আঁধার কাটিয়ে
আঁধার কাটিয়ে


এটা কোন মাস, কত তারিখ? কিছুই যে মনে করতে পারছিনা | যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি তা যেন একটা কয়লার খনি | চারিপাশে এক আদিম অন্ধকার এবং নিস্তব্ধতা | আসে পাশের বাড়িগুলি যেনো মিসরীয় পিরামিড, যেখানে এখন আর কোনো জীবিত প্রাণীর বসবাস নেই | মেঘ একটু সরে যেতেই, হালকা জোৎস্নাতে হটাৎই মনে হলো শত শত অশরীরি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে | এ কোন নরকে এসে পড়লাম জানিনা | ভয়ের তীব্রতা আরো বেড়ে গেলো যখন সেই অশরীরি ছায়া মূর্তি গুলির কিছু মুখ আমার পরিচিত মনে হলো | এদের মধ্যে কেউ আমার প্রতিবেশী, কেউ বন্ধু বান্ধব, আবার কেউ কেউ আত্মীয় স্বজনও বটে | বুঝতে পারলাম এরা সকলেই মহামারীর শিকার | মনে হতে লাগলো, এই জগৎ সংসারে কি শুধু আমিই একা বেঁচে? আচ্ছা আমার বাবা মা কোথায়? এই সকল চিন্তা ভাবনা গুলি যখন আমার বিচার বুদ্ধিকে তোলপাড় করে দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দুটি ঠাণ্ডা হাত আমার দুদিক থেকে এসে আমার দু হাত-কে স্পর্শ করলো | তাকিয়ে দেখি একদিকে আমার বাবা, অন্যদিকে মা দাঁড়িয়ে | মনের মধ্যে অনেকটা সাহস সঞ্চার হলো যেন | তারা একসাথে কান্না মিশ্রিত স্বরে আমার কানে যেন ফিসফিস করে বললো পালিয়ে যাও, যত দূর সম্ভব পালিয়ে যাও | আমি তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই মুহূর্তের মধ্যে দুজনেই গভীর আঁধারের অতলে অদৃশ্য হয়ে গেলো | প্রচন্ড ভয়ে, বিস্ময়ে যখন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম, ঠিক সেই মুহূর্তে মোবাইল ফোনের অ্যালার্মটা বেজে উঠলো |
এখন ভোর সাড়ে তিনটে, ফোনটা নিয়ে নেটটা অন করতেই ঘুম জড়ানো চোখে যে হেডলাইনটা চোখে পড়লো, সেটা হয়তো আজ সমগ্র দেশবাসীর কাছে সব থেকে বড় ব্রেকিং নিউস | আজ সকাল থেকে গোটা দেশ লক ডাউন-এর বেড়াজাল থেকে মুক্ত হবে | মারণ ভাইরাস কোরোনার আক্রমণ থেকে আমরা এখন সম্পূর্ণ ভাবে সুরক্ষিত | দীর্ঘ সাত মাস পর পঙ্গু দশা কাটিয়ে যেনো মুক্তি এলো, আবার দেশবাসী সচল হয়ে উঠবে | আবার আমাদের স্বাভাবিক, সুস্থ দৈনন্দিন ব্যস্তময় জীবনে ফেরার পালা |
এখন ভোর চারটে, অনলাইন-এ রেডিওটা চালু করতেই বেজে উঠলো “যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী……..” | আজ মহালয়া, এই পূর্ণ প্রভাতের সন্ধিক্ষণে যেনো ধরিত্রী অভিশাপ মুক্ত হলো | বাবা তিন কাপ কফি করে এনে একটা মা-কে আর একটা কাপ আমায় দিয়ে পাশে বসলো | এ যেন বাঙালির রক্তে মিশে থাকা আরেক ঐতিহ্য, এক নষ্টালজিয়া | এই আনন্দকে আরও শতগুন বাড়িয়ে দিলো সেই চিরপরিচিত মায়াবী কণ্ঠে মায়ের আগমন বার্তার মন্ত্রোচ্চারণ……………….
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।
আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নব ভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।
তাই আনন্দিতা শ্যামলীমাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।
আজ চিৎ-শক্তিরূপিনী বিশ্বজননীর শারদ-স্মৃতিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।“