SHUBHAMOY MONDAL

Tragedy Classics

4.3  

SHUBHAMOY MONDAL

Tragedy Classics

আষাঢ়ে গল্প

আষাঢ়ে গল্প

5 mins
483



আষাঢ়ে গল্প

শুভময় মণ্ডল 


আষাঢ় মাসের এক বৃষ্টির সন্ধ্যা - ভুতুদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে স্বপন স্যারের কাছে টিউশন পড়তে হাজির আমরা জনা বারো ছাত্র। গ্রামে কারেন্ট এলেও বৃষ্টি হলেই নিশ্চিত লোডশেডিং হবেই জেনে হ্যারিকেন নিয়েই এসেছিলাম সবাই, শুধু ভুতু বাদে। কারণ, কারেন্ট থাকলে তো তখন শুধু ওদের বাড়ির লাইট-ই জ্বলে, তাই লোডশেডিং হলে আমাদের কেরোসিনে জ্বলা হ্যারিকেনগুলোই জ্বালাতে হয়, ওরা কেরোসিন খরচ করে না। তাই হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় বসে আছি সবাই, আর বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির একটানা আওয়াজ আসছে। যাই হোক, স্যার বোধ হয় বৃষ্টির জন্যই কোথাও আটকে গেছেন, এখনও এসে পৌঁছাননি। আর আমরা মোটেও সুবোধ বালক না হওয়ায়, স্যার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে নিজেদের পড়াশুনা সব ডকে তুলে দিয়ে জমিয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। আলোচ্য বিষয় - ভূতের গল্প, কে বা কার কাকা, জ্যেঠা, মাসি, পিসি, ঠাকুমা, দাদু বা দিদা কোথায় কবে কি কি ভূতুড়ে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলো তারই যত আজগুবি রং চড়ানো সব বর্ণনা।


গল্পের আসর এমন জমে উঠেছিলো যে, ব্যাচের সবচেয়ে স্টুডিয়াস আর ভালো ছাত্র বিলুও এমনকি পড়াশুনা ছেড়ে সেই দলে যোগ দিলো! বিলু ক্লাসে ফার্স্ট হয়, স্কুল আর টিউশনের সব স্যারেরাই খুব ভালোবাসেন ওকে। তাই, পড়াশুনা ছাড়া অন্য বিষয়ে যেন ওর ঢুকতেও মানা, কথা বলতেও মানা। সেই বিলুই কিনা এসে আমাদের এই আষাঢ়ে ভূতের গল্পের আসরে যোগ দিলো? আমার ব্যাপারটা কেমন যেন বেমানান লাগলো। 


অবশ্য বিলু মুখ খুলতেই বুঝতে পারলাম আমার ধারণা অভ্রান্ত - এইসব ছেঁদো আজগুবি গল্পে ডুবে যাওয়ার পাত্রই নয় বিলু। সবারই নিজের নিজের প্রথম গল্প বলা শেষ হলে, বিলুর পালা এলো। কিন্তু বিলুর মুখ থেকে যা বেরোলো তাতে সন্ধ্যার অমন জমাটি আসরটাই বুঝি আর একটু হলেই মাটি হয়ে যাচ্ছিলো! বিলু একবারে বেরসিকের মত আসরের তাল কেটে দিয়ে বললো - ওসব ভূত প্রেত বলে কিছু হয় না বুঝেছিস, ওসব আনসাইন্টিফিক চিন্তাধারা। যত সব আজগুবি গালগল্প, মিথ্যা চিন্তা ভাবনা যাদের মাথা খায়, শুধু তাদের মগজেই ঐ সব ভূত প্রেতেরা বাস করে, আর কোথাও তাদের টিকিটিও দেখা যায় না। ওসব বাজে আলোচনা বন্ধ করে চল এবার পড়াশুনা শুরু করি, নইলে স্বপনদা এসে পড়া ফেলে সবার গল্প করা বের করে দেবে। 


এমন সময় স্বপন স্যার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন - না না, এমন পরিবেশে তো আষাঢ়ে গল্পই জমে রে। পড়াশুনা তো রোজই হয়, আজ বরং একটু গল্প গুজবই করা যাক। ভুতু, কিসের গল্প করছিলি রে? বলতে বলতে দরজার পাশের আসনটায় বসে পড়লেন স্বপন স্যার। আমি বেশ অবাক হলাম দেখে যে, এত বৃষ্টিতেও এক ফোঁটা ভেজেননি স্বপন স্যার! একবার ভাবলাম তাঁকে জিগ্গেস করি, তারপর মনে হলো আজকাল ঐ যে রেনকোট, টেনকোট সবাই পরছে না, হয়তো সেটাই পরে এসেছেন স্যার, তাই বৃষ্টির জল তাঁর গায়ে লাগে নি!


এমন সময় ভুতু স্যারকে বললো - আমরা ভূতের গল্প করছিলাম স্যার, জানেন তো আমার মেজ মামা না একবার... তাকে থামিয়ে দিয়ে স্বপন স্যার বললেন - আর বিলু কি বলছিল, ওসব ভূত প্রেত বলে কিছু হয় না? স্বপন স্যারের গলায় এমন একটা তাচ্ছিল্য ছিল যে, বিলুও মিনমিন করে বললো - হয় নাই তো। তার গলার স্বভাবসুলভ জোরটা যেন শোনা গেলো না ঐ কথাটার মধ্যে। স্বপন স্যার বললেন - হয় রে হয়, বিশ্বে যা কিছু নিয়ে মানুষ আলোচনা করে, ভাবনা চিন্তা করে, পড়াশুনা করে, রীসার্চ করে তা অবশ্যই আছে। বিশ্বাস না হয় তো, আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথাই তবে শোনাই তোদের, শোন।


স্বপন স্যার এরপর নিজের কাহিনী শুরু করলেন, আর আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম - কাল পর্যন্ত এইসব আজগুবি বিষয় নিয়ে আমাদের ফিসফাস করতে শুনলেও যে স্বপন স্যার কানমোলা দিয়ে এক্সট্রা পড়া চাপিয়ে দিয়ে বলতো - পাঁচ মিনিটের মধ্যে এই পড়াটা দিবি, নয়তো তোদের সব আজগুবি গল্প আজকেই তাড়িয়ে ছাড়বো। - সেই তিনিই কিনা আজ সবাইকে ভূতের গল্প বলছেন? বিষয়টা আমার সত্যিই কেমন যেন আবার বেমানান ঠেকলো! বুঝতে পারলাম, কিছু একটা গড়বড় তো কোথাও না কোথাও হচ্ছেই, যদিও আমার কাছে সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।


স্বপন স্যার বলতে শুরু করলেন - আমি এই রকমই এক সন্ধ্যায় পড়াতে যাচ্ছিলাম একজন ছাত্রের বাড়ি। তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই সাইকেল চালাচ্ছি, ঝোড়ো হাওয়ার জন্য কিছুতেই তাড়াতাড়ি চালিয়ে যেতে পারছি না। এদিকে পাশ দিয়ে দেখছি আমায় ওভার টেক করে সাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো! বেশ অবাক লাগলো ভেবে যে - আমার মত রোজ ব্যায়াম করা এমন স্বাস্থ্যবান যুবক যে হাওয়া ঠেলে আগে যেতে পারছে না, ঐ বাচ্চা ছেলেগুলো কিভাবে যাচ্ছে?


ভালো করে খেয়াল করে দেখতেই অবাক হয়ে গেলাম দেখে যে, ওদের সাইকেলের চাকা যেন মাটি না ছুঁয়েই চলছে! সাইকেলগুলোর দিকে ভালো করে নজর দিতেই বুঝলাম - ওটা অনেকগুলো সাইকেল না, শুধু একটাই সাইকেল একজনই চালিয়ে বারবার আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে! আশ্চর্যের বিষয় না? সে সব সময়ই আমায় পিছন থেকে ওভার টেক করছে, কিন্তু তাকে একবারও উল্টো দিক থেকে ফিরে আসতে তো দেখলাম না? অনেকবার চেষ্টা করলাম বুঝতে যে ছেলেটা কে, কিন্তু অন্ধকারে ঠিক দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে চিনতে না পারলেও, এটা বুঝতে পারছিলাম যে সে আমার খুব চেনা কেউই।


তাই, তাকে ঠিকমত দেখবো বলে সাইকেলটা থামিয়ে রাস্তার ধারেই একটা তালগাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই দেখলাম ছেলেটা যথারীতি জোর গতিতে সাইকেল চালিয়ে আমার দিকেই আসছে। আমি তাকে থামবার জন্য হাত দেখাতে, সে আমায় এগিয়ে যাবার জন্য ইশারা করলো! কিন্তু আমি তখন স্থির করেই ফেলেছি, তাকে ভালো করে আগে না দেখে আর ছাড়ছি না! তাই রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে তার পথ আগলে দাঁড়ালাম। সে একবারে আমার গায়ের ওপরে এসে যেন সাইকেলটা ব্রেক কষে দাঁড় করালো!


আমি তার মুখের দিকে তাকাতেই যাচ্ছিলাম, এমন সময় কড়কড়াৎ করে তীব্র আলোর ঝলকানি দিয়ে সশব্দে বাজ পড়লো পাশের সেই তালগাছটার ওপর, দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো গাছটা আর আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম রাস্তায়! এই পর্যন্ত বলে স্বপন স্যার থামলেন।


রবি বললো - ছেলেটা কে ছিলো, চিনতে পারলেন না, না স্যার? 

স্বপন স্যার বললেন - কি করে চিনবো, আমি তো সেই রাস্তাতেই বজ্রাঘাতে মরে পড়ে আছি! 

বিলু এবার উঠে দাঁড়িয়ে আবার মিন মিন করে বললো - ওটা আমি ছিলাম স্যার, আমিই চাইছিলাম ঐ বজ্রপাত থেকে আপনাকে বাঁচাতে। তাই বারবার আপনার পাশ দিয়ে জোরে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে আপনাকেও জোরে চালাতে উৎসাহ দিচ্ছিলাম। যতই হোক, আপনি আমার সবথেকে প্রিয় স্যার বলে কথা! নইলে আর কি, আমিও তো ওখানেই তার আগেই কেউটের ছোবল খেয়ে মরে পড়ে আছি! তাই আমি চাইছিলাম অন্তত আপনাকে আজ ঐ অপঘাতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে। চলুন না আমার সঙ্গে, আমার বডিটাও আপনার বডির পাশেই এখনও পড়ে আছে ওখানে, আপনাকে দেখাচ্ছি।

- বলতে বলতেই বিলু আর স্বপন স্যার হাওয়ায় যেন ভাসতে ভাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো!


আমরা ভয়ে চিৎকার করে ওখানেই সকলে জ্ঞান হারালাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy