Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy Classics

2.6  

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy Classics

অকাল বোধন

অকাল বোধন

5 mins
1.4K


অনুর মা শাক শাপলার আঁটি বেঁধে বেঁধে বড়ো গাঁঠরি বোঝাই করছিলো। অনু মাটির দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে কুড়োনো ফুলের মালা গাঁথছিলো। দু-তিনটে পাঁচমেশালি ফুলের মালা। আর একটা বেশ বড়ো করে বেলপাতা আর শিউলি-টগর মিশিয়ে গোড়ের মালার মতো করে গেঁথেছে। মালা গাঁথা হতে অনু মালাগুলোতে জলের ছিটে দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে রাখলো। এতে মালার ফুলগুলো বেশ টাটকা থাকে। বিশালাক্ষীতলায় নিয়ে দাঁড়ালেই খানিকক্ষণের মধ্যেই মালা বিক্রি হয়ে যায়। অনুর মাও হাতের কাজ শেষ করেছে। এবার মেয়েকে নিয়ে দুটো পান্তা মুখে দিয়েই বাজারে যাবে। আজই যা বিক্রিবাটা হবে। বিকেলের বাজারটাও ধরে আসবে। কাল থেকেই শাকপাতা শাপলা... এইসবের বাজার মন্দা যাবে। বচ্ছরকার দিনে দুর্গাপুজোর চারটে দিনে মানুষে ছেলেপুলে নিয়ে একটু আধটু ভালোমন্দ খায় দায়। আজ অনুর মা তাই সন্ধ্যে হয়ে গেলেও শাক শাপলার সব আঁটিকটা কাটিয়ে দিয়ে তবেই ফিরবে। নয়তো এতো কষ্ট করে জল ঘেঁটে ঘেঁটে তোলা সব জিনিসগুলো নষ্ট হবে।


অনুর মা একটা বড়ো কানা উঁচু কাঁশিথালায় পান্তা ঢেলে ভালো করে গন্ধরাজ লেবুর পাতা আর নুন দিয়ে চটকে মাখলো। তারপর আগের দিনের চালডাল বাটা দিয়ে শুশনি শাকের বড়া কামড়ে মেয়েকে নিয়ে খেয়ে উঠলো। অনুকে পইপই করে বলে গেলো, মালা কটা বিক্রি হয়ে গেলেই যেন অনু রোদ চড়বার আগেই ঘরে চলে আসে। এই আশ্বিন মাসের রোদ বড়ো খারাপ। শেষকালে জ্বরজ্বালা হলে এই পুজো আচ্চার দিনে মেয়েটা একটু আনন্দ করতে পারবে না। অনুর মা অনুকে এখনো কিছু বলে নি। খানিকটা টাকা গুছিয়েছে। আজকে যা পাবে তার থেকে খানিকটা নিলেই, বাজারের কোণের নীলুর দোকান থেকে মেয়ের জন্য ঐ লাল-হলুদে চকচকে ছিটের জামাটা নিয়ে যাবে। খুব মানাবে অনুকে।




আট-ন'বছরের অনুকে ভারী সুশ্রী দেখতে। গরীবের ঘরে এতো সৌন্দর্য্য দেখলে বোধহয় মানুষের চোখ টাটায়। তাই অনুর রূপ দেখে এখন থাকতেই পাড়া- ঘরের বৌ-ঝিরা ফিসফাস করে। তার কতক অনুর মায়ের কানেও আসে। কিন্তু দিন আনা দিন খাওয়া মায়ের কী আর সব কাজকম্ম ফেলে মেয়ে আগলে বসে থাকবার জো আছে? মনে মনে মা দুর্গাকে আর গাঁয়ের মা বিশালাক্ষীকে স্মরণ করে, "অনুকে তোমার ভরসায় রেখে গেলুম মা," বলে অনুর মা বাজারের পথে হাঁটা দিলো।




মা বেরিয়ে যেতেই অনুও কলাপাতায় মোড়া মালা ক'টা নিয়ে ঘরের দরজায় শেকল তুলে, উঠোনের আগড়টা টেনে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রোদ মাথায় উঠতে দেরী আছে। অনু হনহন করে হাঁটা লাগালো বিশালাক্ষী তলার দিকে। মালা ক'টা বিক্রি হয়ে গেছে। অনু ঘরে ফেরার পথ ধরলো। যে পথে অনেক লোকের যাতায়াত, সেটা একটু ঘুরপথ, বেশী হাঁটতে হয়। অনু তাই শর্টকাট নিলো, বাবুদের বাড়ীর পাঁচিল ঘেরা বাগানের পেছন দিক দিয়ে। এই বাগানে অনেক রকমের গাছ। সবসময় গেট বন্ধ থাকে বলে কেউ ভেতরে ঢুকতে পায় না। কিন্তু আজ বোধহয় পুজোআচ্চার দিন বলে বাড়ীর পেছনদিকে বাগানের গেটটাও হাট করে খোলা। অনেক রকম ফুলের মিষ্টি গন্ধ আসছে। তার মধ্যে অনু চিনতে পারলো গন্ধরাজ, যূথী, চাঁপা ফুলের গন্ধ। বারোমাসই এখান দিয়ে গেলে এই গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু সব গন্ধ ছাপিয়ে শিউলির গন্ধে ম ম করছে বাবুদের বাড়ীর বাগান।




গেট খোলা দেখে কী মনে করে অনু এদিক ওদিক চেয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ঢুকে পড়লো বাবুদের বাগানে। এতোবড়ো বাড়ী, এতোবড়ো বাগান, কিন্তু গাছের তলায় শিউলি ফুল বিছিয়ে পড়ে আছে। এতোটা বেলা হয়েছে, কিন্তু কেউ কুড়িয়ে তুলে নেয় নি ফুলগুলো। আবার একবার চারধারে চোখ বুলিয়ে অনু ফুল কুড়োতে বসে গেছে। জামার কোঁচড় ভরে ফুল কুড়িয়ে অনু ভাবলো, রোজই তো ফুলের মালা গেঁথে বিক্রি করে দেয়, আজকের এই ফুলগুলো দিয়ে একটা বড়ো মালা গেঁথে তাদের ঘরের গোপালঠাকুরের পটটাতে পরাবে। 




অনু সবে উঠে দাঁড়িয়েছে ফুলগুলো নিয়ে, অমনি বাবুদের বাড়ীর ফর্সাপানা ছোটছেলেটা অনুর পথ আটকে দাঁড়ালো। অনু ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। ততক্ষণে অনুর জামার কোঁচড় থেকে সব ফুল পড়ে গেছে। অনু একছুটে পালাবার আগেই ছোটবাবু খপ করে অনুর হাত ধরে ফেললো। অনু প্রায় কেঁদে ফেলে, ছোটবাবু বলছে, "ভয় কিসের রে? তুই বরং রোজ এসে সব ফুল নিয়ে যাস। তুই ঐ সদগোপ পাড়ায় থাকিস না? বিশালাক্ষীতলায় মালা বেচিস।চিনি তো আমি তোকে। এগুলো তো পড়ে পড়েই নষ্ট হয়! তুইই নিয়ে যাস। চল, লজেন্স খাবি?" অনু গরীব ঘরের মেয়ে, লজেন্স খাওয়ানোর বিলাসিতা ওর মা করতে পারে না। এককথায় রাজী বছর আট-নয়েকের অনু। ছোটবাবুর শক্ত মুঠিতে ধরা অনুর হাতখানা। অনুও ছোটবাবুকে চেনে, আগে দূর থেকে দেখেছে, মায়ের সঙ্গে বাবুদের বাড়ীতে ঠাকুর দেখতে এসে। বাগানটা বাড়ীর পেছনদিকে, ফাঁকা শুনশান। বাড়ীর সামনের দিকটায় ঠাকুরদালানে পুজো চলছে বোধহয়। ওদিকেই সবাই হবে হয়তো!




অনুকে ছোটবাবু একটা ঘরে নিয়ে গেলো, শুধু বই আর বইয়ে ঠাসা সে ঘর। অনেকগুলো লজেন্স খেতে দিয়েছে। কী ভালো খেতে! অনু চোখ বুজে লজেন্সের স্বাদ নিতে নিতে বললো, "বাবু আমি বাড়ী যাবো, বেলা হয়ে যাচ্ছে, মা রোদ লাগাতে বারণ করেছে।" "আচ্ছা যাবি, তোর গাল দুটো তো খুব সুন্দর।" অনু হাসলো। "বাহ্, তোর হাসিটাও তো খুব সুন্দর। তুই এক কাজ কর, বাড়ী যাবার আগে আমার পিঠটা একটু চুলকে দেতো।" বলেই জামাটা খুলে ফেলে চেয়ারে বসলো ছোটবাবু। অনু আস্তে আস্তে ছোটবাবুর পিঠে হাত ছোঁয়াতেই ছোটবাবু অনুকে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো। অনুর কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। অনু আবার বাড়ী যেতে চাইলো। ছোটবাবু বললো, "এই তো যাবি। তুই এতো সুন্দর, তোকে একটু আদর করে দিই, তারপর বাড়ী যাবি।" ছোটবাবু অনুর সারাগায়ে হাত বুলোলো, মুখ ঘষলো, তারপরে আরো কীকী সব করলো, তাকে কী বলে, অনু জানে না। তবে ছোটবাবু বললো, "একে নাকি আদর করা বলে। কিন্তু কাউকে বলতে নেই এইরকম আদরের কথা। বললে পরে অনুর মাও মরে যেতে পারে অনুর বাবার মতো।"





ঢাক,কাঁসর, ঘন্টার আওয়াজ আজ কেমন যেন অচেনা লাগছে অনুর। ভয়ে, যন্ত্রণায় সিঁটিয়ে আছে অনু। কখন ফিরে যাবে বাড়ীতে তাই ভাবছে। মার কাছে অনু কিচ্ছু লুকোয় না, যতই ছোটবাবু মানা করুক মা'কে ঠিক বলবে, তাই ভেবে যাচ্ছে অনু। ছোটবাবু এবার অনুকে বললো, "যেই এসব কথা মা'কে বলবি, অমনি তোর মা মরে যাবে কিন্তু। খুব সাবধান।" অনু তখন ব্যথা যন্ত্রণায় ফোঁপাচ্ছে। খুব জোরে জোরে ঢাক বাজছে, সেই আওয়াজে অনুর ফোঁপানির আওয়াজ চাপা পড়ে গেলো।




ছোটবাবু অনুর হাতে অনেকগুলো টাকা দিয়ে বললো, "নতুন জামা কিনে পরিস। আর দাঁড়া", বলে.... পাশের ঘর থেকে একটা ভালো শাড়ী এনে অনুর হাতে দিলো। বললো, "এটা তোর মা'কে দিবি"। বলবি আজ এবাড়ীতে অনেক গরীব দুঃখী মানুষকে পুজোর জন্য নতুন শাড়ী দেওয়া হয়েছে।"

অনু অনুর ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝলো, "ছোটবাবু আদর করাতে একটু ব্যাথা লেগেছে ঠিকই, তবে মানুষটা ভালো। কতকিছু দিলো!"



ছোটবাবু অনুকে পেছনের গেট দিয়ে বাইরে বের করে দিলো। অনুর হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে, অনেকটা কেটেও গেছে। রক্তটা ছোটবাবু একটা সাদা কাপড়ের টুকরোয় মুছে দিয়েছে। অনু ঘরে এসে আর পারলো না বসে থাকতে, শুয়ে পড়লো। মা কখন আসবে? বাইরেটায় একটু অন্ধকার হয়ে আসছে যখন, তখন অনু উঠোনের আগড় খোলার আওয়াজ পেলো। "অনু ছিটের জামাখানা পেয়ে খুব খুশী হবে", ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকেছে অনুর মা। অসময়ে অনুকে শুয়ে থাকতে দেখে, অনুর মাথার কাছে রাখা নতুন শাড়ীখানা আর অনেকগুলো টাকার নোট দেখেই অনুর মা সব বুঝে গেলো, ঠিক কী হয়ে থাকতে পারে? কিন্তু অনুর মাও চুপ করেই রইলো, কারণ তার মতো হতদরিদ্র মায়েদের অনেক কথা হজম করে নিতে হয়, কাউকে কিছু বলতে পারে না। গরীব হওয়ার হাজারটা জ্বালা। শুধু দূরে বাবুদের বাড়ী থেকে ভেসে আসা বোধনের বাদ্যি বাজনাকে অনুর মায়ের মনে হোলো বিসর্জনের বাজনা বাজছে।

বোধনের আগেই হল বিসর্জন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy