অনামিকা
অনামিকা
- তোর ফোনে একটা পিডিএফ ফরওয়ার্ড করলাম। দ্যাখ!
- হুঁ মা। কি গো এটা!
- এটা নাকি একটা পূজাবার্ষিকী। ছোটবেলা পুজোর আগে কিনে দিতাম, মনে আছে। তেমন নাকি। তবে মোবাইলে পড়তে হয়। তোর ছোট মাসির ননদের ছেলের তোলা একটা ফটো বেরিয়েছে। ফটোগ্রাফি করে তো ও! দ্যাখ দ্যাখ, কি সুন্দর ছবি তুলেছে। তোর ছোটমাসি পাঠালো।
- ওহ! মা! তুমিও না! এরম পূজাবার্ষিকী ই-ম্যাগাজিন আকারে কত বেরোচ্ছে বল তো আজকাল।
- দেখতে বলেছে, দ্যাখ না। এত কথায় কাজ কি!
- বেশ, কত পেজ নাম্বার!
- এই রে, ৭৬ বোধহয়। তা না হলে ৯৬।
- ওকে, দেখে নেব।
কি একটা ফটো দেখার জন্য মা কি বিরক্ত করছে! বাপরে বাপ! মেঘা ভাবলো না দেখেই একটা দায়সারা “ভালো” বলে দেবে আপাতত। মা ছোট মাসীকে ফোন করে বলবে “জানো তো আমি, আমার বর, মেঘা সবাই দেখেছে তুতানের তোলা ফটোটা। খুব ভালো লেগেছে”। তারপর সেই সূত্র ধরেই আরেকটু গল্প হবে আর কি! তাই হয়তো এত তাড়া!
ছোট মাসির উদ্দেশ্য একটা পরিশীলিত সংসারে যে তার বিয়ে হয়েছে, সেটা দেখানো। তুতানের নিজের উদ্দেশ্য ছিল নিজের কাজের একটু প্রচার, একটু প্রশংসা পাওয়া, এই আর কি! এই দুনিয়ার সাথে সবার চাওয়া-পাওয়াও যেন কোনো কিছুকে ভরকেন্দ্র করে এরমভাবেই ঘুরপাক খায় সারাক্ষণ। কখনো সেই চাওয়া পূর্বনির্ধারিত, কখনো সেই চাওয়া হঠাৎ করেই পাওয়া। এক্ষেত্রে ভরকেন্দ্র একটা ই-ম্যাগাজিন!
রবিবারের দুপুরগুলো বেশ রংবেরঙের হয় সাধারণত, তবে আজ দুপুরটা কেমন যেন নিরস। আজ মাংসও রাঁধেনি মা, আকাশেরও মুখ ভার কেমন যেন! সব মিলিয়ে কিছুই ভালো লাগছে না মেঘার, এমনকি ফেসবুক স্ক্রল করতেও না। মায়ের পাঠানো সেই ই-ম্যাগাজিনটা খুলল মেঘা। কিছু যখন ভালোই লাগছে না, এটাই একটু আধটু দেখবে বলে মনস্থির করল ও। তুতানের তোলা ফটোটা দেখার পরই একটা কবিতায় চোখ পড়ল মেঘার। একটা দুটো পংক্তি চোখে পড়তেই পুরো কবিতাটিই পড়ে দেখার ইচ্ছে হল মেঘার। কবির নাম লেখা আছে “বাউন্ডুলে”, আজকাল কিসব ছদ্মনাম বানায় লোকজন! এমন কবির নাম বা ছদ্মনাম জীবনে শোনেনি মেঘা। অবশ্য শুনবেই বা কি করে! এই অনামী ই-ম্যাগাজিনের সমস্ত কবি, লেখকের নামও যে অনামী হবে তাই তো স্বাভাবিক!
