত করে ধরে অনেকটা লম্বা পথ পাড়ি দিতে পারে... বহু এলোমেলো ভাবনা আজ দাক্ষায়নীর মনটা আচ্ছাদিত করে রেখেছে যেন ভেবেই কুল পাচ্ছে না... এর শুরু আছে কিন্তু কোনো শেষ নেই... এমনসময় প্রত্যুষ আসে, সাথে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ, আর দাক্ষ্যায়নীর প্রিয় ফুল... বাইরের ঝড়ের থেকেও তীব্র ঝড় বইছে তার মনের ভেতর... প্রথমবার একটা অপরাধবোধ যেন কুরে কুরে খাচ্ছে, মনে হচ্ছে আজ পঞ্ছির এই শারীরিক অবস্থার জন্য সেও কিছুটা দায়ী... মনের কথাটা খুলে ওই বলতে চায়, শুধু ভয় লাগে... মেয়েটা এমনিতেই নিজের পরিজনদের বিরাগ ভাজন হয়েছে, পরিবার তাকে পরিত্যাগ করেছে... নিজের জন্মদাতা বাবা মা তাজ্যপূত্রী করেছে... এখন প্রত্যুষ জীবনের সাথে পাকাপাকিভাবে জড়িয়ে গেলে ওর যদি আরো বড় কোনো ক্ষতি হয় !!! সেটা প্রত্যুষ কিছুতেই মানতে পারবে না.. ও জানে পঞ্ছী ভীষণ জেদি, একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে তখন ওকে আবার নিজের জীবনের মূল স্রোতে ফেরানো সত্যিই বড়ই কষ্টের... প্রত্যুষ নিজেই তো ওই মেয়েটাকে প্রত্যাখ্যান করার কষ্টটা সহ্য করতে পারে না... কাছে টেনে নিতে চায়... কিন্তু মন আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ে প্রতিবার মস্তিষ্কই জেতে... এইটাই যে প্রত্যুষর হার, বিরাট বড় হার... কিন্তু ওই যে কিছু সময় নিজেকে হারতে হয় প্রিয়জনের মঙ্গলের জন্য... সমাজ হয়তো বোকা আর স্বার্থপর... সব আখ্যাই দিয়ে দেয় কিন্তু সবটাই তো বাহ্যিক... অন্তরটা আর পড়ে দেখে ক'জন... এই আকাশপাতাল ভাবনার মাঝেই লক্ষ্য করে দাক্ষ্যায়নী ওর দিকেই আকুল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, যা ভিতর ভিতর কাঁপিয়ে দিচ্ছে প্রতুষকেও... কিন্তু যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকতেই হবে ওকে এখন... কারণ কাল পঞ্ছির অপারেশন... প্রত্যুষ যতই রোগের তীব্রতা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, ও তো নিজেও জানে যে পঞ্ছি নিজেও একজন ডাক্তার... তাকে সবটা খুলে না বললেও সত্যিটা বোঝার এবং মুখোমুখি হাওয়ার ক্ষমতা দুই দাক্ষ্যায়নীর আছে... শুধু নেই প্রত্যুষের নিজের... নিজের ভালোবাসাকে অপারেশন টেবিলে শুয়ে থাকতে দেখা এবং তার ওপর ছুরি কাঁচি চালানোর মতো মানসিক দৃঢ়তা সত্যিই এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও তার নেই... আর ইতিমধ্যেই ওর শারীরিক অবস্থার বিগত সাতদিন বেশ অবনতি ঘটেছে, তাই তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রত্যুষ...

দাক্ষ্যায়নী যতই হোক, মেয়ের জাত তো... তাই মনের কষ্ট লুকিয়ে মুখে অভিমানী হাসি এঁকে নেয়... নাহ !!নিজেকে দুর্বল দেখাবে না কিছুতেই... এক ফোঁটা চোখের জলও পড়তে দেবে না মাটিতে... কারণ, সত্যিটা দাক্ষ্যায়নী নিজেই জানে... তাই শেষ সময়ে এসে দুর্বল করে দিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে জিততে চায় না সে... হেরে যাওয়া মানুষই থাকতে চায় বরাবর... এইটাই হয় তো ভাগ্য !! এইটুকু সময়ই হাতে ছিল প্রাণ খুলে বাঁচার জন্য, নিজের ডাক্তার হয়ে স্বপ্ন পূরণের জন্য... শুধু একটা আপসোস রইলো, তার পরিবার তাকে বুঝলো না... আর তো কয়েকটা মুহূর্ত, চলেই তো যাবে তার পরিবারকে মুক্তি দিয়ে... এই শেষ মুহূর্তটুকু কি তারা উপহার দিতে পারতো না তাকে !! হিসেব নিকেষটা একটু কম করে লাভক্ষতিটা না হয় একটু কমই দেখতো... সম্পর্কের ব্যবসায় বিরাট কিছু ক্ষতি হতো না বোধ হয় !! কিন্তু ওই যে কপাল !! তাকে কে খন্ডাবে ?? তাই প্রত্যুষও চোখের জল খুব কষ্টে আটকে রাখলো... এরপর কিছুক্ষণ দুজনের মাঝে গহীন, গভীর নীরবতা আর নিস্তব্ধতা... বড্ড দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে দু'জনেই... একটু ভালোবাসার কাঙাল মেয়েটা কাঙ্খিত ভালোবাসা পেয়েও তাকে ছুঁতে পারে নি কখনো, তার ভালোবাসার মানুষটা চিরটাকাল তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল... যদিও তারই ভালো থাকার জন্য... তবে আজ দাক্ষায়নীকে দেখে প্রত্যুষের মন যেন আচমকাই যুদ্ধ করতে শুরু করেছে তার যুক্তিবুদ্ধির সঙ্গে, ভেঙে ফেলতে চাইছে তার এতদিনের বাঁধাবাঁধন, ভাঙতে চাইছে কুসংস্কার... ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, এগিয়ে যেতে, যদি খুব দেরি হয়ে যায়... আর যদি কোনোদিন সুযোগ না পেয়ে ওঠে মনের কথাটা বলার... তাই আজ সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দাক্ষ্যায়নীর সব চাওয়া পূর্ণ করবে... সে-ও দাক্ষ্যায়নীকেই নিজের সব সত্ত্বা উজার করে দিয়েই ভালোবেসেছিল... কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে নি কখনো !! আজও কথা শুরু করতে পারছে না, কি করে বলবে দাক্ষ্যায়নীকে ওর শারীরিক অবস্থার কথা, অপারেশনের কথা !!! যদিও বরাবরের মতো দাক্ষ্যায়নীই এক গাল হেসে চোখ বড় বড় করে কথা শুরু করে... যদিও খুব থেমে থেমে...

দাক্ষ্যায়নী : বাব্বা !!! কি... কি হয়েছে রে তোর !!! Acidity !!!

প্রত্যুষ : আহহহ পঞ্ছি... সবসময়ই মজা ভালো লাগে না !!!

দাক্ষ্যায়নী : মজা !!! মজা করলাম আমি !! তোর তাই মনে হলো !! আচ্ছা বল, তুই নিজে Normal কখন থাকিস !!! অবশ্য এখন তোর ব্যাপারই আলাদা... দেবকী মা, যশোদা মা- দু'জনেরই আদর পাচ্ছিস... তার উপর ঘরে একটা ছোট্ট পুচকি এসেছে... পঞ্ছির কথা এখন তোর কেন মনে থাকবে বল !!!

প্রত্যুষ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেডে শুয়ে থাকা দাক্ষ্যায়নীকে... যেন অনুভব নয়, নিজের শরীরে ধারণ করে আত্মস্থ করতে চাইছে তার ভালোবাসাকে, নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে... যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে, আর ফিরে পাবে না কখনো... কোনোদিন... দাক্ষ্যায়নীর চোখের পাতা ভিজে আসে... প্রাণ ভরে আস্বাদ গ্রহণ করে এই আলিঙ্গনস্পর্শের... কারণ সে জানে তার দিন ফুরিয়ে আসছে... তাই প্রতিটা মুহূর্ত এখন 'বেঁচে' থাকাটা জরুরি, যতটা রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ সহযোগে প্রতিটা ক্ষণ উদযাপন করা যায়... আর হয়তো সুযোগ পাবে না এইভাবে জড়িয়ে ধরার, আর হয়তো চেষ্টা করলেও আঁকড়ে ধরতে পারবে না এই মানুষটাকে... জীবন যে কেন এমন উপহাস করলো তার সাথে ?? 'মৃত্যু'-কে কিনা প্রহরী হতে পাঠিয়ে দিল !!আরেকটু বাঁচলে কি বা ক্ষতি হতো !! একটু বেশিদিন না হয় হেসে খেলে থাকতো !! একটু বেশিদিন না হয় দৈনন্দিন রোজনামোচায় ক্লান্ত হতো !! তাও তো নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে পাশে পেত !! তাদের তো হারাতে হতো না !! নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে ফেলতেই দাক্ষ্যায়নী প্রত্যুষের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

দাক্ষ্যায়নী : নিঝুম কেমন আছে রে !!!

প্রত্যুষ : ঘুমাচ্ছে !!! কিন্তু তুই আর একটাও কথা বলবি না !! তোর সাহস দিন দিন বাড়ছে !! কোনো কথা শুনিস না তুই !! আচ্ছা তুই কেন এটা করতে গেলি, সেটা আমায় একবার বোঝাবি ?? আমি তো তোকে O.T. করতে বারণ করেছিলাম, তাহলে !!

দাক্ষ্যায়নী : (ক্লান্ত ম্লান হেসে) কি করতাম বল !! আমার এই ক্ষয়িষ্ণু শরীর আর দুটো জীবনের মধ্যে কাকে বাছতাম !!! তার মধ্যে একজন তো পৃথিবীর আলোই দেখে নি... আমি তো ডক্টর, ওদের প্রয়োজনীয়তাটা কি করে উপেক্ষা করতাম বল !!! কি করে সরে থাকতে পারতাম !!! কিন্তু তখনও অত ধকল হয় নি জানিস... সবচেয়ে বেশি কষ্ট হলো তো তখন, যখন নিঝুমের বাবা ওকে কিছুতেই মানলো না... কত বোঝালাম জানিস !!কিন্তু বোঝার চেষ্টাই করলো না !! মানুষ আজকাল পোশাক, সাজগোজ আর বড় বড় বক্তৃতা- এতেই আধুনিক হয়েছে শুধু... কোনোরকম উন্নতি হয় নি শুধু মানসিকতাতেই, যেটা বেশি জরুরি ছিল আজকের নিরিখে... আজকাল আমরা ঘর বাহির দুই নিপুণ হাতে সামলাই, যতটা ভালো রান্না করতে পারি ততটাই ভালো Presentation-ও দিতে পারি... কিন্তু মানুষ আমাদের ওই কন্যা ভ্রূণ আর রান্না ঘর, আঁতুড় ঘরের বাইরে ভাবতেই পারলো না... এইটাই এই সমাজের ব্যর্থতা, যা সমাজ কোনোদিন মানতেই পারলো না... যে ফাঁপা জায়গা তাকে শুধুমাত্র বাইরের সাজসজ্জা, কিছু মেকি হাসি আর অতিরঞ্জিত কথাবার্তা দিয়ে ঢেকে রাখে... ভয় হয় জানিস !! যদি কোনোদিন এই মিথ্যে আবরণটা সরে যায়, তবে এ সমাজ মুখ লুকোবে কার কাছে !!কোনো নারী আদৌও বাঁচবে তো এই লজ্জা গ্রহণ করে এদের শান্তনা প্রদানের জন্য !!! কারণ সব কুঁড়ি তো অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যাচ্ছে !! তাহলে আর পড়ে থাকবে কে !! বলা যায় না, সমাজ তাই লোলচর্মহীন কঙ্কালে পরিণত হয়ে গেলো !! তাই তো এত বোঝানো সত্বেও একটা কথা শুনলো না, শুধু মেয়ে বলে ত্যাগ করে গেলো !! বুঝলো না, কোনো নারী তাকে জন্ম না দিলে আজ তিনি কোথায় থাকতেন !! সেটা অনুভব করতে পারলে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের কন্যাকে বিসর্জন দিতে পারতেন না !! তাই তো, কি করতাম বল ওই একরত্তিকে নিয়ে !! ওর তো কোনো দোষ নেই !! ও তো উপলক্ষ্য মাত্র..তাতে আমাদের দোষটা তো কিছু কমে যায় না... আমরা দায়িত্ব নিতে পারি নি... তাই মানুষ সত্যিই অক্ষম..সবাই বলে না, আমাদের সমাজ না কি এগিয়ে গেছে !!! এই এগিয়ে যাওয়ার নমুনা, সায়র !!!

প্রত্যুষ : জানি না... জানি না আমি... তুই এত কথা বলিস না... কাল তোর অপারেশন...

দাক্ষ্যায়নী : আমায় বলতে দে সায়র... আর যদি বলার সুযোগ না পাই...

দাক্ষ্যায়নীর কাছ থেকে সরে গিয়ে ধমক লাগায়, জল ভরা চোখেও যেন আগুনের দীপ্তি...

প্রত্যুষ : পঞ্ছিইইই... কি বলছিস তুই !!!

আর আজ যেন সত্যিই দাক্ষ্যায়নীকে কথায় পেয়েছে... চুপ করতেই পারছে না... ও যে... ও যে আর অল্প সময়ের অতিথি... সেটা কথা বলতে বলতে ওর বারবার মনে পড়ছিল... কিন্তু সত্যিটা মনে পড়লেও পাত্তা দিতে চায় নি... মনে না হয় নাই বা করল.. সত্যি বোধহয় এইরকমই নিষ্ঠুর হয় সবসময়, না চাইতেও শাস্তি দিতে চায়... তাই দাক্ষ্যায়নী বলতে শুরু করে আবার,

দাক্ষ্যায়নী : চুপ করে থাকিস না !! বল না সায়র !!! আমরা কতটুকু এগিয়েছি !!! তোর ভালো মা, কতটা কষ্ট সহ্য করেছেন সারাটা জীবন ধরে... আচ্ছা, মহাভারতে রাজা দ্রুপদ তো তার তিন লিঙ্গের সন্তানকেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন, তাহলে আজ আমরা পারি না কেন !!! কন্যাসন্তান বা তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানকে কেন মেনে নিতে এত সমস্যা হয় আমাদের এই আধুনিক সমাজের !!! তাহলে আমাদের আধুনিকতা কি শুধুই বাহ্যিক !!! মানসিকতা এখন অন্ধকারেই রয়ে গেছে !!

প্রত্যুষ : ছোটবেলায় আমার জন্মদাত্রী মায়ের উপর খুব অভিমান হতো জানিস... কেমন করে ফেলে চলে গিয়েছিল আমাকে !! না হয় আমি আর পাঁচজনের মতো নই... তবুও কেন ছেড়ে চলে যাবে... তারপর মা আর তোর কাছে সবটা শোনার পর ওনাকে গ্রহণ করতে, ওনাকে জড়িয়ে ধরে আগলে নিতে আমার এতটুকু দ্বিধাবোধ হয় নি, জানিস...

দাক্ষ্যায়নী : আমাদের সমাজ এখনও শুধু বাহ্যিক শরীরটুকুই দেখে রে... কেউ তোর এই মনটা দেখতে পায় না... তোদের লিঙ্গটুকুই তো শুধু ভিন্ন, ঠিক যেমন নারী আর পুরুষ ভিন্ন... মানুষ আজ ডিগ্রীধারী শিক্ষিত হয়েছে, কিন্তু চিন্তাভাবনা সেই 'লিঙ্গ' পরিচয়েই আটকে আছে... সে নারী হোক বা পুরুষ আর এই তৃতীয় লিঙ্গের 'তোদের' কথা তো ছেড়েই দিলাম... তবে রূঢ় হলেও সত্যিইটা কি জানিস, এই সমাজ তোদের লিঙ্গ পরিচয় ভেদে ভিন্ন করে রাখে, সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়... কিন্তু রাতের অন্ধকারে বা দিনের গভীরে তোদের ভোগ করে শয্যাসঙ্গী বা সঙ্গিনী হিসেবে পেতে এতটুকুও কুণ্ঠা বোধ করেনা... আসলে শরীরের তো লিঙ্গ হয় না... শরীর তো শুধুই রক্তমাংসের দলা, ঠিক নারীর মতো... নারী যেমন স্তন, নিতম্ব আর ঊরুসহ যৌন ভোগ্যবস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়...

কিন্তু অন্তর আর কেউ দেখে না তোদের বা আমাদের..আমি...আমি... আমি খুব ভাগ্যবতী ছিলাম জানিস, তাই বোধহয় সুখটা সহ্য হলো না...

প্রত্যুষ : এইভাবে বলিস না পঞ্ছি... ভালোবাসা কাকে বলে !! ভালোবাসায় মানুষ কি কি করতে পারে !! ভালোবাসায় কেউ ঠিক কতটা ত্যাগ করতে পারে !!!এই... এইসব আমি... আমি তোর কাছ থেকে জেনেছি... আমাকে ভালোবাসা অনুভব করিয়েছিলিস তুই... দুটো প্রাণের, দুটো আত্মার, দুটো অন্তরের মিলন বুঝিয়ে ছিলিস তুই... বাইরের আঘাত থেকে আড়াল করার জন্য দুটো প্রাণের প্রেমবন্ধনে এক সুন্দর অপরূপ মায়া-মোহ ভালোবাসা ভরা স্বপ্ন রাজ্য রচনা করেছিলিস তুই, যেখান শুধু আর শুধু ভালোবাসা ভরা নরম অনুভূতিরা থাকত... যেখানে বাইরের কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা, কোনো ঠুনকো নিয়ম, কোনো ঘৃণা আমাকে স্পর্শ করতো না... আজ তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব পঞ্ছি !!! বল ??

দাক্ষ্যায়নী : আমাদের মেয়েকে নিয়ে... আমাদের 'নিঝুম'... পারবি না ওকে বড় করতে !!!

প্রত্যুষ : নাহহ... পঞ্ছিকে ছাড়া সায়র কিচ্ছু পারে না...

দাক্ষ্যায়নী : পাগল... ঈশ্বরের তৈরি পৃথিবীতে তিনি কোনো লিঙ্গ নিয়ে পার্থক্য তৈরি করেন নি... তোকে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করবে তোর ভেতরের আগুন, তোকে দেওয়া মিষ্টি মায়ের শিক্ষা... তোর আত্মার বিশুদ্ধতার আলোয় তুই সব ঋণাত্মক চিন্তণ আর মনণের কালো মুছে দিবি... মুছে দিবি সব বিভেদ... সমাজ আমাদের পুরুষ, স্ত্রী বা 'ছক্কা' হিসেবে চিনবে না, চিনবে মানুষ হিসেবে... সম্মান দেবে মানব ধর্মের আর মনে রাখিস কোনো ঋণাত্মক শক্তি যেন তোকে দমাতে না পারে কোনোদিন... এই সমাজের বিষাক্ত তীব্র কালো অন্ধকার চিরে তোর মননের মানবতার আলো সকল অবজ্ঞা, অবহেলা, উপহাসের বুকে নব চিন্তণের নব অঙ্কুর রূপে যেন উদ্ভাসিত হয়... যে আলোয় অর্ধনারীশ্বরকে আরতি করা হয়, সেই অপার্থিব আলোয় সকল লিঙ্গের বৈষম্যবিহীন এক নতুন পৃথিবীর অগ্রদূত হবি তুই... একদিন এই রাতের অমানিশা কেটে নতুন ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তুই রেখে যাবি জগৎ সভায় একটাই পরিচয়- সফল মানুষের বিশ্বজয়ের পরিচয়...

এবার একটু শ্বাসকষ্ট বাড়ে দাক্ষ্যায়নীর... প্রত্যুষের হাতটা একটু শক্ত করেই আঁকড়ে ধরে খুব কষ্টে দম নিতে থাকে সে....

প্রত্যুষ : আমাকে একটা Injection দিতে দে... Relief পাবি তুই...

দাক্ষ্যায়নী : (জোরে জোরে দম নিতে নিতে) নাহহহ... এম... এমনিতেই আমার... সম... সময় ফুরিয়ে আসছে... এখ... এখন আমি ঘুমাবো না... মূহুর্তরা এই স্বল্প... স্বল্প সময়ের ঘেরাটোপেই বাঁচে সায়র... ভালোবাসার মৃত্যু হয় না রে... ভালোবাসা প্রতি মূহুর্তে নতুন করে জন্ম নেয়... সা... সায়র...

প্রত্যুষ : তুই Please এত কথা বলিস না... ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোর... তুই এত বড়ো ডাক্তার হয়ে একটা ইনজেকশন নিতে ভয় পাচ্ছিস... তুই কি এখনও ছোট আছিস পঞ্ছি !!! আমরা এখন একটা মিষ্টি মেয়ের 'বাবা মা'... তুই কি সেটা ভুলে গেলি ??

দাক্ষ্যায়নী : সা... সায়র !!! তুই কি বললি !! আম.. আমরা বাবা মা !!! আমি.. আমিও মা !! হে, ভগবান !! আরেকটু সময় কেন আমায় দিলে না ঈশ্বর !! কেন এতো তাড়াতাড়ি ডাক পাঠালে আমায় তোমার কাছে যাবার জন্য... এখন যে আমি আবার লোভী হয়ে পড়ছি একটু একটু করে, সকলকে নিয়ে বাঁচার লোভ... তোকে আর নিঝুমকে নিয়ে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা... জানলার বাইরের ওই... ওই কদম গাছটা দেখ... এত্ত সুন্দর গাছটা... গাছটা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে... একটা হাল্কা মিষ্টি গন্ধে কেমন সুরভিত হয়ে উঠেছে চারপাশ... বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল... আর... আর হয়তো একসাথে আমাদের দেখা হবে না...

প্রত্যুষ : পঞ্ছিইইই...

দাক্ষ্যায়নী : তুই হেরে যাবি না তো সায়র... কাল যদি আমি না থাকি, আমি... আমি তোর মধ্যে বেঁচে থাকব... তোর ভালোবাসার মধ্যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবি তো সায়র !!! আমাদের মেয়ে, আমাদের নিঝুমকে আমাদের মতো করে বড় করে তুলবি তো !!! প্রমাণ করবি তো, ভালোবাসা হারালে জীবন থমকে থাকে না... বরং ভালোবাসাকে অন্তরে অনুভব করে আরো গভীরভাবে একসাথে বাঁচা যায়... বল... কথা দে... নইলে... নইলে যে আমি... আমি মরেও শান্তি পাব না...


প্রত্যুষ : আর আমি এইভাবে সবকিছু শেষ হতে দেব না... তুই আমার হাতটা ছাড়... জানিস তো লোকে বলে, ভালোবাসা নাকি পদ্মপাতায় টলটল করা জলের বিন্দু... এই আছে এই নেই... কিন্তু আমার কাছে ভালোবাসা গোলাপের মতো... সঠিকভাবে যত্ন না করলে কাঁটার আঘাতে রক্তাক্ত হতে পারো আর সেই ক্ষতটুকু যদি হাসি মুখে সহ্য করে নাও, তবে অনুভব করবে এক অপার সৌন্দর্য... তাই একসময় তোর ভালোবাসাকে গ্রহণ না করে তোকে যে কষ্ট আমি দিয়েছি প্রকাশ্যে, তার কষ্টও আমি দ্বিগুণ পেয়েছি জানিস... আমি যে তোকে খুব ভালোবাসি পঞ্ছি... তুই ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই বল... কে আমার Leg Pull করবে তুই ছাড়া !! কে আমায় ঠিকমতো খাবার না খেলে বকা দেবে ?? বেশি কাজ করলে হাত ধরে টেনে নিয়ে কফি খেতে নিয়ে যাবে !! কে মন দিয়ে আমার সব কথা শুনবে !! আমি কষ্ট পেলে কাকে জড়িয়ে ধরবো এমন করে !!! বল না পঞ্ছি !! তুই তো সব জানিস !! আমি কেমন !! তুই তো জানিস সারাদিনের কথা তোকে না বলতে পারলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না..তবে আজ তুই স্বার্থপরের মত চলে যাবি কি করে !!হবে না... সেটা কিছুতেই হবে না... তোকে থাকতেই হবে আমার সঙ্গে !! থাকতেই হবে !! নয়তো সারা.. জী.. বন.. জীবনের ম.. তো.. ও.. ও.. আ... আ... ড়ি... ই.. ই...

বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে প্রত্যুষ, ঠিক যেন ছোট্ট শিশু... 'কিছুতেই যেতে দেবে না কোথাও' -বলে হাতের আঙ্গুলটা চেপে ধরে আছে...

দাক্ষ্যায়নী : কোথা থেকে দু'কুলপ্লাবী জল এসেছে সায়র... আমি... আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে... জলের তোড়ে নিঃ... নিঃশ্বাস নিতে পারছি না... এবার... এবার স্রোতের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে ভেসে যেতে হবে রে... তুই কিন্তু ভেঙে পরবি না একদম... ম... ম... জান... ন... বি... ই... তোর পঞ্ছি তোর সাথে... ই... থা.. ক... ক... বে.. এ.. এ... চির.. ও.. ও.. কা.. ল.. ল....

প্রত্যুষ : (কান্না ভেজা গলায়) চুপ কর... একদম চুপ কর... কিচ্ছু হবে না তোর... একটাবার আমায় ছাড়... চেষ্টা করতে দে আমায়... Please... আমায় হারিয়ে দিস না... Please...


দাক্ষ্যায়নী : আমার একটা শেষ ইচ্ছে রাখ... খ... বি... ই... সা... য়... ও... র... র... তোর স্পর... শ... শ... ও এঁ...ক... কে... এ... দি... বি... ই... ইই... আম... আ.. য়.. য়... তো... র.. র... ছোঁ... য়া... আ... আ... টু... কু... উ... উ... থ... আ... আ... ক... ক...

প্রত্যুষ আর পারে না না... অঝোরধারায় ভেঙে পড়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় সবচেয়ে প্রিয় নারীর ঠোঁটে... শুষে নিতে চায় সব কষ্টও... হারিয়ে যেতে চায় ভালোবাসার মানুষের মাঝে... আগলে রেখে দিতে চায় নিজের বুকের মাঝে... সময়ও যেন থমকে দাঁড়িয়েছে... জলভরা চোখে প্রত্যক্ষ করেছে 'শেষ চুম্বন'... ধরে রাখতে চেয়েছে সময়টুকু... যতক্ষণ দুটো মানুষকে বেঁধে রাখা যায়... ছেড়ে দিলেই তো চলে যাবে আর ফিরবে না কোনো দিন... সায়রের পঞ্ছি আর প্রত্যুষের দাক্ষ্যায়নী... দাক্ষ্যায়নী এবার নিশ্চিন্ত, জীবন তাকে পূর্ণতা দিয়েছে... আর কোনো আক্ষেপ নেই জীবনে, সায়র থাকলো তো নিঝুমের জন্য... ঠিক দেখে রাখবে তাদের আত্মজাকে... শুধু ভয় একটাই, নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে তো তার সায়র !! যদিও সময় একদিন ভুলিয়ে দেবে সবকিছু...


দাক্ষায়নী: (মনে মনে) ভালো থাকিস রে সায়র... খুব ভালো থাকিস...


হঠাৎ করেই হেঁচকি ওঠে দাক্ষ্যায়নীর... Convulsion শুরু হয়... প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে সে... এবার প্রত্যুষ দাক্ষ্যায়নীর হাতটা শক্ত করে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে মেট্রণকে ডাকে... দাক্ষ্যায়নী নিজের বেড-এ তীব্র convulsion-এ অসহায়ভাবে কাতরাচ্ছে... প্রত্যুষ নিজেই দাক্ষ্যায়নীকে Oxygen Musk পরিয়ে Ventilation Start করে... কিন্তু ওর Convulsions কমে না... দুই চোখ দিয়ে জল অবিরত জল গড়াচ্ছে দাক্ষ্যায়নীর... কিছুক্ষণ পর একটু Stable হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে... মানসিক ঝড়গুলো অতিক্রম করতে করতে দাক্ষ্যায়নী ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যায়... ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশের সব কিছু... কোনো অদৃশ্য মানুষের মুখ ভেসে ওঠে, যে হাত বাড়িয়ে বলছে, 'আয়.. আয়.. আর দেরি কিসের !! আমরা যে অপেক্ষা করছি... স্বর্গধামে স্বাগত'... দাক্ষ্যায়নীর দুই চোখ বেয়ে অবিরত জল গড়াতে থাকে আর আপ্রাণ চেষ্টা করে তাদের বুঝিয়ে দিতে যে সে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চায় না... এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, নিজের প্রিয়জনদের ছেড়ে সে থাকতে পারবে না, সে চলে যেতে চায় না... কিন্তু তার আকুলতা শোনার জন্য যে আর কেউ অবশিষ্ট নেই... তাই যেতে যে এবার হবেই, অন্য জগতের সবাই যে অপেক্ষারত... এরপর হঠাৎই রাতভোরে কাতরভাবে ডাকে পাশে বসে থাকা প্রত্যুষকে....

দাক্ষ্যায়নী : সা... সা... সায়... র....


প্রত্যুষ : (ব্যস্ত হয়ে) বল... জল খাবি !


কথা বলতে খুব কষ্ট হয় দাক্ষ্যায়নীর... তাও জীবনের অন্তিমক্ষণে তোতাপাখির মতো সর্বক্ষণ বকে চলা মেয়েটা শেষবারের মতো উচ্চারণ করে যায় কিছু শব্দ...


দাক্ষ্যায়নী : তো... তোর... সাআআ থেএএ... বাআআ... বাআআ কিইইই... পপপপ থথথটা... আআআআ ররর... চ... চলা... হহহহ লোওওও... নাআআআ... ভা...ল... থ... আ... কি... স... সা.. য়.. র..

বলেই কষ্ট করে একটু হাসি ছুঁয়ে যায় ঠোঁটের কোণায়, যাতে পঞ্ছির সায়র সারাজীবন ওর হাসি মুখটুকুই মনে রাখে... আর কিছু নয়... ধীরে ধীরে প্রত্যুষের হাতের মুঠি আলগা হয়ে যায়... তারপরে নিঃস্তব্ধ হয়ে যায় দাক্ষ্যায়নী... ICU-র বেড নম্বর ২০-র মনিটরে এতক্ষণ এঁকেবেঁকে থমকে থমকে চলতে থাকা লাইনগুলো হঠাৎই সরলরেখায় পরিণত হয়ে গেল... Cardiac Monitor-এর বিপ বিপ শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল, কেবল বন্ধ হলো না Ventilation-এর ফোঁস ফোঁস শব্দটা... প্রত্যুষ অনুভব করে চিরটাকাল তাকে ভালোবাসার ওমে আগলে রাখা মানুষটার হাত ধীরে ধীরে শীতল হতে শুরু করেছে....


                   পঞ্ছি... ইই.. ই.. ই..

প্রত্যুষের গগনভেদি চিৎকার শোনা যায় একবার... তারপর সব চুপ...

কথায় বলে আত্মা অবিনশ্বর... সমস্ত পিছুটান, ষড়রিপুকে অতিক্রম করে সে এই নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করেছে... কিন্তু যাওয়া মানে কি শুধুই যাওয়া ?? কাছে আসা নয়... জীবিত থাকাকালীন মানুষ অর্থ, বৈভব, যশ, প্রতিপত্তির সন্ধান চালিয়ে যায় নিরন্তর... এই যে মানুষগুলো চলে যায়, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে কি !!সঙ্গে করে নিয়ে যায় কিছু !!! তবে কিসের এই দম্ভ !!কিসের অহংকার !! মানুষ যেদিন পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করে সেইদিনও সে একা ছিল আর আজ যখন যাবার বেলা এগিয়ে এসেছে তখন যেতেও হবে সেই একাই... তাও সমগ্র মানব জাতি সম্পর্কের অবহেলা করে... নষ্ট করে অবহেলায়, তিক্ততায়... যখন যত্ন করতে যাওয়ার সময় হয়, তখন হয় তো তার অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে গেছে... তাই জীবন পথের বাঁকে বাঁকে অপেক্ষা করে নিঃসঙ্গতা... গ্রাস করে একাকিত্ব...

কেমন চুপ করে শান্ত মেয়ে হয়ে শুয়ে আছে সায়রের আদরের পঞ্ছি... মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়তো মেয়েটা... এই আকাশ থেকে ওই আকাশে... নিজে বাঁধনহীন সাহসী ছিল বলেই তো সকলকে ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধে রাখতো... দেখো এখন কেমন সত্যিই মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে চলে গেলো !! তবে সত্যিই কি ছিন্ন করলো !!! না কি বেঁধে দিয়ে গেলো সবাইকে একই সূত্রে... এই তো ওর পরিবার এসে দাঁড়িয়েছে... শোকে মূহ্যমান তারাও.. একদিন যে মেয়েটার মুখটাই দেখতে চাইনি, আজ তাকেই কোল ছেড়ে যেতে দিচ্ছে না... আর পঞ্ছির মিষ্টি মা !! সে যে একপ্রকার পাথর হয়ে গেছে... শুধু ওপরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো... এবং সায়র !! সে তো ওই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে ঝগড়া করছে নীরবে তার পঞ্ছির সঙ্গে,


প্রত্যুষ : এইভাবে খেলার শেষ দান না দিয়ে পালিয়ে গেলি তো... চিটিং করলি... আমি কিন্তু আর তোকে খেলায় নেবো না.. যা, বাজে মেয়ে কোথাকার !! যেদিন দেখা হবে দেখিস, একটা কথাও আর বলবো না.. আড়ি.. আড়ি... আড়ি.... জন্মের আড়ি...

সময় বয়ে যায়... শুধু আর ফিরে আসে না সেই মানুষগুলো, যাদের হয়তো এত দ্রুত যাওয়ার তাড়া ছিল না... দাক্ষ্যায়নী চলে যাবার পর প্রত্যুষের মনের রিক্ততা ছুঁতে আর কেউ আসে নি... কেউ পায় নি প্রত্যুষের অস্তিত্বের খোঁজ... এক আকাশসম বিষন্নতা নিয়ে রোজ প্রত্যুষ রিক্ত হয়... সব ঠিক ছিল, ঠিক থাকারও কথা ছিল হয়তো... তবু থমকে গেল... মূহুর্তরা চলে যায়... আস্তে আস্তে শোক তাপ সয়ে যায় মানুষ... ওপরের ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে ভেতরের জ্বালা মেটাতে চায়... ধীরে ধীরে আজ যে মানুষটা আছি, গতকাল ছিল... সেই আগামীকাল নেই হয়ে স্মৃতির পাতায় ঠাই নেয়.. . বহু মুহুর্ত ভর করে আসে মনে....স্মৃতি সতত মধুর, তবে তাতে তিক্ততারও কিছু উপকার আছে... নয়তো মাধুর্য নির্ধারিত হয় না যে... রক্তমাংসের শরীরটা পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়... পড়ে থাকে সেই মানুষটার কথা তথা কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি... আর একটু একটু করে সেই সবকিছুকে গুছিয়ে নিয়ে সাথে করে বাকি পথ হাঁটে তাদের প্রিয়জন... ভাবে সাথেই তো আছে শুধু শারীরিক উপস্থিতিটাই নেই... আর সাথে কিছু অবুঝ কথকতার স্মৃতিচারণ, ডায়েরীর অসমাপ্ত ছন্দহীন বর্ণের কাটাকুটি জানান দেয় একাকীত্ব... হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রত্যুষ, পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায় স্মৃতির দল... মনে করায়,

এভাবে শেষ হওয়ার তো কথা ছিল না, তবে কেন !!! উত্তর নেই যে... তাই জানা হয় না


'সায়র,


যত দিনে এই চিরকুটটা তুই হাতে পাবি ততদিনে আমার সাথে তোর লক্ষ যোজন দূরত্ব বেড়ে গেছে... তুই হয়তো তোর সব কাজে আমায় চাইবি... কিন্তু দুঃখ একটাই, আমি আর তোর কাছে আসতে পারবো না... আমি যে কয়েকটা দিনের অতিথি হয়ে ছিলাম শুধু... তবে এই অতি ক্ষুদ্র জীবনে যদি কিছু পূণ্য করে থাকি, তার ফলস্বরূপ তোকে পেয়েছিলাম... কিন্তু সেই সঙ্গসুখ বেশি দিন উপলব্ধি করার মতো ভাগ্য যে আমার নেই... যাই হোক, নিজের কথা ছেড়ে কাজের কথায় আসি.. শোন, আমি তোর কাছে না থাকলেও পাশে যে থাকবো সর্বদা... তাই কড়া নজর থাকবে কিন্তু তোর ওপর... খেলি কি না, ঘুমোলি কি না, নিজের যত্ন নিচ্ছিস কি না... আর ঠিক মত ডাক্তারিটা করিস কিন্তু... আমাদের স্বপ্নের হাসপাতালটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে... সবটা কিন্তু তোর হাতে থাকবে তখন... আর... আর আমার মেয়েটার খেয়াল রাখবি সব সময়... আমি নেই বলে দুঃখে বিবাগী হয়ে গেলি, এমনটা যদি দেখি না ভূত হয়ে ঘাড় মটকাবো তোর- এই বলে রাখলাম... নিজের কাজের বাইরে সংসারের কাজ তো কিছুই শিখলি না, তাই ডাইরিটায় সব লিখে রাখলাম... নিঝুমকে মানুষ করার নিয়মাবলি... সাথে তোর নিজের দৈনন্দিন রুটিনটাও, যেটা একদিন আমি নিজেই বানিয়ে দিয়েছিলাম তোকে... মনে রাখিস, তুই কিন্তু আমাদের মেয়ের বাবা এবং মা দুটোই... আমার জন্য কষ্ট পেয়ে ওর প্রতি দায়িত্বটা অবহেলা করিস না... Please Sayor... দেখবি যে বন্ধুত্বটা তুই আজ হারিয়ে যাচ্ছে বলে কষ্ট পাচ্ছিস, সেইটা দ্বিগুণ ফেরত পাবি সুদে আসলে... নিঝুম বড়ো হলে দেখবি, কোনো একদিন তোর পঞ্ছি এসে তোর কন্যা রূপে তোর সামনে দাঁড়িয়েছে... আমি ওর মধ্যে বেঁচে থাকবো... একদিন আমার মেয়েই পাখির মতো স্বাধীন মানুষ হয়ে পরাধীনতার শিকল কেটে মুক্তি দেবে সবাইকে... আমি হয়ে... সেদিন সবাই বলবে, দাক্ষ্যায়নী ফিরে এসেছে... দেখিস, ওই দিন তোর গর্বে বুকটা ফুলে ওঠবে... ভালো থাকার চেষ্টাটুকু করিস প্রত্যুষ... দুই মাকে দেখে রাখিস... মিষ্টি মাকে বলিস, তার পঞ্ছি ভালো আছে... আর নিঝুম, সবসময় জানবি তোর মাম্মাই তোকে দেখছে ওই দূর আকাশের তারা হয়ে... মনখারাপ হলে আকাশের দিকে তাকাবি... দেখবি আমায় দেখতে পাবি... জ্বলজ্বল করছি সবার মাঝে... আর সায়র, I will really miss you a lot... অপেক্ষায় থাকলাম... এবার যে যেতেই হবে... আসি তাহলে... টা টা...

                                                     ইতি,

                                                           তোর পঞ্ছি'


প্রত্যুষের গায়ে চাঁদর টেনে দিয়ে বুকের উপর রাখা ডায়েরিটা টেবিলে রেখে চোখের চশমা খুলে কপালে স্নেহের পরশ দেয় নিঝুম... আজ সে Gynaecologists অপাবৃতা ব্যানার্জী... এই ডাইরির চিরকুটটা সে বহুবার পড়েছে... বলা ভালো, এর প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা অক্ষর তার চেনা... কিন্তু প্রতিবারই যখনই পড়ে, আবার নতুন লাগে... মনে হয় এই তো সবে মাত্র চিঠিটা এসে পৌঁছল, আর সে পরলো... আসলে এমন ভালোবাসা যে এই বিশ্বে প্রায় বিরল... এই স্বার্থান্বেষী, মুখোশধারী আর চাকচিক্যময় প্রেমের জগতে এমন নিঃস্বার্থ প্রেম বোধ হয় খুব কম দেখা যায়... যেখানে নিজের মানুষটা চলে যাওয়ার পরও একজন প্রেমিকপুরুষ তার প্রেয়সীর স্মৃতি আগলে কাটিয়ে দেয় ত্রিশটা বছর... এই চিরকুট, প্রেমিকার নিত্যব্যবহার্য জিনিস, বই থেকে শুরু করে পেন, স্টেথোস্কোপ নিয়েই তার সাথে অবিরল কথা বলে চলে তার সায়র... পঞ্ছির সায়র... তবে এত বছরের পিতার কর্তব্যে এতোটুকু ত্রুটি হয়নি তার... কখনো বা প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই কথা রেখেছে সে, একদিন যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল... তাই আজ তার নিঝুম সফল,তবে কন্যা হিসেবে.. এতগুলো বছর তার বাবাইয়া তাকে আগলে রেখেছে, এখন সে বাবাইয়াকে আগলে রাখে... সেই এখনও বাবাইয়ার একমাত্র বন্ধু ও সহযোদ্ধা... তার মাম্মাই-এর Mission এবং Vision দুটোকেই এগিয়ে নিয়ে যাবার মশাল তার হাতে... তবে অপাবৃতা বোঝে, সে বাবাইয়ার বন্ধু তো হয়েছে... কিন্তু মাম্মাই-এর মতো সবথেকে কাছের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে নি... বাবাইয়াকে আদর করে গায়ে Apron চাপিয়ে ডক্টর অপাবৃতা ব্যানার্জী এগিয়ে যায় তার কর্মযজ্ঞের দিকে... দাক্ষ্যায়নীর ছবির সামনে তখন একটি মোমবাতির শিখা যেন জ্বলজ্বল করছে... অদ্ভুত আলোয় মাখা ওই মুখমণ্ডল যেন আজ আরো উজ্জ্বল,আরো দৃপ্ত, ভীষণ জীবন্ত... অনেক দিনের পরে আজ যেন দাক্ষ্যায়নী হাসছে... জিতে যাওয়ার হাসি... এই জয় যেন ভালোবাসার জয়... চিরন্তন পাশে থাকার বিজয় বার্তা... দূর থেকে ভেসে আসছে সংস্কৃত শ্লোক,

অসতো মা সদ্‌গময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মামৃতংগময় আবিরাবীর্ম এধি।

রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্‌।

                                                                (সমাপ্ত)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance