অন্তিম অবসর
অন্তিম অবসর
অবশেষে আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে। আমি অবসর নিতে চলেছি, না না চাকরি থেকে নয় বরং জীবন থেকে।
বয়স তো কম হলো না, সাতাত্তর বছর তো দেখলাম এই বসুন্ধরাকে। এই চোখ দুটো যে অনেক কিছু দেখলো আর নতুন নতুন জিনিস শিখলো।
জন্মের পর বাপের বাড়িতে তেমন সম্মান পাইনি, আসলে আমি তো মেয়ে তাই। তবে শ্বশুর বাড়িতে আসার পর সম্মান পেয়েছি। চাকরি করতে হয়নি কখনো তবে সংসারের জাঁতা কলে পেশাই হওয়া কি কম বড় কাজ নাকি!! স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি সবার মন জুগিয়ে চলতে হয়েছে, যদিওবা তাদের আমাকে নিয়ে অভিযোগ ছিল না। তবুও তাদের আমি ভালোবাসি যখন তাদের জন্য তো করবোই।
সংসার আমার সুন্দর সাজে সাজানো, তখন কোল আলো করে এলো ছোট্ট একটা রাজপুত্র। তাকে মানুষ করার চেষ্টা করেছিলাম আমি, কিন্তু কেন জানি মানুষ হলো না। ছোটবেলায় ঠিক ছিল তবে বড় হতে হতে বদলে যেতে লাগল। বদলটা চোখে পড়ল ওর বাবা মানে আমার স্বামীর মৃত্যুর পর।
আমাকে খাওয়াতে নাকি ওর কষ্ট হচ্ছে, পড়াশোনা করে এত বড় চাকরি করার পরও খাওয়ানোর জন্য টাকার অভাব!!! না, টাকার অভাব নয়, মনুষ্যত্ব বিবেক এর অভাব। বিয়ে করে বউ আনার আগেই আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিল, বউ হয়তো আমাকে পছন্দ করে না তাই হয়তো.!
ভগবান, এই জীবনের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, কি পেলাম আমি এই জীবনে? ছোট থেকে যাকে স্নেহ ভালোবাসায় বড় করলাম সেও তো দেখলো না। ভাগ্য ভালো যে স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি ভালো ছিল, তবে তারাও যে ছেড়ে চলে গেছে আমাকে। ভেবেছিলাম স্বামীঘর করার পর পরবর্তী জীবন ছেলের সঙ্গে, নাতি নাতনীর সঙ্গে ভালো কাটবে, কিন্তু কিছুই হলো না। উল্টে আমি একা হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি খুশি, খুব তাড়াতাড়ি আমিও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাবো। ছেলেটা একবারও দেখতে এলো না আমাকে এই শেষ সময়ে। তবুও আমি খুশি, অবশেষে অবসর নিচ্ছি আমি।
চোখের কোন থেকে জলটা গড়িয়ে পড়ল, আর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল চঞ্চলা দেবীর। মৃত্যু যন্ত্রনা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কষ্ট, তবুও চঞ্চলা দেবীর মুখে হাসি কারন তিনি অবশেষে এই জীবন থেকে অবসর নিতে পারছেন। এই মৃত্যু যন্ত্রনার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে চঞ্চলা দেবী ইহলোক ত্যাগ করলেন, আর পরে রইল চঞ্চলা দেবীর নিথর দেহ টা।
কাল সকালে হয়তো খবর পেয়ে উনার ছেলে আসবে, মায়ের মৃত্যুর জন্য লোক দেখানো শোক পালন করবে। লোক খাওয়াবে, আনুষ্ঠানিক ভাবে শোকসভা হবে।
তবে হ্যাঁ, সব কিছুতেই থাকবে ভালো মানুষীর পর্দা। আদতে যদি ভালো হতো তাহলে কি পারতো বৃদ্ধাশ্রমে মা'কে রেখে যেতে??? পারতো শেষ বয়সে মায়ের অবলম্বন না হয়ে থাকতে!!!