কবিতাটির নাম “অনামিকা”। কবি লিখছেন
“গাছের পাতায় দোলে সৌর-জ্যোতি
অফিস গেটে দাঁড়ায় অফিস বাস,
ব্লু জিনস আর হোয়াইট কুর্তিতে তুমি,
হঠাৎ করেই সুরেলা দখিনা বাতাস।
হাতে তোমার ব্রাউন ব্যান্ডের ঘড়ি,
চুলের আড়ালে চোখ দুটো যে লুকায়
মনের অজান্তে মনেই ওঠে ঝড়
তুমিই আমার বাস্তবের রুবি রায়।
ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা তিল,
হাসির মাঝে মুক্ত পড়ে ঝরে
সবচেয়ে দামী তুলির টানে
উপরওয়ালা তুলেছেন তোমায় গড়ে।
তুমি আমায় চিনবে না কোনোদিনও,
কবিতার পাতায় থাকবে তুমি রাখা,
ভীষণরকম যত্ন নেব আমি,
খুব ভালো থেকো, অনামিকা। ”
কিছু কবিতা থাকে, যেগুলো হয়তো খুব ভালো কিছু নয়, কিন্তু কিছু কিছু মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। কবিতাটা মেঘার কাছে তেমনই একটা কবিতা! স্মৃতির স্মরণী বেয়ে মেঘা তখন তিন তিনটে বছর পিছিয়ে গিয়েছে। একটা আই.টি. কোম্পানিতে চাকরি করত তখন মেঘা, এখন যদিও একটা সরকারি চাকরি করে। তো সেই তিন বছর আগে হঠাৎই কতগুলো দিন যেন হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেঘার মনের অলিন্দে। সকাল ন’টায় অফিস পৌঁছাতে হত। অফিস বাস অফিসের গেটে নামিয়ে দিত মেঘাকে। সিক্সথ ফ্লোরে মেঘার ডেস্ক। ওখানে যাওয়ার জন্য একদিন লিফটে চড়েছে। লিফটের দরজা বন্ধ হতে যাবে, হঠাৎই একটা ছেলে হুড়মুড়িয়ে লিফটের ভিতর দৌড়ে ঢুকে এল। ঢোকার মুখে লিফটের দরজাতে ধাক্কাও খেল একবার। আর তারপর মেঘার চোখে চোখ পড়তেই একটা বোকা বোকা হাসি। মেঘাও হাসি চেপে রাখতে পারেনি। ছেলেটি ফিফথ ফ্লোরে নেমে গেল বটে, কিন্তু একটা এপিসোডের সূচনা হল সেদিন থেকে। অনামী একটা এপিসোড!
পরদিন লিফটে উঠতেই অদ্ভুতভাবে আবার সেই ছেলেটিও লিফটে উঠল। তবে সেদিন আর ওরম হুড়মুড়িয়ে নয়, বরং ধীরস্থির, পরিশীলিত, পরিমার্জিত ভাবে। আলতো করে লিফটের সিক্সথ ফ্লোরে যাবার বোতামে চাপ দিল মেঘা। ছেলেটিও ফিফথ ফ্লোরে যাবার বোতাম প্রেস করল। কোনো কথা হল না দুজনের। শুধু একবার দুজন দুজনের দিকে তাকালো। নির্বাক সেই দৃষ্টিতে প্রফেসনালিজমের আধিক্যই ছিল বেশি। একদিন, দুদিন না, লিফটে উঠতে নামতে মাঝেমধ্যেই মেঘার তখন দেখা হয় ছেলেটির সাথে। প্রথম প্রথম কাকতালীয় ভাবলেও ক্রমশ মেঘা বুঝতে পারল ব্যাপারটা হয়তো কাকতলীয় নয়। এই লিফটের মধ্যে দেখা করার মধ্যে কেমন যেন একটা অমোঘ আকর্ষণ কাজ করে। ছেলেটার নাম, পরিচয় কিছুই জানে না মেঘা। মেঘা জানে না ছেলেটি অফিসের বস নাকি কেরানী! তবে এই লিফটের মধ্যে ছেলেটি না থাকলে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে মেঘার! ফিফথ ফ্লোরে লিফট থামলে মেঘার চোখ লিফটের বাইরে সেই ছেলেটাকে খোঁজে। কথা বলতে মন চাইলেও কথা বলা হয়ে ওঠে না মেঘার। প্রফেসনালিজমের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পরিচয় করা আর তাই হয়েও ওঠেনি।
এর মধ্যেই মেঘা সরকারি চাকরিটা পেয়ে গেল একদিন। তিন মাসের নোটিস পিরিয়ড চলছে তখন, চলছে লিফটে ওঠা নামার মাঝে দেখা সাক্ষাৎ। ভারী অদ্ভুত! আগে থেকে মেঘা ঠিক করে রাখে অন্তত “হাই”, “হ্যালো” টুকু বলবে, কিন্তু কই আর বলতে পারে! ছেলেটি ফিফথ ফ্লোরে নেমে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘা। একটু হাসি বিনিময়ের চেষ্টাও আসে দু পক্ষ থেকেই, কিন্তু সেই হাসিটুকুও যেন প্রফেসনালিজমের কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। আবার যে যার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কথা আর হয়ে ওঠে না।
দেখতে দেখতে লাস্ট ওয়ার্কিং ডে চলে আসে মেঘার। ওর অফিস থেকে ফেয়ারওয়েলের ব্যবস্থা করে। সেসব শেষে বাড়ি ফেরার সময় মনের ভেতর গাঢ় মেঘ জমে মেঘার। কলিগদের ছেড়ে আসবার দুঃখ, আর সেই সাথে সেই নাম না জানা ছেলেটার সাথে আর দেখা হবে না, সে কথা ভেবেও মেঘার মনের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। বাড়ি ফেরার জন্য অফিস বাসে উঠবে, সবাইকে বিদায় জানিয়ে লিফট লবিতে এসে দাঁড়ায় মেঘা। সুতপা, মেঘার কলিগ, অফিস গেট অবধি ছেড়ে দেবে বলে মেঘার সাথে আছে। ওরা লিফটে ওঠে। মেঘার হাতে ফেয়ারওয়েলে পাওয়া ফুলের তোড়া, আর একটা পার্স। ফিফথ ফ্লোরে দাঁড়ায় লিফ্টটা! লিফটের দরজা খোলে। ছেলেটি লিফটে ঢোকে। সে জানেও না আজই হয়তো তাদের শেষ সাক্ষাৎ! মেঘার হাতে ফুল, পার্স দেখে বড্ড অবাক হয় সে। যদিও অভিব্যক্তির কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটে নি। গ্রাউন্ড ফ্লোর চলে আসে। মেঘা বেরিয়ে যায় লিফট থেকে। সুতপা বলে “অল দ্য বেস্ট ফর ইউর ফিউচার এনডেভারস”। লিফট থেকে আর নামে না ছেলেটা। ও আবার ফিফথ ফ্লোরে যাবে, কিছু একটা জিনিস ফেলে এসছে বোধ হয়। লিফটের দরজা বন্ধ হয় ক্রমশ। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই প্রথমবারের জন্য বোধহয় দৃষ্টি ফেরানোর কোনো তাড়া নেই। লিফটের দরজা বন্ধ হয়। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চোখের পলক পড়ে। ধীরে ধীরে মনের মাঝ থেকে হারিয়ে যায় এপিসোডটা হাজারো ব্যস্ততার মাঝে।
আজ কবিতাটা পড়ে বড্ড সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ছে। কেমন আছে ছেলেটা? এরকমই কোনো একজন ছেলে হয়তো কবিতাটা লিখেছে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মেঘা। নিজের ঠোঁটের কোণে তিলটাকে ছুঁয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সুন্দর করে হাসলো নিজের দিকে তাকিয়ে। তারপর একটা ঘন দীর্ঘশ্বাস। ফিসফিসিয়ে মেঘা বলল “ভালো থেকো, বাউন্ডুলে। হয়তো খুব শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের” ।
