অভিশাপের নববর্ষ
অভিশাপের নববর্ষ
সারা বিশ্ব জুড়ে চলেছে করোনার তাণ্ডব, মানুষ গৃহবন্দী, দৈনন্দিন কর্মকান্ড শিকেয় উঠেছে। মানুষ তার অস্তিত্ব রক্ষায় প্রানপনে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে এসে পড়ল বাংলা নববর্ষ। ডিজিটাল পদ্ধতিতে নববর্ষ উদযাপনের আশায় ১৪২৮ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাতে টেলিভিশন খুলে বসেছিলাম । লাল সাদা ও নানা রঙের পোশাকে সুসজ্জিত শিল্পীগণ গেয়ে চলেছেন- আনন্দধারা বহিছে ভুবনে–। টেলিভিশনের পর্দার নিচের দিকে করোনার সর্বশেষ পরিসংখ্যান ভেসে উঠছে; দেশ জুড়ে, বিশ্ব জুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সংখ্যা। মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, চোখ সরিয়ে নেই পর্দা থেকে। করোনা করোনার কাজ করে যাচ্ছে ক্লান্তিহীন। আমরা কী করছি? অনেকে প্রাণ দিয়ে খাটছে। তাঁদের জন্য অভিবাদন আর আশীর্বাদ। কিন্তু অনেকে ত্রান বিতরণের নামে আত্মপ্রচার করছে, বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যেমন করে বিজয়ীর হাতে পদক তুলে দেওয়ার সময় প্রধান অতিথির সঙ্গে অন্যান্য অতিথিগণ হাত লাগান তেমন করেই নাটকীয় কায়দায় চাল ডালের ঝোলা তুলে দেওয়া হচ্ছে নিরন্নদের হাতে। অনেকে আবার দুস্থদের জন্য বরাদ্দ ত্রান থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। খবরে লাগাতার আসছে ত্রান বেহাত হওয়ার কথা। জব্দ হওয়ার কথাও আসছে। বীরের জাতি বলে গর্বের শেষ নেই আমাদের। একটি ফুলকে বাঁচাবে বলে প্রাণ দিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে । ঘুমিয়ে আছে তাঁরা এই মাটিরই বুকে। তাঁদের রক্তভেজা মাটিতে দাঁড়িয়ে ত্রানচুরিতে বীরত্ব দেখিয়ে চলেছে আমাদের দেশের অনেকে, যাদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি, এবং তাঁদের অনুসারী বশংবদদের নামও আসছে।
তাই বলে উৎসবতো বন্ধ করা যায়না! উৎসবের মুল অনুষঙ্গ খাবার। আহা, যদি তা চলে আসত ইথারে কিংবা অন্তর্জালে! ধুমধাম করে রান্না করার মতো যথেষ্ট কাঁচামাল মজুত আছে, কেবল ইলিশ ছাড়া। কিন্তু দেশজুড়ে কোটি মানুষ অভুক্ত আছে। চৈত্রের শেষ দিবসে খবর এসেছে প্রত্যন্ত গ্রামের এক পর্ণ কুটিরে দশ বছরের একটি কিশোরী গলায় দড়ি দিয়েছে। সে একা নয়; ক্ষুধার জ্বালায় গলায় ফাঁস নিয়েছে আরও কতজন! আমার সন্তান দিনরাত দেখছে সব খবরে। এ অবস্থায় পরিবারের সকলের আনন্দ উৎসবের কথা বিবেচনা করে কেমন করে মাংসের হাঁড়ি রান্নার জন্য চাপাই! বরাবরের মতো পায়েস রান্নার আয়োজনই বা কীভাবে করি!
তবে এই দাহনকালের পয়লা বৈশাখে অভিজাত আবাসিক এলাকার অনেক বাড়ী থেকে ইলিশ ভাজা, পাঁচফোড়ন, গরম মসলার সুবাস মৌ মৌ করে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে গিয়ে রাস্তার ওপারে ছিন্নমুল বস্তিতে গিয়ে মিশে গিয়েছে। বিরিয়ানি পোলাও’র খুশবুও আকাশে ভেসে ভেসে নাকে এসে লেগেছে। বাঙালী আভিজাত্য এমনই; উৎসব থাকবে চলমান, যতক্ষণ থাকে প্রাণ।
উৎসবে পোশাকের অবস্থান কিন্তু খাবারের আগেই। বুদ্ধিমান উৎসবপ্রিয় জনতা বেশ আগেভাগেই পোশাক ক্রয় করে রেখেছেন। যারা পারেননি তারা কিছুটা হাপিত্যেশ করছেন। তাই বলে লাল সাদা পোশাকের ঘাটতিতো নেই। ব্যক্তিগত সংগ্রহের বিশাল ভাণ্ডার থেকে একটা বেছে নিয়ে গায়ে জড়ান। এমন দুর্দিনে কড়া সাজ মানাবেনা। তাই হালকা রূপসজ্জার টিপস এসেছে গণমাধ্যমে। রোদটা পড়ে এলে বিকেলের কনে দেখা আলোয় হালকা মিষ্টি সাজে রমণীগণ বাড়ীর ছাদে গিয়ে আনন্দ উদযাপন করেন, ঝাঁকে ঝাঁকে সেলফি তোলেন আর সেখানে দাঁড়িয়েই ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই সঙ্গে দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলেন- বাইরে ঘোরাঘুরি হলনা, মাটির সানকিতে পান্তা ইলিশ আর রকমারি ভর্তা খাওয়া হলনা, নাচ গান হলনা, ফুচকা খাওয়া হলনা। করোনা আর বুঝি সময় পেলনা; এমন করে আমাদের উৎসব মাটি করে দিল! সত্যিই কী করোনা বড় অসময়ে এল?
বেশ অনেক বছর ধরে আমাদের নাগরিক সমাজে একটা ধারা চলে আসছে- আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের উৎসব অনেকটাই বিনোদনের কব্জায়, বিনোদন কেন্দ্রিক। প্রাণের ছোঁয়া যৎসামান্য। ঐতিহ্যতো কবেই জাদুঘরে গিয়ে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে। চিত্রজগতের তারকারাই এখন আমাদের জীবনাদর্শ, পথ প্রদর্শক; ‘রোল মডেল’ বললে একালের পাঠকদের কাছে বেশ তাড়াতাড়ি বোধগম্য হবে। বলিউড, ঢালিউড আর ছোট পর্দার এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ বাঙালী উৎসবে অদ্ভুত এক মাত্রা যোগ করেছে। তারকাদের মতো সাজসজ্জা না হলে আমাদের উৎসব জমেনা। খাবার ঘরের সাজটাও তাই ওদের অনুকরনে করা চাই। আমাদের উৎসবে তাই পোশাকি আভরণটাই মুখ্য হয়ে যায়।
বলছিলাম উৎসবের ঘনঘটার কথা। বর্যপঞ্জিতো আর বৈশ্বিক দুঃসময় বোঝেনা। প্রকৃতিও সংকটের ধার ধারেনা; ফুল ফুটিয়ে যায়, ফল ফলিয়ে যায়। যে যার দিনপঞ্জি মতো কাজ করে যায়। আমরা সংস্কৃতিবান বাঙালিরাও বাঁচি কী মরি, উৎসব আয়োজনে কাটছাঁট করিনা। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে উৎসব ভেস্তে গেল বলে হাহাকার। অথচ পয়লা বৈশাখের দিনেই সরকারী হিসেব মতো করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী (এখন অবশ্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে) তাতে কী! সেদিনের জন্য অন্তত সব দুর্ভাবনা তুলে রাখি। আমাদের নৃশংস আনন্দে বাগড়া দেয়, কার সাধ্য!
বিদেশে নয়, দেশে এবং একই শহরে বসবাস। তবু বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা নেই দু’মাস গড়িয়ে গেল। প্রবাসী ভাইবোনদের মতো মুঠোফোনে আলাপ আর সাপ্তাহিক ডিজিটাল বৈঠকেই চলে খবর আদান প্রদান। গৃহকর্মীকে ছুটি দিয়ে একা হাতে ঘর গেরস্থালী সামলাতে কষ্ট হচ্ছে মায়ের । চাইলেও মাকে গিয়ে সাহায্য করার উপায় নেই। বাড়ীতে সবজির সরবরাহ ফুরিয়ে গেছে। খাবার মুখে রোচেনা বাবার। তাঁর পছন্দের তেল ঝাল মশলাবিহীন সবজী রেঁধে নিয়ে যাওয়া বা পাঠিয়ে দেওয়ার উপায়ও নেই। এমন গল্প এই শহরের বেশীর ভাগ পরিবারের। টেলিভিশন তবু গেয়ে চলে ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা–
মহামারী এসেছে বলে জীবন থেমে যাবেনা, সত্যি। উৎসব আনন্দবিহীন জীবন অর্থহীন, তা-ও সত্যি। তাই বলে উৎসবের নামে উন্মাদনা, অপচয়ের মচ্ছব, আর নৃশংস অমানবিক আচরণের মহড়া বন্ধ হওয়া বড় প্রয়োজন। এবারের বৈশাখকে মনের মতো করে রাঙাতে পারেনি বলে পরের বছর আরও বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব আয়োজনের শপথ যারা নিয়েছেন তাঁদেরকে একটু সংযত হওয়ার জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি। সবচেয়ে বড় কথা, করোনা কতদিন আমাদেরকে আটকে রাখবে তা বিশ্বের নামজাদা বিজ্ঞানীগণ আজও জানেননা। তাছাড়া করোনা পরবর্তী পৃথিবীও আর আগের মতো থাকবেনা। জীববিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, পরিবেশবিজ্ঞানী, অর্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই সে আশংকা প্রকাশ করছেন।
তাই বলে আত্মসমর্পণ নয়, আত্মাহুতিও নয়। বিজ্ঞানীগণ নিরন্তর খেটে চলছেন। সুদিন আসবে ফিরে। আমাদের প্রার্থনা কেবল সর্বশক্তিমানের কাছে। মানব জাতি নিজ কর্মফলে পাওয়া প্রকৃতির এই ভয়ংকর অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক। নিম্ন আয়ের প্রান্তিক মানুষগুলো দু’বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পাক। অসুস্থ মানুষগুলো উপযুক্ত চিকিৎসা পাক, সেবা পাক। আমাদের ছেলেমেয়েরা আগের মতো করে স্কুলে যেতে শুরু করুক, বিকেলবেলায় খেলে নেচে পাড়া মাতিয়ে রাখুক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারের মানুষগুলো পুনর্মিলিত হোক। উৎসবের নৃশংসতা মুছে যাক আমাদের জাতীয় জীবন থেকে।