Anishri's Epilogue

Romance

3.4  

Anishri's Epilogue

Romance

অনাদৃতা (পর্ব ৭)

অনাদৃতা (পর্ব ৭)

19 mins
313


"যাহাকে ভালোবাসিয়াছো... সে যদি ভালো না বাসে, এমনকি ঘৃণাও করে... তাও বোধ করি সহ্য হয়... কিন্তু যাহার ভালোবাসা পাইয়াছি বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছি, সেইখানে ভুল ভেঙ্গে যাওয়াটাই নিদারুণ... পূর্বেরটা ব্যাথাই দেয়, কিন্তু শেষেরটা ব্যাথাও দেয়, অপমানও করে... আবার এই ব্যাথার কোনো প্রতিকার নাই, এ অপমানের কোনো নালিশ নাই..." (কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

আপেক্ষিকতা বলে কিছু আছে কি !!! অনন্ত নক্ষত্রবিথীতে দিন, দিনের পর রাত, মাস-ঋতু, বছরের আর্বতে সম্পর্কগুলো স্বার্থের টানে, আপেক্ষিকতার নিয়মে এক নিমেষেই সম্পর্কগুলো বদলে যায়... যেখানে আকাশের নক্ষত্রও অমরত্ব পায় না কখনো, সেখানে কোনো সম্পর্ক কি আদৌ স্থায়ী হবে বা আদৌ স্থায়ী হওয়া কি সম্ভব !!! 


বিশ্বভারতী :

----------------

বাইরে তখন চাঁদ উঠেছে... পূর্ণিমার রাত কি !!! হতেও পারে, কাল তো শ্রাবণী পূর্ণিমা ছিল... প্রকৃতি যে তার মোহময় মায়াবী রূপ চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, একটা স্নিগ্ধ নির্মল পরিবেশ... এই পরিবেশেই তো সবাই বেঁচে থাকতে চাই... কিন্তু মানুষের লোভ আর লোলুপতা সব নষ্ট করে দেয়... কবে বুঝবে মানুষ !! তাই আজ চাঁদের জ্যোৎসাতেও যে বেদনার অঞ্জন... সব ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার জন্য হয় না, কিছু ভালোবাসা স্মৃতি হয়ে থাকার জন্যও হয়...

জানলা থেকে ফিরে আসে আদ্বান... গলাটা একটু শুকিয়ে যাওয়াতে জল খেতে গিয়ে অন্যমনস্কতাবশতঃ সে মৈথিলীর ব্যাগে জল খুঁজতে যায়, হঠাৎই বেশ কয়েকটা ওষুধের Strip ওর হাতে এসে পড়ে... বেশ বিস্মিত হয় আদ্বান... কোন ওষুধের Stripe এইগুলো !!! এক মুহুর্তের জন্য বুকটা যেন আৎকে ওঠে আদ্বানের... তাহলে কি তার সন্দেহই ঠিক !!! দিব্যান্তর সব স্মৃতি ভুলতে মৈথিলী ঘুমের ওষুধ খেত... কিন্তু কতটা খেত !!! সবদিক থেকে ওর বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায় নি তো !!! নাহহহ... একটা মানুষের স্বার্থপরতার জন্য তার মেথি পাতা শেষ হয়ে যেতে পারে না... আদ্বান কাল কথা বলে এইটুকু বুঝেছে যে, মৈথিলী আজো দিব্যান্তর স্মৃতিতে বাঁচে... কিন্তু তাই বলে এইভাবে নিজেকে শেষ করে দেবে মেয়েটা !! এইরকম কত আত্মহনন আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত হচ্ছে, সব আত্মহত্যা কি আর নথিভুক্ত হয় !!! আদ্বান একবার ঘুমন্ত মৈথিলীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়, তারপরেই ওষুধের Strip-টা নিয়ে Ward-এর বাইরের দিকে হাঁটা লাগায়...

'সকাল সকাল আকাশ কালো, জমানো যেন ব্যাথা

ঝরঝর মুখর বাদল বললো সব কথা

মানুষ অদৃশ্য কিছু বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত... নিতান্তই সস্তা অথচ অত্যন্ত দামী কিছু অদৃশ্য বোঝা...হয়তো চাইলেই যে কোনো 'সময়' সেই বোঝার ভার হাল্কা করতে পারা যায়... কিন্তু মানুষ তা পারে না যে... সেই 'সঠিক সময়'-টাই যে বুঝতে পারে না... অজুহাত না আক্ষেপ- কার জন্য মন আজ নিরুদ্দেশ, তার কারণটা বৃষ্টির জলে ধুয়ে মুছে গেছে কবেই...' (সংগৃহীত)

পরেরদিন সকালে আদ্বান চোখে মুখে জল দিয়ে এসে দেখে মৈথিলী পাগলপ্রায় হয়ে নিজের ব্যাগে কিছু একটা খুঁজছে... আদ্বানের বুঝতে অসুবিধা হয় না, মৈথিলী ঠিক কি খুঁজে চলেছে !! সে ধীর অথচ দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে এসে পাশের টেবিল থেকে মৈথিলীর সকালের ওষুধগুলো ওর দিকে এগিয়ে দেয়,

আদ্বান : (ঋজু স্বরে) তোর ওষুধ...

মৈথিলী : (অস্বাভাবিক অস্থিরতার সাথে) আদ্বান... আদ্বান... আমার ব্যাগে কিছু ওষুধ ছিল... আমার খুব প্রয়োজন... খুঁজে পাচ্ছি না...

আদ্বান : (একইরকম ঋজু স্বরে) পাবি না... আমি ফেলে দিয়েছি....

মৈথিলী : (ক্ষোভের সাথে) কিইইই !!! ফেলে দিয়েছিস !!! কেন !! আমার Permission ছাড়া আমার ব্যাগে হাত দিয়েছিস কেন !!! Why !!!

মৈথিলীর চোখে চোখ রেখে মৈথিলীকে সরাসরি প্রশ্ন করে আদ্বান, কিন্তু অসহিষ্ণু মৈথিলী তার অস্থিরতার দরুণ কিছুতেই আদ্বানের চোখে চোখ রাখতেই পারে না... আকুলভাবে এদিকে ওদিকে কিছু খুঁজতে ব্যস্ত থাকে...

আদ্বান : (কাতর স্বরে) সেটা তো আমারও প্রশ্ন, মৈথিলী... কেন !!! তোর ঠাকুমার ঘুমের ওষুধ তুই খাস কেন !!!

মৈথিলী ততক্ষণে ওষুধ না পেয়ে Aggrassive হয়ে উঠেছে... ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে তার... আদ্বানের চেনা মৈথিলী যেন একেবারেই একটা অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে... আজ যেন আদ্বানের উদ্বেগ, আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা, মানসিক যন্ত্রণা কিছুই তার চোখে পড়ছে না...

মৈথিলী : (অসহিষ্ণুভাবে) আমি কিছু জানি না... আমার... আমার ওষুধ তুই ফেরত দে... ফেরত দে বলছি....

আদ্বান : (কঠিন স্বরে) মন দিয়ে বোধহয় আমার কথাটা শুনিস নি... ফেলে দিয়েছি আমি....

এবার একেবারেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মৈথিলী... মূহুর্তে মধ্যে উঠে আদ্বানের জামার কলার ধরে বলে,

মৈথিলী : কোন !!! কোন অধিকারে !!!

কেন জানে না আদ্বান, তার মনে হলো দূরত্ব জমাট বাঁধছে তাদের দু'জনের মধ্যে... হারিয়ে যাচ্ছে তাদের দু'জনের ভরসা, বিশ্বাস, নির্ভরশীলতা... যখন নিভৃত অন্তরে বুনে চলা একবুক আশা ধীরে ধীরে নিভে আসতে লাগল, আদ্বানের মনের কথাটা যেন এবার ওর অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল...

আদ্বান : বন্ধুত্বের অধিকারে...

আদতে একেকটা ঝড়, যা পুরনো হয়ে যায় হয়তো... তবে তার উপস্থিতি স্মৃতির নৌকা বেয়ে অবশিষ্ট জীবন জুড়ে বয়ে চলে... আদতে মানুষ কিছুই ভোলে না, ভোলার ভান করে মাত্র....

মৈথিলী : (ক্ষুব্ধ স্বরে) আর সেই অধিকারে বেইমানি করলি আমার সাথে... ঠিক দিব্যার মতো... বেইমানিটা বোধ হয় মানুষের রক্তে... তাই একবার সুযোগ পেলেই সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না... দুঃখ একটাই, তুইও তার ব্যতিক্রম হলি না.. হুঃ !!

শেষে কি না এই প্রাপ্তি আদ্বানের !! সে দিব্যার মতো !!! কি এমন অতিরিক্ত চেয়েছিল সে !! শুধুমাত্র বন্ধু হয়ে পাশে থাকতে চেয়েছিল মৈথিলীর... চেয়েছিলো বন্ধুত্বের অধিকারে মৈথিলীকে সুস্থ করতে... খুব বেশি কিছু মনে হয় না প্রত্যাশা করেছিল... কিন্তু মেথি পাতার সাথে যে কাকতাড়ুয়াদের বন্ধুত্ব হতে নেই, সেটা আদ্বান ভুলে গিয়েছিল... তাই এই অপমানটাই হয়তো প্রাপ্য আদ্বানের... কিন্তু তাই বলে ওই মানুষরূপী অকৃতজ্ঞ, প্রতারক মেয়েটার সাথে তুলনা করলো !! এতটাই খারাপ সে ?? মূহুর্তের ক্ষোভে সজোরে একটা থাপ্পড় এসে পড়ে মৈথিলীর গালের উপর...মৈথিলী ছিটকে গিয়ে পড়ে বিছানায়, channel করা হাতে ব্যাথা পায় সে... আদ্বান মৈথিলীকে দুই হাতের শক্ত বাঁধনে নিজের কাছে টেনে জলভরা আগুনে দৃষ্টিতে মৈথিলীকে কঠোর স্বরে বলে,

আদ্বান : হ্যাঁ... আমি দিব্যার মতো বেইমান... তাই তোকে মরতে দেখতে পারব না....

মৈথিলী : (কান্নাভেজা গলায়) তুই আমাকে মারলি !!! ছিঃ আদ্বান... সব পুরুষত্ব কি কেবল মেয়েদের গায়ে আঘাত করেই ফলাতে হয় তোদের !! 

এতক্ষণে যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে আদ্বান চমকে ওঠে... যেটা করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না, সেটা সে ক্ষণিক ক্ষোভে কি করে ফেলল !!!

মৈথিলী : (উন্মাদপ্রায় হয়ে) তুই চলে যা... এক্ষুনি চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে... আমি তোর মুখ দেখতে চাই না... দেখতে চাই না আমি তোর মুখ...

আদ্বান ধীরে ধীরে নিজের বাঁধন থেকে মুক্ত করে মৈথিলীকে... তারপর নিজের ব্যাগ তুলে মাথা নীচু করে মৈথিলীর সামনে থেকে চলে যায়...

ডক্টর বর্মন : আদ্বান... আদ্বান... কোথায় যাচ্ছো তুমি !!!

ডক্টর বর্মনের কথায় আদ্বান একটু থমকে দাঁড়ায়... তার মুখের জমাট বাঁধা মেঘ দেখে ডক্টর বর্মন সহজেই অনুমান করে নেয় কি হয়েছে আদ্বানের !!!

ডক্টর বর্মন : মৈথিলী কিছু বলেছে !!! গায়ে হাত তুলেছে !!!

আদ্বান : না... না... ও গায়ে হাত তোলে নি...

ডক্টর বর্মন : আদ্বান, তুমি চলে যেতে চাইলে চলে যেতে পারো... মৈথিলীর কিন্তু এইসময় একজন ভালোবাসার মানুষের খুব দরকার, যে ওকে এই Phase দুই হাতে আগলে রাখবে কোমলে-কঠোরে... শাসনে হোক বা সোহাগে... কারন কথায় আছে, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে... আর মৈথিলী... ও দীর্ঘদিন Physically, Mentally 'Burnt Out' হয়েই কিন্তু আজ এই অবস্থায়... মৈথিলী অন্তরের হাজারটা ক্ষতদাগ লুকিয়ে একগাল হাসির মেলা নিয়ে তোমাদের সামনে ঘুরে বেড়াত বলে হয়তো কেউ অনুভব করে নি, সে ধীরে ধীরে রক্তাক্ত অন্তর নিয়ে সর্বস্বান্ত, একাকী হয়ে গেছে... ওর অতীতের মূহুর্তগুলো আজো ওর অন্তরে স্থির হয়ে আছে... তাই ও ওই ওষুধগুলো খেতো, যেটা আমি তোমাকে কাল রাতে বললাম যখন তুমি ওই ওষুধগুলো নিয়ে এলে আমার কাছে... কিন্তু আজ তার পাশে ওর হাতটা শক্ত করে ধরার মতো কেউ নেই, হয়তো তুম... তবে আমি তোমাকে জোর করব না... তুমি বয়সে অনেকটাই ছোট আদ্বান... তাই এই অবস্থায় মৈথিলীর মতো মানুষের পাশে দাঁড়াতে গেলে যে মনের জোরটা লাগে, সেটা তোমার কাছ থেকে আশা করতে গেলে একটু বেশিই দাবী করা হয়ে যাবে তোমার কাছ থেকে... মৈথিলীর Caseটা এমনিতেই almost Lost Case হিসেবেই... (ক্ষণিক নীরবতা).... কিছু মানুষ থাকে আদ্বান, কিছু সম্পর্ক থাকে- যারা পরস্পরকে ছেড়ে কখনো যায় না, বলা ভালো যেতে পারে না... তাদের মনে আশা থাকে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে... হয়তো মাঝে মাঝে ক্লান্তি আসে, তবুও ওইটুকু আশা তাদের ছেড়ে কখনো যায় না... আসলে হতে পারে অনেক কিছুই, হয়তো সবকিছুই স্বপ্ন নয়... বাস্তবে স্বপ্নরাও সত্যি হয়, যদি খুব খাটি ভালোবাসা থাকে...

হঠাৎই মৈথিলীর ফোনটা উড়ে এসে পড়ে ওদের পায়ের কাছে... নার্স একপ্রকার ভয়ার্ত হয়েই দৌড়ে এসে বলে,

নার্স : স্যার, মৈথিলী ভয়ঙ্কর Aggrassive হয়ে উঠেছে... সবকিছু ছুঁড়ে দিচ্ছে... তছনছ করে দিচ্ছে...

ডক্টর বর্মন : তবে এখন আসি আদ্বান...

আদ্বান বেশ কিছুক্ষণ ওখানেই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে... হঠাৎই ওর কানে আসে মৈথিলীর আর্ত চিৎকার...

ছেড়ে দাও আমাকে... ছেড়ে দাওওওও.... আমি ইঞ্জেকশন নেব না... Pleaseeee.... ছেড়ে দাওওওও....

আদ্বান দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে দেখে মৈথিলীর শরীরের Nerve Soothing Injection ওকে দেওয়া হয়ে গেছে... মেয়েটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে... আদ্বান আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না... দৌড়ে মৈথিলীর পাশে এসে দাঁড়ায়, হাত রাখে ওর মাথায়... মৈথিলী শান্ত চোখে আদ্বানের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখটা ভরে আসে অভিমানী শ্রাবণে... ঘোর লাগা গলায় মৈথিলী বলে ওঠে,

মৈথিলী : তুই !! খেয়েছিস কিছু !!!

আদ্বান : জানি আমি ক্ষমার যোগ্য নই... তবুও আমাকে কি ক্ষমা করা যায় মৈথিলী !!!

মৈথিলী : আম... আমি তো... তোকে ক্ষমা করার কে আদ্বান !! আমি তো অবা... অবাঞ্ছিত.... অনাদৃত... আমার... আমার ভুলের শাস্তি তো আমাকে পেতে...

আদ্বান : ক্ষমা কর মৈথিলী... এইভাবে দূরে ঠেলে দিস না...

মৈথিলী : তখন... রা... রাগের মাথায়... তোকে বাজ... বাজে কথা বলে.... দিলাম... Sor... Sorry... Sorry....

আদ্বান : তোর বন্ধুত্বের অধিকার থেকে আমি নিজের দোষে ভ্রষ্ট হলাম... নিজের দোষে....

মৈথিলী কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়ে... আদ্বান ঘুমন্ত মৈথিলী হাতটা নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে একবার তাতে অধর পরশ দিয়েই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে... হঠাৎই পিঠে একজনের স্পর্শ অনুভব করে চমকে পিছনে তাকায় সে...

দুপুরবেলা :

--------------------

মৈথিলী টেবিলে রাখা ছুরিটা সবার অলক্ষ্যেই তুলে নেয়... আজ যে সে একেবারেই নিঃস্ব, রিক্ত... যে ওষুধের ভরসায় সে সব যন্ত্রণা ভুলে থাকতো, আদ্বান সেইটুকুও তার কাছ থেকে সরিয়ে নিল... হয়তো সবাই ভাববে, মৈথিলী হঠকারিতা করেছে... কিন্তু নাহ... এই সিদ্ধান্তটা মৈথিলী ভীষণ ঠান্ডা মাথাতেই নিয়েছে... মৈথিলী জীবনে সবকিছু হারিয়েছে... সব ভালোবাসা হারিয়েছে... কখনো অন্য কোনো চরিত্রের জন্য, কখনো অপরিণত ভাবনার জন্য, আবার কখনো শুধুমাত্র অন্য কারোর Ego-র জন্য... মৈথিলী ধীরে ধীরে এইসব হেরে যাওয়াটা রপ্ত করে নিয়েই বেঁচে ছিল... কিন্তু আদ্বানের এই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বটা সে কিছুতেই যে গ্রহণ করতে পারছে না... ছেলেটা বড্ড বেশি নিজেকে মৈথিলীর দুর্ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে ফেলছে... নাহহ.. নাহহহ... মৈথিলী আদ্বানের এতবড় ক্ষতি করতে পারে না... কিছুতেই না... আদ্বান গেছে মৈথিলীকে হাসপাতাল থেকে Discharge করাতে... আসতে সময় লাগবে আদ্বানের... তার আগেই মৈথিলীকে সবকিছু শেষ করে দিতে হবে... দিতে হবেই... ছুরিটা শক্ত করে নিজের কব্জির উপর ধরে চোখ বন্ধ করে মৈথিলী...

মৈথিলী : (স্বগতোক্তি করে) আর একটু সাহস মৈথিলী... আর একটু সাহস আর শরীরের সব শক্তি একত্রিত কর... একটু কষ্ট হবে তোর... কিন্তু তোর একমাত্র কাছের মানুষ, তোর বন্ধু আদ্বান মুক্ত হয়ে যাবে রে... ওর জন্য এইটুকু কষ্ট করতে পারবি না তুই !!!!

হঠাৎই তার ছুরি ধরা হাতটা শক্ত করে ধরে এক ঝটকায় ছুরিটা কেড়ে নেয় সেই তার চিরপরিচিত স্পর্শ....

আদ্বান : (যন্ত্রণাবিদ্ধ গলায়) কি করতে যাচ্ছিলি তুই মৈথিলী !!! আমাকে এত কষ্ট দিয়ে কি পাস তুই, একটু বলবি !! কেন এমন করছিস বারবার... কেন !!

মৈথিলী আজ আবার ভাষা হারিয়েছে... জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে একটাও কথা বলছে না.... কারুর সাথেই না.... মৈথিলীর শূন্য দৃষ্টি ছাড়া আদ্বান আর কিছুই প্রত্যুত্তর পায় না.... ক্ষণিক চোখ বন্ধ করে সে নিজের আত্মবিশ্বাস ফেরায়... মৈথিলীর আত্মবিশ্বাস একেবারেই তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে, বা হয়তো নিঃশেষই হয়ে গেছে... তাই আজ আদ্বানের নিজের আত্মবিশ্বাসের বড় দরকার, যাতে সেই বলে সে মৈথিলীকেও বলিয়ান করতে পারে.... তাই এই সময়টা অবুঝ মৈথিলীর সাথে মান অভিমানের নয়, বরং অগোছালো মৈথিলীকে আগলে রাখার সময়...

আদ্বান : চল... তোর হসপিটাল থেকে ছুটি হয়ে গেছে... আজ আমরা ঘুরতে যাব... দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েই এলো... চল....

মৈথিলীর ব্যাগটা তুলে নেয় আদ্বান... নার্স এসে মৈথিলীর হাত থেকে Channel খুলে ব্যান্ডেজ করে দেয়... আদ্বান হাত বাড়িয়ে মৈথিলীকে ভীষণ আগলে নিয়ে বেড থেকে নামায়... মৈথিলী আদ্বানকে একটাও প্রশ্ন করে না, আদ্বানের হাত ধরে ছোট্ট শিশুর মতো টলমল পায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়....

সোনাঝুড়ি :

-----------------

আদ্বান মৈথিলীকে ক্যানেলের পাশে একটা গাছের তলায় বসায়... মৈথিলী একপ্রকার নিঃশব্দ হয়ে গেলেও এই জায়গাটায় এসে ওর মুখেও কেমন যেন একটা উজ্জ্বল দীপ্তির আভা খেলে যায়... জলের ছলছল হাওয়া, একটু ঠান্ডা এসে ওর মুখে আছড়ে পড়ে... চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে মৈথিলী সেই শীতলতা অনুভব করে... হয়তো এই শুদ্ধ মুক্ত বায়ুটারই বড্ড প্রয়োজন ছিল মৈথিলীর এই গুমোট জীবনে...

আদ্বান : This is for you, Mam....

মৈথিলী চোখ খুলে দেখে আদ্বান শালপাতার প্লেটে ওর জন্য ঘুগনি এনেছে, একটু বেশি করে টক দই, পেয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা কুচি দিয়ে....

মৈথিলীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে... মৈথিলীর মুখের উজ্জ্বলতা মুসৌরির সেই উদিত সূর্যের কথা মনে পড়ায় আদ্বানকে... মৈথিলী কাঁপা কাঁপা হাতে ঘুগনি তুলতে যায়, কিন্তু পারে না... আদ্বান নিজের হাতে করে মৈথিলীকে ঘুগনি খাইয়ে দেয়... মৈথিলী আর আদ্বান দু'জনেরই মুখ স্মিত হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে... কিন্তু তা নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী হয়... হঠাৎই মৈথিলীর জোরে জোরে হেঁচকি উঠতে শুরু করে... হেঁচকি তুলতে তুলতে ঝালে হু হাঃ করতে শুরু করে মৈথিলী... চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করে ওর... অপ্রস্তুত আদ্বান দ্রুত ওকে জল দেয়... কিন্তু জল খাবার পর চোখের জল মুছতে মুছতে মৈথিলী ফুলে ফুলে হাসতে থাকে... সেই হাসি আদ্বানের মুখেও ছোঁয়া লাগায়... লঙ্কাগুলো ফেলে দু'জনেই ঘুগনি শেষ করে....

আদ্বান আর মৈথিলী বেশ কিছুক্ষণ ক্যানেলের ধারে বসে থাকে... অবশ্য অসুস্থ মৈথিলী খানিক পরেই তার ক্লান্ত মাথাটা আদ্বানের কাঁধে এলিয়ে দেয়... বেশ কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধতার পর আদ্বান বলেই ফেলে,

আদ্বান : আজ নিজের দুর্ঘটনার কথা বল আমাকে মৈথিলী... আমার জন্য নয়... কিন্তু নিজের জন্য বল মৈথিলী... নিজের ভেতরের কষ্টগুলোকে মুক্তি দে... আমি আছি তোর পাশে... আর আমৃত্যু থাকব... কিন্তু তুই একটু হাল্কা হো, মৈথিলী... আমি তোকে এইভাবে ধীরে ধীরে মরতে দেখতে পারছি না... Please মৈথিলী, ওই কথাগুলোকে এই ক্যানেলের জলেই ভাসিয়ে দে... আমি আছি শক্ত করে তোর হাতটা ধরে... তোকে ডুবতে দেব না... কিন্তু তুই আজ বল... Please....

বেশ জোরে একবার ফুঁপিয়ে ওঠে মৈথিলী....

মৈথিলী : আমার ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা সবকিছু শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছিল সেদিন....

আদ্বান : ভুল... ভালোবাসা কখনো হারে না, হেরে তো যাই আমরা... জীবনের কাছে, পরিস্থিতির কাছে, ষড়যন্ত্রের কাছে... কিন্তু পুরাতনের প্রতি দুর্বলতাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে জীবনের নতুন রঙে কেন নিজেকে রাঙিয়ে নিচ্ছিস না তুই !!! কেন আমার এই অতি সাধারণ বন্ধুত্বটা থেকেও তুই পালিয়ে বেড়াচ্ছিস.... কেন নতুনকে আপন করার সাহস নেই তোর !!! কেন !!! বল মৈথিলী... বল...

মৈথিলী : কিছু মানুষ বাস্তবে বড্ড একা হয় আদ্বান... বড্ড একা... তারা জায়গা বুঝে মিথ্যে বলতে পারে না, তারা কারোর মনের মতো হতে গিয়ে নিজস্বতা লুকোতে পারে না... বাস্তব তাদের রূঢ় আঘাত দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে বেশিরভাগ সম্পর্ক মানেই সুবিধার আদানপ্রদান... এটা ফুরোলেই সব শেষ... একা থাকা বোধহয় বারংবার কষ্ট পাওয়ার চেয়ে ভালো... তাই একটা সময় আসে, যখন তার দিকে কেউ নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও সে আর সেই হাত ধরতে পারে না... মনে হয় সবটাই তাৎক্ষণিক... মরীচিকা যেন.... হাত দিয়ে ছুঁতে গেলেই যেন স্বপ্নটা ভেঙে যাবে....

তাই হয়তো জীবনে সব চাওয়া বোধহয় পূর্ণতা পেতে নেই, কিছু পূর্ণতায় অপূর্ণতা থাকাও ভালো... মাধুর্য্য বিন্যাস করে....

এই রাত ! বেড়ে যায় !

তবু চোখাচোখি হয় নাই দেখা

আমাদের দুজনার! দুইজন, একা ! 

                      (জীবনানন্দ দাশ)

ঝড় যেমন ওঠে, তার ভয়াবহতায় প্রলয় আসন্ন বলে আশঙ্কার দোলাচল তৈরি করে... তেমন তা থেমেও যায়... তেমন তা থেমেও যায়... এক কালবৈশাখী কেটে গিয়ে আরেক কালবৈশাখী... শাশ্বত শূন্যতা বলে কিছু নেই এখানে... প্রচন্ড দাবদাহে পৃথিবী পৃষ্ঠের বাতাস হাল্কা হয়ে উপরে ওঠার পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তার কাল দীর্ঘায়িত হলেই মনে হয় এই রিক্ততা বোধহয় আর কোনোদিন কাটবে না... কিন্তু সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য শীতল বাতাসের কোথা থেকে উড়ে আসছে, তা আগাম বোঝা যায় না... প্রবল বারিধারায় তপ্ত ধরা সিঞ্চিত হলে তবে বোঝা যায় যে সে এসেছে... বছর ঘুরে যায়... গ্রীষ্মের দহন, রিক্ততা আর রুক্ষতা কেটে গিয়ে বর্ষা, শরৎ আসে, শীতের পরে বসন্ত... পৃথিবীর আহ্নিক আর বার্ষিক গতির চক্রে কোনো পরিবর্তন হয় না...

সোনাঝুরি :

---------------

"সন্ধ্যা বেলার এই সময়টা ভালো না.. এই সময় মানুষ বড় একাকীবোধ করে.. তাদের বুক হুহু করে... অকারণেই তাদের চোখ ভিজে ওঠে....সন্ধ্যা বেলার এই অদ্ভুত সময়টাতে প্রিয়জনদের কাছে যেতে

নেই... তবু সব মানুষই প্রিয়জনদের

কাছে যাবার জন্য এই সময়টাই বেছে নেয়.. কেন কে জানে !!" (দ্বৈরথ, হুমায়ূন আহমেদ)

কিন্তু আদ্বান একাকী মৈথিলীর হাত শক্ত করে ধরার জন্য এই সময়টাই বেছে নিল... আমরা যতই বড় হই না কেন, আমাদের সচেতন মনের আড়ালে একটা অবচেতন মন আছে... সে যে বড়ই ছেলেমানুষ, বড়ই আদুরে... প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে আসলেই যেন একটু আদর পাবার জন্য তার আকুলতা বেড়ে যায়... তাই আদ্বান নির্দ্বিধায় মৈথিলীর কোলে শুয়ে ওকে একটু চুলে বিলি কেটে দিতে ইশারা করে... এমনিতে মৈথিলীর চেহারাতে যেন সুনামী পরবর্তী এক ভূখন্ড নিঃশব্দ ভয়াবহতা, কিন্তু আদ্বানের আব্দার মৈথিলীর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে দেয়... আদ্বানের একাকীত্ব, তার বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার গভীরতা এবং তীব্রতাকে দূর থেকে অনুভব বা উপলব্ধি কিছুই করতে পারে নি মৈথিলী... বুঝলো যখন মৈথিলীকে মৃত্যু ছোবল মারতে উদ্যত হলো.... শেষ কবে কেঁদেছে, ভুলে গেছে মৈথিলী... আজ আদ্বানকে এই ব্যবহার করতে দেখে বুকের ভেতরটা যেন হু হু করে উঠলো তার, চোখের কোলটাও সামান্য আর্দ্র হয়ে আসে... মনের দ্বিধা নিয়েই আলতো করে আদ্বানের চুলে হাত রাখে মৈথিলী... আর সেই স্পর্শেই বোধহয় দু'জনের আবেগ এবং সংযমের শেষ আলগটুকুও আলগা হয়ে গেল... মৈথিলী ঝুকে এতদিনের রণক্লান্ত আদ্বানের মাথাটা আলতো করে নিজের বুকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে... ছেলেটা একা একা সাধ্যাতীত কষ্ট সহ্য করছে তার জন্য... আদ্বানও দুই হাতে আগলে নেয় মৈথিলীকে... মৈথিলীর বুকে মুখ গুঁজে মৈথিলীর মমতার ওমটুকু অনুভব করে... এই আলিঙ্গনস্পর্শ এই দুই বন্ধুকে প্রথমবার এইটুকু অনুভব করায় যে, সব আলিঙ্গনে কামের গন্ধ, স্পর্শ থাকে না... থাকে মমতার ওম, বন্ধুত্বের গাঢ়ত্ব, আর আত্মিক সম্পর্কের উষ্ণতা... কখন যে জীবনের সব অপূর্ণতার জলভরা মেঘ আবেগ আর অনুভূতির শীতল বাতাসের স্পর্শে ভারী হয়ে যায়, দু'জনের কেউ তা বুঝতে পারে না... সেই ঘন বাষ্প সবার অলক্ষ্যেই, স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝরে পড়ে... মৈথিলীর চোখের জলে ভিজে যেতে থাকে আদ্বানের কপাল, আর আদ্বানের চোখের জলে মৈথিলীর গাল... মৈথিলী আর আদ্বান জীবনে প্রথমবার একে অপরকে এইভাবে আঁকড়ে ধরতে পারছে... এই প্রথম তারা জানলো, শরীরের আকর্ষন ছাড়াও মনের টান তৈরি হয়... ভাবে, সত্যিই তাদের প্রথম ভালোবাসায়, প্রথম কাউকে আপন করে চাওয়ায় কতটা ভুল ছিল... আজ তারা নিঃস্বার্থভাবে একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেলেও আপন করে নিতে পারছে না... মৈথিলীর কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই যে আদ্বানের মতো বড় মনের মানুষকে আপন করে নেবার... ঝড়ে ছিন্ন পত্রকে যেমন পায়ে করে দুমড়ে, মুচড়ে, দলে নষ্ট করে দেয়, তাকে ঠিক সেভাবেই দলে দিয়ে গেছে ঋক... সে যে আজ নষ্টা... আজ আদ্বানের জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে মৈথিলীর... জীবনে এই প্রথম হলো কারুর জন্য... একজন পুরুষ তার পুরুষত্বে, তার দৃঢ়তায় মৈথিলীকে উতলা করে দিচ্ছে, কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে মৈথিলীর গহন মনে, ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে মৈথিলীর শরীরের গভীরতম অনুভূতিস্থল... আদ্বান তাকে মুখে একদিনও না বললেও মৈথিলী জানে, আদ্বান অন্তর থেকে কতটা ওর সাথে জড়িয়ে পড়েছে... মৈথিলীও আদ্বানকে ভরসা করে, বিশ্বাস করে... কিন্তু ওরা একে অপরকে ভালোবাসে কি !!! নাকি এটা শুধুই ওই খড়কুটো আঁকড়ে ধরা !! আচ্ছা, এটাই কি ভালোবাসা !! তাহলে দিব্যান্তর প্রতি তার অনুভূতির নাম কি ছিল !! জানে না মৈথিলী, জানতে চায় না... কিন্তু আদ্বান কি মৈথিলীকে ভালোবাসে !!! একতরফা, অসম হলেও হয়তো ভালোবাসে... মনের কোণে একটা ছোট্ট আশা উঁকি মারে... আদ্বান স্বল্পভাষী, দায়িত্ববান, সক্ষম, স্থির... সব জেনেও ও যদি বর্মের মতো মৈথিলীকে ঘিরে থাকে, আগলে নেয় তার ভালোবাসার মোড়কে !!! না... না... আদ্বানের থেকে বড্ড বেশি দাবী করে ফেলছে মৈথিলী... আবারও জীবন নিয়ে পরীক্ষা করতে বড় ভয় করে মৈথিলীর... আর আদ্বানকে মৈথিলী ঠকাতে পারবে না... কারন, আদ্বানকে মৈথিলীও ভালোবাসে, কিন্তু সে এটাও জানে এই ভালোবাসার টানে তার এই মরে যাওয়া শরীর কোনোদিন কথা বলতে পারবে না... শরীরবিহীন ভালোবাসা দিয়ে কি পুরুষকে তৃপ্ত রাখা সম্ভব !!! তাই আদ্বানকে সে দূর থেকে এইভাবেই ভালোবেসে যাবে, ওর মঙ্গলকামনা করে যাবে... এমন ভালোবাসার যে কোনো পরিণতি হয় না, অবশ্য মৈথিলী আর ক'টা দিনেরই বা অতিথি এই পৃথিবীর... যতদিন থাকবে, তার এই একতরফা ভালোবাসার নির্যাসটুকু নিয়েই বাঁচবে... তবে জীবন শেষ হবার আগে সে তার ভালোবাসার মানুষ, আদ্বানকে বলে যাবে তার জীবনের সেই অন্ধকার ভয়াবহতম অধ্যায়ের কথা, তার যন্ত্রণা, তার কুন্ঠা, তার দ্বন্দ্ব, তার মৃত্যুর কথা... অন্ততঃ একজন জানুক, তার আসল সত্তাকে... আচ্ছা, আদ্বান যদি নিঃস্বার্থভাবেই তাকে গোপনে ভালোবেসে থাকে তাহলে তার জীবনের সেই ভয়াবহ মূহুর্তের নিরুপায় অবস্থাটা বুঝবে না !!! ঘেন্না করবে ওকে !! যদি ঘেন্না করে ছেড়ে চলে যায় !! পারবে তো মৈথিলী সেই আঘাত সহ্য করতে !!! না, না... মৈথিলী কবে থেকে এতটা স্বার্থপর হয়ে গেল !!! আদ্বানের চলে যাওয়াই তো ভালো, নয়তো মৈথিলীর এই তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়া সহ্য করতে না পেরে যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে !! না, না... তার থেকে ভালো আদ্বান মৈথিলীকে একলা করে চলে যাক... অন্ততঃ ও তো বাঁচুক... মৈথিলী আদ্বানকে আরো আঁকড়ে ধরে ওর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়... এইটুকুই না হয় থেকে যাক... কিন্তু আদ্বান ফুঁপিয়ে ওঠে...

আদ্বান : কেন !! কেন ঘুমের ওষুধ খেতিস, মেথি পাতা !!!

মৈথিলী : কি করব !! প্রতি রাতে পাঁচ ছ'টা ঘুমের ওষুধ না খেলে যে আমার ঘুম আসে না... একটা দিনের স্মৃতির ঢেউ বারবার আছড়ে পড়ে আমার চোখের সামনে... আমি... আমি যে নষ্টা, আদ্বান...

আদ্বান ঝটিতিতে মৈথিলীর বাঁধন ছাড়িয়ে উঠে বসে... চোখের আগুন আর দুই হাতের শক্ত বাঁধনে বেঁধে নেয় মৈথিলীকে... বাঁধন এতটাই শক্ত মনে হয় যেন আদ্বানের ওই শক্ত শক্ত আঙুলগুলো মৈথিলীর হাতে গেঁথে বসে যাবে...

আদ্বান : (কঠোর স্বরে) অনেক হয়েছে মৈথিলী... অন্যের নোংরা মানসিকতার দায় তুই নিবি না... আমার মৈথিলী শুদ্ধ... সে কখনো নোংরা হতে পারে না... কিছু নোংরা স্পর্শ তাকে ছুঁতে পারে, কিন্তু অশুদ্ধ করতে পারে না...

মৈথিলী : না আদ্বান, তুই সবটা শুনলে হয়তো আমাকে ঘেন্নাই...

আদ্বান : আজ আমি সবটা শুনব মৈথিলী... কিন্তু তোর মনের ওই জমাটবদ্ধ যন্ত্রণাগুলোকে মুক্তি দেবার জন্য শুনবো... আমি চাই, তোর ওই জমাটবদ্ধ যন্ত্রণাগুলো শেষ হোক... নয়তো ওইগুলো তোকে কুড়ে কুড়ে শেষ করে দিচ্ছে... আর আমি আমার মেথি পাতাকে হারাতে পারব না... কোনোকিছুর বিনিময়ে না....

ক্লান্তিতেও হেসে ফেলে মৈথিলী, আজ যে আদ্বানের সাথে তার বোঝাপড়ার দিন... মুখে হাসির রেশটুকু নিয়ে আদ্বানের বুকের স্পন্দনের উপর হাত রেখে বলে,

মৈথিলী : সারাজীবনে কতবার আমাদের কত মানুষের সাথে সম্পর্ক হয়... তারপর ধীরে ধীরে আগ্রহের অভিমুখ পাল্টে যায়, জীবনের গুরুত্ব বদলে যায়, কথা কমে আসে, সম্পর্ক হারিয়ে যায়... হয়তো আমার অতীত জানার পর তোর গুরুত্বের অভিমুখ বদলে যাবে, কথা কমে আসবে, সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যাবে... জানিস একদিন যে মেয়েটা গড়গড় কথা করে বলতো, স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকলেই মেয়ে হাসিমুখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরতো সবাইকে... সারাদিনে কি কি হয়েছে- তার কষ্ট, আনন্দ, অভিমান, দুঃখ, রাগ, সব তার বাবা-মাকে না জানানো অবধি শান্তি পেতো না... একদিন সেও হারিয়ে গেল অসফলতার অন্ধকারে... সে যে প্রতিভাবান নয়... প্রতিভাবান তার সহোদর... তাই তার অভিভাবকের গুরুত্বের অভিমুখ ঘুরে গেল... এখন সে মনের কথা মনেই রাখতে শিখে গেছে... বয়সোচিত গাম্ভীর্য এসেছে... এটাই জীবন... কথা ফুরিয়ে যায় যখন গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়... পাখি বাসা ছেড়ে উড়তে শেখে...

চমকে ওঠে আদ্বান... সত্যিই তো... মৈথিলী কি নির্দ্বিধায় ওর বাবা-মাকে মিথ্যে বলে... হসপিটালে থাকাকালীন ও যে বলে দিত, ও হোস্টেল ফিরে গেছে... ওর বাড়ির সবাই বিশ্বাসও করে নিত... ওর গলা শুনেও কি কিছু অনুমান করতো না ওরা !!! এতটাই অনাদৃত মৈথিলী !! আদ্বানের হৃদয় দ্রবীভূত হয়... যে সম্পদ যার আছে, সে তাকে কত তুচ্ছ মনে করে, যেন ওই সম্পদে তার জন্মগত অধিকার... আর অধিকারস্থ বলেই অভ্যাসে বিবর্ণ, তুচ্ছ, কদরহীন... অথচ যার তা নেই, সেইই জানে তার কি মূল্য !! এটাই কি কারণ, সবার কাছে অবাঞ্ছিত, অনাদৃত হতে হতে ও আজ নিজেকে চিনতে ভুলে গেছে... আদ্বানের বাড়ানো হাতটাও ধরতে ভয় পাচ্ছে আবার আঘাত পাবে বলে... আজ ফেলে আসা স্মৃতিগুলো কখন যেন সব এক হয়ে ঝরে পড়ছে মৈথিলীর গাল বেয়ে অবাধ অশ্রু হয়ে... ঝরে পড়ুক আজ সব যন্ত্রণা... শেষবারের মতো...

আদ্বান : কথা না বলে আমরা মানুষ হারিয়ে ফেলি... সম্পর্ক হারিয়ে ফেলি... কথা নেই, মনে পড়াও নেই... মানুষগুলো কেমন যেন ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে জীবন থেকে... কত কষ্টে একটা মানুষ একটা সুসম্পর্ক অর্জন করে... আর আমরা শুধুমাত্র নিয়মিত কথার অভাবে তা শেষ করে ফেলি... মানুষ সম্পর্ক খরচ করে ফেলে অকারণে... কত ছোট আমাদের জীবন... কত মূল্যহীন আমাদের রোজের চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ, রাগ, রোষ, ক্ষোভ, মান-অভিমান, অভিযোগ... একটা মানুষ চলে গেলে ক'দিন তাকে মনে রাখে মানুষ ?? কতদিন তোকে মনে রেখেছে দিব্যান্ত আর দিব্যা ?? সাধারণ মানুষ বাতাসের মতোন... বাতাস উষ্ণ হয়ে উপরে উঠে গেলে পার্শ্ববর্তী বাতাস ছুটে এসে শূন্যস্থান পূর্ণ করে যেমন, কেউ মরে গেলে বা জীবন থেকে সরে গেলে আত্মীয়-পরিজন, কাছের মানুষ তেমন‌ই নিজেদের প্রয়োজনে তাকে বাদ দিয়ে দেয় ধীরে ধীরে... মরে যাওয়ার আগে তাই আর কাউকে হারিয়ে যেতে দিতে ইচ্ছে করে না... কথা ফুরোতে ইচ্ছে করে না...

মৈথিলী : আমার হাতে সময় বড্ড কম, প্রতি মূহুর্তে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি আমি... তাই হয়তো এত কথার সমাবেশ... কোনোদিন আমি চাই নি জানিস কাকতাড়ুয়া... একটু একটু করে সূর্য থেকে গড়িয়ে আসা আলোরা যখন পৃথিবীর বুকে পা রাখে, গড়ে তুলছে তাদের সাম্রাজ্য... তখন কেউ জেগে বসে থাকুক আমার জন্য.. হ্যাঁ, হ্যাঁ... শুধুমাত্র আমারই জন্য তুই ভয়ঙ্কর কালো অন্ধকারে ক্লান্তিতে জড়ো হয়ে আসা দু'চোখ নিয়ে কাটিয়ে দিলি কত কত রাত !! কিন্তু আমি তোর বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরতে পারছি না... আচ্ছা, হাসপাতালে তোর কত বিল হয়েছে রে !!

আদ্বান : বিল জেনে কি হবে !!! তুই কি নিজে রোজগার করিস, যে বিল মেটাবি... যেদিন এই অনাহুত মৃত্যুকে হারিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রোজগার করবি, সেদিন নয় আমার কাছ থেকে বিল জানতে চাস...

মৈথিলী : অত সময় আমার হাতে হয়তো নেই রে... আমি না আমার H.S.-এর রেজাল্টের জন্য বেশ কিছু জায়গা থেকে পুরষ্কারস্বরূপ কিছু টাকা পেয়েছিলাম... সেই টাকা দিয়েই এই সোনার কানের দুলটা কিনেছিলাম... (কানের দুলটা খুলে) তুই এটা রাখ... এতে হবে না !!!

আদ্বানের ক্ষণিকের জন্য মনে হচ্ছিল, আরেকটা সজোরে থাপ্পড় মৈথিলীর গালে পড়লে ভালো হতো... অপরিণতমনষ্ক মেয়ে একটা... কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে, ও নিজেই এতটা ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত... ও তো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই এখন, তাই স্বাভাবিক কিছু ওর কাছ থেকে এই মূহুর্তে আশা করা যায় না... ওর এখন ভালোবাসার দরকার... শুধু ভালোবাসার... তাই মৈথিলীর হাত থেকে ওর কানের দুলটা নিয়ে ওর কানেই পরাতে পরাতে বলে,

আদ্বান : উহু... এত কমে তো আমার হবে না... আমি যা চাইব, তাই দিতে হবে কিন্তু....

আতঙ্কিত হয়ে ওঠে মৈথিলী... তাহলে কি সেই মূহুর্ত আগত !!! আদ্বান কি ওর কোনো কথা না শুনেই নিজেকে সমর্পণ করে দেবে !!

মৈথিলী : (ভয়ার্ত স্বরে) ক্কি !!! কি চাস তুই !!!

আদ্বান :

দু’হাত বাড়িয়ে আছি, কাছে এলে ঘর হবো

তোমার উঠোন হবো, এঁকে বেঁকে গাছ হবো

তোমার আঙুলে হবো আঙুলের মিল... (রুদ্র গোস্বামী)

মৈথিলী : মানে !!!

আদ্বান : এখন বুঝবি না... যেদিন বুঝবি, সেদিন তোর ওই বিলের টাকা শোধ করে দিস... সুদে আসলে আদায় করে নেব সেদিন...

বলেই একটা অদ্ভুত হাসি হেসে মৈথিলীর নাকে নাক ঘষে দেয়... তারপর কপালে আদ্বানের নির্লোভ অধর পরশ পায় মৈথিলী... ফুঁপিয়ে ওঠে মৈথিলী....


(কি আছে মৈথিলীর অতীতে !!! মৈথিলীর আশঙ্কা কি সত্যিই হবে !!! মৈথিলীর অতীত জেনে আদ্বান কি ছেড়ে চলে যাবে মৈথিলীকে !! না কি আদ্বানের অন্তরের ভালোবাসা আরো গভীরভাবে আগলে নেবে মৈথিলীকে !!! আদ্বান আর মৈথিলীর এই সুপ্ত ভালোবাসা কি পারবে অতীত আর মৃত্যুকে জয় করতে !!)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance