সুদিন
সুদিন
আমি মিচি, এই কেক শপের কর্ণধার। মায়ের অসুস্থতার জন্য মা'কে কাজ ছাড়তে হয়, আর তখন থেকেই আমি আর আমার বোন মিকি এই কেকের দোকান টা চালাচ্ছি। তিলে তিলে গড়ে তুলে ছিলাম এটা, তবে হঠাৎ করে পৃথিবীর বিভীষাকাময় রুপের মুখোমুখি হতে হলো। সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল করোনা ভাইরাস নামের মহামারী। জীবন টা থেমে গেল, আর তার সঙ্গে ঘরবন্দী হয়ে গেলাম। কাজ কারবার বন্ধ হয়ে গেল, যেটুকু সঞ্চয় ছিল তাতেই কষ্ট শিষ্ট করে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কবে সব আগের মতো ঠিক হবে!!! ভগবানের দয়ায় ধীরে ধীরে সব আবার আগের মতো স্বাভাবিক হচ্ছে। আমি ও আবার আমার কেক শপ খুলেছি, তবে এই মহামারির আবহাওয়া তে আগের মতো মানুষ কেকে কিনবে এই ধারনা রাখাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
এতক্ষন ধরে মিচি এইসব ভাবছিল নিজের মনে, মিকির আওয়াজ পেয়ে মিচি নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা'র দিকে তাকাতে মিচি দেখল একটা বয়স সাতের বাচ্চা ছেলে দরজা ঠেলে ভেতরে এলো।
একতো এই ভয়াবহ ভাইরাসের পরিবেশ, তার উপর ছোট বাচ্চা'টা কে একা দেখে মিচি অবাক হলো।
"তুমি একা এসেছো?" মিচি বিস্ময়ের সঙ্গে বলল।
বাচ্চা'টা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
"তো বলো কি সাহায্য করতে পারি তোমার জন্য!!" মিচি আবার প্রশ্ন করল।
বাচ্চা'টা সাজিয়ে রাখা কেক গুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা চকলেট কেকের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল "আমার এই কেকটা চাই, আজ আমার মায়ের জন্মদিন। আমি মা'কে সারপ্রাইজ দিতে চাই"।
মিচি বেশ সুন্দর করে কেকের উপর লিখে দিল "মা"। কেকটা প্যাকেট করে বাচ্চা টার দিকে এগিয়ে দিতে সে নিজের কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে মিচির সামনে রাখলো। প্যাকেট ভর্তি খুচরো পয়সা দেখে মিচি বুঝলো এগুলো নিশ্চয়ই বাচ্চাটার জমানো টাকা।
"কত দাম এটার?" বাচ্চা টা প্রশ্ন করল।
"তিনশো কুঁড়ি" মিচি বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল।
কথাটা শুনে বাচ্চাটা মুখ কালো করে বলল "দিদি আমার কাছে তিনশো টাকা আছে, বাকি কুঁড়ি টাকা তো...."
বাচ্চা ছেলেটার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিচি হেঁসে বলল "আজ আমার দোকানে বাম্পার সেল চলছে, আর তুমি তার লাকি বিজেতা। তাই তোমার থেকে আমি কুড়ি টাকা নিলাম"।
বাচ্চা টার মাথায় যে হিসাবের কারসাজি চলছে সেটা মিচি বুঝতে পারছে ওর মুখ দেখেই। তবে হঠাৎ বাচ্চা টা বেশ খুশি হয়ে মিচির হাত থেকে কেকের প্যাকেট টা নিয়ে নিল।
"তুমি একা যেতে পারবে তো?" মিচি হেসে জিজ্ঞেস করল।
বাচ্চা টা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে, হাসতে হাসতে কেকটা নিয়ে চলে গেল।
"দিদি তুই এটা কি করছিস বলতো? এমনিতেই ব্যবসার অবস্থা ভালো নয় তার মধ্যে তুই হঠাৎ বাম্পার অফার দিয়ে বসলি!!" মিকি বেশ বিরক্তির সুরে বলল।
"দেখলি তো, ওই টুকু ছেলে নিজের মায়ের জন্মদিন এর জন্য কেক নিতে এসেছিল" কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে বলল মিচি।
"এরকম দয়ার সাগর হলে ব্যবসা লাটে উঠবে" মিকি গম্ভীর গলায় বলল। প্রতিউত্তরে মিচি শুধু হাঁসলো।
এই ঘটনার পর একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। মিচি মিকি নিজের দোকান নিয়ে ব্যস্ত। এরই মাঝে ওই ছোট্ট বাচ্চাটা'র আবির্ভাব ঘটলো সঙ্গে একজন ভদ্রলোক।
বাচ্চা টা দৌড়ে মিচির কাছে এসে ওর হাত ধরে টেনে ভদ্রলোকের সামনে এনে দাঁড় করালো।
"এটা আমার বাবা" বাচ্চা টা বলল।
করমর্দনে স্বাগত জানালো মিচি।
"রোহিত গত একসপ্তাহ আগে আপনার দোকান থেকে কেক নিয়ে গেছে, আপনি টাকা নেননি!!!" ভদ্রলোক বললেন।
"টাকা তো নিয়েছি" মিচি বলল।
"হ্যাঁ তবে একটা কেকের দাম কুড়ি টাকা হতে পারে না, তাও আবার এই সময়" ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন।
"ও নিজের মায়ের জন্য কেক নিতে এসেছিল তাও আবার নিজের জমানো টাকা দিয়ে, আমি টাকাটা নিতে পারিনি। ওর থেকে তবুও কুড়িটা টাকা নিয়েছিলাম" মিচি হেঁসে বলল।
"ও এখানে এসেছিল কাউকে না বলে, আমি পরে জানতে পেরেছি। কেকটা সত্যি খুব সুন্দর খেতে ছিল" কথাটা বলে ভদ্রলোক একটা ভিজিটিং কার্ড মিচির দিকে এগিয়ে দিল। ভিজিটিং কার্ড টা দেখে মিচি বুঝলো ভদ্রলোক একজন পার্টি প্ল্যানার।
"আমি অনেক বড় বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করি, তখন কেকের ও দরকার হয় খুব। আপনি যদি রাজি থাকেন আমি আপনার হাতের কেক আমার অনুষ্ঠানে সার্ভ করতে চাই" ভদ্রলোক বেশ অনুরোধের সুরে বলল।
মিচি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, আর মুখে মিস্টি হাসি।
ভদ্রলোক বেরিয়ে চলে যাওয়ার পর মিকি মিচির কাঁধে হাত রেখে বলল "তুই ঠিক বলেছিস দিদি যে অন্যের ভালো করে তার সঙ্গে কখনো খারাপ কিছু হয় না"।
"সব ঠিক হয়ে যাবে মিকি। মা আসার সময় যে হয়ে গেছে, দেখবি সবার জীবন থেকে সব দুঃখ কষ্ট মুছে যাবে। আবার সব স্বাভাবিক হবে, হতেই হবে" মিচির চোখে জল চিকচিক করছে।