Anishri's Epilogue

Romance Tragedy Thriller

4  

Anishri's Epilogue

Romance Tragedy Thriller

বৃত্তের বাঁধনে ( Part 9)

বৃত্তের বাঁধনে ( Part 9)

35 mins
408


মূহুর্ত :

----------

অনেক দিন পর 'কথা'-র একটা ছোট্ট জমায়েত বসেছে তিন জনের... যতই কাজের কথা হোক, ছোটো সূত্র মেলানো হোক... কথা তো... যে কথার ভান্ডারটাই ধীরে ধীরে কমে আসছিল ওদের মধ্যে কোনো কারণবশত... মুখোমুখি সাক্ষাৎ অনেক অভিমান, জমিয়ে রাখা যন্ত্রনায় প্রলেপ লাগাতে সাহায্য করে আর তার মাঝের ওই টুকরোটাঈরা হাসিগুলো মলিন হলেও ভালো থাকার ওষুধ হিসেবে কাজ করে... কিন্তু বিধি বাম !! সুখ শব্দটা প্রাঞ্জলবাবুর পরিবারে আসতে এখনও একটু দেরি আছে... তাই, কলিংবেলের শব্দে চমকে ওঠে সমুদ্র, ঢেউ আর পরাগ... এমনসময় মালতিদির গলা পাওয়া যায়...

মালতি : ও ছোটো দিদিমনি, তোমারে ডাকতাছে...

ঢেউ : আমাকে ডাকছে !!! এখন ?? কে ??

সমুদ্র : ঢেউকে ডাকছে !!! কিন্তু কে ??

তিনজন পরষ্পরের প্রতি মুখ চাওয়াচাওয়ি করে....

পরাগ : আমি আগে দেখবো !! ঢেউ আগে সামনে যাবে না... আমাদের এটা ভুলে গেলে হবে না যে, ঢেউ এই Murder Case-এর একমাত্র Eye Witness... যে কোনো সময়ে ওর ওপর যে কোনো রকম আক্রমণ হতে পারে, সেটা প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ... বা হয়তো এমন কেউ যাকে দেখে আমরা আপাতভাবে বুঝতেই পারবো না যে ইনি ঢেউ এর ক্ষতি চান... তাই Be Careful...

কৌতুহল বড়ো বালাই, না চাইতেও মানুষকে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনার সম্মুখীন করে যা না ঘটলেই বোধ হয় ভালো হতো... কিন্তু তাও মানুষের জীবন ঘটনাবহুল.. হয়তো এই বাহুল্যতাটা না থাকলে জীবনের ভালোমন্দ অনেক দিকই অজানা অসম্পূর্ণ রয়ে যেত... তাই পরাগ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ঢেউ খুব সন্তর্পণে পা টিপে টিপে পরাগের পেছন পেছন গিয়ে দেখে, কে ওর খোঁজ করছে !!! ঢেউ-এর অহেতুক কৌতুহলের জন্য সমুদ্রও বাধ্য হয় ঢেউ-এর পেছনে যেতে... কিন্তু যে এসেছে, তাকে দেখেই আৎকে ওঠে ঢেউ... পা দুটো যেন মুহূর্তেই মাটির সাথে আটকে দেয় কেউ, অবাক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে.. এ কাকে দেখছে !! কে এসেছে এতদিন বাদে তার খোঁজ নিতে !!!

সমুদ্র : কি হলো !! তুমি এইভাবে আৎকে উঠলে কেন !!! কে ইনি !!

                              মা

ঢেউ-এর গলা দিয়ে বেরনো মা ডাকটা কেমন যেন আর্তনাদের মতো শোনালো সমুদ্রের কানে... ঢেউকে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরার আগেই ঢেউ কেমন যেন যন্ত্রচালিতের মতো এগিয়ে গেল ওনার দিকে.... সমুদ্র দ্রুত পায়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়... নিজের অজান্তেই ঢেউ ছোট্ট বাচ্চার মতো পরাগের পাশে এসে ওর বাহু আঁকড়ে দাঁড়ায়, পরাগও অভিভাবকের মতোই ঢেউ-এর হাতের উপর তার আশ্বাসের হাত রেখেছে... পরাগ আর সমুদ্র অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে ঢেউ-এর মুখের দিকে তাকিয়ে... বড্ড ক্লান্তি নেমেছে আজ ঢেউ-এর চোখের পাতায়.. তবে তা শারীরিক নয়, মানসিক... বুকের মাঝে জমা মেঘ অন্তরে উন্মত্ততা শুরু করেছে, কিন্তু চোখের বৃষ্টি আজ যেন দাড়িপাল্লায় নিজেকে মাপতে ব্যস্ত...

হয়তো, নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়েছিল ঢেউ যদিও কিছু নীরব কান্না আজো নিস্তব্ধে চিৎকার করে কাঁদতে চায়... কিন্তু আজ সেই অসমাপ্ত প্রহর যেখানে নিঃসঙ্গতা নিস্তব্ধতা আজো বড্ড ভারী....আজ আবার তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে... কাজল কালো স্তব্ধতার মধ্যে সমুদ্র আর পরাগ দুজনেই বোঝে, ঝড় উঠলো বলে... শুধু এটা জানে না এই ঝড় শান্তির ইঙ্গিত না প্রলয়ের... তবে অনুমান করে, এই প্রলয়ে আবার সব কিছু ওলটপালট না হয়ে যায়... তাই দুইজন দুইদিক থেকে ঢেউ-এর ঢাল হয়ে দাঁড়ায়... হয়তো বা শক্তি, যা আপাতত মেয়েটার অজানা... অনেকদিন পর আবার এই বাড়িতে কোনো অশুভের আগমনবার্তা শোনা যায়... আচমকা একটা টিকটিকি টিকটিক করে ওঠে দেওয়ালে... এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ভেদ করে এক মহিলার কণ্ঠস্বর ঢেউকে সম্মোধন করে বলে ওঠে,

সমাপ্তি : (গলার স্বর যেন খাদে নেমে গেছে, এতটাই নরম) কেমন আছিস মা !!! এরা তো তোর সাথে আমাকে !!!

ঢেউ : (নির্লিপ্ত ঋজু গলায়) কেন এসেছেন !!

সমাপ্তি : (একটু থতমত খেয়ে) কি !!!

ঢেউ : (একই স্বরে) ঠিকই শুনেছেন, কেন এসেছেন !!!

সমাপ্তি : কেন !!! আমি তোর ম...

ঢেউ : ব্যাস... ওই শব্দটা ভুলেও উচ্চারণ করবেন না... ওতে ওই শব্দটার অপমান হয়... তার সাথে আমার স্বর্গীয় বাবাইয়ারও... আমার মা, বাবা দুটোই শুধুই আমার বাবাইয়া ছিল... শুধুই আমার বাবাইয়া... আপনি কোনোদিনই আমার বৃত্তের কোন যোজনেই ছিলেন না, সমাপ্তি দেবী !! তাই হঠাৎ করে আমার সামনে উপস্থিত হয়ে নিজের মাতৃত্বের অধিকার চেয়ে বসবেন না, বড্ড দৃষ্টিকটু দেখায়... তাই ভদ্র ভাবে বলছি, আপনি চলে যান... যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানেই ফিরে যান... আপনার ক্ষমতার রাজ্যে, ওইখানেই আপনি ঠিক... এখানে যে বড্ড বেমানান... আপনি চলে যান, Please....

সমাপ্তি : কিন্তু মা, তোর সাথে যে আমার অনেক কথা এখনো বাকি আছে... সেগুলো না বলে, চলে যাই কি করে বল !!!

অস্বাভাবিক শ্লেষাত্মক হাসিতে ফেটে পড়ে ঢেউ, যা দেখে পরাগ আর সমুদ্র দু'জনেই একটু শঙ্কিত হয়ে পড়ে.... পরক্ষণেই চোখে আগুন জ্বেলে পরাগকে ছেড়ে টলমল পায়ে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় ঢেউ.... পরাগ আটকানোর চেষ্টা করেও পারে না, উত্তেজনায় ঢেউ-এর শরীরে তখন আসুরিক শক্তি...

ঢেউ : (অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে) কথা !! কি কথা আপনার সাথে বাকি থাকতে পারে বলে মনে হয় আপনার !! আর আপনি চাইলেই বা আমি কথা বলবো কেন আপনার সাথে !! আর আপনি তো কোনো কাজ অকারণ করেন না !!! তাহলে কেন এসেছেন !! কারনটা বলুন !!! এবার কোন খেলা খেলতে এসেছেন !!! বলুন... আমাকেও তো জানতে হবে সত্যিটা...

সমাপ্তি : শুনলাম তুমি কাদের যেন বাড়িতে এনে তুলেছো !!! তা অপরিচিত লোকেদের আশ্রয় দেওয়ার আগে কার কাছ থেকে Permission নিলে তুমি !!! আমাকেও তো একবার জানাতে পারতে !!! এমন তো নয় যে আমি কোথায় থাকি বা আমার সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবর তুমি জানো না... তবে !!!

ঢেউ : (বরফের থেকেও ঠান্ডা স্বরে) Permission !!!হাসালেন... আপনি কে হন যে কাউকে প্রাঞ্জল রায়চৌধুরির বাড়িতে আনার জন্য আপনার Permission লাগবে... এত গুরুত্ব কেন দেন নিজেকে !! আর ঠিকই শুনেছেন... আমি এনেছি... বরণ করেই এনেছি.... তবে অনাম্নী কাউকে নয়, যাকে আপনি 'কাদের যেন' বলে সম্বোধন করলেন সেই পরম 'পরিচিত' আত্মীয়দের... সে যতই আপনার কাছে অপরিচিত হোক না কেন... তবে আপনি যে তাদের একদম চেনেনই না, সেই নাটকটা করবেন না Please... ধোপে টিকবে না... বরং যাদের এই অধিকার প্রাপ্য ছিল, যাদের আপনি বঞ্চিত করেছিলেন- আমি তাদের ফিরিয়ে এনে আমার পাপস্খলন করার চেষ্টা করেছি মাত্র... আমার বাবাইয়া-র পরিণীতা স্ত্রী আর তাদের একমাত্র সন্তানকে তাদের বাড়িতে আমি নিয়ে এসেছি, যেখানে বহু বছর আগেই তাদের আসার অধিকার ছিল... শুধু আপনার স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেটা হয় নি... আমি শুধু আপনার সেই ভুল বা অন্যায় যাই বলুন সেটার Justification দেবার চেষ্টা করেছি মাত্র... মা বাবার ভুলের খেসারত চিরকাল সন্তানকেই দিতে হয় আর সেই ত্রুটি সংশোধনের দায় ভারও তার ওপরেই এসে বর্তায়... আমিও তার ব্যতিক্রম হতে পারলাম কই !!!

হঠাৎই 'একমাত্র সন্তান' কথাটা বড্ড কানে এসে ঠেকে পরাগের, হয়তো অন্তরে এসে ধাক্কা দেয়... বোঝে যতই কাছে থাকুক না কেন, এক লহমায় প্রিষা তার আর পরাগের অবস্থানের পার্থক্যটা বুঝিয়ে দিল... বুঝিয়ে দিল আদতে সম্পর্কে ভাই বোন হলেও তারা কত লক্ষ যোজন দূরের পথিক... হঠাৎ করেই যেন মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো পরাগের... মনে হলো কেউ যেন মিছরির ছুরি বসিয়ে দিল মনে, যাতে নিজের ক্ষতবিক্ষত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই... পরাগ নিজেই রাখেনি... তবে চেষ্টা সে করবে... করবেই.... আবার সবকিছু ঠিক করার আগের মতো করার জন্য.... করবেই...

সমাপ্তি : এই ঢেউ... Hold On... Hold On... একমাত্র সন্তান মানে !!! কি সব বলছো !! মাথা তাথা খারাপ হলো নাকি ?? ও যদি একমাত্র সন্তান হয়, তাহলে তুমি কে !!!যা বলবে একটু ভেবে বল... তাহলে তুমি কে !!!

ঢেউ : এমা !! আপনি জানেন না আমার পরিচয় !! আমি আসলে 'জারজ'... অনাহুত একজন সন্তান, যার আর বাকি পাঁচজনের মতো সম্মানের সাথে বাঁচার অধিকার ছিল, কিন্তু আপনার জন্য তা হয়নি... আর হবেও না কখনো... আপনি তো ব্যবহার করেছিলেন আমায় আপনার জেতার জন্য.... আপনার জেতার Trump Card ছিলাম আমি... বাংলায় যাকে বলে 'খেলার গুটি' তাই না !!! আমার জন্মের সত্যিটা আজ আমি জানি... কেন করেছিলেন এমনটা !!! আপনার হয়তো লজ্জা বলে কিছু নেই, কিন্তু আমাকে কেন পাপের ওই পাকে ঠেলে দিয়েছিলেন !! উচ্চাকাঙ্ক্ষা... আপনার ঐ তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যই তো আমার বাবাইয়া মকে সিঁড়ি বানিয়ে ওপরে উঠতে চেয়েছিলেন... তাই নিজের গর্ভের সন্তানকেই দান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন... এরপর যেই দেখলেন, আপনার প্রাঞ্জল রায়চৌধুরীকে দখল করা শেষ আর নিজের কার্যসিদ্ধিও হয়ে গেছে অমনি ছুঁড়ে ফেলে দিতে একবারের জন্যও ভাবলেন না... কি অদ্ভুত স্বার্থপর মহিলা না আপনি !! শুধু মাত্র নিজের জন্য সব করতে পারেন... নিজের সন্তানকে অস্বীকার করতে হলে তাও করতে পারেন !!!

                            ঠাস.. স.. স...

সমাপ্তি সজোরে ঢেউ-এর গালে একটা চড় বসায়, আর তার প্রাবল্য এতটাই ছিল যে, ঢেউ-এর ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে যায়... স্বাভাবিক এটাই... মানুষ কবেই বা সত্যিকে সহজে মেনে নিতে পারে বা পেরেছে !! আর যদি জেনেই থাকে দোষটা নিজের, তবে তো আর কোনো কথাই অবশিষ্ট থাকে না... তবে যতই হোক, মা তো... তাই কুমাতা হলেও সন্তানের মনে তার একটা আলাদা জায়গা থেকেই যায়, যা যুক্তি তর্কের বাইরে.. এদিকে এবারকার মতোন পরাগ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগটা সহ্য করে নিলেও সহ্য হয় না সমুদ্রের... সে একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ঢেউকে... একপ্রকার ভৎসনার স্বরে বলে,

সমুদ্র : ঢেউ !!! তোমার লাগেনি তো !! ইস !! গালটায় পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে...আর ঠোঁট কেটে তো রক্ত পড়ছে... বাহহহ !!! কি ভালো মা হবার যোগ্যতা রাখেন আপনি !! আপনার লজ্জা লাগে না !!! যে সন্তানকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একদিন ফেলে রেখে গিয়েছিলেন, ফিরেও তাকান নি... আজ তার সামনে মাতৃত্বের প্রদর্শন করতে এসেছেন, না প্রহসন !!! বাহ !!! অসাধারণ !!!

সমাপ্তি : (কর্কশ স্বরে) এই... কে তুমি !! কে তুমি !! আর আমার আর ঢেউ-এর কথার মাঝখানে ঢুকছোই বা কোন অধিকারে !!! কে দিয়েছে তোমাকে অধিকার !!! আর তুমি যে এতগুলো কথা বলছো, কে হও তুমি ঢেউ-এর !! কারোর কথার মাঝে যে কথা বলতে নেই, সেই Manners-টাও শেখো নি... Ridiculous !! যত্তসব Pedigreeless লোকজনকে কে ঢোকায় আমার বাড়িতে !! যেমন বাবা, তার ঠিক তেমনই মেয়ে...

ঢেউ : সমাপ্তি দেবী... ই.. ই !!!!

আচমকা ঢেউ-এর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়... আপনার সাহস তো কম নয়, আপনি বাবাইয়ার বাড়িতে দাঁড়িয়ে তার মানস পুত্রকে অপমান করেছেন !! আর যে সংসারটাই আপনি কোনোদিনও করলেন না, উল্টে একটা হাসিখুশি সুখী পরিবারকে ভেঙে দিলেন শুধু লোভের কারণে... সেখানে দাঁড়িয়ে এটা কে নিজের বাড়ি বলে দাবি করতে একটুও লজ্জা লাগছে না আপনার !!! অবশ্য চক্ষু লজ্জা কোনদিনই বা ছিল আপনার !! আমারই আশা করা ভুল ছিল... আর অধিকারের কথা বলছেন না !! অধিকার আমি দিয়েছি... বেদ আমার প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, আমার পাশেই থাকবে... কারণ বাবাইয়া ওর হাতে আমাকে সমর্পণ করে গেছে এবং ও সেই দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য মানুষ... তাই ও আর আমার দাদাভাই, আর এই বাড়ির প্রত্যেকে এখন আমার অভিভাবক... আর আপনি বেদকে Pedigreeless বলছিলেন না !! একজন মানুষের বংশ পরিচয় হয়, তার বংশের মানুষদের ব্যবহার, পরিচয় আর ভালোবাসার আথিতেয়তায়.... অন্তত আমি তাই মনে করি... তাই সেই দিক দিয়ে বিচার করলে আপনি কোনোদিন বেদ ব্যানার্জীর Pedigree-র ধারে কাছে যেতে পারবেন না.... আর যোগ্যতার কথা তো না হয় ছেড়েই দিলাম....

সমাপ্তি : চুপ করো ঢেউ... অনেকক্ষণ ধরে তোমার বেয়াদপি আমি সহ্য করছি... তুমি আজ, এখনই আমার সাথে যাবে... এই বাড়ি ছেড়ে... ভুলে যেওনা তুমি সমাপ্তি দেবনাগ-এর মেয়ে... আর যে বাড়িতে আমার কোনো সম্মান নেই, সেখানে তুমিও থাকবে না... প্রাঞ্জল তো তোমার দায়িত্ব ফেলে ড্যাংড্যাং করে চলেই গেলো, একবার ফিরেও তাকালো না তোমার দিকে... কিন্তু আমি তো প্রাঞ্জলকে ভালোবাসি, তাই তার সন্তানকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য...

ঢেউ : (স্মৃতির সরনিতে পথ হাঁটতে হাঁটতে) এই বাড়ির প্রতিটা কোণে আমার আর বাবাইয়া-র স্মৃতি জড়িয়ে আছে... আমার বাবাইয়া-র স্মৃতি ছেড়ে, আমার আপনজনদের ছেড়ে, বাবাইয়া-র অসমাপ্ত কর্তব্য, বেদ-কে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না... কোথাও না... (উত্তেজিত অথচ দৃপ্তভাবে) আর ভালোবাসা দেখাচ্ছেন আপনি !!! তাও এতদিন পরে !!! যখন আর দেখার মতো মানুষটাই রইলো না... (তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে) আপনি নাকি বাবাইয়াকে ভালোবাসেন... 'Jokes of the Day'... আচ্ছা, আপনি তো আমাকে আর বাবাইয়াকে Reject করে চলে গিয়েছিলেন, তাই না !!! যদিও কোনো সম্পর্ক থেকে বেরোতে চাইলে কোন সঙ্গত কারণ লাগে না, একটা অজুহাতই যথেষ্ট... কখনও কখনও আবার অজুহাতটুকুও বাড়তি বলে মনে হয়, কারণ Reject করার স্বাধীনতা তো সবারই থাকে... আপনার তো শুধু দরকার ছিল উল্টোদিকের মানুষদুটোকে তিলে তিলে শেষ করার মতো মনের জোর, বিশেষ করে বাবাইয়াকে... তখন ছোট ছিলাম, বুঝি নি তার আগেই তোমার নোংরা মানসিকতার জন্য বাবাইয়া তার ভালোবাসাকে হারিয়েছে, তাদের ভালোবাসার অঙ্কুরকে হারিয়েছে... কি মারাত্মক নরক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে প্রতি ক্ষণে, প্রতি মূহুর্তে গেছে... শুধুমাত্র আমার মতো একটা নগণ্য ভ্রূণকে আপনার নোংরা মানসিকতা থেকে বাঁচানোর জন্য.... আর সেই আপনি আজ আমাকে মায়ের কর্তব্য দায়িত্ব শেখাতে এসেছেন... সত্যিই, আপনার মতন নির্লজ্জ, বেহায়া মানুষ আমি কোনোদিন দেখি নি... ঠাম্মির মুখে শুনেছিলাম কুসন্তান যদি বা হয়, কুমাতা কদাপি নয়... আপনি সেই প্রবাদ বাক্যটাকেও মিথ্যে প্রমাণ করে ছাড়লেন... আমার দূর্ভাগ্য !! ছিঃ !!! ছিঃ !! ছিঃ !!! ঘেন্না করি আমি আপনাকে বুঝলেন... ঘেন্না করি...

আজ বহু অযাচিত সত্যের উন্মোচন, তাও এই খোলা হাটে... বিশেষত, পরাগ আর সমুদ্রের সামনে... সমাপ্তিকে একপ্রকার উন্মাদ করে তোলে... আসলে কিছু মানুষ থাকে যারা অন্য মানুষদের পায়ের তলায় দমিয়ে পিষে মারতে চায়, এটাই তাদের অভ্যেস... এক প্রকার নেশা বলা জেতে পারে... সেই মানুষগুলোই যেদিন আত্মজ বা আত্মজার যুক্তির সামনে হারতে থাকে, হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর... তাই আর সইতে না পেরে সে চিৎকার করে ওঠে,

                                 ঢেউ

আহত বাঘিনীর গর্জনের সাথে তার ভয়াল থাবা আরো একবার ঢেউ-এর উপর আছড়ে পড়তে গেলে আরো এক বলিষ্ঠ হাত এসে তার পথরোধ করে.... সমাপ্তি অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকায়, একটু চমকেই যায়... কারণ সামনের মানুষটার প্রতিরোধ সে বোধহয় সত্যিই কল্পনা করেনি ঘুণাক্ষরেও... কারণ মুখে না বললেও নিজের কৃতকর্মের সত্যিটা তো তার চে য়ে ভালো কেউ জানে না... তাই একটু থতমতই খেয়ে যায় একপ্রকার... সামনে দাঁড়ানো মানুষটির চোখে তখন বজ্র কঠিন দৃষ্টি... যতই হোক নিজের বোন তো, তার ক্ষতি দাদা হয়ে কিছুতেই মানতে পারবে না সে... তাই চিৎকার করে ওঠে,

পরাগ : Mrs.Debnag..g..g... Please stay in your limit... otherwise...

ঢেউ পরাগের হাতটা আঁকড়ে ধরে... পরাগ একটু স্থির হয়ে বলে,

পরাগ : একটু আগে ঢেউ কি বললো, আপনি বোধহয় ভালো করে শোনেন নি তাই না !!! ওর দাদাভাই এখন ওর অভিভাবক... আর তার বোনের উপর কোনোরকম আঘাত এই পরাগ রায়চৌধুরী সহ্য করবে না... আর ঢেউ এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না...

শেষের কথাটা একটু জোর দিয়েই বলে... ঢেউ অবাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে পরাগকে দেখছিল... সমুদ্রের মুখে যদিও একটা হাল্কা হাসির আভা লেগে আছে... সে জানতো, কঠোরতার আবরন একদিন খসবেই... স্নেহের যে প্রবল স্রোত, তার গতিরোধ করে এমন ক্ষমতা কার আছে !!!

সমাপ্তি : তার মানে তোমরা ঢেউকে আমার সাথে যেতে দেবে না !!!

পরাগ : নাহহহ... কোনো প্রশ্নই ওঠে না... আসলে ভুল টা আমার... আমি আপনি কেমন, সেটা জানা সত্ত্বেও আপনার উপর রাগটা আমার এই ছোট্ট বোনটার উপর বহিঃপ্রকাশ করেছি.... আপনি আমার ক্ষতি করেছেন, আমার মায়ের ক্ষতি করেছেন, আমার বাবারও ক্ষতি করেছেন... আপনার জন্য আমার পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেছে... এই সবগুলোই আমার জানা এবং নিজের চোখে দেখা ছিল... শুধু যেটা জানা ছিল না, সেটা হলো আপনি নিজের স্বার্থে নিজের মেয়েকেও ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন... আপনি সত্যিই মা নামের কলঙ্ক...

আজ পরাগের ব্যবহার ঢেউকে স্তব্ধ করে দিয়েছে... মুখে কিছু না বললেও পরাগকে ও প্রথম দিন থেকেই নিজের দাদাভাই এর জায়গাটা দিয়েছিল... কিন্তু পরাগের কথা ভেবেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল... এই ভেবে যে ওর দাদাভাই তাকে ঘেন্না করে... আর এই সবকিছুর পেছনে ঢেউকেই দায়ী... তবে আজ সেই ভুল ধারণা ভেঙে যাওয়াতে সে যারপরনাই খুশি, এই মুহুর্তে যেন একটা চাপা হাসি খেলা করছে ওর চোখে, মুখে...

ঢেউ : আপনাকে ভুলতে আমার অনেকটা সময় লেগেছিল... শিশুমন তো বারবার চায় ফিরে যেতে চাইতো আপনার কোলে, যদিও আপনি থাকাকালীন তার পরশ খুব একটা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না... তবুও ছোট্ট মানুষের ছোট্ট মন কি অত সমীকরণ বোঝে !! জানেন, বোঝে না... কি বোকা না আমি !!!এখনও অজান্তেই আমি আপনাকে প্রত্যাশা করি... শুধু বুঝি না, আমি আপনার জীবনের তাগিদ ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারি নি... আমার দুর্ভাগ্য.... কিন্তু ফিরে যেতে চাইলেই আদৌ ফিরে যাওয়া যায় !! না কি যায় না !!! যে মানুষগুলোকে ঘিরে একটা ছোট্ট শিশুর জীবনটা গড়ে ওঠে, তাদের কাউকে, বিশেষ করে 'মা'-কে ভুলে হঠাৎ করেই এগিয়ে যাওয়া কি আদৌ যায় !! হয়তো না... কিন্তু আমাকে পারতে হয়েছিল... কারন থেমে গেলেও যে বেঁচে থাকা যাবে না !! তাই মাঝেমাঝে অনিচ্ছায় হলেও আপনার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে আমার আর আপনার সম্পর্কে ইতি টানতে হয়... অবশ্য নিজেকে ভালো রাখার তাগিদটা কিছু ক্ষেত্রে ভালোবাসতে নিষেধ করে... অনিচ্ছায় স্বত্ত্বেও সম্পর্কে ইতি টানতে হয়েছিল সেদিন... নিজের আপনজনদের ভালো রাখার তাগিদটাও কিছু ক্ষেত্রে ভালোবাসতে নিষেধ করে...

একরাশ স্মৃতি আর আবেগ যেন বাঁধভাঙা বন্যার মতো ঢেউকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল... ঢেউকে এমন মূহুর্তে সমুদ্রের বাঁধন আগলে নেয়... যতদিন যাচ্ছে, ঢেউ অন্তরে সমুদ্রকে শুধু ভালোই বাসে না... সে এখন সমুদ্রের গুণমুগ্ধ... সমুদ্র শান্ত, স্নিগ্ধ অপলক দৃষ্টি মেলে সমুদ্র ঢেউকে নরম গলায় বলে,

সমুদ্র : ঢেউ, তুমি ঘরে চলো... তোমার শরীর খারাপ লাগছে...

ঢেউ : (আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো) কেন বেদ !!! কেন উনি এসেছেন আবার !!! আমি তো জীবনটা আমার মতো করেই সাজিয়ে নিয়েছিলাম... জানতাম যে এই বিশাল পৃথিবীতে আমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই... অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতিটা আলাদা... তুমি আমার বারণ সত্ত্বেও নিজের জীবনটা আমার সাথে মিলিয়ে নিয়েছ... তবে উনি সব কিছু ওলট পালট করতে কেন এলেন আবার !! কেন এলেন বলো !!আমার কি এতটুকু নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতাটুকুও নেই !! সেটাও কি আমায় কারোর কৃতকর্মের জন্য উৎসর্গ করতে হয়েছে !!।বা হবে !! বলো না বেদ !! বলো না !!

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ঢেউ.... সমুদ্র ঢেউকে জড়িয়ে নিয়ে....

সমুদ্র : কেঁদো না ঢেউ... Please, কেঁদো না... আমরা আছি তো তোমার পাশে... আমি আছি তো... আমাদের টপকে উনি তোমাকে স্পর্শ অবধি করতে পারবেন না আর... আর জানতে চাইছো না, কেন উনি এসেছেন !! হয়তো স্বার্থের কোনো হিসেব মেলাতে... তাতে তোমার কি ঢেউ !!! তুমি তো এখন তোমার বাবাইয়া-র সাথে গভীরভাবে বাঁচো... তোমার অন্তরে, তোমার অনুভবে আজ তিনি বেঁচে আছেন... শুধু তুমি কেন, আমাদের সবার অন্তরে তিনি বেঁচে আছেন... তাহলে আজকের এই ঝড়ে কেন তুমি এত উতলা ঢেউ !!! কেন এতদিন পর তোমার বুকের ভেতর মাতৃসুধার জন্য এত উথালপাতাল, কেন চোখ জলে ভরে যাচ্ছে !!! কেন বৃষ্টিস্নাত হচ্ছে সেই অন্তর, যেখানে তোমার বাবাইয়া-র অধিষ্ঠান !! কেন তুমি রক্তাক্ত ঢেউ !!! কেন !!! জানি উনি তোমার মা !! ঘেন্না করা এত সহজ নয়... কিন্তু তাও !! উনার কৃতকর্মের শাস্তি তো উনাকে পেতেই হবে !! পেতেই হবে !! শুধু তুমি নিজেকে দোষ দিও না !!! Please !! কথা শোনো !! (ঢেউ-এর ঠোঁটের রক্ত পরম মমতায় মুছে দিয়ে) এবার শান্ত হও ঢেউ... এবার শান্ত হও...

যেন বৈশাখের কালবৈশাখীর তান্ডব থামিয়ে বসন্ত এলো জাগ্রত দ্বারে... ঢেউ-এর অন্তর ছুঁয়ে বলে গেল, 'সে এসেছে, সে এসেছে'... মনের কোনে, স্মৃতির অতলে, প্রকৃতির মাঝে, গাছগাছালির নবীন পাতার ফাঁকে... এইভাবেই নিশ্চুপ হয়ে চোখ বুজে কান রাখো খোলা.... শিরশিরানী হাওয়া তার হয়ে বয়ে এসে কানে কানে বলে যাবে, 'আমি এসেছি ওগো অভিমানিনী, অনুভব করো অন্তরে'... অন্তরের দাবদাহ নিভে গিয়ে কানে ভেসে ওঠে সেদিনে যুগলের গেয়ে ওঠা সেই রবি ঠাকুরের গান...

তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে,

আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে॥

আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে,

বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে॥

সমাপ্তি এতক্ষণ ধরে এত কথাকথান্তর দেখে এইটুকু অনুধাবন করতে পারেন, ঢেউকে রক্ষা করার মানুষের অভাব নেই... প্রাঞ্জলবাবু না থাকলেও তার উত্তরসুরিদের রেখে গেছেন তার 'সম্পদ' রক্ষার জন্য... তাই এখানে তার দাঁত ফোটানো এত সহজ হবে না... তবে সেও সমাপ্তি দেবনাগ... হারতে সে শেখেনি, বরং নিজের কাজে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে স... থাক... এই মূহুর্তে আর ভাবলেন না তিনি... ভাবনায় এখানেই ইতি টেনে ঢেউকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন...

সমাপ্তি : ঢেউ !! চল আমার সাথে....

সমাপ্তি ঢেউ-এর হাত ধরে টানতে যেতেই ওর ডান হাতের আঁকা Tattoo-টা চোখে পড়ে ঢেউ-এর... ওটা কি !! ঢেউ কি ঠিক দেখলো !!! সেই.... সে.. ই.... প্রা.. নী.. টা.. যেটা ও সেই.. দিন.. নাহ !! আর ভাবতে পারে না সে... একটা অস্বাভাবিক আতঙ্ক গ্রাস করে তাকে... বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সামনে সমাপ্তির দিকে তাকায়, যেন কেমন অন্ধকার লাগছে সব কিছু... মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল তার, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব চিন্তাধারা... আর পারছে না... মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবে... হঠাৎই একটা অব্যক্ত আকুতি নিয়ে পরাগ আর সমুদ্রের দিকে তাকায় ঢেউ, চোখে যেন রক্ষা করতে বলার আকুলতা..... তার এই ভয় পাওয়া ফ্যাকাসে সাদা মুখের দিকে তারাও সন্দিহান চোখেই তাকিয়ে... কি হলো হঠাৎই মেয়েটার !!!

পরাগ : কি হলো ঢেউ হঠাৎ !!! রাগ, ক্রোধ, অভিমান- এগুলো এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিল... কিন্তু ভয় পাচ্ছিস কেন !!! দেখ... আমি তোর দাদাভাই, তোর বেদ সবাই আছি... কেউ তোকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে না... আর ছিনিয়ে নিয়ে গেলে থানার Lock Upটা চির দিনের জন্য কারোর থাকার জায়গা হিসেবে গণ্য হতে পারে, কারণ আমার IPS পরিচয়টা কারোর অজানা নয়... সেই দিনের ছোট্ট পরাগ অপারগ ছিল এটা সত্যি... কিন্তু তাই বলে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা যেন কেউ আর দ্বিতীয় বার না করে... তবে কিন্তু মুশকিল...

সমুদ্রের যেন ঢেউকে ভীষণ অচেনা লাগে... এতদিন ধরে মেয়েটাকে দেখছে সে... শুরুতে একটু খামখেয়ালি থাকলেও এখন এই মেয়েটা চেয়ে পরিণত মানুষ খুব কম আছে... আর যে জারজ আখ্যা পেয়েও কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে এক লহমায় নিজেকে দূরে ঠেলে দিয়ে, বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে নিজের পিতার প্রথমা স্ত্রীকে অগ্রাধিকার দিয়ে বরণডালা হাতে বরণ করে সব ফিরিয়ে দিতে পারে... সেই মেয়ে, মা জোর করে নিয়ে চাইছে বলে ভয়ে কুঁকড়ে যাবে, তা সমুদ্রের বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না... ঢেউ তো মাতৃ পরিচয় স্বীকারই করে না... তবে !! কি দেখে এমন ভয় পাচ্ছে মেয়েটা !! এই একই আচরণ সমুদ্র দেখেছিল ওই হসপিটালে... তবে কি !! এমন কিছু সবার চোখের সম্মুখেই ঘটছে যা আপাত গুরুত্বহীন মনে হলেও ভীষণ প্রয়োজনীয়... কিন্তু সেটা কি ?? আর তার সাথে ঢেউ-এরই কি সম্পর্ক... নাহ !! হিসেব মিলছে না !! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই আনমনে বলে ওঠে সমুদ্র,

সমুদ্র : ভয় নয়... এটা ভয় নয়... আতঙ্ক... ও কিছু একটা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে... ঠিক... ঠিক সেদিনের মতো... যেদিন স্যারকে Murder করা হয়....

ঢেউ এতক্ষণ সমুদ্রের বুকে পিঠ চেপে হাঁপাচ্ছিল... কিন্তু সমুদ্র কথাটার উচ্চারণ করার সাথে সাথে হঠাৎই চিৎকার করে ওঠে,

নাহহহহ.... নাহহহহ.... এটা.... এটা হতে পারে না.... হতে পারে না এটা... বাবাইয়া আআআআ....

বলেই এক ঝটকায় সমাপ্তির হাত ছাড়িয়ে সমুদ্র আর পরাগকে সজোরে ধাক্কা মেরে সরিয়ে প্রাঞ্জলবাবুর Study Room-এ ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়.... ঢেউ-এর এমন ব্যবহারে কিংক্তব্যবিমূঢ় পরাগ এবং সমুদ্র বুঝে উঠতেই একটু সময় নয় যে কি ঘটলো !! অবশ্য পরমূহুর্তেই সম্বিত ফিরে পেয়ে দুজনেই ছুটে যায় Study Room-এর বাইরে... কিন্তু দেখা যায়, দরজা তখনও অবধি বন্ধই আছে...পরাগ একটু চিন্তায় পড়ে যায়...

পরাগ : (দরজায় জোরে ধাক্কা মেলে) ঢেউ... ঢেউ.... কি হচ্ছেটা কি !! দরজা খোল... আধঘন্টা হয়ে গেল দরজা বন্ধ করে রেখেছিস... দরজা খোল বলছি...

সমুদ্র : ঢেউ... এবার কিন্তু সত্যিই বাড়াবাড়ি হচ্ছে... দরজাটা খোলো Please... Please... আমরা সবাই আছি তো... ভয় কিসের !!! আমরা থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, দেখো !! Please ঢেউ দরজাটা একবার খোলো !! Please !!

এত ডাকাডাকি সত্ত্বেও দরজা না খোলায় দুজনেই স্বভাবতই চিন্তিত হয়ে পড়ে... ততক্ষনে বাড়ির বাকি সদস্যরাও চিৎকার চেঁচামেচি শুনে Study Room-এর বাইরে ভিড় করেছে... সকলেই ঢেউ-এর জন্য দুশ্চিন্তায় আকুল...

পরাগ : (অধৈর্য্য হয়ে) আমার ভালো লাগছে না... বেদ ধাক্কা মারো... দরজা ভাঙতে হবে....

দু'জনে বেশ কয়েকবারের প্রচেষ্টায় দরজা ভেঙে ঢুকেই আৎকে ওঠে... সংজ্ঞাহীন হয়ে মাটিতে পড়ে ঢেউ.... সমুদ্র দৌড়ে এসে ঢেউ-এর মাথা নিজের কোলে তুলে নেয়... পরাগ ওর Pulse check করে...

সমুদ্র : এই ঢেউ !!! কি হলো তোমার !! ঢেউ !!! চোখ খোলো... চোখ খোলো Please....

পরাগ : এইভাবে হবে না বেদ... ওর আবার Panic Attack হয়েছে... Pulse Rate ভীষন High... কোনো কারনে খুব ভয় পেলে, বা উত্তেজিত হলে এইরকম হয়... জল !!! জল কোথায় !!!

সমুদ্র : ওই তো টেবিলের উপর রাখা...

পরাগ দ্রুত উঠে জল নিয়ে এসে ঢেউ-এর চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয় বেশ কয়েকবার... সমুদ্র নরম হাতে ঢেউ-এর গালে আলতো চাপড় মারে...

সমুদ্র : (কাতরভাবে) এই ঢেউ... ঢেউ... চোখ খোলো... কথা বলো আমাদের সাথে...

পরাগ : এত নরমভাবে হবে না বেদ....

বলেই বেশ জোরে ঢেউ-এর হাতের পাতাটা বেশ জোরে কয়েকবার ঘষে একটু জোরেই ঢেউ-এর গালে চাপড় মারে পরাগ...

পরাগ : ঢেউ... এই ঢেউ... Come On... চোখ খোল... কথা বল... Come On Buddy...Open your Eyes... Come On... Come On Buddy....

ঢেউ হঠাৎই বেশ জোরে পরাগের হাতটা আঁকড়ে ধরে... তারপরেই ছটফট করতে করতে অদ্ভুতভাবে যেন বেঁকে যায়... সমুদ্র আর পরাগ দু'জনে শক্ত করে ধরেও ওকে শান্ত করতে পারে না... ঢেউ বরাবরই উচ্ছল ছিল, সেটা বহুদিন যাবৎ ঢেউকে দেখার দরুণ সমুদ্র জানে... যদিও তখন তাদের আলাপ হয় নি... কিন্তু স্যারের বাড়ি আসার দৌলতে দু'জনের সাথে দু'জনের পরিচয় দীর্ঘদিনের... কিন্তু এ কোন ঢেউকে দেখছে সমুদ্র !!! এত অশান্ত !! হঠাৎই ঢেউ-এর ঠোঁটটা নড়ে ওঠে... সমুদ্র আর পরাগ দু'জনেই কান নামিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঢেউ কি বলতে চাইছে !!!

ঢেউ : বে... বেদ... বেদ...

সমুদ্র : এই তো ঢেউ... এই তো আমি...

ঢেউ : আম... আমি সস... সহ্য... কর... করতে পার... পারছি না... পার... পারছি না... আম... আমি আআআ... আর... আর বাঁচ... বাঁচতে চা... চাই না...

সমুদ্র : (আর্তনাদ করে) কি বলছো ঢেউ !!! ঢেউউউউ !!

নাহ... ঢেউ ততক্ষণে আবার জ্ঞান হারিয়েছে... পরেরদিন সকালে জ্ঞান ফেরে ঢেউ-এর... ডক্টর Nerve Soothing Sedative দেওয়াতে ঢেউ ঘুমিয়েছিল সারাটাদিন... চোখের ভারি পাতাটা ঠেলে খুলে ঢেউ দেখে নিজের কোলের উপর ঢেউ-এর হাতটা আঁকড়ে ধরে ঢেউ-এর পাশে বসে বসেই ঘুমিয়ে আছে সমুদ্র... সমুদ্রকে এইভাবে দেখে ঢেউ একবার ফুঁপিয়ে উঠতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সমুদ্র... কাতর দৃষ্টি নিয়ে ঢেউ-এর মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে ওঠে,

সমুদ্র : ঢেউ !!! ঢেউ, তুমি উঠেছো !!! কেমন আছো ঢেউ !!!

সমুদ্রের অনবরত প্রশ্ন ঢেউকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে... ঢেউ-এর চোখ ভীষণরকম বাঙ্ময় হয়ে সমুদ্রকে কিছু একটা বলতে চায়.... কিন্তু গলা দিয়ে একটাও স্বর বেরোয় না... উচ্ছল ঢেউ আজ ভাষা হারিয়েছে... এভাবেই হয়তো ঢেউ-এর মতো একসময় থেমে যাই আমরা সবাই... প্রতিনিয়ত নিজেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টাটা বন্ধ করে দিই, কারণ মাঝেমধ্যে থামাটাও জরুরি... হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য আর সাথে সাথেই গাঢ় অন্ধকার নেমে আসতে থাকে ঢেউ-এর সামনে... কাঁপতে কাঁপতেই পড়ে যায় সমুদ্রের কোলে... মুখে শুধু অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

                সা... সা... আ.. আ... প... প....

আবার জ্ঞান হারায় ঢেউ সমুদ্রবক্ষে... কিন্তু ঢেউ-এর উল্টোদিকের মানুষটা !!! সে কি থামতে দেবে ঢেউকে !!! মেনে নেবে ঢেউ-এর এই পরাজয় !!! মেনে নেবে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া !!!


মূহুর্ত :

----------

'বুকের মাঝে হয়ে চলেছে অবিরত রক্তক্ষরণ,

এখনও মন খুঁজে চলে

হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ভিড় অকারণ...

এখন মন হতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে,

শুধু বিশ্বাসঘাতকতার কঠিন বার্তা....

জানি না কোথায় গিয়ে থামবে বানভাসি এই যাত্রা... '

                                                   (সংগৃহীত)

জানলার বাইরে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঢেউ... অদ্ভুত ভাবে এই কয়েক ঘণ্টা যেন ওর জীবনে অনেক ঘটনার সমাহার বহন করে এনেছে, হঠাৎ করেই যেন পাল্টে গিয়েছে চারিপাশ... অবশ্য সেটা ওর মনে হওয়া...

ঢেউ : (স্বগতোক্তি) কই দাদাভাই, বেদ ওরা তো যেমন ছিল, তেমনই আছে... ওদের তো কিছু বদল হয় নি...

নাকি হয়েছে !! যা ঢেউ-এর চোখে পড়েনি... আসলে কোনও কিছুকে সূক্ষ্মভাবে মস্তিষ্কে ধারণ করার যে ক্ষমতা এবং বুঝে নেওয়ার যে অনুভূতি প্রকাশ- কোনোটাতেই ঢেউ এই মুহূর্তে স্বচ্ছন্দ নয়... কারণ তার মন জুড়ে বিস্তার করেছে এক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সুত দিয়ে তৈরি এক দীর্ঘস্থায়ী অন্তর্জাল, যা কেটে বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাতে তার পা আটকে হচ্ছে বারবার... তাই তো এই নিস্তব্ধতার আশ্রয় নিয়েছে ঢেউ, ইচ্ছে করেই চুপ করে গেছে... মুখ খুললেই যে অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এবং প্রত্যেককে Clarification দেবার মতো মানসিক অবস্থা এই মূহুর্তে ঢেউ-এর নেই... ও যে বড্ড ক্লান্ত... তাই একটু একা থাকতে চায়... আর কি বা উত্তর দেবে !! কোনো উত্তরই তো অবশিষ্ট নেই... বলতে তো পারবে না সত্যিটা !! কারণ তাহলে হয় তো তার বেঁচে থাকার অধিকারটাই আর থাকবে না... সেটা যদি বাদও দেয়, ও নিজেই তো জান... থাক, আর ভাবতে পারে না সে... যন্ত্রণায় মাথাটা যেন ছিঁড়ে যায়... চোখটা বন্ধ করে বসে...

আর ঢেউ-এর এই আচমকা চুপ করে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় সমুদ্রকে... সব সময় একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে তার- সে কথা দিয়েছিল স্যারকে যে স্যার-এর শ্রেষ্ঠ সম্পদকে রক্ষা করবে কিন্তু পারলো না... ব্যর্থ সে... জীবনের Career-এ আপাদমস্তক সফল একজন মানুষ সম্পর্কের Career-এ বারবার ডাহা ফেল করেছে... সেটা নিজের জন্মদাত্রী থেকে প্রেমিকা, সব জায়গাতেই... তাই নিজেকে ক্ষমা করতে একটু অসুবিধাই হয় তার... তবে এতৎসত্ত্বেও সমুদ্র দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে জিততে তাকে হবেই... বারবার জীবনের খেলায় সে হারবে না, পুতুল হবে না কিছুতেই...

পরাগ দূর থেকে অনেকক্ষন সমুদ্রকে লক্ষ করছিল... সে বাবুর নিজের রক্তের সম্পর্কের সন্তান হতেই পারে, কিন্তু তার মানস পুত্র যে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে এবং যাচ্ছেও... ভালোবাসার যুদ্ধে ছেলেটাকে যত দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে পরাগ... পরাগ সারাজীবনে সবসময় নিজের অবস্থান নিয়ে সজাগ ছিল... ভাবেই নি, চারিপাশে এমন বহু মানুষ আছে, যারা হয়তো পরাগের মতো পরিস্থিতির মধ্যেই বসবাস করছে... তবে তীব্রতার মাত্রা বেশি... একাধারে ঢেউ এবং অন্য দিকে সমুদ্র- এই দুজন তাকে একটা বড়ো শিক্ষা দিয়ে গেলো... আর সমুদ্র !! ও নিজেও তো নিঃস্ব... কিন্তু রিক্ততার প্রলেপ দিয়ে সব কিছু ঢেকে রাখে এমন নয়, শুধু নিজেকে মেলে ধরে না সাধারণের বৃত্তে... তবে পরোপকারের হাতটা বাড়িয়েই আছে... ওদের কাছে পরাগও যে এক প্রকার ঋণী... স্নেহের ঋণ, সম্পর্কের ঋণ... আর সমুদ্র-এর সাথে বন্ধুত্বের ঋণ... তাই এই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের দাম সে মেটাবেই এই দুই যুগল প্রেম-এর মিলন ঘটিয়ে, মেটাতে হবেই তাকে... হঠাৎই ডাক্তারবাবুর গলার আওয়াজে তার চিন্তা বাস্তবের মাটিতে পা দেয়...

ডক্টর সমাদ্দার : দেখুন, আমার মনে ও কোনো কারনে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে...

পরাগ : কিন্তু কেন !!!

ডক্টর সমাদ্দার : The Desire for Life came to an end which may occur for Several Reasons... It may happen when someone are disillusioned about his/ her Current Situation... Perhaps he/she has lack of Interest in Life as a result of dissatisfaction to which he/she has not respond... The Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders (DSM) have some Symptoms like...

ডাক্তারবাবুর কথায় এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এইবার কথোপকথনটা সমুদ্রই শেষ করতে চায়..

সমুদ্র : Feelings of Uselessness or Excessive or Incoherent Guilt, almost every day...

ডক্টর সমাদ্দার : Yes... that's may be primary symptoms which lead to reoccurring of Thought of Death, recurrent suicidal ideation without any a specific plan... or attempted suicide....

আত্মহত্যা !! মৃত্যু !!! আবার !! প্রিয়জনকে আবার ছাড়তে হবে ওই যম রাজার হাতে !! চিন্তাগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় সমুদ্রের... আর সহ্য করতে না পেরে এইবার চিৎকার করে ওঠে...

সমুদ্র : নাহহহ... নাআআ... আমার ঢেউ এইসব কিচ্ছু করবে না... কিচ্ছু করবে না... আমি ফেরাব ওকে জীবনের পথে... আমি খুঁজে নিয়ে আসব ওর হারিয়ে যাওয়া জীবনীশক্তি...

ডক্টর সমাদ্দার : Well, Young Man... then try your Level Best... I believe Pure Love can do anything... so, All the best... আর, আপনারা চাইলে আমি ওকে Sedative দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারি... কিন্তু এতে কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না... দেখুন, আপনার এই ভালোবাসার জোর যদি কোনো পথ খুঁজে পায়...

ডাক্তারবাবু চলে যাবার পর সমুদ্র পরাগের কাছে অনুমতি চেয়ে একা ঢেউ-এর ঘরের দরজা বন্ধ করে ঢেউ-এর কাছে আসে... ঢেউ শূন্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, তার চারপাশের কোনোকিছুই আজ তাকে স্পর্শ করছে না... সমুদ্রও না... সমুদ্র ঢেউ-এর পাশে বসে ঢেউ-এর অগোছালো চুলগুলোকে পরম যত্নে ওর কানের পাশে সরিয়ে দিয়ে ওর কপালে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অধর পরশ দেয়... তারপর ঢেউ-এর কোলে মাথা রেখে শুতেই ঢেউ একবার কেঁপে ওঠে... প্রকৃত পুরুষ মাত্রই জানে, নারীকে শান্ত করার একমাত্র পথ হলো তার স্নেহসুধা... সে ঝড় আদ্যাশক্তি মহাকালীর বাইরের ক্রোধের ঝড় হোক, বা ঢেউ-এর অন্তরের ঝড়... স্বয়ভূ মহাদেবদের শিশু ভোলানাথ হয়েই তাদের শান্ত করতে হয়...

'ওরে শিশু ভোলানাথ, মোরে ভক্ত ব’লে

নে রে তোর তাণ্ডবের দলে;

দে রে চিত্তে মোর

সকল ভোলার ওই ঘোর,

খেলে না - ভাঙার খেলা দে আমারে বলি।

আপন সৃষ্টির বন্ধ আপনি ছিঁড়িয়া যদি চলি

    তবে তোর মত্ত নর্তনের চালে

আমার সকল গান ছন্দে ছন্দে মিলে যাবে তালে।'

ঢেউ-এর নরম হাতটা নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে সমুদ্র নরম স্বরে বলে ওঠে,

সমুদ্র : ঢেউ, আমি জানি তুমি আমার সব কথা শুনতে পাচ্ছো... আজ আমি তোমাকে যে কথাগুলো বলবো ঢেউ, সেই কথাগুলো আমি কোনোদিন কাউকেই বলতে পারি নি.... ভবিষ্যতেও হয়তো কোনোদিনই বলতে পারব না... কিন্তু আজ তোমাকে এই কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে... কারন আমি যে চিরকালের পরাজিত... তবে জীবনের এই লড়াইটা তোমার হাত ধরে আমি জিততে চাই... আর তোমায় যে আমি কিছুতেই হারাতে পারব না ঢেউ, হারতে দিতেও পারবো না... তাই আজ থেকে আমরা দুজনে মিলে লড়বো... যতই বাঁধা আসুক, এক সাথে পার হয়ে যাবো... বল না ঢেউ, আমরা পারবো না !!! পারবো না আমরা ??

ঢেউ-এর চোখের কোলটা মুছিয়ে দিয়ে হাতটা আরো শক্ত করে ধরে সমুদ্র...

সমুদ্র : চলো আজ একটা গল্প বলি তোমায়, তোমার বেদ-এর জীবনের গল্প... জানো ঢেউ, তোমার মতো আমার জন্মটাও অভিশপ্ত... আমার মামাই আমার তথাকথিত জন্মদাতার আসল রূপটা চিনতে পারে নি... চিনবেই বা কি করে বলো !!! অমানুষগুলো তো দেখতে একদম মানুষের মতোই হয়... তার নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে ওই অমানুষটার হাতে সমর্পণ করেছিল... আমার মায়ের ছিল তীব্র আত্মসম্মান... তাই প্রতিরাতে পণের জন্য নিজের স্বামীর কাছে ধর্ষিতা, প্রহৃত হয়েও কোনোদিন মামাই-কে সেইসব কথা তো জানতে দেয়ই নি... পণের কথাও মামাই কোনোদিন জানতে পারে নি... অত্যাচারিত হতে হতে যেদিন মায়ের প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়, সেদিন ছিল মামাই-এর বাসি বিয়ে... মা শুধু তার অপর অংশ, মামাই-এর আসার অপেক্ষাতে ছিল... মামাই-এর হাতে নিজের শেষ চিহ্ন, তার সাতদিনের আত্মজকে দিয়ে সেই নরক থেকে ওকে বার করে নিয়ে যেতে বলে... মামাই-এর কোলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আমার মা...

কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির সমুদ্রের কপালে ঝরে পড়ে... সমুদ্র দেখে, ঢেউ-এর দৃষ্টি শূন্য হলেও চোখে অকাল শ্রাবণ নেমেছে... হয়তো, একেই বলে সমব্যথী...

সমুদ্র : জানো ঢেউ, যেদিন প্রথম ও শেষ আমার মামাইকে সবাই রাগতে দেখেছিল... মামাই মিষ্টি মা-র কোলে আমাকে দিয়ে মায়ের শেষকৃত্য করে... আমার তথাকথিত জন্মদাতাকে মায়ের মৃতদেহ ছুঁতে দেয় নি মামাই... বুকে পাথর চাপা দিয়ে নিজেই মুখাগ্নি করেছিল, শেষসজ্জায় মায়ের ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে একটু শান্তি দিতে চেয়েছিল যে...

আমার যশোদা মা আর বাবা, মানে মিষ্টিমা আর মামাই কোনোদিন স্নেহ, আদর, শাষন, ভালোবাসার কোনো খামতি রাখে নি আমার জীবনে... কোমলে-কঠোরে জীবনের মূল্যবোধগুলো পরম যত্নে শিখিয়েছিল আমাকে.... তারপর আমার জীবনে এলো আমার সেরা উপহার- ছোট্ট একটা জ্যান্ত পুতুল.... আমার সিয়া... জানো ঢেউ, ছোটো থেকেই আমার কোনো বন্ধু ছিল না তেমন... হয়তো গর্ভে থাকাকালীন আমার মায়ের একাকীত্বটা আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল... আমার মামাবাড়ির স্নেহ, আদর, ভালোবাসার কোমল অনুভূতিগুলোয় সিঞ্চিত হয়েও আমার অন্তরে ছিল গ্রীষ্মের রুক্ষ্মতা... যৌবন এলেও কোনোদিন বসন্ত ছোঁয় নি আমাকে... নিজেকে অধ্যাবসায় আর কড়া নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে বেঁধে রেখেছিলাম আমি... বন্ধু বলো, সঙ্গী বলো- ওই আমার ছোট্ট বোন সিয়া... মেয়েটার কিছুদিন পর বিয়ে, কিন্তু আমার কাছে ও ওই তোয়ালেতে মোড়া ছোট্ট সিয়াই রয়ে গেল... হ্যাঁ, আরো একজন অসমবয়সী বন্ধু ছিল বই কি !!! তোমার বাবাইয়া, আমার স্যার... অধ্যাবসায় আর বন্ধুত্বের এক অনন্য যুগলবন্দী...

একদিন হঠাৎই বসন্ত এলো আমার জীবনে... বসন্ত এলে এইসময় অদ্ভুত এক হাওয়া দেয়, মনে হয় খুব চেনা... হাত বাড়িয়ে ধরতে যাই হাওয়ায় লেগে থাকা মুহূর্তগুলো... সিয়া আমাকে ওকে ওদের NGO থেকে আনতে বললো... ওকে নিতে গাড়ি থেকে নামতেই একটা ঘুঙুরে তাল দেওয়ার 'ছম' শব্দ কানে এলো... শব্দ অনুসরণ করে পেছন ফিরতেই দেখি একটা দ্যূতি... সেই দ্যূতির ছটায় বস্তির ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত... তারা ওর কাছে নাচ শিখছে...

নীল দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল,

অনেক কালের মনের কথা জাগল।

এল আমার হারিয়ে যাওয়া

কোন্‌ ফাগুনের পাগল হাওয়া।

বুঝি এই ফাগুনে আপনাকে সে মাগল,

 সর্ষেক্ষেতে ঢেউ হয়ে তাই জাগল॥

দাম্পত্য মাধুরী :

-----------------------

আকাশে এখন গভীর অন্ধকার... ধ্রুবতারাও যেন লক্ষ তারার মাঝে ছায়াপথ ভুলে পথ হারিয়েছে... পথ খুঁজতে সে নারাজ... পরাগ সেই আঁধারের মাঝে সেই উজ্জ্বলতম তারাটাকে খুঁজছে, যার খুনের রহস্য সমাধান সে এখনো পর্যন্ত অপারগ... এদিকে ঢেউ দিনের পর দিন আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে... আর আজ তো ওর ব্যবহার পরাগকে দিশেহারা করে রেখে দিয়েছে... হঠাৎই পেছন থেকে একটা নরম হাতের বাঁধন পরাগকে আবদ্ধ করে নেয়... মনের গহন অন্ধকারে ঠিক যেন জোনাকির মতো নিঃশব্দে এক চিলতে আলো এসে পড়লো... পরাগ নরম হাতটা নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে বলে,

পরাগ : Sorry পিয়া... জানি, আমার সব যন্ত্রণাগুলো মুছে দিতে তোমার কথাগুলো আমার স্তব্ধতার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করছে...

পাঁপড়ি : আমি কি কিছু বলেছি তোমায় !!!

পরাগ ঘুরে আলতো হাতে পাঁপড়ির অগোছালো চুলগুলোকে কানের পেছনে সরিয়ে পাপড়িকে নিজের বুকে টেনে নেয়....

পরাগ : তুমি আমাকে কিছু না বললেও আমার কি খারাপ লাগে না !!! কাজু আমাদের দু'জনের সন্তান, কিন্তু আমাদের ভালোবাসার অঙ্কুরকে তুমিই তো তোমার গর্ভে সৃষ্টি করেছো পিয়া... তারপর অত বড় অপারেশনের ধকল... তারপরেও নিজের দিকে না তাকিয়ে ছোট্ট ওই এক রত্তিকে মানুষ করা... কতটুকু Rest পাও তুমি, পিয়া !!! আমার তো সারাদিন কাজ... কাজ.... আর কাজ...

পাঁপড়ি : (সজোরে ঘাড় নেড়ে) না... না... আমার যত্নের কিন্তু কোনো অভাব নেই... মা আর ঢেউ তো আমাকে একেবারে যেন পুরো তুলোয় মুড়ে রাখে... সবকিছু হাতের সামনে হাজির... সব খাবার মুখের সামনে এনে ধরে... আর কাজুর কথা বলছো !! তার যে কে আসল মা, আমার সেটাই মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়... আমি তো ওকে শুধু বুকের দুধটুকু দিই... বাকি সব তো ওর পিপিই করে... তোমার Night Duty থাকলে ঢেউই তো সারা রাত জাগে... মাকেও এই ঘরে থাকতে দেয় না... ঠাম্মির কাছে শুতে পাঠিয়ে দে...

হঠাৎই পাঁপড়ি তার কপালে হঠাৎই অকাল শ্রাবণের ছোঁয়া পেয়ে মুখ তুলে পরাগের দিকে তাকায়... কাতর স্বরে বলে ওঠে,

পাঁপড়ি : কি হয়েছে তোমার, পরাগ !! কাঁদছো কেন তুমি !!!

কিন্তু পাঁপড়ি প্রশ্নের উত্তর পায় না... পাঁপড়িকে আঁকড়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে অঝোরে কেঁদে ফেলে পরাগ, লৌহ মানব IPS Officer পরাগ রায়চৌধুরি... পাঁপড়িও যতটা সম্ভব পরাগকে তার ভালোবাসার ওমে ভরিয়ে দিয়ে নিজের মধ্যে জড়িয়ে ধরে.... কাঁদুক.... একটু কাঁদুক মানুষটা.... নিজের সব ক্ষত নিজের মধ্যেই গোপন রেখে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের জীবন সংগ্রাম লড়েছে মানুষটা... সবার মতো পাঁপড়িও প্রথম প্রথম ওকে ভুল বুঝতো... ওকে ভীষণ Arrogant, Rebellious লাগতো ওর... কিন্তু পরাগকে চিনতে ওর বাবার কোনো ভুল হয় নি, যতই হোক শিক্ষক মানুষ তো... ওর ওই অশান্ত, ক্ষুব্ধ স্বভাবের আড়ালে যে এক আকাশ ভালোবাসা আর যত্ন লুকিয়ে আছে, তার খোঁজ তিনি ঠিকই পেয়েছিলেন... পাঁপড়ির বাবা-মাই পরাগের মা বাবা বিচ্ছিন্ন হবার পর পরাগ আর ওর মাকে আগলেছিল... আর করবে নাই বা কেন ?? যতই হোক, বন্ধুপত্নী বলে কথা... ওরা তিনজনে মিলেই পরাগ আর পাঁপড়িকে বড় করে তোলে... যত সময় এগোয়, পাঁপড়ি হয়ে ওঠে পরাগের একমাত্র বন্ধু, ভালোবাসার মানুষ... এতটুকু আঁচড় কখনো পাঁপড়ির গায়ে লাগতে দেয় নি পরাগ... এমনকি যেদিন ওর বাবার অসুস্থতার খবর এলো, সেদিন পাঁপড়ির বাবা শতবার বলা সত্ত্বেও গর্ভযন্ত্রণায় কাতর পাঁপড়ির আঁকড়ে ধরা হাত ছেড়ে সে তার বাবার কাছে ছুটে যায় নি... পরের পাঁপড়ির মা বলে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাঁপড়ির জ্ঞান ফিরেছে ততক্ষণ পরাগ পাঁপড়ির হাত ছেড়ে কোথাও এতটুকু নড়ে নি পর্যন্ত... তবে পাঁপড়ি সুস্থ হবার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়... বাবার প্রতি সন্তানের শেষ কর্তব্যটুকু পাঁপড়ির পাশে থাকতে গিয়ে পরাগ করতে পারে নি...

পরাগ : (ফোঁপাতে ফোঁপাতে) আমি খুব খারাপ পিয়া, আমি খুব খারাপ... আমি.... আমি সবাইকে কষ্ট দিই...

পাঁপড়ি : কেন !!! কাকে আবার কষ্ট দিলে তুমি !!!

পরাগ : ঢেউকে... জানো, ঢেউ আজ ওর মাকে বললো, আমি নাকি বাবুর একমাত্র সন্তান... তাহলে ও কে, পিয়া !!! ওর দিকে 'জারজ' অপবাদটা আমিই ছুঁড়ে দিয়েছিলাম রাগের মাথায়... একবারও জানার চেষ্টাও করি নি যে মেয়েটার ছোটোবেলাটা আমার মতোই ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত ছিল... মেয়েটা তখন মুখে একটাও প্রতিবাদ করে নি... কিন্তু ও নিজের প্রাপ্য সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে... এমনকি নিজের বাবার পরিচয় থেকেও....

পাঁপড়ি : শান্ত হও... একটু শান্ত হও তুমি... জানতো পরাগ, সময় বহমান নদীর মত... কারোর জন্য অপেক্ষা যেমন করে না, তেমনই মানব জীবনের সমস্ত মলিনতা, দুঃখ, যন্ত্রণাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সে রাখে... সময়ের সাথে পরিস্থিতি যেমন শীতল হয়, তেমন শিথিলও হয় কিন্তু... তাই কিছু মূহুর্ত সময়ের ওপর ছেড়ে দাও... সঠিক সময় আসলে দেখবে আপনাআপনি বহু জটিল অঙ্কের সরল সমাধান হয়ে গেছে, যা হয়তো আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তুমি তার উপলব্ধিও করতে পারছ না... তাই বলছি, একটু ধৈর্য ধরো... ঢেউ একদম ঠিক হয়ে যাবে... (ম্লান হেসে) আমাদের মেয়েদের না কই মাছের প্রাণ... তাই কঠিন পরিস্থিতি আমাদের খাবি খাওয়ালেও সে আমাদের মানসিক জোরের কাছে তুচ্ছ আর ভালোবাসার মায়া কাটানো কি এতই সহজ !! তাই ভেবো না, ঢেউ ফিরবেই একদিন... ফিরতেই হবে ওকে নিজের মানুষদের কাছে... ও নিজেও তো ভালো নেই, বলো !!!

মূহুর্ত :

-----------

সমুদ্র : কি অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা ঘিরে আছে ওদের অনাবিল আনন্দের মাঝে... মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকলাম সেই সর্ষেক্ষেতের 'ঢেউ'-কে... বসন্ত বুঝি এমনি হয় !! নাচ শেষ হতেই কোমরে ওড়না বেঁধে কি নিপুনতার সাথে মেয়েটা চেয়ারের উপর উঠে এটা লাগাচ্ছে, সেটা লাগাচ্ছে- এই বেলুন লাগাচ্ছে তো তক্ষুনি ফুলের মালা দিয়ে চারপাশটা সাজাচ্ছে... আর আমার মুগ্ধতা যেন বেড়েই চললো... সেদিন শুধু মনে হয়েছিল তুমি মানুষ ছিলে না, অনুভূতি ছিলে... অনন্ত দিগন্তে আমার আর প্রকৃতির অনুভূতিতে এক অজানা রেশ হয়ে লেগে ছিলে... আজও লেগে আছো...

কখন যে সিয়া এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, বুঝতে পারি নি... ও মূহুর্তেই অনুভব করে নেয় আমার মুগ্ধতা... জীবনে সেই প্রথম আর সেই শেষবার মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলাম, আর তাতে সিয়ার কাছে আরো ধরা পড়ে গেলাম... মজা করে গেয়ে উঠল,

গোপন কথাটি রবে না গোপনে,

উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।

না না না,    রবে না গোপনে॥

বিভল হাসিতে  বাজিল বাঁশিতে,

স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে,

না না না,    রবে না গোপনে॥

সত্যিই বোধহয় আমার সেদিন তেমন অবস্থাই ছিল... ওকে চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে গাড়িতে তুললাম... কিন্তু তুমি তো বসন্ত... তোমার তো চলে যাওয়া নেই... ছোট থেকে কোনোদিন দোল খেলি নি, জানো তো ঢেউ... মিষ্টিমা শিখিয়েছিল, ঠাকুর আর গুরুজনের পায়ে আবির দিতে হয়... দোল বলতে আমার কাছে সেইটুকুই... কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটালে তুমি... দোলের দিন স্যার আমাকে ডেকেছিলেন কিছু বিষয় আলোচনার জন্য... আর তোমার বাচ্চাদের কাছে যাওয়ার তাড়া ছিল... তাই তাড়াহুড়োতে বাবাইয়াকে আবির নিয়ে প্রণাম করতে এসে জোর ধাক্কা খেলে আমার সাথে, আর তোমার থালার সব আবির এসে পড়লো আমাদের গায়ে... খুব রাগ হয়েছিল সেদিন তোমার উপর... কিন্ত রাগতে আর পারলাম কই !! আবির রাঙানো তোমার দিকে চোখ যেতেই আবার সেই মুগ্ধতা... আসলে আমরা প্রত্যেকেই কারও না কারও প্রতি দুর্বল, যতই আমরা নিজেদের অনুভূতিগুলোকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি না কেন, নির্দিষ্ট কোনো একজন মানুষের কাছে আমরা ভীষণ আবেগপ্রবণ... গোটা পৃথিবীর কাছে যে আমরা প্রচণ্ড রুক্ষ, জেদী, আর ভীষণ একগুয়ে... কিন্তু সেই আমরাই কোন একজন বিশেষ মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করি না...

কিন্তু তুমি তো তুমি ছিলে ঢেউ... মূহুর্তে নিজের গা থেকে আবীর ঝেড়ে ফেলে তোমার বাবাইয়া-র জামা আর তোয়ালে দিয়ে আমাকে স্নানে পাঠালে... স্নান সেরে বেরিয়ে শুনি, তুমি সব পরিষ্কার করে ঠাম্মিকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে বেরিয়ে গেছো... সেদিন আমার অন্যমনস্কতা স্যারের কাছে আমাকে ধরিয়ে দিল... স্যার যদিও মুখে কিছুই বলেন নি, তবুও ওনার চোখ এড়ায় নি কিছুই... যদিও তুমি কিছুই বুঝতে না, তুমি তো প্রাণশক্তিতে ভরপুর উচ্ছল এক বসন্তের দখিন হাওয়া... কারুর চোখের নীরব মুগ্ধতা দেখার মতো সময় কোথায় তোমার !!!

দাম্পত্য মাধুরী :

-----------------------

পাঁপড়ি পরাগকে হাত ধরে টেনে এনে খাটে বসিয়ে নিজে ওর পাশে বসে... কিন্তু পরাগ আবারও পাঁপড়িকে ছোট্ট কাজুর মতো করে আঁকড়ে ধরে...

পাঁপড়ি : শান্ত হও... ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শোনো... দেখো, তোমাদের সম্পর্কটা তো এত সহজ নয় পরাগ, আর না তোমাদের ছোটোবেলাটা... একজন মহিলার লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা চার চারটে জীবন তছনছ করে দিয়েছে... কিন্তু তোমরা কেউ খারাপ নও, পরিস্থিতিটা প্রতিকূল... এই প্রতিকূল পরিস্থিতিটা আমাদের সবাইকে শক্ত করে হাতে হাত ধরে পার করতে হবে... মা তো নিজের স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা দিয়ে মূহুর্তে আমাদের গোটা পরিবারকে বেঁধে নিয়েছে... কিন্তু ঢেউ এখনও সহজ হয়ে উঠতে পারে নি... তোমরা দুই ভাই-বোন যতই দূরে দূরে বড় হও না কেন !!! তোমরা স্বভাবে এক... তোমরা তোমাদের মনের ক্ষত, আর বুক ভরা ভালোবাসা গোপন করো... একজন রাগ, বদমেজাজ দিয়ে... আর একজন নীরবতা আর কর্তব্য দিয়ে... শোনো পরাগ, ওঠো ওঠো... ওইভাবে কাঠবেড়ালীর মতো বুকে মুখ লুকিয়ে থাকলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না... তাকাও আমার দিকে...

পরাগ মুখ তুললে পাঁপড়ি পরম মমতায় আদরমাখা পরশ দিয়ে ওর চোখ, মুখের জল মুছিয়ে দেয়....

পাঁপড়ি : শোনো পরাগ, একজনের জন্য এইভাবে চার চারটে জীবন নষ্ট হতে পারে না... তার মধ্যে বাবু তো চলেই গেল... আর ঢেউ !! ওকে নিয়েও আমার বড় দুশ্চিন্তা হয়... ও ভালো নেই পরাগ... ও একদম ভালো নেই... আচ্ছা, পরাগ ওকে Slow Poisoning করা হচ্ছে না তো !!! বা Drug !!!

চমকে ওঠে পরাগ....

পরাগ : মানে !!! কেন মনে হচ্ছে তোমার !!

পাঁপড়ি : ও শরীর দিন দিন Deteriorate করছে... মনের জোরে সবকিছু করে যাচ্ছে, শুধুমাত্র ওর পরিবার আর বেদ-এর পাশে থাকবে বলে... ওর যদি কিছু হয়ে যায়....

পরাগ : নাহহহ... ওর কিছু হতে পারে না... ওর পাশে ওর গোটা পরিবার আছে, ওর বেদ আছে.... এমনকি ওর কাজু সোনাও আছে... যদিও এই কথাটা আমারও কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছে.... আমি একদিন বেদকে বলেওছিলাম... আমি আর বেদ খুব তাড়াতাড়িই ওকে Blood Test-এর জন্য নিয়ে যাব...

পাঁপড়ি : হ্যাঁ পরাগ, তোমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর Blood Test করার ব্যবস্থা করো... আর একটা কাজ, ওর দাদাভাই আর বৌদিদি হয়ে আমাদের খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে...

পরাগ : কি !!!

পাঁপড়ি : দেখো পরাগ, আত্মীয়তা হয় আত্মার সম্পর্কে... কিন্তু যার নিজের সন্তানের প্রতিই কোনো মাতৃত্বের টান নেই, সে এতবড় অনুভূতিটা অনুভব করবে না বা তাকে অনুভব করানোর চেষ্টাটাও বৃথা হবে... তাই বলছিলাম, ঢেউকে এবার একজন অভিভাবকের হাতে সামাজিক এবং আইনিভাবে তুলে দাও, যাতে ওই মহিলা ঢেউ-এর দিকে তাকানোর আগে দশবার ভাবে...

পরাগ : কেন !!! ঢেউ-এর দাদাভাই নেই !!!

পাঁপড়ি : সেটা ঢেউ স্বীকার করে, তুমি স্বীকার করো, মা করে, ঠাম্মি করে, বেদ করে, আমি করি... কিন্তু সমাজের সবাই সেটা স্বীকার করে না... তাছাড়া, বেদ আর ঢেউ-এর সম্পর্ক যতই নিষ্পাপ আর সুন্দর হোক, তার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই... এবার ঢেউকে বেদ-এর হাতে তুলে দাও...

পরাগ : এই Case Solve Out না হওয়া অব্দি ঢেউ এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না...

পাঁপড়ি : আমি জানি পরাগ... এতদিন পর তুমি তোমার বোনকে কাছে পেয়েছো, ওকে সারাজীবন তুমি বুকে করে আগলে রাখতে চাইবে... কিন্তু, আজ ওই মহিলা চলে গেলেও যে আবার ঢেউকে নিতে ফিরে আসবেন না, তার কোনো Guarantees আছে... নেই তো !! উনি যদি বেদ আর ঢেউ-এর এই নির্মল সম্পর্কটাকে কলঙ্কিত করেন, ঢেউ কিন্তু সহ্য করতে পারবে না... ওর জন্য বেদ-ও অপমানিত হলে ও কিন্তু নিজেকে শেষ করে দেবে... ওদের এখনই বিয়ে দিতে বলছি না... ওদের আর্শীবাদ আর Registry-টা করিয়ে রাখো...

পরাগ : আমার বোনটা এত তাড়াতাড়িই পর হয়ে যাবে, পিয়া...

পাঁপড়ি : ভালোবাসার মানুষটাকেও তো পাবে, আদর পাবে... যেমন আমি পেয়েছি তোমাকে...

দুষ্টুমি করে পাঁপড়ির চোখের দৃষ্টি বদলে যেতেই স্বল্পবাক পরাগ এক ঝটকায় তার আদরের 'পিয়া'-কে নিজের চওড়া বুকে টেনে নিয়ে নিজের গরম ঠোঁট দিয়ে পাঁপড়ির নরম ঠোঁটের সব ভালোবাসার শুষে নিতে থাকে... নিজে দুষ্টুমি করতে গিয়ে এমন ঘটনার আকস্মিকতায় পাঁপড়ি হকচকিয়ে যায়... পরাগের পুরুষালী গন্ধ, দুই বলিষ্ঠ বাহুর পেশীর মধ্যে আবদ্ধ পাঁপড়ি তখন মোমের মতো গলছে, আবেশে বুজে এসেছে দুই চোখ... এই চিরপরিচিত অথচ চিরনতুন অনাস্বাদিত অনুভূতিতে তাদের শরীর বেয়ে নামছে উষ্ণ প্রসবনের স্রোত... পরাগের স্পর্শে তার সারা শরীর রোমাঞ্চিত... পাঁপড়ির বুকে বাজছে দুন্ধুভী... এবার পরাগের অধর পাঁপড়ির অধর ছেড়ে কপাল স্পর্শ করেছে... তারপর পরাগ পাঁপড়ির কানে কানে বলে,

এখন এতটুকুই... কয়েকমাস পর এতদিনের সব আদর কিন্তু উজার করে দেব... কিন্তু এখন না... পিয়া, সবে তো তিন মাস হয়েছে তোমার অপারেশনের... এখনও Stitch কাঁচা আছে... তাই এখন এইটুকুই... তুমি আমার কাছে সত্যিই খুব আদরের... তাই তোমার এতটুকুও ব্যাথা লাগে, এমন কোনও কাজ তোমার পরাগ কোনোদিনও করবে না...

মূহুর্ত :

-----------

ওদিকে, জীবনে বোধহয় প্রথমবার এতগুলো কথা একসাথে বলছে সমুদ্র... ঢেউ চুপ চাপ থাকলেও ওর প্রতিটা নিশ্বাস-প্রশ্বাস, চোখের জল বলে দিচ্ছে সে এই ঘরের মধ্যেই থাকা একটি মানুষ, কোনো বিচ্ছিন্ন দুনিয়ায় বসবাসকারী নয়... প্রকাশ করতে চাইছে, কিন্তু পারছে না... আটকে দিচ্ছে তার গভীর ক্ষত.. শুধুই কি ক্ষত, একরাশ পর্বতসম লজ্জাও কি নেই !! যখন সত্যিটা সবাই জানতে পারবে, কি করে মুখ দেখাবে ঢেউ সবার কাছে !! একবার না হয় বড়মাকে তার পরিবার দেরিতে হলেও ফিরিয়ে দিয়ে সামান্য পাপস্খলন করেছে... কিন্তু এইবার !!! প্রকৃত সত্যিটা জানার পর সবাই তো ঘেন্নায় তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে সবাই যতই ভালোবাসা দেখাক... আর ঠাম্মি !! তার সামনেই বা দাঁড়াবে কি করে !! যতই হোক তার তো সন্তান !! আর সবশেষে বেদ !! সব কিছু বেদ সহ্য করলেও তার দ্রোণাচার্যের ক্ষতি এই একলব্য কিছুতেই মেনে নেবে না !! তাই ঢেউকে তো সেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতেই হবে... আশ্রয় নিতে হবে ওই আস্তাকুড়েই... নাহ !! আর পারবে না সে !! তার আগে নিজেকেই শে... আচমকাই বোঝে সমুদ্রের স্থির দৃষ্টি তার ওপরই বর্তেছে... ঢেউ একটু মুখ তুলে চাইতেই চোখাচোখি হয়.. সমুদ্র আবার বলতে শুরু করে...

সমুদ্র : কিন্তু সেদিন স্যারের কাছে প্রথম Threat Call আসে... স্যার তোমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করায় আমি গিয়ে নিয়ে আসি তোমাদের... কিন্তু তোমার তো আবার প্রবল আপত্তি সাহায্য নিতে... ঠাম্মির বকুনি খেয়ে মুখ গোমড়া করে আমার পাশে বসে বাড়ি ফিরলে...

পরেরদিন স্যার হঠাৎই উপস্থিত আমার কাছে- আমার আর তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে... আমার মনে হচ্ছিল, আমি স্বপ্নের ঘোরে আছি... বিশ্বাস করতে পারছিলাম না... কিন্তু তোমার মতামতটাও তো সমান গুরুত্বপূর্ণ... পরেরদিন আমাকে তোমাদের বাড়ি যেতে বলে স্যার চলে গেলেন...

তারপরের ঘটনা তো তোমার জানা... Traffic Signal-এ তোমার সাথে দেখা... তারপর তোমার এই বিয়েতে অসম্মতি জানানো... তুমি আমাকে আবার বাস্তবের মাটিতে এনে ফেললে... তোমার অসম্মতি জানানো নয়, তোমার ওই তীব্র মানসিক যন্ত্রণা আমাকে ভেতরে থেকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল... বুঝতে পারলাম, হঠাৎ যখন ভুল বোঝাবুঝিগুলো পাহাড়ের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে দু'পক্ষের মাঝে এসে দাঁড়ায়, তখন হাজারখানেক কৈফিয়তও যেন কম পড়ে যায়... আর কোথাও একটা অভিমান জমাট বাঁধতে শুরু করে, বোঝানোর চেষ্টাগুলো ধীরে ধীরে হাঁপিয়ে ওঠে... উল্টোদিকের মানুষটা যতোই বিশেষ হোক, প্রিয় হোক.... নিজের আত্মসম্মানটাও যে ভীষন জরুরি... এটাও বুঝলাম- সব হাসি, সব প্রাণবন্ততা খাঁটি হয় না... কোথাও কোথাও সেটা ভাঙাচোরা অন্তরটাকে আড়াল করার মুখোশও হয়....

বাড়ি ফিরে গিয়েও এতটুকু স্বস্তি পাচ্ছিলাম না জানো ঢেউ... তোমার ওই কান্না আমার গোটা ঘরে গুঞ্জরিত হতে থাকে... সেদিন বুঝেছিলাম, আমার ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে... তোমাকে আপন করে পাই আর নাই পাই, আমি তোমাতেই সমাহিত হয়ে পড়েছি... জানো ঢেউ, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন একজন বিশেষ মানুষ আসে, যাকে হারানোর ভয়ে প্রতিটা মুহূর্তে আমরা আরও বেশি করে ভালোবেসে ফেলি মানুষটাকে... কিন্তু জীবন সবসময় সহজ পথে চলে না যেখানে হারানোর ভয়টা বেশি থাকে, সেখানেই আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলি সেই মানুষটার মাঝে....

হঠাৎই তোমার ফোন এলো, আর তারপর সব কেমন যেন উল্টেপাল্টে গেল... স্যার আমাদের বেঁধে দিলেন পরষ্পরের সাথে, কিন্তু নিজেই....

ঢেউ : আআআআ...

খুব জোরে ফুঁপিয়ে ওঠে ঢেউ... সমুদ্র বোঝে, তার ভালোবাসার আজ পেরেছে, পেরেছে তার ভালোবাসাকে জীবনের পথে ফেরাতে... ওর কাঁদাটা খুব দরকার... ঢেউ-এর কোল থেকে উঠে দুই হাতে ঢেউকে আঁকড়ে ধরার আগেই ঢেউই সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ে...

ঢেউ : বা... বা... বাবাইয়ার খু... খুনি...

সমুদ্র : কি বলো !!! বলো !!!

ঢেউ : ম্মা... মা...

সমুদ্র : মায়ের কাছে যাবে !!!

ঢেউ : নাআআআ.... মাআআ... খু... খুনি...

সমুদ্র : কি বলছো তুমি, ঢেউ !!! তুমি কি করে জানলে !!! ঢেউ !!! ঢেউ !!!

ঢেউ ততক্ষণে আবারও জ্ঞান হারিয়েছে... ঢেউকে বুকে আঁকড়ে ধরে সমুদ্র স্বগতোক্তি করে,

সমুদ্র : না... না... ঢেউ-এর সাথে কথা না বলে এতবড় কথাটা কাউকে বলা যাবে না... এতে সবাই ঢেউকেই আবার ক্ষতবিক্ষত করবে... মেয়েটা এমনিতেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভেতর ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছে... আমাকে ওকে আগলে রাখতে হবে... আগলে রাখতে হবে আমাকে ওকে....

দূরে তখন কোথাও বেজে ওঠে,


"নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল,

বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল॥

আকাশের লাগে ধাঁদা  রবির আলো ওই কি বাঁধা॥

বুঝি ধরার কাছে আপনাকে সে মাগল,

 সর্ষেক্ষেতে ফুল হয়ে তাই জাগল॥"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance