Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

3  

Ushri Chatterjee Bandyopadhyay

Romance Action Thriller

অন্তরালে (অন্তিম পর্ব)

অন্তরালে (অন্তিম পর্ব)

39 mins
203


(সমাপ্তি থেকে যেখানে ভালোবাসার সূচনা)


Wishywave Hospital :

------------------------------------

ধীরে ধীরে চোখের পাতা মেলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় শ্রদ্ধা... ইনায়ৎ আকাশ পানে দুই হাত তুলে চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে শ্রদ্ধার জ্ঞান ফিরিয়ে দেবার জন্য কারন, শ্রদ্ধা এখনো জানেই না যে তার জীবন থেকে দু'দুটো মাস হারিয়ে গেছে... সে একে একে সবাইকে দেখতে থাকে... তার শরীরের বেশ কিছু হাড়ের সাথে বুকের পাঁজর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল... তাই কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে শ্রদ্ধার... কেবল আকুল নয়নে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে সে... অভয়াঙ্করা আর শ্রদ্ধার মামাই দু'জনেই এগিয়ে আসতে যায় শ্রদ্ধার কাছে... কিন্তু আদর্শ অভয়াঙ্করার কাঁধে হাত রেখে তাকে আটকে দেয়... অভয়াঙ্করা অবাক দৃষ্টিতে আদর্শের দিকে তাকায়...


আদর্শ : আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার... কিন্তু এই মূহুর্তে শ্রদ্ধার উপর যদি কারুর অধিকার থাকে, সেটা মামাই-এর... রাহী তো আপনারই ছিল স্যার- আপনার সৃষ্টি, আপনার ছায়া, আপনারই অংশ... আপনার, একান্তই আপনার, আপনার আত্মজা... কিন্তু আপনি তো ওকে আপন করেন নি স্যার... ওর মাকে হারানোর দুর্ভাগ্যের ভার ওর কাঁধে চাপিয়ে আপনি ওকে ত্যাগ করেছিলেন... কিন্তু মামাই পারে নি... নিজের ছোট বোনকে হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়েও মামাই তার শেষ চিহ্ন, তার অংশ - ওই ছোট্ট রক্তমাংসের পুটুলিটাকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরেছিল... নিজের মেয়ের সাথে কোনোদিন কোনো তফাৎ করে নি.... রাহী কোনোদিন আপনাকে প্রশ্ন করবে না... কিন্তু আমি আজ আমার রাহীর হয়ে জানতে চাইছি স্যার- কেন করেছিলেন এমন কাজ !!! কেন !!


অভয়াঙ্করা : এদিন তুমি বুঝবে মেঘদূত আমার অবস্থাটা, যেদিন তুমি বাবা হবে... যখন তোমার সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য তোমার রাহীকে যন্ত্রণাতে কাতরাতে দেখবে... অথচ জানো তো, যেদিন ওর মা প্রথম নিজের শরীরে ওর অস্তিত্ব অনুভব করলো, যে সে কি অদ্ভুত অবর্ণনীয় মিষ্টি একটা উপলব্ধি... আজও বোধহয় ভাষা খুঁজে পাব না সেই অনুভূতিকে বর্ণনা করার... ভাষাতীত... প্রতিটা দিনের প্রতিটা মূহুর্ত কি অসীম রোমাঞ্চে ভরে উঠতো আমাদের... আর সাথে বুকে নানান অজানা ভয়- ও ঠিক আছে তো !! ঠিক করে বড় হচ্ছে তো !! শুতে গেলে, বসতে গেলে, নড়তে গেলে ওর লেগে যাবে না তো! আজ নড়েছে তো !! Kick করেছে তো !! মনে আকাঙ্খা আর অধৈয্য অপেক্ষা- দিনগুলো, মাসগুলো যেন আর কাটতে চায় না... আমাদের ভালোবাসার অঙ্কুর আসছে- কেমন হবে সে, কবে তাকে দেখতে পাবো, পাবো তার কোমল স্পর্শ আর সারা শরীরে দুধের গন্ধ... তার কান্নায় আমাদের দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন হবে... তবুও ক্লান্তি আসবে না, তাকে শুধুই অপলকে দেখতে থাকব... কিন্ত রাহী আসার ঠিক একমাস আগে আমাকে একটা অপারেশনে কাশ্মীর চলে যেতে হলো... রাহীর মা নিজের হাতে আমার Uniform iron করে দিল, সব গুছিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলল... কিন্তু ওই আর আমার জন্য অপেক্ষা করলো না... সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক শিউলি ভেজা ভোরে পৃথিবীতে এলো ছোট্ট রাহী... খবরটা পাবার পর আমার দু'চোখ আনন্দে জলে ভরে উঠেছিল... কিন্তু তারপরেই এলো সেই খবর... আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে সে চিরতরে চলে গেছে... শোকে, দুঃখে অমানুষ হয়ে গেলাম আমি... আমার সব রাগ গিয়ে পড়ল আমার সেই ভালোবাসার অঙ্কুরের উপর... সেই ছোট্ট কুড়িটার মুখ দেখবো না ঠিক করলাম... কথায় আছে, 'একগুয়েমি ভালো কাজে ভালো, মন্দ কাজে ভালো নয়'... আমি তখন জানতাম, শত অপেক্ষাতেও আমার ভালোবাসা আর আমার কাছে ফিরে আসবে না... আসলে কি জানো তো মেঘদূত, আমরা যে অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত... কারন অপেক্ষা পূর্ণ হবার আশাটুকু আমাদের বাঁচতে শেখায়, আর পূর্ণ না হবার ব্যাথাটুকু শেখায় বাস্তবতা... বছর পেরতে লাগলো... রাহী বড় হতে লাগল... ওকে Miss করতে লাগলাম.... কিন্তু ওই যে অপরাধবোধ... Hit of the Moment একটা কথা বলে ফেলেছিলাম- 'মেয়ে বলে ত্যাগ করলাম... ছেলে হলে আমার শৌর্য্যটা ধরে রাখতে পারত'... আমার সন্তানকে একবার ছোঁয়ার জন্য অপেক্ষার পর অপেক্ষা জমতে লাগল, কিন্তু সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারলাম না... আমার আর রাহীর মধ্যে তখন এক সমুদ্র অভিমান জমে... আমাদের ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো অপূর্ণই রয়ে গেল... কিন্তু যখন ওর উপর একের পর এক আঘাত আসতে থাকলো, আমার পিতৃত্ব আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল... প্রথমে গুলিবিদ্ধ হওয়া, তারপর ঐশ্বরিকার ওই অপহরণ... আমার ছোট্ট রাহী নীরবে আমার গালে একটা চড় মেরে দিল... বুঝিয়ে দিল, শৌর্য্যের কোনো লিঙ্গ হয় না... সেটা অন্তরে থাকে... আচ্ছা মেঘদূত, ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে তো !! ওর হাত, পা, বুকের পাঁজর, শিরদাঁড়া যেভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে... ও ফিরবে তো মেঘদূত আমাদের কাছে !


আদর্শ : আজ দু'মাস পর যখন ও কোমা থেকে ফিরে এসেছে... জীবনেও ও ফিরবে... আমি ফেরাব ওকে ওর স্বাভাবিক জীবনে... শুধু ওর আভ্যন্তরীণ ক্ষতগুলো সেরে যাক... আমি নিজে ওকে Physiotherapy করাব... স্বাভাবিক জীবনে ওকে ফিরতেই হবে... ওকে গান গাইতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে... দেখুন স্যার, মামাইকে একবার


মামাই পরম মমতায় আস্তে আস্তে শ্রদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

মামাই : আমার ম্যাও বুড়ি, কেমন আছো মা !!!

শ্রদ্ধা : ব্যা... ব্যাথা...

মামাই : কোথায় ব্যাথা মা !!!

শ্রদ্ধা : মা... মামাই... আম... আমি... আআ... আর... বাঁচ... বাঁচব না... তাই না !!


মামাই : ছিঃ মা !! এমন কথা বলতে নেই... আজ দু'মাস পর তোর জ্ঞান ফিরল... আজই এইসব কথা বলিস না মা... আমার ম্যাও বুড়ি তো কখনো তার মামাইকে কোনো কষ্ট দেয় নি... তাহলে আজ কেন এত হৃদয়বিদারক কথা বলছিস ছোট্ট মা !!! একবার আদির কথাটা তো ভাববি !!


শ্রদ্ধা চোখ বন্ধ করে একবার ফুঁপিয়ে ওঠে... ডক্টর আদর্শকে ইশারায় বলে, শ্রদ্ধার বিশ্রাম দরকার... এই মানসিক চাপ ওর ক্ষতি করতে পারে... আদর্শ সবাইকে শ্রদ্ধার কেবিন থেকে বার করে দেয়... তারপর মামাইকে জড়িয়ে ধরে বলে,

আদর্শ : মামাই, রাহী এখন ঘুমাবে...

শ্রদ্ধা : নাহহহ... তোম... তোমরা যেও না... আমা... আমার ভ... ভয় লাগছে...

মামাই : আমার তো বয়স হয়েছে মা গো... আমি যাই... আদি রইলো তোর কাছে...

মামাই আদর্শের কাঁধে হাত রেখে চোখের ভাষায় ওকে একটু একান্তে থাকতে বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়...


আদর্শ : রাহী... আহা... কোনো কথা নয়... এবার আমার রাহী একটু ঘুমাবে... আমি এই তোমার পাশে বসে রইলুম... সারারাত জেগে থাকব... এখনো ভয় লাগছে না কি আমার রাহীর !!

বুকের ভাঙা পাঁজরের যন্ত্রণাতে কথা বলতে পারে না, শুধু শ্রদ্ধার দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে... চ্যানেল করা হাতটা একটু তুলে আদর্শকে ছুঁতে চায় শ্রদ্ধা... কিন্তু হাতটা ভাঙ্গা থাকায় যন্ত্রণাতে কঁকিয়ে ওঠে সে... আদর্শ দ্রুত ওর হাতটা ধরে নেয়...

আদর্শ : না রাহী... একদম না... আর চোখের জল নয়... এবার জীবনের গান গাইব আমরা... জীবনের গান... বুদ্ধদেব বসুর একটা কবিতা শুনবে রাহী !!!

'ওগো চপল-নয়না সুন্দরী

তোলো মোর পানে তব দুই আঁখি,

মম শিয়রের কাছে গুঞ্জরি’- গাও সকল অগীত সঙ্গীতে

মোর দেহমন রও ঢাকি- তব স্বপন-আবেশ-হিল্লোলে,

চির- নিত্য-নূতন ভঙ্গীতে

ঢেউ তোলো মোর প্রাণ-সিন্ধুতে,

সুখে উচ্ছসিয়া ওঠে কল্লোলে

ছোটে দুই তট দেশ লঙ্ঘিয়া,

চাহে গ্রাসিতে পূর্ণ ইন্দুকে- মহা আকাশের দ্যায় রঙ্গিয়া

ওগো মোর পিপাসিত যৌবনে- কর শান্ত একটি চুম্বনে।'

শ্রদ্ধা : ধ্যাত...

অভয়াঙ্করা কেবিনের ঘসা কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখে শ্রদ্ধাকে আঁকড়ে ধরে বেড-এর Headboard-এ মাথা রেখেই অঘোরে ঘুমাচ্ছে....

প্রথম বিবাহ-বার্ষিকী :

------------------------------

সদ্য নতুন প্রভাতের অপার্থিব ভোরের আলোয় ঘরটা ভরে ওঠে... শ্রদ্ধা তখনো ঘুমাচ্ছে আদর্শের প্রশয় আঁকড়ে ধরে... ব্যানার্জি বাড়িতে আজ সাজ সাজ রব... দীর্ঘ ছয় মাসের অঘটনের কালো মেঘ সরিয়ে আজ এই বাড়ি আবার সেজে উঠেছে... দু'মাস কোমায় থাকার পর শ্রদ্ধার জ্ঞান ফেরে, তারপরেও চার মাস হাসপাতালে থাকার পর কাল আদর্শ তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে... এর মাঝে আদর্শ আর ইনায়ৎ আরো একটা গুপ্ত অভিযান সফলভাবে শেষ করে ফিরে এসেছে... এতো আনন্দের মাঝে শুধু একটা দুশ্চিন্তার কাঁটা বিধে আছে সবার মনে- শ্রদ্ধা এখনো হাঁটতে পারছে না... তার ভাঙা পা জোড়া লেগে গেছে, কিন্তু মন থেকে ট্রমা কাটানো যায় নি... কাল সারারাত ঘুমন্ত শ্রদ্ধাকে বুকে নিয়ে রাত জেগেছে আদর্শ... আজ সে একটা পরিকল্পনা করেছে শ্রদ্ধার এই ট্রমা কাটানোর... তাছাড়া এটাই তার বিবাহবার্ষিকীতে তার শ্রদ্ধার জন্য উপহার... আদর্শের চিন্তার ঘোর কাটে শ্রদ্ধার গলার আওয়াজে...

শ্রদ্ধা : তুমি সারারাত ঘুমাও নি আদি !!!

আদর্শ : কখন ঘুম ভাঙলো তোমার !!!

শ্রদ্ধা : অনেকক্ষণ... তোমাকে দেখছিলাম...

আদর্শ : তা কি দেখলে !!!

শ্রদ্ধা : আমি খুব ভাগ্যবতী জানো আদি... আমি এমন একজনকে ভালোবাসি, যে নিজের জন্য কখনো ভাবে না... অন্যের সুরক্ষা, অন্যের খুশিতেই যে খুশি... নিজের কত স্বল্প প্রাপ্তিতে আনন্দিত হয়ে ওঠে... এইরকম একটা মানুষ আমার মনের মানুষ, আমার ভালোবাসা....

কথাটা বলে আদর্শের বাহুডোরে আরো নিবিড়ভাবে নিজেকে সমর্পণ করে দেয় শ্রদ্ধা...

আদর্শ : জানো রাহী, কতো মানুষ আমাকে আর্শীবাদ করে... তুমি না জেনে, জেনে এইভাবে আমার পাশে না থাকলে আমি এইভাবে নিজের ব্রতে সফল হতাম না... মানুষের ভালোবাসা, মানুষের আর্শীবাদের থেকে বড় উপহার আর কি হতে পারে বলো !!! এইগুলো না থাকলে হয়তো তোমার অতবড় বিপদ থেকে আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম না... আজ আমার আবার তোমাকে পাশে চাই রাহী... থাকবে তো আমার পাশে !!!

শ্রদ্ধা : এমনভাবে কেন বলছো !!!

আদর্শ শ্রদ্ধার মুখটা তুলে ধরে আঁখিপল্লবে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে,

আদর্শ : আমি জানি, তুমি আজীবন সবার করুণা পেয়ে বড় হয়েছো... আমি জানি, এই করুণা আর দয়া নিয়ে বেঁচেটা কতটা কষ্টের... কিন্তু ক্ষমাই তো মানুষের পরম ধর্ম, বলো তো !!! ক্ষমায় যে সুখ আছে, তা প্রতিশোধে নেই... আর মানুষ নিজেই নিজের কর্মফল ভোগ করে... আমরা বৃথাই প্রতিশোধের পেছনে সময় নষ্ট করি... 

শ্রদ্ধা : তোমার মনে হয়, আমি প্রতিশোধ নিতে পারি !!!

আদর্শ : (উদাসভাবে) জানি পারো না... তবে আজ তোমার সাথে আমারও পরীক্ষা রাহী... আমারও পরীক্ষা...

কথাগুলোর মধ্যে এমন একটা ব্যাথা ছিল, শ্রদ্ধা আদর্শের মাথা নিজের বুকে টেনে নেয় আর আদর্শও পরম নিশ্চিন্তে শ্রদ্ধার বুকে মাথা রাখে ওকে শক্ত করে আলিঙ্গনবদ্ধ করে...

সন্ধ্যেবেলায় ছোট্ট একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়... সেখানে ব্যানার্জি পরিবার, শ্রদ্ধা আর শ্রেষ্ঠার বাপের বাড়ির লোকজন আর ইনায়ৎ.... ও অভয়াঙ্করা... শ্রদ্ধা আর শ্রেষ্ঠা আজ অনন্তার শাড়িতে সেজে উঠেছে... আদর্শ শ্রদ্ধার Wheelchair ঠেলে শ্রদ্ধাকে Dining Hall-এ নিয়ে আসে... ইনায়ৎকে শ্রদ্ধা আয়ান বলে চিনলেও অভয়াঙ্করাকে চিনতে না পেরে আদর্শর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়... সংস্কার, শ্রেষ্ঠা আর সম্প্রীতি পরষ্পরের দিকে ভয়ার্ত চোখে দৃষ্টি বিনিময় করে...

ইনায়ৎ : ভাবিজান, ইনি আমাদের স্যার... আমাদের অভিভাবক বলতে পারেন...

শ্রদ্ধা : ওহহহ... আমাদের প্রণাম নেবেন স্যার... আপনার আর্শীবাদের হাত সবসময়ই আমাদের মাথার উপর রাখবেন... ওইটুকুই আমাদের পাথেয়...

নিজের আত্মজার মুখে 'স্যার' সম্বোধন শুনে অভয়াঙ্করার দু'চোখে প্লাবন নামতে চায়... কিন্তু আদর্শের পরিকল্পনার সঠিক সময়ের অপেক্ষায় নিজেকে সংবরণ করে নেয়... অভয়াঙ্করা, ইনায়ৎ আর শ্রদ্ধা টুকটাক কথাবার্তা বলতে থাকে... আদর্শ এসে সংস্কারদের পাশে দাঁড়ায়...

আদর্শ : জীবনে প্রথমবার আমার এত ভয় লাগছে, জানিস ভাই... যদি কোনো ভুল হয়ে যায়...

সংস্কার : না দাভাই... ভুলের কোনো জায়গা রাখলে হবে না... এটা আমাদের রাহীর জীবনের প্রশ্ন...

আদর্শ : ঠিক বলেছিস... তাহলে গিয়ে ওকে সত্যিটা বলি...

সংস্কার : হ্যাঁ, যা... আমরাও যাই তোর সাথে...

সম্প্রীতি : হ্যাঁ দাভাই... আজ আমরা সবাই মিলে রাহীকে সামলাবো....

শ্রেষ্ঠা : রাহী যে কিভাবে পিসুনকে ক্ষমা করবে কে জানে !!! আমার তো ওনাকে দেখলেই....

সংস্কার : আহহহ শ্রী... ওমনিভাবে কথা বলে না... মাথা ঠান্ডা করে এসো আমাদের সাথে...

কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে যায় একটা অঘটন... আর সেটা ঘটায় শ্রদ্ধার মামীমা লতিকা দেবী...

লতিকা : ও কি !!! সূর্য না !!! তুমি !! এতদিন পর !!

সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে শ্রদ্ধার, কারন শ্রদ্ধা তার বাবাকে না চিনলেও নাম জানে- 'সূর্য চ্যাটার্জি'... নিজের অজান্তেই Wheel Chair-টা শক্ত করে ধরে মাটিতে দৃঢ়ভাবে পা ফেলে শ্রদ্ধা...

শ্রদ্ধা : ক্কে !!! কে সূর্য !!! মাম... মাম...

লতিকা : তোতলাচ্ছিস কেন লা !! এ তো তোর বাপ !!! যে তার মুখটুকুও দেখতে চায় নি... এই যে সূর্য... এই তোমার মেয়ে...

মূহুর্তে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় শ্রদ্ধা... আদর্শ দৌড়ে এসে শ্রদ্ধাকে আঁকড়ে ধরে, যাতে ও বেসামাল হয়ে পড়ে না যায়...

শ্রেষ্ঠা : মা... তোমার কি কোনোদিনও বোধবুদ্ধি কিছু হবে না... না কি ইচ্ছে করে করো এইসব !! আক্রোশে !!!

লতিকা : আ মলো যা... এই মেয়েকে আমি... এই আমি দয়া না করলে এই মেয়ে এতবড় হতো... বাপ তো জন্মের পর থেকে মেয়ের মুখটাও দেখে নি...

আদর্শ : ব্যাস... এবার থামুন আপনি... এইজন্য, শুধুমাত্র এইজন্য আমি আপনাকে আর কাম্মাকে রাহীর হাসপাতালে Allow করি নি... জানেন তো আমাদের প্রায় সবারই কিছু না কিছু 'না পারা' থাকে, কিছু না কিছু অক্ষমতা থাকে- এই যেমন ধরুন আপনারা, কখন কোথায় কি বলতে হয় এত বয়স অব্দিও শিখে উঠতে পারলেন না... কিন্তু এই অক্ষমতাগুলোর অধিকাংশ সময় একটা নির্দিষ্ট কারণও থাকে... তাই যখনই আমরা কোনো সেরকম কাজ করতে গিয়ে ঠিকমতো করে উঠতে পারি না, তখনই শুনতে হয়— 'তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না', 'দেখ ও পারছে, আর তুই পারছিস না?' বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইধরনের কথা কাছের মানুষরাই বলে থাকে- এই যেমন আপনি, অহোরাত্র রাহীকে খোঁটা দিয়ে যান ওর বাবার কৃতকর্মের জন্য... কিন্তু রাহী যে নিজের জীবনের প্রতিকূলতার বিপরীতে হেঁটে জীবনে এগিয়ে যায়, আপনাদের পাশে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টাও করে যায়- কই সেখানে তো আপনি তো ওকে কখনো অনুপ্রেরণা দেন না... ওকে অনুপ্রেরণা দেওয়া তো দূর, আপনি বা কাম্মা কেউ ওর এই 'না পারা'র পিছনের কারণ খোঁজার চেষ্টামাত্র করেন না.... আচ্ছা, ওর 'না পারা' নিয়ে এত কথা বলেন, কই 'পারা'গুলো নিয়ে, ওর ভিতরের 'প্রতিভা'গুলো নিয়ে তো কোনো কথা বলেন না ?? আচ্ছা, কোনোদিন ওর গান নিয়ে একটাও কথা বলেন আপনি !!! বলেন না !! মানুষের দুঃখ গুলো নিয়ে উল্লাস করার কি যে খারাপ মানসিকতা আপনাদের !! আচ্ছা আপনারা কেন এমন করেন, তার কারণটা কখনো খুঁজতে চেয়েছেন !! আপনারা জানেন আপনাদের এই কৃতকর্মের পেছনের আসল কারনটা হলো আপনাদের ঘৃণ্য প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা... কখনো শ্রদ্ধার জায়গায় নিজেদের বসিয়ে দেখতে পারেন তো !! তাহলে বুঝতেন, যে মেয়েটা নির্দ্বিধায় সকলের জন্য খাটতে পারে মুখ বুজে, শত অপমান, দীর্ঘ লাঞ্ছনাতেও যার বুক ফাটে, তবু মুখ ফোটে না... তার এই নীরব যন্ত্রণাটা আপনাকে বা আমার কাম্মাকেও বলেছি... আপনারা নিজেরাও তো মেয়ে, আপনাদের মধ্যেও তো নারী সত্তা প্রবল, তবে মনুষ্যত্বটা এত কম কেন !! কই, রাহী তো এত বাছবিচার করে না কখনো !! এত অন্যায়, এত অবিচারের পরেও তো ও আপনাদের ক্ষমা করে বুকে টেনে নিতে দ্বিধা বোধ করে নি কখনো !! কারন আপনাদের মধ্যেই ও নিজের হারিয়ে যাওয়া মাকে খুঁজেছে... আপনাদের শাড়ির আঁচলেই পেতে চেয়েছে সেই মায়ের গায়ের গন্ধ... কিন্তু আপনারা তো কখনো এর মর্যাদাই দিলেন না... ঠেলে সরিয়ে দিলেন নিজেদের থেকে !!

শ্রদ্ধা : আদি... আদি... দোহাই তোমার চুপ করো !!

ভেতরে ভেতরে শ্রদ্ধার শরীরটা একটু খারাপ করতে শুরু করে আবার.. আদর্শ কথার উত্তেজনায় তা খেয়াল করে না...

আদর্শ : না... রাহী না !! অনেক সহ্য করেছ তুমি... আজ আমাকে আর আটকাতে পারবে না... আজ আমি বলবই... যে শ্রদ্ধা আপনাকে মামিমার মধ্যেকার ওই মায়ের আসনটাতে বসিয়েছিল, আপনি সেই মেয়েটার সাথে কি করলেন !!! একটা মাতাল, লম্পট ছেলের হাতে তাকে তুলে দিচ্ছিলেন যাতে সহজেই মেয়েটাকে ওরা বিক্রি করে দেয়, আর আপনার ঘাড় থেকে চিরতরে ওকে নামিয়ে দিতে পারেন !! শুধু তাই নয়, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন মেয়েটা সম্মান নিয়ে বেঁচে না ফিরতে পারে- তার পাকাপাকি ব্যবস্থা করলেন, আর কি !!!

শ্রেষ্ঠা : ছি !! মা !! ছি !! তোমায় মা বলে ডেকে তোমার দিকে তাকাতে আমার লজ্জা বোধ হচ্ছে !! এত লোভ তোমার যে রাহীকে বিক্রি করে দিতে তোমার একবার ও বুক কাঁপলো না !! আর কোনোদিন তুমি আমার সামনে আসবে না... আমি তোমায় মা বলে ডাকতে চাই না !! জানবো সবার যেমন মা থাকে না, আমারও আজ থেকে নেই...

বলেই শ্রেষ্ঠা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না চেপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়...

লতিকা : শ্রী !!!

এই মুহূর্তে লতিকা দেবীর চোখেও জল... যতই হোক, নিজের সন্তান মাতৃসত্তাকে অস্বীকার করলে তা সহ্য করার ক্ষমতা কোনো কুমাতারও থাকে না... সংস্কার ছুটে যায় শ্রেষ্ঠার সাথে সাথে...

শ্রদ্ধা : দি... দিভাই... দি... দিভাই... (আটকে আসা দম একটু নিয়ে) এটা তুমি কি করলে আদি !!! একজন নিরপরাধকে কষ্ট দিয়ে ফেললে !! সে যে তোমাকে দাদা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করে, তোমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সে... আর তুমি... তুমিও তো তাকে ছুটকির থেকে আলাদা চোখে দেখো না, ছোট্ট বোনের মতোই স্নেহ করো... তাহলে !!! কি করে এত নিষ্ঠুর হলে আদি !! কি করে !!!

লতিকা : আদর্শ... শ্রদ্ধা... আমি নয় খুব খারাপ... হ্যাঁ, আমি এই... এই অপয়া মেয়েটার পেছনে করা সমস্ত খরচ সুদে-আসলে আদায় করতে চেয়েছি... সেগুলো আমার স্বামীর ছিল, আমি আদায় করতে চেয়েছি... আর তুমি যদি এতই ন্যায়পরায়ন যুধিষ্ঠির হও, তাহলে আজ এই লোকটা... এই সূর্য চ্যাটার্জি এখানে কি করছে !!! কি হলো আদর্শ, বলো !!! কি করছে এই লোকটা এখানে !!!

আদর্শ : সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে আদর্শ ব্যানার্জী বাধ্য নয়.... আর তার চেয়েও বড়ো কথা, কোনো সূর্য চ্যাটার্জিকে আমি চিনি না... আমি যাকে চিনি, তিনি হলেন আমার স্যার 'Mr. অভয়াঙ্করা'... তাই যদি কারোর উপস্থিতি স্বীকার করতেই হয় তবে আমি আমার স্যারের উপস্থিতিটাইই স্বীকার করবো... আর কথাবার্তা যা হবে, সেটা সেই মতোই হবে... আর সূর্য চ্যাটার্জিকে আমি চিনিও না... তাই অচেনা একজন মানুষ সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্যও নেই... আশা করি আমি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি...

লতিকা : হু হু !! তোমার ঐ বড়ো বড় বুকুনি তুমি তোমার কাছেই রাখো আদর্শ !! তুমি কি মানলে না মানলে তারওপর ভিত্তি করে তো সত্যিইটা বদলে যেতে পারে না তাই না !!! এই সূর্য চ্যাটার্জি একটা সুবিধাবাদী লোক.... যখন দরকার ছিল তখন মেয়েটাকে আমাদের ঘাড়ে ফেলে দিয়ে পিঠটান দিয়েছিল, কোনো দায়িত্ব নেয়নি... একটা মেয়েকে মানুষ করতে কত টাকা খরচ হয় তা সে জানতো না ?? সব জানতো !! ইচ্ছে করে মামার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল এই আপোদটাকে... অবশ্য করবে নাই বা কেন !! অপয়া, অলক্ষ্মী একটা !!এতদিন আমার সংসারটা জ্বালিয়েছে, এখন আমার মেয়ের সংসারটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে এসেছে... এই মেয়ের জন্মানোটাই একটা পাপ... ওর ফিরে না আসাটাই উচিত ছিল !! যত্ত সব !!

                      বৌদি... ই.. ই.. ই..

আচমকা এক গম্ভীর হুঙ্কারে ঘরে উপস্থিত সকলেই কেঁপে ওঠে... আদর্শ শুধু অবিচল... এই গলার আওয়াজ যে তার চিরচেনা.. আর প্রতিরোধটা যে দেরিতে হলেও আসবে তা তার জানাই ছিল... তাই সকলের চোখের অগোচরে এক চোরা হাসি খেলে যায় তার মুখে... শুধু ইনায়ৎ-এর চোখ এড়ায় না...

অভয়াঙ্করা : (ভৎসনার সুরে) ছিঃ !! বৌদি !! ছিঃ !! আপনি এতটা নীচ, এতটা নিষ্ঠুর আমি এটা কোনোদিনও ভাবতেই পারি নি... আপ.... আপনি আমা... আমার.. র.. র..

কথা বলতে বলতে বয়সজনিত কারণেই একটু হাঁপিয়ে ওঠেন... দূর থেকে একজন জল ভরা চোখে সেটা লক্ষ্য করলেও মুখে প্রকাশ করে না কিছুই... ইনায়ৎ ছুটে এসে তাকে ধরে বসানোর চেষ্টা করে.. কিন্তু অভয়াঙ্করা তো আজ সূর্য চ্যাটার্জিও বটে... তাই পিতৃত্বের টানে কন্যার অসম্মান তিনি সহ্য করেন কিভাবে !! তাই ইনায়ৎ-এর উপস্থিতি অগ্রাহ্য করেই তিনি বলে বসেন,

অভয়াঙ্করা : (শ্লেষাত্মক গলায়) লতিকা বৌদি, আমার মাতৃহারা মেয়েটা কি এতটাই অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছিল আপনাদের কাছে যে তাকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো একটা ঘৃণ্য কাজ আপনি করতে গিয়েছিলেন !! এত টাকার লোভ আপনার!!আমার শ্রদ্ধা মা তো নিজের মতো করে আপনার সংসারটা একা হাতে সামলে নিয়েছিল... আপনি ছোট থেকে ওর কোনো ইচ্ছেকেই পূর্ণতা দেননি... না ওর পড়াশোনার প্রতি অধ্যবসায়, না ওর গান এর প্রতি সাধনা... সবটাই আপনার কাছে বাড়তি ছিল... আপনার স্বামী, আপনার কন্যা মানে আমাদের শ্রেষ্ঠা মা যখন যেভাবে পেরেছে, সেভাবেই আমার রাহীকে আগলে রেখেছে... আর দূর থেকে হলেও আদর্শ... তাহলে আপনার অবদানটা সংসারে বা সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রে কি একটু বলতে পারেন ?? আপনি যখন যেভাবে পেরেছেন রাহিকে অপমান করেছেন, লাঞ্ছনা করেছেন... এমন একটা দিন যায় নি যেদিন আমার মেয়েটার চোখ দিয়ে জল পড়ে নি... আপনি ওকে সম্পত্তি নিয়েও খোঁটা দিতে ছাড়েননি... অথচ আপনি জানতেন কিন্তু, ওই বাড়িতে মাতৃসূত্রে রাহিরও একটা সমান অধিকার আছে থাকার এবং সেটা মৌখিক শুধু নয়,কাগজে কলমেও... যদিও রাহির মা তার দাদার জেদাজেদি সত্ত্বেও কোনোদিনই সেটা দাবি করেনি... (একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে) রাহী এসবের কিছুই যদিও জানতো না কারণ আমাদের জানানোর সুযোগ ছিল না আর আপনি জানতে দেনও নি... তাই আপনি রাহির জন্য দয়া করে কিছু করেছেন, বা রাহী আপনাদের পরিবারে বোঝা হয়ে আছে- সেই কথাটা আপনার মুখে অন্তত মানায় না... হ্যাঁ, দাদার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই... উনি না থাকলে আজ আমার মেয়েটার কি হতো আমি নিজেও জানি না... হয় তো এই কথাগুলো সত্যিই মানায় না আমার মুখে,কারণ আমি কোন দায়িত্ব তো পালন করলাম না কোনো দিনই... তাই কিছু কথা হয়তো এখন বলা নিষ্প্রয়োজন, কারণ.... (ম্লান হেসে)... সঠিক সময় চলে গেছে... কিন্তু তাও বলছি (হাত জোড় করে) দাদার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী... পারলে ছোট ভাই মনে করে ক্ষমা করে দেবেন দাদা...

অভীক বাবু : না, সূর্য এই ভাবে বলো না... আজ এতদিন বাদে তোমায় দেখে যেমন অবাক হয়েছি আনন্দে, যে মেয়েটা তার বাবাকে পেলো এতদিনে... ঠিক তেমনি কষ্ট পাচ্ছি এটা ভেবে যে সেই এলেই তবে আগে এলে না কেন ?? মেয়েটাকে সারাটা জীবন এই জন্ম-যন্ত্রনায় দগ্ধ হতে হতো না আর তুমি এত বড়ো একটা চাকরি করেও কি করে এমন একটা চিন্তা মনের মধ্যে প্রশ্রয় দিলে, তার কোনো সদুত্তর আমি আজ ও পাইনি জানো... তবে আমার বোনটা তো আর নেই, থাকলে ক্ষমাটা ওর কাছেই চাইতাম... এখন তুমি আছো তাই তোমাকেই বলছি, বোনটা আমায় ছোট্ট রাহিকে হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, 'দাদা, আমার তো আর স্বামী, সন্তান নিয়ে আনন্দে সংসার করার সুযোগটা হলো না, তুমি তোমার আদর দিয়ে আমার রাহীকে দেখো..আর সূর্যকে বলো, ওর অর্ণা রাহির মধ্যে দিয়েই ওর কাছে বেঁচে থাকবে চিরকাল... ও যেন কখনো আমাদের সন্তানকে ভুল না বোঝে....আর সূর্যের তো বড়ো মেয়ের সাধ ছিল, তাই আমরা দুজনে মিলে যে নামটা ঠিক করেছিলাম সেই নামটাই যেন রাখে- 'শ্রদ্ধা'... সূর্য যেন আমার রাহির বাবা, মা দুটোই হয়... মেয়েটা যেন কোনোদিন মায়ের অভাব বুঝতে না পারে... আমি সবসময় সূর্য আর রাহির পাশে থাকবো, ওরা দুজন যেনো দুজনকে জড়িয়েই বাঁচে... আর রাহী বড়ো হলে বলো, ও যেন কোন মুহূর্তেই ওর বাবার পাশ থেকে না সরে যায়... সে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন... তোমরা ভালো থেকো... আমার শ্রেষ্ঠামা-কেও দেখে রেখো... অনেক ভালোবাসা দিলাম ওর জন্য...

এতক্ষণ কথা বলে একটু চুপ করে মামাবাবু... এইরকম একটানা কথা বলার অভ্যেস অনেকদিন হলো চলে গেছে, বলা ভালো নিজের ছোট বোনটার চলে সাথে সাথেই... আসলে একদম ছোটবেলাতেই স্বল্প সময়ের পার্থক্যে বাবা মা দুজনেই চলে যান, তারপর থেকেই অনাথ দুই ভাইবোন পরস্পর পরস্পরের শক্তি এবং সহায় দুই হয়ে ওঠেন... এরপর যথাসময়ে দুজনের গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ..কিন্তু অর্ণা বিয়ে করে চলে যাবার পর থেকেই কোথাও একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, যেটা পরবর্তী কালে স্থায়ীভাবে বাড়লেও শ্রেষ্ঠা আর শ্রদ্ধা সময়ের সাথে সাথে দুই হাত ভরে তাতে প্রলেপও দিয়েছিল... তাই তিনি বরাবরই তার দুই কন্যার মধ্যে বিভেদ করেন নি কখনো, মনে মনে মেনে এসেছেন এরাই তার পরিবারের দুই লক্ষ্মী... ওদের আগমনেই এই সংসার ফুলে ফেঁপে উঠেছে... কিন্তু শ্রেষ্ঠার প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দিলেও তেমন করে তার শ্রদ্ধামা-এর প্রতি যত্নশীল হতে পারেন নি, সেটাও নিজের স্ত্রীর কারণেই... লতিকা যে কোনোদিনই শ্রদ্ধাকে কাছে টেনে নিতে পারলো না, বলা ভালো শিখলোও না.. যদিও শ্রদ্ধা বরাবরই স্বয়ংস্বিগ্ধাই ছিল... একটু বড় হতেই ঠিক নিজের মায়ের মতোই নিজের সাধ্য অনুযায়ী মামার শক্তি ও সহায় হয়ে উঠতে থাকে.... যাই হোক, আজ সত্যিটা জানিয়ে কিছুটা হলেও তিনি ভারমুক্ত... তার বোনের বলা যে কথাগুলো দূত হিসেবে এতদিন তিনি বহন করছিলেন, আজ সঠিক জায়গায় সেই বার্তা তিনি পৌঁছে দিয়েছেন... যদিও একটা কাঁটা এখনও খচখচ করছে, শ্রদ্ধা সে কথা জানলেও সূর্যকে জানানো আজ বড্ড জরুরি...

অপরদিকে, নিজের জীবনের চরমতম সত্য জানার পর সত্যিই সূর্য চ্যাটার্জি আজ এক নিরুপায় বিধ্বস্ত পিতা, যার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান রত্নটাই পর্যাপ্ত যত্নের লালন পালনের অভাবে আজ হারিয়ে গেছে আর যার পেছনে তার নিজের অমানবিক আচরণটাই দায়ী... ভীষণ বড়ো একটা ভুল সে করেছে, যার দাম আজ তাকে দিতেই হবে... চাইলেও বা না চাইলেও... তাই নিজের মেয়েকে চোখের সামনে দেখে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না নিজেকে... আদর্শের সতর্ক বার্তা ভুলেই আর্দ্র কণ্ঠে ডেকে ওঠেন তার ভীষণ প্রিয় নামটা ধরে, যা একসময় তিনি আর অর্ণা ঠিক করেছিলেন ভালোবেসে,

অভয়াঙ্করা : শ্রদ্ধা.... আ... আ.. মা.. আমার র র... কথা বলবি না বাবার সাথে ?? একটিবার ??

অনেকক্ষন ধরে চুপ করে দুই পক্ষ, অনেক মানুষ, চেনা-অচেনা সকলের কথা শুনছিল শ্রদ্ধা... আর একটু একটু করে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হচ্ছিল পরবর্তী শব্দ লড়াই এর জন্য, যাকে আমরা 'কথা' নামে চিনি... শ্রদ্ধার মন আজ তোলপাড়... একদিকে তার এতদিনের অজানা নিজের প্রতি তার পরম প্রিয় মায়ের আদেশ বাক্য, আবার অপরদিকে আজন্ম চিনতে চেয়েও না চেনা বাবার হঠাৎ করে নিজের জীবনে আগমন.... বহু নতুন যুক্তি, তর্ক আর গল্পের সমাবেশ, যা মুহূর্তেই তাকে ঠিক-ভুলের খেলায় দিশেহারা করে তোলে.. শুধু খুঁজে পায় না কোনো সমাধানের পথ, জানে না কোন পথে গেলে মিলবে সূত্র !! তবে, চিরকাল মন আর মস্তিকের দ্বন্দ্বে মন জিতলেও এবার জিতেছে মস্তিষ্ক... তাই এই দীর্ঘজীবনে যে যে প্রশ্ন করার সুযোগ হয়নি কখনো, আজ শ্রদ্ধা নিজের সেই প্রকৃত সত্য তথা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় যা হয়তো বহু সমীকরণ বদলে দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে.... তাই আজ না চাইতেও এতদিনের জমে থাকা অভিমান, নিজের জন্মবৃত্তান্তর লজ্জা লাভা উদগীরণের ন্যায় বাইরে বেরিয়ে আসে... তবে শান্ত শীতল রূপে, যার তীব্রতা হয় তো আরো বেশি ভয়ঙ্কর...

শ্রদ্ধা : (নির্লিপ্ত কন্ঠে) বাবা !!! বাবা কাদের বলে স্যার !!! কেমন দেখতে হয় তাদের ?? তারা কাছের মানুষ হয় নাকি ভিন গ্রহের ?? আসলে আমার তো সত্যিই এই বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই... তাই আপনাকেই প্রশ্নটা করলাম আর কি ??

শ্রদ্ধার এই সহজ সরল প্রশ্ন যেন উপস্থিত প্রত্যেকজন মানুষের সন্মুখেও একটা প্রশ্নচিহ্ন উত্থাপন করে যার উত্তর প্রত্যেকের জানা থাকলেও দিতে সাহস হয় না... আর অভয়াঙ্করা তো আজ সত্যিই নিশ্চুপ, যেন সপাটে একটা চর কষিয়ে দিয়েছে কেউ গালে... না না !! নিজের ভাবধারার ওপর !! ওদিকে শ্রদ্ধা র চোখ আজ স্থির, সোজাসুজি চোখ মিলিয়েছে সামনে উপস্থিত বয়স্ক মানুষটির চোখে... যদিও ব্যক্তিটির আজ সে ক্ষমতা নেই, বলাবাহুল্য সাহসও নেই.. যতই রক্তের সম্পর্ক থাকুক... একটুক্ষণ জরিপ করে আবার বলতে শুরু করে,

শ্রদ্ধা : আজ আমাকে নিয়ে বহু মানুষের বহু বক্তব্য স্যার, তাই আমি একটা দুটো ছোট্ট গল্পও share করতে চাই... কোনোদিনও কাউকে বলার সুযোগ হয় নি, তাই আজ বলছি... (একটু উদাস হয়ে) জানেন স্যার, আমি তখন খুব ছোট, স্কুলে পড়ি... সব বন্ধুদের বাবারা নিতে আসতো স্কুল থেকে, আমারও খুব ইচ্ছে করতো... ওরা কেমন সুন্দর বায়না করতো ঝালমুড়ি, আলুকাবলি, আবার Cadbury কিনে দেওয়ার জন্য... আর ওদের বাবারা কেমন হাসি মুখে ওদের সব আবদার পূরণও করতো যথাসাধ্য... মামাই তার সবটুকু দিয়ে আমার খেয়াল রেখেছিল.... মায়ের অভাব বুঝতে দেয় নি কোনোদিনই... কিন্তু ওই যে পোড়া মন !! সে কি আর অত যুক্তি তর্ক বোঝে ?? সে শুধু আশা করতে জানতো... একদিন হয়তো তার জীবনেও 'বাবা' নামক মানুষটা আসবে, তাকে কাছে টেনে নেবে... দুহাত বাড়িয়ে ডাকবে, 'রাহীমা, দেখ আমি এসেছি'... কিন্তু সবটাই তো অলীক কল্পনা, বাস্তবে হবে না জেনেও আকাশ কুসুম আশা করে যাওয়া... (একটু থেমে) যাই হোক, যে কথাটা বলছিলাম... একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বাসস্টপে একা দাঁড়িয়ে আছি, এক দল ক্লাসমেট জিজ্ঞেস করেছিল, 'হ্যাঁ রে, আমাদের সবার বাবারা নিতে আসে, তোর বাবা তোকে নিতে আসে না কেন !!' চুপ করে ছিলাম... কোনো উত্তর দিতে পারিনি সেদিন... অবশ্য প্রশ্ন যারা করেছিল, আমার মামিমার কল্যাণে উত্তর তারাই দিয়েছিল- 'অবশ্য তোর বাবা তোকে নিতে আসবেই বা কি করে !! তোকে তো তোর বাড়ির লোক ত্যাগ দিয়েছে !! তোর বাবা নাকি তোকে অপয়া ভাবে ?? তাদের কি বা দোষ বল, তুই যেমন !! নয় তো জন্মেই কেউ নিজের মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় !!'

গলাটা যেন একটু কেঁপে যায় শ্রদ্ধার... আদর্শের সান্নিধ্য অনুভব করতেই মৃদু হেসে বলে,

শ্রদ্ধা : চোখ ফেটে জল এসেছিল সেইদিন... সবাই কিন্তু হা হা করে হেসেছিল আমার হেনস্থা দেখে... আসলে বাবা থেকেও পিতৃপরিচয়হীন বাঁচার কষ্টটা হয়তো আপনাদের মতো মা-বাবার আদরে মানুষ হওয়া লোকেরা বুঝবেন না... সেদিন যখন একা দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম সকলের সামনে হাস্য কৌতুক প্রদান করে, তখন না পাশে কেউ ছিল না... শুধুমাত্র এই ছেলেটা ছাড়া, যে আজও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে... এখনও ছাড়েনি... সেদিন আপনার এই আদিই একমাত্র বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করেছিল... নাহ্ !! কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, সহানুভূতি দেখাতে নয়... বরং প্রকৃত বন্ধু হিসেবে, সহমর্মী হিসেবে... ছোটো থেকে একমাত্র এই ছেলেটাই ছিল যে আমার না বলা কথাগুলোও বুঝে যেত সহজেই... প্রয়োজন ছিল না মুখে কিছু বলার... হয়তো এটা সত্যিই কিছু সময় আমি ওকেও না বলেছি, জেনে বুঝে কষ্টও দিয়েছি যাতে আমার মতো একটা পাপী মেয়ের সাথে নিজের জীবনটা ও না জড়ায়... কিন্তু ওই একমাত্র মানুষ যাকে আমি আটকাতেও পারিনি কখনো, যে স্বেচ্ছায় আমার জীবনের সাথে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছে... (ম্লান হেসে) তাই তো দুর্ভাগ্যও ওর এখন পিছু ছাড়ে না... আসলে কোথাও গিয়ে আমার আর ওর পরিস্থিতিটা এক ছিল, কারণ হয়তো ভিন্ন... কিন্তু দুজন দুজনকে বুঝতে তো পারতাম... তাই বোধহয় সেদিন পরিস্থিতির চাপে হলেও দুজনের জীবনের ছন্দটা মিলে গিয়েছিল... আসলে কি জানেন তো, আদর্শ আপনার আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও ও তো ভীতু কাপুরুষ নয় আপনার মত... নিজেকে কষ্ট দিয়েও অপরের প্রতি দায়িত্ব পালন করতেও ভোলে না কখনো... নিজে ক্ষত বিক্ষত হয়, তবু অন্যের অনুভূতির দামটুকু দিতেও জানে... তাই আপনার শিষ্য হলেও গুরুকেও ছাপিয়ে গেছে ও অনেককাল... এমন মানুষের পাশে তাই নির্দ্বিধায় থাকা যায় চিরটাকাল... তাই না স্যার !!! অবশ্য এই কথাগুলোর মানে আপনি বুঝবেন না, আপনার অভিজ্ঞতা নেই কি না... যাক গে ছাড়ুন, আপনাকে বলেই বা কি লাভ !! অপাত্রে দান ছাড়া কিছুই নয়...

শ্রদ্ধার কথাগুলো আজ তীরের মত বিঁধছে সূর্য চ্যাটার্জির মনে... প্রত্যেকটা শব্দ যেন ফালাফালা করে কেটে দিচ্ছে তাকে, ঘাড় ধরে মনে করাচ্ছে তার প্রত্যেকটা অতীত মুহূর্ত... কিভাবে তিনি অস্বীকার করেছিলেন তার নিজের কন্যাকে !!! তবে আজ শ্রদ্ধার কথায় তিনি কিছুই মনে করছেন না... কারণ তিনি জানেন, নিজের সন্তানের প্রতি যে অপরাধ তিনি করেছেন, তার কোনো ক্ষমা নেই... ক্ষমা হয় না... তবুও বাবা তো !! বড্ড সাধ হয় নিজের মেয়েটাকে কাছে টেনে নেওয়ার... তাই কষ্ট চেপে রেখে কাঁপা গলায় বলে ওঠেন,

অভয়াঙ্করা : মা রে, তোর বাবাটা খুব খারাপ... সে যা অন্যায় করেছে তাতে ক্ষমা চাওয়ার মুখটা আর থাকে না... তবে কি জানিস তো মা, এখন তো তুই কারোর স্ত্রী, কারোর প্রেমিকা... তুই হয়তো বুঝবি সেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে... জানিসই তো আমাদের চাকরির গতি প্রকৃতি, আমরা যে দেশের সেবায় নিয়োজিত করেছি নিজেদের... তাই আমাদের সাথে জীবনটা জড়ানো খুব সহজ ছিল না সেইদিনও... আর আজও নয়... তবে তোর মা মানে আমার অর্ণা, সে কিন্তু প্রথম দিন থেকে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, আমাকে কখনো সংসারের কোনো চাপ, দায়িত্ব বুঝতেই দেয় নি... আমি যাতে নিজের কাজটা মন দিয়ে করতে পারি, সেই দিকটাতে ওর ছিল তীক্ষ্ম নজর... প্রত্যেক সময় আমি হয়তো ওর কাছে থাকিনি, কিন্তু অর্ণা কোনোদিন অভিযোগ করে নি তাই নিয়ে... হাসি মুখে সামলেছে সব... আমার পরিবার আর তার সাথে আমাকেও, একেবারে যোগ্য হাতে... ঠিক তুই যেমন এখন আদর্শর পাশে থাকিস, প্রকৃত স্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে... তাই যেদিন থেকে প্রথম জানতে পেরেছিলাম তুই আসছিস আমাদের জীবনে, আমরা যে কি খুশি ছিলাম !! আমি ছুটি নিয়ে অর্ণার কাছে চলে এসেছিলাম, সে কি প্রতীক্ষা আমাদের তোকে দেখবো বলে !! তোকে কোলে নেব বলে !! কিন্তু হটাৎই আমার জরুরি তলব এলো... আমি ফিরে গেলাম কর্মক্ষেত্রে... অর্ণা সুস্থ দেখেই রেখে গিয়েছিলাম ওর দাদার কাছে... যেদিন ফিরে আসবো, তার আগেরদিন শুনি অর্ণা আর আমাদের মাঝে নেই... ও ফিরে গেছে ওর কাছের মানুষদের কাছে, ওর মা-বাবার কাছে... আমায় ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের মতো... কিন্তু একজন সুস্থ মানুষের কি যে হলো, এত অল্প সময়ে এত জটিলতা একটা সদা হাস্যময়ী মানুষের কি করে তৈরি হলো- তা আর আমার জানা হয়নি... ইতিমধ্যে তুই এসেছিস, কিন্তু অর্নার প্রাণের বিনিময়ে... এই সত্যিটাই আমি আর মানতে পারিনি সেদিন, যে মানুষটা আমার জন্য এত কিছু করলো, সেই মানুষটা আমার সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে চলে গেল... এটা আমি সহ্য করতে পারিনি সেদিন... সব রাগ গিয়ে পড়লো তাই তোর ওপর... কিন্তু আমি কি বোকা না !!! একবারও ভাবলাম না যে, আমি যেমন আমার স্ত্রীকে হারালাম, তুইও তেমনি তোর মাকে হারালি... এই সার সত্যিটা বুঝতে এতটাই সময় লাগলো যে তোকেই হারিয়ে ফেললাম... (একটু চুপ করে থেকে) জানি এখন সবটাই অজুহাতের মতো শোনাবে... তাও আমি আমার কারণটা তোকে বললাম... যদি সম্ভব হয় কখনো এই বুড়ো বাপটাকে ক্ষমা করে একটু প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগটুকু দিস মা... এইটুকুই বলার...

শ্রদ্ধা যেন আজ তার বাবার প্রতিটা মুখের রেখা চিনতে পারে, পড়তেও পারে.... আজ আদর্শ ব্যানার্জীর স্ত্রী হওয়ার সুবাদে সেদিনের সূর্য চ্যাটার্জির করা কৃতকর্মের কারণটা সে সময়ের সাথে সাথে একটু হলেও বুঝেছে... হয়তো সবটা ঠিক নয় তার জানা, বা ঠিকও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে তার সেই দিনের করা কাজের দায়ভার তো মিথ্যে হতে পারে না কিছুতেই...

তার একটা ছোট্ট হটকারি সিদ্ধান্তের জন্য, সেই ছোট্ট শ্রদ্ধা থেকে আজকের পূর্ণ যুবতী শ্রদ্ধা- এই যে তার একার যন্ত্রণাময় যাত্রাপথ তার ভাগীদার তো কেউ হতে চায়নি কখনো... শুধুমাত্র ওই একটি মাত্র মানুষ ছাড়া- রাহীর 'আদি'... যদি ও না থাকতো, তবে যে শ্রদ্ধার কি হতো এতদিনে তা ভাবলেও সে আজও শিউরে ওঠে... তাই যাই হয়ে যাক, এই প্রথম সে তার মায়ের অবাধ্য হবে... মা নিশ্চই বুঝবে শ্রদ্ধার অভিমান ভরা কষ্টটা... যতই হোক বাবা তো !! অভিমান করলেও মানুষটাকে দেখে কষ্টও তো হচ্ছে নিজেরও, কিন্তু এতদিনের যন্ত্রণার দরজাটাটা ভেঙে বেরোতে পারছে না যে... তাই নিজেকে গোপন করেই প্রকাশ্যে জানায়,

শ্রদ্ধা : আদর্শের শিক্ষাগুরু হিসেবে আপনার পায়ে শতকোটি প্রণাম অভয়াঙ্করা স্যার... কিন্তু আমার প্রশ্ন আমার জন্মদাতার প্রতি... বলুন, কেন ফিরে এলেন !! মেয়ে মরতে বসেছে, এইটা জেনে অন্তঃসলিলা পিতৃত্ব কি ফল্গুধারা হয়ে বেরিয়ে এলো !!! যাকে ত্যাগ করেছিলেন, তার প্রতি কিসের কর্তব্য আপনার !! কোন অনুভূতি বলুন তো- দয়া !!! করুণা !!! কোনটা দেখাতে এসেছেন আজ !!! এতদিন যার প্রতি উপেক্ষা, তাচ্ছিল্য, অবহেলাই তো বরাদ্দ ছিল আপনার পক্ষ থেকে !!! তবে আজ কি হলো !!! মায়া জন্মালো হঠাৎই !!! না কি সহানুভূতি !!

  

শ্রদ্ধা পাশের টেবিলটা ধরে নিজেকে একটু সংযত করার চেষ্টা করে... আদর্শ ওর কাঁধে হাত রাখতে গেলে অভিমানে ওর হাতটা সরিয়ে দেয় শ্রদ্ধা....

শ্রদ্ধা : না আদর্শ... এই লড়াইটা আমাকে একা লড়তে দাও... বিশ্বাস করো, এত বড় আঘাতের পরেও যখন এই অপয়া, অলক্ষ্মী মেয়েটা মরে নি, তখন আজকেও মরবে না... অপয়া, অলক্ষ্মীরা এত সহজে মরে না... তুমি পারলে দিদিভাইকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো এইখানে...

আদর্শ : না রাহী, তুমি এখনও সুস্থ নও... তাই তুমি শত বললেও আমি এখন তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না, কিছুতেই যাবও না... এত উত্তেজনা তোমার শরীরের পক্ষে ঠিক নয়... তাই আমি যেমন আছি, তেমনভাবেই তোমার পাশে তোমাকে ধরেই থাকবো... সে তুমি যতই রাগ করো না কেন !! আর রইলো শ্রেষ্ঠার কথা, ওকে তো ভাই আনতে গেছে... ও ঠিক নিয়ে আসবে... ওর-ও তো একটু সময় লাগবে সত্যির ধাক্কা সামলাতে... ওই দেখো রাহী, বলতেই বলতেই ভাই চলে এসেছে তোমার দিভাইকে নিয়ে.. দেখো তাকিয়ে...

রাহী জলভরা চোখে তাকাতেই শ্রেষ্ঠা এসে জড়িয়ে ধরে বোনকে... কান্নায় ভেঙ্গে পরে বলে ওঠে,

শ্রেষ্ঠা : ক্ষমা করিস বোন আমাকে... আমি তোর বড় দিদি হয়েও সেদিন কিছুই জানতে পারিনি... জানলে কিছুতেই এমন অনর্থ হতে দিতাম না... যদি সেদিন দাভাই না থাকতো, তবে যে কি হতো !!!

আদর্শ শ্রেষ্ঠার মাথায় স্নেহাশীষ মাখানো হাত রাখে, তবুও সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেই যায়,

শ্রেষ্ঠা : সেটা... সেটা ভেবেই আমার মনটা কেঁপে উঠছে... আমার মা খারাপ জানতাম, কিন্তু এতটা নীচ, লোভী সেটা বুঝি নি... সত্যিই রে.. পারলে তোর দিদিভাইকে এই বিশ্বাসটুকু করিস রাহী... আমি সত্যিই কিছুই জানতাম না...

শ্রদ্ধা শ্রেষ্ঠার দুটো হাত নিজের অঞ্জলির মধ্যে নিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলে,

শ্রদ্ধা : দিদিভাই, তুই এগুলো কি সব বলছিস !! তুই না থাকলে আমি তো কবেই তলিয়ে যেতাম রে !! তুই এইসব কিছুর থেকে সেই কোন ছোট থেকে আমায় আগলে রেখেছিলেন... বাড়ির ভিতর থেকেই হোক বা প্রয়োজনে বাইরে থেকেও... তাই এমন করে বলিস না... তোর তো মা, খুব খারাপ লাগে আমার... আর মামী যাই ভাবুক, যেমন ভাবেই দেখুক বিষয়টা, আমার ভালোবাসায় তো কোনো খাদ ছিল না... তাই আমি মামীকে আমার আরেক মা হিসেবেই দেখেছি... যেমন এখন কাম্মাকেও দেখি... যদিও উনিও হয়তো বোঝেন না বিষয়টা, সেটা আমার দুর্ভাগ্য... তাই বলে কাউকে দোষ দেওয়া আমার সাজে না... আর তুই এইরকম কোনোদিনও আর ভাববি না... নিজেকেও দোষী ভেবে কষ্ট পাবি না... তবে কিন্তু আড়ি হয়ে যাবে সেই ছোটবেলার মতো...

বলেই হালকা হেসে জড়িয়ে ধরে দুই বোন পরষ্পরকে... দুই বোনের কান্ড দেখে সকলে এত দুঃখেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে... সম্প্রীতি এসে পেছন থেকে ওদের জড়িয়ে ধরে ওদের সাথে হাসিতে যোগ দেয়... অভীক বাবুর চোখে জল... এগিয়ে এসে দুই মেয়ে সমেত সম্প্রীতির মাথায় হাত রেখে বলেন,

অভীক বাবু : এই দিনটা দেখার জন্যই তো আমার বেঁচে থাকা রে মা... তবে এখনও যে একটা ছোট্ট অপরাধ স্বীকার করতে আমার বাকি থেকে গেছে... সূর্য তুমি জানতে চাইছিলে না, হঠাৎ অর্নার কি এমন হয়েছিল, যাতে তোমার সুস্থ রেখে যাওয়া অর্নাকে তুমি হারিয়ে ফেললে,তবে শোনো... শ্রী আর রাহী তিনদিনের ছোট বড়... যেদিন শ্রী হলো, সেদিন দুপুর থেকেই গভীর নিম্নমানের থেকে মুষলধারে বৃষ্টি... আমি স্কুল থেকে ফিরতেই পারি নি... বন্যার আশঙ্কায় গ্রামের মানুষরা তখন স্কুল বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে... অর্না আমার কোনো কথা শুনলো না... নিজের আর লতিকার দায়িত্ব নিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিল সেই বিপদগ্রস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য... আর সেদিন বিকেলেই লতিকার প্রসব যন্ত্রণা উঠলো... যেখানে কাতারে কাতারে মানুষের মুখে দু-গ্রাস অন্ন তুলে দেওয়া যাচ্ছিল না, সেখানে দাইমা বা ডাক্তার কোথায় পাবো !!! যদিও আমার কাছে কোনো খবরও পাঠায় নি অর্ণা... আমার কর্মযজ্ঞে বিঘ্ন ঘটাবে না বলে... নিজের দায়িত্বে সুস্থভাবে শ্রী-কে এই পৃথিবীর আলো দেখালো... কিন্তু বারবার ওই ভারী গরম জলের হাড়ি তোলাটা ওর সহ্য হলো না... রাহী মা এই পৃথিবীতে আসতে তখনও এক মাস বাকি... আমি বাড়ি ফিরে দেখি, অর্নার Bleeding শুরু হয়ে গেছে... তোমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম... কিন্তু সেই দুর্যোগের সময় কোনোভাবেই যোগাযোগ করা গেল না... অর্নাকে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে... ডাক্তার যে কোনো একজনকে বেছে নিতে বললেন- হয় মা নয় সন্তান... বিশ্বাস করো সূর্য, আমি কিন্তু আমার ছোট্ট বোনটাকেই বেছে নিয়েছিলাম... কিন্তু ভাগ্য !!! অর্না সুস্থ সন্তানের জন্ম দিল... কিন্তু ওর Internal Bleeding বন্ধ করা গেল না... তারপর ধীরে ধীরে আমার হাতের উপর সব শেষ হয়ে গেল...

মেয়েদের ছাড়িয়ে অভয়াঙ্করার হাতটা ধরে অভীক বাবু,

অভীক বাবু: সেদিন আমি নিরুপায় ছিলাম সূর্য, বিশ্বাস করো... নিরুপায় ছিলাম... অর্ণাকে তো তুমি জানতে, নিজেকে তুচ্ছ করে সবার জন্য ছুটে যেত... এত বড়ো মন ছিল আমার বোনটার, যেটা আমার শ্রদ্ধা মা পেয়েছে তার মায়ের কাছ থেকে... তাই আমার কোনো বারণ কিছুতেই সে শোনে নি সেদিন, যার ফলস্বরূপ আজ তোমাদের এই তিন তিনটে জীবন নষ্ট হলো... আমি বড্ড অপরাধবোধে ভুগি জানতো, কেন সেদিন আমি অর্নার কথাগুলো শুনতে গেলাম... মনে হয়, আমার জন্যই বুঝি এমন হলো... সেদিন আমি ঘরে থাকলে আমার ছোটো বোনটার সাথে সেই অঘটনটা ঘটতো না, কিছুতেই না... আর এতকিছুর পরও লতিকা !! ছি !! তুমি কি করে পারলে এটা করতে !!! আমার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলে চিরকালের মতো !!! মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো মাথাটুকুও রাখলে না... কি আর বলবো !! সব আমার পাপের শাস্তি !!

লতিকা দেবীর মাথা নিচু, চোখের কোলটাও বোধহয় চিকচিক করে উঠলো !! চোখের ভুলও হতে পারে !!জানা নেই ইনায়াতের...

ওদিকে ঠাম্মি অনেকক্ষন থেকেই উশখুশ করছেন... একে তো বয়স হয়েছে, তার উপর এত অজানা অচেনা কথার ভার... তিনি যে আর সইতে পারছেন না... সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন শ্রদ্ধাকে দেখে, মেয়েটার যে শতেক জ্বালা... একদিকে পিতৃত্ব নামক রক্তের সম্পর্কটাকে চাইলেও সে উপেক্ষা করতে পারবে না, আবার নিজের পিতার কাছ থেকে পাওয়া এতদিনের অপমান আর বঞ্চনা- মেয়েটা যে কোনদিকে যায় !! তার ওপর অসুস্থ, ভীষণ চিন্তা হয় উনার রাহীকে নিয়ে... এত চাপ মেয়েটার শরীর সহ্য করতে পারবে তো !!! ক্ষতি হয়ে যাবে না তো কিছু !! আর ভাবতে পারেন না তিনি... ছোটছেলেকে বলে ওঠেন,

ঠাম্মি : দর্শন, আমায় একটু ঘরে দিয়ে আসবি ?? আমার যে শরীরটা আর চলছে না...

উদ্বিগ্ন রাহী আর আদি ছুটে আসে,

শ্রদ্ধা : ঠাম্মি !! তোমার শরীর খারাপ করছে ?।চলো, আর তোমায় বসতে হবে না... ঠাম্মি, আজ আমার জন্য তোমাদের সবাইকে ভুগতে হচ্ছে... এইজন্য জানো তো ঠাম্মি, এই জন্য আমি আদিকে ডিভোর্সটা দিতে চেয়েছিলাম... যাতে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে ওর জীবনটা নরক না হয়ে যায়... কিন্তু ও বুঝলো না...

কাম্মা এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার আর খোঁচা দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারলো না,

নন্দিতা : থাক রাহী, অনেক হয়েছে... আর আমাদের তোমাকে দয়া করতে হবে না... তুমি কি না দেবে Divorce ?? এত শান্তি দেওয়ার থাকলে তুমি বিয়েটাই করতে না বাপু... একবার যখন আমাদের ছেলেটার ঘাড়ে চেপেছো, এত সহজে মুক্তি দেওয়ার জন্য তো নয়... তাই আর আদিখ্যেতা করতে হবে না... আর বাকি রইলো মায়ের কথা... শরীরের আর কি দোষ !! যবে থেকে এই মেয়ে বাড়িতে এসেছে, তবে থেকে তো কিছু না কিছু লেগেই আছে... এইজন্যই তো ওই মেয়েকে আমি ঘরে তুলতে চাইনি... এখন তো আবার কোথায় না কোথায় গিয়ে মুখ পুড়িয়ে এতগুলো দিন হাসপাতালেও কাটিয়ে এলো... এখন আবার নতুন নাটক !! উনার বাবা কোত্থেকে এসে জুটেছেন না কি মেয়েকে সোহাগ দেখাবেন বলে !! যত্তসব !! আমার সংসারটাই সৃষ্টিছাড়া হয়ে গেল... আর আমাদের আদিটাও একটু শান্তি পেল না গো বিয়ে করা ইস্তক !!!

                  কাম্মাআআআআ !!!!!!!!!

আদর্শের ব্যাঘ্র গর্জন স্বরূপ চিৎকারে নন্দিতাও এবার যেন একটু কেঁপে ওঠে... বোঝে তীরটা ভুল জায়গায় ছুড়ে ফেলেছেন... তাই বুমেরাং-ও হতে পারে...তিনি শান্ত করার করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সবই বিফলে যায়...

আদর্শ : চুপ করো !! আর অজুহাত দেখাতে এসো না !!! আজ হঠাৎ করে আদির জন্য দরদ উথলে উঠছে না, যখন থেকে জানতে পেরেছো আদি আসলে কি করে !! ওর ওই বাইরের প্রায় গুন্ডার মতো পরিচয়টা শুধুই একটা Eye Wash ছাড়া আর কিছু নয়... তাই এখন বোধহয় আমাকে আর বাড়ির ছেলে বলে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে না, এতদিন যেটা লাগতো !!! আর সত্যিকারের অনাথ যে নই.. এই ব্যানার্জী পরিবারের রক্তই যে শরীরে বইছে, এটা জানতে পেরেই বোধহয় আরো বেশি করে বড়ো ছেলের পরিচয় দিয়ে তোমার নাটকটা বেড়ে চলেছে, তাই না !! কিছু ভুল বললাম কি ?? আর তোমাকে যা বলার, তা তো আগেই মামীর সাথেই বলে দিয়েছিলাম... তাই আবার করে আর সেই কথাগুলোই বলে সময়টা নষ্ট করতে চাই না... শুধু এইটুকুই বলতে চাই, তুমি কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছ... যখন খুশি যা ইচ্ছে বলে তুমি আমার রাহীকে অপমান করতে পারো না... আর রাহিকে তুমি মেনে নিতে পারার কে ?? আমি ছোটবেলা থেকে রাহীকে ভালোবাসি... আর ঠাম্মি সহ আমার পরিবারের সবাই রাহীকে নিজেদের মধ্যেকার একজন সদস্যই মনে করে... হয়তো বা ভালোবাসে আমার চেয়েও বেশি... তাই তুমি আমাদের পরিবারে থাকা নিয়ে রাহিকে অপমান করতে পারো না...আর রইলো তোমার ঐ So Called 'মুখ পুড়িয়ে' আসার কথা... আমাদের সম্পর্কটা এতটা ঠুনকো নয় যে, তোমার ঐ মনগড়া কল্পনাকে এত গুরুত্ব দিয়ে ভাববো... আর যদি মুখ পুড়িয়ে এসেও থাকে, তাও তো সেটা আমার উপস্থিতিতেই ঘটেছে... তাই আমার রাহির মতো পবিত্র আর কেউ হতেই পারে না, তুমিও না... তাই ভবিষ্যতে এই রকম চলতে থাকলে আমি রাহীকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবো... তোমাদের মত মানুষদের সংস্পর্শে ওকে আসতেই দেবো না... আর তোমায় শেষবারের মতো সাবধান করলাম আজ... এরপর নিজেকে সংযত না করলে, আমি কিন্তু আইনি সাহায্য নিতে বাধ্য হবো... মনে থাকে যেন...

শ্রদ্ধা যেন বোবা হয়ে গেছে... এত কথা, কথান্তর, চাপানউতোর কোনোটাই যেন আজ ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না... এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর.. ও তো কোনোদিন কারোর জন্য এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করতে পিছপা হয় নি... কখনো কখনো তো সাধ্যের বাইরে গিয়েও করেছে... কিন্তু কেউ তো কোনোদিন শ্রদ্ধাকে শ্রদ্ধার কথাগুলো জানতে চাইলো না... শুধু নিজেদের বক্তব্যগুলো চাপিয়ে দিলো ওর ওপর সারাজীবন, যেন ও চিরকালের ভৃত্য... হুকুম তামিল করাটাই ওর জীবন... আর পান থেকে চুন খসলেই কিছু অকথ্য বাক্য বর্ষিত হয়েছে ওর কৃতকর্মের উপহারস্বরূপ... কিন্তু এইভাবে কতদিন?? আদর্শ চিরটাকাল ওকে বাঁচিয়ে এসেছে... ভবিষ্যতে ও আবারও বাঁচাবে কিছুর প্রত্যাশা না করেই... তবে এর শেষ কোথায় !! সারাটা জীবন মানুষের উপেক্ষা আর মানুষের জন্য অপেক্ষা নিয়ে কাটিয়ে দিলো যে মেয়ে... আজ তাকে নিজের পরিচয়ের সম্মান দিতে এগিয়ে এসেছেন সূর্য ব্যানার্জী, তার জন্মদাতা.. কিন্তু আজ আর কিসের প্রয়োজন এই সম্মানের !! যখন সব শেষ হতেই বসেছে... তবে এই বাদানুবাদের একটা উপসংহার প্রয়োজন আর তার সাথে নিজের মুক্তি... তাই চিৎকার করে উঠলো শ্রদ্ধা,

                       আদি... ই... ই....

চিরকালের নরমসরম একটা মেয়ের গলা তোলার আওয়াজে সবাই যেন হকচকিয়ে যায়... বোঝে এতদিনে ক্রোধ, অভিমান, যন্ত্রণা বহিঃ-উৎক্ষেপণের সময় হয়েছে... কিন্তু শ্রদ্ধার শরীর !! সেটা তো ক্ষতবিক্ষত... মনও তার সাথে হাত মিলিয়েছে... তাই আদর্শ এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন মুখে শ্রদ্ধার সামনে দাঁড়ালে জল ভরা চোখ নিয়ে আদর্শকে প্রশ্ন করে শ্রদ্ধা,

শ্রদ্ধা : আর কত ?? আর কত বলবে আমার হয়ে !! লড়েই তো যাচ্ছ সেই কবে থেকে !!! বোঝাতে পারলে কি কাউকে কিছু !! তবে এবার ছেড়ে দাও.. কারোর অপমানে তোমার রাহির কিছুই যাবে আসবে না, যতক্ষণ না সে নিজে নিজের গায়ে সেই কালি মাখবে... তাই এবার চুপ করো, Please... তুমি আছো তো, তবেই হবে... আর কিছু চাইনা... তোমাকেও মুক্তি দিতাম জানো, কিন্তু দেখছি তো এতদিন... সবাইকে যে তোমার কাছাকাছি পৌঁছতে দাও না তুমি... তাই তোমার কথা শোনার, তোমাকে ভরসা দেওয়ার জন্য আমি থেকেই যাবো... যেমন আমার মা ছিলো, ঠিক তেমন.. তোমার যোগ্য স্ত্রী হিসেবে...

একটু থেমে, আদর্শের এগিয়ে দেওয়া গ্লাস থেকে এক ঢোক জল খেয়ে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বিষন্ন গলায় বলে ওঠে,

শ্রদ্ধা : দেখলেন তো স্যার, এই সমাজে বাবা থেকেও পিতৃপরিচয়হীন ভাবে বাঁচার কি নিত্য যন্ত্রণা !!! সমাজ আধুনিক হলেও সেই পুরাতন ধ্যানধারনার জগদ্দল পাথর এখনও ভাঙ্গা যায়নি... তাই স্বাভাবিকভাবে জীবনধারনের জন্য মাতৃপরিচয়টা যথেষ্ট নয়, সে পিতা তার কন্যাকে পরিচয় দিতে না চাইলেও... আজকের দিনে দাঁড়িয়েও এতটা রিক্ত, এতটা ভিখারী আমরা যে অবাঞ্ছিত জেনেও হাত পাততে হয় আপনাদের কাছে শুধু ওই নামটুকুর জন্য... নইলে স্কুল বা কলেজে ভর্তি হওয়া আটকে যাবে নয়তো... পরিচিত, অপরিচিত মানুষের সামনে, 'এই, তোমার বাবার নামটা কি গো?' এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না... তবে একটা কথা এতদিনে বুঝেছি, জানেন... পিতা মানে শুধু জন্মদাতা নয়, বা পিতৃত্বের ধ্বজা উড়ানো নয়... বাবা মানে ভরসার হাত মাথায় থাকা, দরকারে অদরকারে বলা, 'তুই এগিয়ে যা, এই তো আমি থাকলাম তোর জন্য... চিন্তা কিসের...' 

আমার আক্ষেপ এইটুকুই আপনি বললেন না কোনোদিন... তাই অযথা পিতৃত্বের দাবি বা অধিকার নিয়ে আসবেন না... আমি সেটা হয়তো রাখতে পারবো না... জানি যে মাকে আমি দেবতাজ্ঞানে পুজো করি প্রতিদিন, যাকে আমি সত্যিই দেবতার আসনেই ঠাই দিয়েছি- সেই মাতৃ আদেশ অবজ্ঞা করা হবে... তবে আমার স্থির বিশ্বাস মা যেখানেই থাকুক, সে অন্ততঃ আমায় ভুল বুঝবে না... আমার পরিস্থিতিটা ঠিক বিচার করবে... তাই আমায় ক্ষমা করবেন অভয়াঙ্করা স্যার... আপনার কথাটা আমি রাখতে পারলাম না..

জল ভরা চোখে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই শুনতে পায় আদর্শর গলা,

আদর্শ : দাঁড়াও রাহী... এতক্ষণ আমি তোমার হয়ে লড়াই করলেও তোমাদের বাবা-মেয়ের কথোপকথনে ঢুকতে চাইনি... এখনও চাই না... শুধু তোমায় ক'টা নিজের কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি... তাই বলছি... জানো রাহী, কখনো যদি এমন কোনো পরিস্থিতি আসে, যেখানে আমায় তোমায় আর আমার সন্তানের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে বলা হয়, আমি কিন্তু তোমাকেই বাছবো আমার সন্তানের আগে... কেন জানো, কারন তুমি আমার ছোটবেলার ভালোবাসা... যেটা একদিনে হয় নি, একটু একটু করে গভীর থেকে গভীরতা হয়ে তৈরি হয়েছে... এতে সমাজ হয়তো আমায় নিষ্ঠুর বলবে, কিন্তু তাও আমি তোমাকেই বাছবো রাহী... শুধু তোমাকেই... ভগবান করুন এমন দিন যেন কখনো আমাদের জীবনে না আসে... কিন্তু তাও !! তবে হ্যাঁ, আমি কোনোদিনই আমার সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হব না... তার পাশে বাবা হিসেবে আমার যা যথাসাধ্য, তাই দিয়ে সারাজীবন থাকার চেষ্টা করবো... কিন্তু তোমার জায়গাটা আমার জীবনে আলাদাই থাকবে, সেটা কেউ কখনো নিতেই পারবে না...

অভয়াঙ্করা স্তম্ভিত আদর্শের কথায়... তিনি শ্রদ্ধাকে কাছে পান নি ঠিকই, কিন্তু সন্তান হারানোর যন্ত্রনায় প্রলেপ লাগিয়ে তার প্রিয় শিষ্যকে তৈরি করেছেন একটু একটু করে, সঠিক অনুপাতে... তবে আদর্শ যে বরাবরই আলাদা সবার থেকে, সেটা আর তারচেয়ে বেশি কে জানে !!! তাই বলে নিজের মেয়ের কথাগুলোও তো মিথ্যে নয়... সবই তার কৃতকর্মের ফল, যা তিনি এখন ভুগছেন এবং আগামীতেও ভুগবেন... সন্তানের কাছ থেকে 'বাবা' সম্মোধনটা যে তিনি আর কখনোই শুনতে পাবেন না, তা তিনি নিশ্চিত... তবে একটাই স্বস্তি, মেয়েটা সঠিক মানুষের হাতেই অর্পিত হয়েছে, যে ওকে ওর মতো করে বুঝে ভালো রাখবে.... আর আদর্শের জন্য তো শ্রদ্ধা নিজেই থাকলো... দুটিতে ভালোই থাকবে... তার আর প্রয়োজন নেই এই সংসারে... সব প্রয়োজন ফুরিয়েছে... ওদের না হয় চিরকাল দূর থেকেই আর্শীবাদ করবেন... শুধু একটাই আফসোস রয়ে গেল, মেয়েটাকে একটু জড়িয়ে ধরে আর্শীবাদটুকু করতে পারলেন না... পারলেন না দিতে স্নেহের ছোঁয়া... যাই হোক, এবার তার বিদায়ক্ষণ উপস্থিত... ভাবছেন, এবার Retirement নিয়ে দূর দেশে পাড়ি দেবেন, যাতে তার ছায়াটুকুও তার শ্রদ্ধামা-এর জীবনে আর না পড়ে... মনে মনে শুধু বলবেন, 'সুখে থাকিস দুটিতে, প্রাণঢালা শুভেচ্ছা রইলো...'

ওদিকে, শ্রদ্ধা আজ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার আদর্শের দিকে... এই আদিকে যে সে চেনে না, জানেও না.... কেমন শান্ত, শীতল...

শ্রদ্ধা : (নিজের মনেই প্রশ্ন করে) এত ভালবাসে ও আমাকে !! আমি কি সত্যিই এর যোগ্য !!!

ওদিকে, শ্রদ্ধাকে বিস্মিত হতে দেখেও বলে চলে আদর্শ... কারণ সে জানে, তার শ্রদ্ধা অবুঝ নয়, শুধু আজ যুক্তি অভিমানে চাপা পড়ে গেছে...

আদর্শ : রাহী, আমি সূর্য চ্যাটার্জিকে চিনি না, জানিও না তেমন.. যাকে চিনি, তিনি আমার অভয়াঙ্করা স্যার... আমি জানি- উনি তোমার জন্মদাতা হিসেবে তোমার সাথে যা করেছেন, তা ভয়ঙ্কর অন্যায়, অপরাধ... কিন্তু ওনার জায়গাটাও একটু বুঝে দেখো... আমি জানি তুমি ঠিক অনুধাবন করবে, আমরা যারা দেশের জন্য লড়াই করি- তাদের কাছে স্ত্রী আর পরিবারের,বা সন্তানের গুরুত্ব কতটা !!! উনি কিন্তু মানুষটা খারাপ নন.. যে ক'বছর আমরা ওনাকে দেখছি, আমরা জানি উনি ওনার হারিয়ে যাওয়া সন্তান,পরিবারের জন্য কতটা কষ্ট পান... কিন্তু সত্যিই এখন দেরি হয়ে গেছে ,তাই সেই সময়টাও চলে গেছে শুধরে নেওয়ার...

শ্রদ্ধা : তুমি আমাকে এই কথা বলছো আদি !!! তুমি জানো না, এই মানুষটার জন্য আমি কি সহ্য করেছি !!! এতকাল !!! বা এখনও করি... আমার কি সত্যিই এটা প্রাপ্য ছিল আদি !! বলো না !! এটা কি প্রাপ্য ছিল !!

কথাটা বলতে বলতেই আদর্শের পাঞ্জাবির কলারটা চেপে ধরে তারই বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে শ্রদ্ধা... সকলকে ভুলে শ্রদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর্শ বলে ওঠে,

আদর্শ : আমি সব জানি রাহী, আর কিচ্ছুটি আমি ভুলিও নি... তাই তোমায় কষ্ট দেওয়ার অপরাধে সূর্য চ্যাটার্জিকে আমি কোনোদিনও ক্ষমা করিও নি আর করবও না... কিন্তু নিজের বাবা-মাকে হারিয়ে বুঝেছি, তাদের মর্ম কতটা গুরুত্বপূর্ণ !!! কতটা দরকার তাদের পাশে থাকা !! তাই বলছি একটিবার ক্ষমা করে দাও না রাহী... তুমিও তো রোজ না জেনেই এই মানুষটার মঙ্গল কামনায় তোমার গোপালের কাছে কাঁদতে... তাই আজ যখন মানুষটা সামনে উপস্থিত, তখন একবার 'বাবা' বলে কাছে টেনে নাওই না....তোমারই বাবা... আর তুমি তো বল; ক্ষমা করলে মানুষ ছোটো হয় না বড়ো হয়... তবে আজ কেন ক্ষমা করছো না রাহী !!

শ্রদ্ধা : আমি পারবো না...এতদিন পর !!

আদর্শ : পারবে রাহী, পারবে... একবার যাও, Please..

হঠাৎই ইনায়ৎ লক্ষ্য করে, তাদের স্যার বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত.. এক পা বাড়িয়েও দিয়েছে,সে শুধু চোখের ইশারায় আদর্শকে দেখায়, 'ভাই....স্যার...'

আদর্শ : স্যার দাঁড়ান... আপনি এইভাবে চলে যেতে পারেন না... স্যার...

অভয়াঙ্করা : নাহহ মেঘদূত... তা হয় না... আমি তো সত্যিই অপরাধী... আর আজ তা অস্বীকার করার তো কোনো জায়গা নেই... আমি করতেও চাই না... তাই নিজের সব অপরাধ কাঁধে নিয়ে আমি চলে যেতে চাই... আমায় আর আটকিও না... আমি আসি...

ঠাম্মি শ্রদ্ধার হাতটা ধরেন, নরম গলায় শেষবার বোঝানোর চেষ্টা করেন,

ঠাম্মি : দিদিভাই... সূর্য, তোর বাবা চলে যাচ্ছে... একটা বার আটকাবি না... যা দিদিভাই যা...

শ্রদ্ধাও তখন ভেতর ভেতর ভেঙ্গে পড়েছে... সে যতই অভিমান করুক, মানুষটা তাকে আবার একা করে চলে যাবে- এটাও বোধহয় সে চায় না... আজ তো মানুষটা একা, নিঃসঙ্গ... তার উপর বয়স হয়েছে... এখন তার স্নেহের দরকার, ভালোবাসার দরকার... আর... দরকার যত্নের... মানুষটা তার সাথে যতই অন্যায় করুক না কেন, দেশকে ভালোবেসে গেছে নিঃস্বার্থভাবে.... দেশকে ভালোবেসে সব হারিয়েছে- নিজের পরিবার, সন্তান, আপনজন.... নিজের ভালোবাসা... জীবনের গোধূলি লগ্নে এসে তার কি একটুও শান্তি, সন্তানদের স্নেহছায়া, আপনজনদের সান্নিধ্য প্রাপ্য নয় !!!!

                              বাবাআআআ....

কাঁপা কান্নাভেজা কণ্ঠে ডেকে ওঠে পেছন থেকে শ্রদ্ধা... আদর্শ একহাতে আগলে নেয় ওকে...

অভয়াঙ্করা দরজা দিয়ে বের হতে গিয়েও থেমে যায়.. কি বললো শ্রদ্ধা !!! কি বলে ডাকলো তাকে !! বাবা ?? 'বাবা' বলে ডাকলো শ্রদ্ধা !! উত্তেজনায় পেছন দিকে মুখটা ঘোরায় অভয়াঙ্করা... দেখে ঠিক পায়ে পায়ে তার কাছে উপস্থিত হয়েছে তার একমাত্র কন্যা... আবেগে গলা বুজে আসে... তাও জিজ্ঞেস করে,

অভয়াঙ্করা : ক্কি !!! কি বলে ডাকলি মা !! আবার বল !!আরেকটি বার ডাক !!!

                       বাবা !! বাবা !! বাবা !!!!

শ্রদ্ধা আর পারে না... এতদিনের জমানো কান্নার দমকে সামনেটা পুরো আবছা হয়ে যায়... আর তিনবার 'বাবা' ডেকেই জড়িয়ে ধরে নিজের আজন্মের চাওয়া জন্মদাতাকে... ঘরে উপস্থিত সবার চোখেই তখন প্লাবন নেমেছে... মাথা নিচু করে রেখেছে কাম্মারাও... পিতা আর পুত্রীর মিলন দৃশ্য !!! চোখের জল কি ধরে রাখা যায় !!

শ্রদ্ধা : তুমি এমন কেন করলে বাবা !! তুমি কি করে এত কষ্ট দিতে পারলে আমাকে !!! আমি কি কিছুটা হলেও মায়ের অভাব পূরণ করতে পারতাম না ?? এতটাই কি খারাপ মেয়ে ছিলাম আমি !! বলো না বাবা !!! বলো না !!!

বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার স্রোতে এমন অজস্র প্রশ্ন করে যায় শ্রদ্ধা... আজ যেন তার কথাই থামছে না...

অভয়াঙ্করা : না রে মা... না... সব ভুল তো আমার... আমি খারাপ... তুই তো আমার ভালো মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে... আর তাছাড়া... (মনে মনে) থাক সব কথা সব সময়ের জন্য বলা উপযুক্ত নয়... আজ বরং থাক... একটা দিন নিশ্চই আসবে,.যেদিন নিভৃতে মেয়ে বাবাতে বসে আজকের না-মেটা হিসেবটা নিকেশ করতে বসবো... হয়তো সেদিন আজ যেটুকু অভিমান বাকি থেকে গেলো মিটতে, ওইটুকুই পূরণ করে নেবো... এখন বরং মেয়ের ভালোবাসার স্বাদটাই চেটে পুটে আস্বাদন করি, অনেকদিনের অভুক্ত যে আমি...

শ্রদ্ধা : আর তুমি কখনো আমায় ছেড়ে কোথাও রাতে না, কথা দাও... আমরা সবাই একসাথে এবার থেকে... পরিবার হয়ে... আমি বলবো- আমার 'বাবা' আছে আমার সাথে... আমি এখন সবচেয়ে সুখী মানুষ...

শ্রদ্ধার কথায় আদর্শ চোখে জল নিয়েও হেসে ফেলে... শ্রদ্ধা সেই ছোট্টটাই রয়ে গেলো, বড় আর হলো না... সবার আড়ালে চোখের জলটা মুছলেও শ্রদ্ধার চোখ এড়ায় না... ইশারায় বাবাকে দেখাতেই বাবা আজ আদর্শকেও কাছে ডেকে নেন... মাথায় হাত দিয়ে বলেন,

অভয়াঙ্করা : দুঃখ পেয়ো না মেঘদূত... আজ থেকে আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে হলো- আদি আর রাহী.. আর তাই বা বলছি কেন !!! আমার তো অনেকগুলো সন্তান, সে সম্পর্ক যাই হোক... সংস্কার, সম্প্রীতি, ইনায়ৎ আর... আমার শ্রেষ্ঠা মা !!! কোথায় তুমি !!! এসো তো দেখি কাছে..

ইনায়ৎ আদাব করার পর সবাই এসে প্রণাম করতে গেলে সবাইকেই দুই হাতে জড়িয়ে নেয়... এরপর সূর্য ঠাম্মিকে প্রণাম করে... ঠাম্মি প্রথমে অনুযোগের বকুনি দিলেও সন্তান স্নেহে আশীর্বাদের হাত মাথাতেও রাখেন.. ওদিকে শ্রদ্ধা আর শ্রেষ্ঠা বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মামাই-এর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে মামাই দুই কন্যা সহ জামাইদেরও জড়িয়ে ধরে আশীষ দেন... প্রথম বার মামিমাও ভুল স্বীকার করে শ্রদ্ধা আর আদর্শকে আশীর্বাদ করেন... শ্রদ্ধাও অতীত ভুলে মামিমাকে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরে... ওই যে ক্ষমা.. এরচেয়ে বড় বোধহয় আর কিছুই হয় না... দুই পরিবার অনেকদিন পরে আবার হাসি আনন্দে মেতে ওঠে শ্রদ্ধা আর আদর্শের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে...

এদিকে দীর্ঘক্ষণ শ্রদ্ধাকে সবার সাথে ভাগ করলেও অল্প কিছু সময় যে এখন আদর্শেরও চাই... যতই হোক, ও প্রথম ভাগীদার... তাই সুযোগ পেতেই হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে ঘরে... শ্রদ্ধা অনুযোগ জানাতেই কানে কানে বলে ওঠে,

আদর্শ : মনেআছে, সকালে একটা উপহার চাইবো বলেছিলাম.. সেইটা এখন দিতে হবে যে...

শ্রদ্ধা ইঙ্গিত বুঝেও না বোঝার ভান করে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে,

শ্রদ্ধা : আবার কি উপহার ?? সবই তো হলো...

আদর্শ : উহু !!! একটা বিবাহবার্ষিকীর Special Gift চাই আমার...

শ্রদ্ধা : তা গুন্ডামশাই, কি Gift চাই আপনার ??

আদর্শ : আবার গুন্ডামশাই !!! তবে রে...

মূহুর্তে শ্রদ্ধাকে নিজের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়ে বলে,

আদর্শ : এই যে স্যার, কেমন আজ নিজের মেয়েকে পেলেন এতদিন পরে.. একটা ছেলেও পেয়েছেন যদিও.. তবে এবার যে আমারও একটা ছোট্ট রাহী চাই, যে রোজ এই ভাবে আমার কাছে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ করবে, আবদার করবে.. আর... আর আমি মন ভরে আমার মেয়েকে আদর করবো.. প্রচুর Gift কিনে দেবো... তবে মা যে একদম ই বঞ্চিত হবে এমনটা নয়... মা চাইলেই আদরের ভাগ তাকেও দিতেই পারি...

বলেই আদর্শ জোরে শ্রদ্ধার নাকে নিজের নাকটা ঘষে দেয়...

শ্রদ্ধা : ধ্যাত !!! তুমিও না আদি !! যা তা !!!

লজ্জায় মুখ লুকোয় আদর্শের হাতের মধ্যে... আবার ফিসফিসানি শোনা যায়,

আদর্শ : আমার giftটা পাবো তো ?? অবশ্য চাওয়ার Listটা এখানেই শেষ নয়... সময় মতো যেটা বাকি, সেটাও আমি আদায় করেই নেবো... সেটা যদিও তোমার আর আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাও সেই ইচ্ছেটাও পূরণ করা বাকী আমাদের... একসাথে পথ চলে তোমার স্বপ্নপূরণ করা...

শ্রদ্ধা : (চোখের ইশারায় জানতে চায়) কি ??

ওপাশ থেকে চোখের ভাষাতেই উত্তর আসে, বলবো না...

শ্রদ্ধা : পাবে...

আদর্শ : সত্যিই !!!

শ্রদ্ধা : সত্যি.. সত্যি.. সত্যি... তিন সত্যি...

      আমরা কিন্তু সব দেখছি, সব শুনছি

আদর্শের ঠোঁট শ্রদ্ধার ঠোঁটের উপর নেমে আসতে গেলে পেছন থেকে ভেসে আসে কিছু শব্দ, যা শুনে শ্রদ্ধা আর আদর্শ পরষ্পরের থেকে ছিটকে সরে যায়...

আদর্শ : ব্যাস... এসে গেল জাম্বুবানের দল... (সংস্কারের মাথায় সজোরে একটা চাটি মেরে) এই... তোর আজকে Marriage Anniversary না !! যা না... বউয়ের সাথে প্রেম কর না... আমার পেছনে পড়া কেন তোদের !!!

সংস্কার : নাহহহ... দেখতে এলাম আর কি- তোর আর রাহীর জীবনটা কেমন 'সমান্তরাল'-এ চলছে... 'সমান্তরাল'...

আদর্শ একটু কপট রাগ দেখাতে চাইলেও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সবাই মিলে... ওদের সবার ভালোবাসা মিশে যায় রাতের আকাশে...

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি

                         হৃদয় জুড়ে


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance