Ankit Bhattacherjee

Children Stories Classics Children

3  

Ankit Bhattacherjee

Children Stories Classics Children

ছেলেটি কে?

ছেলেটি কে?

4 mins
368


আজ মহাসপ্তমী, দুর্গাপূজার এই শুভ লগ্নে বিনোদ বাবু ঘুরতে এসেছেন তাঁর ছেলেবেলার গ্রামে। প্রায় ১৭-১৮ বছর আগে স্কুলের পাঠ শেষ করে সেই যে শহরে চলে গেলেন, তারপর আর আসা হয়নি। যেখানে জন্মেছেন, বড় হয়ে উঠেছেন, প্রতিটি মানুষের কত ভালোবাসা পেয়েছেন, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর ওই গ্রামের পথ, মাঠ, পুকুর, গাছপালা, মানুষজন – সব কিছু ঘিরেই। না, বিনোদ বাবু কিছুই ভুলে যাননি। তাই এতগুলো বছর পর যখন গ্রামের রাস্তায় নামলেন, তাঁর বয়স যেন এক ধাক্কায় ২০ বছর কমে গেলো। তাঁর হৃদয় যেন এক অপার্থিব খুশীর জোয়ারে ভেসে গেলো। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে চেয়ে মনের আনন্দে বলে উঠলেন “পলাশপুর, আমার ছেলেবেলার সেই পলাশপুর”। আজও যেন একই রকম ভাবেই ফুটে আছে চারিপাশের প্রাকৃতিক শোভা। শহরের ওই দূষিত বাতাসে জীবন যেন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ তাঁর শরীরে পলাশপুরের বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করছে, যেখানে মিশে আছে তাঁর ছেলেবেলার গন্ধ। 


বিনোদ বাবু হাঁটতে শুরু করলেন তাঁর চেনা পরিচিত পথ ধরেই। এখন সেই কাঁচা রাস্তা আর নেই। চারিপাশের ছবিটা আজ অনেকখানি পালটে গেছে। তাই কিছুদূর এগোনোর পর, তাঁর বাড়ির দিকে যাওয়ার রাস্তাটা তিনি আর ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ মাঠের ধার ঘেঁসে যে পথ দিয়ে তাঁর ছেলেবেলা হেঁটে যেত, সেই মাঠ এখন ছোট-বড় পাকা বাড়ীতে ভরে উঠেছে। তাই, যে পথ ধরে তিনি এগিয়ে চলেছেন, সেই পথ ঠিক কোথায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে ওঠাবে, সেটা বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছে বিনোদ বাবুর। এমন সময় হঠাৎই দেখলেন একটি ১০-১১ বছরের বাচ্চা ছেলে, ওই বাড়ি ঘরগুলির পাশ দিয়েই একটি সরু গলির মধ্যে প্রবেশ করলো। বিনোদ বাবুর কি মনে হতে, উনিও সেই পথই ধরলেন। কিছুদূর এগোতেই তিনি পৌঁছে গেলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। তাঁর সেই মাটির বাড়ি-তো কোন কালে ভেঙ্গে এখন ইটের পাকা বাড়ি হয়ে গেছে। যাই হোক, ছেলেবেলাটা যেন আচমকাই তাঁর সামনে উড়ে এলো। সেখানে দাড়িয়ে কিছুটা সময় স্মৃতিচারণ করে, আবার গ্রাম দেখার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন বিনোদ বাবু।   


তিনি খেয়াল করলেন বাচ্চাটা আবারও তাঁর সামনে দিয়েই তাঁর সাথে সাথে হেঁটে চলেছে। উনি তাঁকে দুবার ডাকলেন কিন্তু ছেলেটি বোধহয় শুনতেই পেলোনা সেটা। এরপর তিনি আর ছেলেটিকে নিয়ে অত না ভেবে এগিয়ে গেলেন স্কুলের দিকে। ছেলেবেলার স্কুলের দিনগুলির কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখলেন ছেলেটিও স্কুলটার গেটের সামনেই দাড়িয়ে। এরপর বিনোদ বাবু যেখানেই গেলেন ছেলেটি অদ্ভুত ভাবেই সেখানে এসে হাজির হল। সে জমিদার বাড়ির প্রাচীন দুর্গা মণ্ডপই হোক যেখানে আজও পূজোর গন্ধে, ঢাকের শব্দে মন মেতেছে বিনোদ বাবুর, বা গ্রামের সেই বিশাল পুকুরটা যেখানে একটা সময় অনেকে মিলে প্রতি সপ্তাহে মাছ ধরতে বসত্‌ কিংবা খোকন-দার সেই চায়ের দোকান যেটা তাঁর বাবার প্রিয় জায়গা ছিল আড্ডা দেওয়ার। তিনি ঠিক যেখানে যেতে চাইছেন, অদ্ভুত ভাবেই কোনো অলৌকিক উপায়ে তা আগে থেকেই টের পেয়ে ছেলেটিও সেই পথ ধরেই এগোচ্ছে।


বিনোদ বাবু প্রথম দিকটাই একটু অবাক হলেও এবার কিন্তু তাঁর মনে কিরকম একটা ভয়ের অনুভূতি জাগছে। তিনি ঠিক যে জায়গাগুলো ঘুরে দেখবেন ভাবছেন, ওই ছেলেটার পক্ষে কিভাবে সেটা জেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে? শুধু তাই নয়, ছেলেটির মুখটা এখনও তিনি দেখতে পাননি। ছেলেটি কোনো কথা না বলেই চুপচাপ হেঁটে চলেছে বিনোদ বাবুর সাথেই, কিন্তু একটু আগে আগে। বিনোদ বাবুর মনে অনেক রকম চিন্তা আসতে থাকে। ছেলেটি চোর-টোর নয় তো? কিংবা তাঁকে হয়তো একটা ফাঁকা জায়গায় পরে নিয়ে গিয়ে, আরও কিছু লোকজন এসে তাঁর থেকে টাকা-পয়সা চেয়ে বসবে ।


যাই হোক, বিনোদ বাবু এবার বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন, কিছু জিনিস সময়ের সাথে পরিবর্তন হলেও, এখনও তাঁর সেই পলাশপুর অনেকটাই আগের মতই আছে। সেই মাঠের ধারের বিশাল বট গাছটা, তার একটু পাশেই সেই কালী মন্দিরটি, সেই ধানক্ষেত, সেই পুকুরে সাঁতরে বেড়ানো হাঁসের দল, সেই স্কুলের মাঠ, আর সর্বোপরি সেই ভালোবাসা, টান, আন্তরিকতা, একটা আপন আপন ভাব – যা এখনও মিশে আছে পলাশপুরের আকাশে – বাতাসে। এসব ভাবতে গিয়ে তিনি খেয়ালই করেননি যে কখন যেন সেই ছেলেটি চলে গেছে তাঁর সামনে থেকে। তিনি একটু এদিক সেদিক চেয়েও ছেলেটিকে দেখতে পেলেন না। বাস আসতে কিছুটা দেরী হবে জেনে ভাবলেন, একটু নদীর ধারে বাতাসের আলিঙ্গনে দুলতে থাকা কাশবন দেখে আসবেন। একটু এগোতেই দেখতে পেলেন সেই ছেলেটি হাতে বেশ কয়েকটা কাশফুল ছিঁড়ে নিয়ে মনের আনন্দে নাচতে নাচতে চলেছে নদীর ধার ঘেঁসে। বিনোদ বাবুও জোড়ে হাঁটা লাগালেন, ছেলেটির রহস্য সমাধানের জন্য। কিন্তু কিছুটা এগোনোর পর ছেলেটি যে সবুজ-সাদা কাশবনের মধ্যে কোথায় মিশে গেলো, আর তাকে দেখতে পেলেন না বিনোদ বাবু।

রাত তখন কটা বাজে তাঁর খেয়াল নেই। হ


ঠাৎ ঘুমের ঘোড়ে পাশ ফিরেই দেখেন পলাশপুরের সেই ছেলেটি তাঁরই বিছানায় তাঁর পাশে বসে আছে। কিন্তু এখনও ছেলেটির মুখ তিনি ভালো করে দেখতে পাচ্ছেন না। প্রচণ্ড একটা আতঙ্কে বিনোদ বাবু জোড়ে বলে উঠলেন –“একি, তুমি এখানে এলে কি করে? তুমি কে? কি চাও তুমি?” উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসা অবস্থাতেই ছেলেটি এই প্রথম বিনোদ বাবুর সাথে কথা বললেন। ছেলেটি তাঁকে প্রশ্ন করলো “তুমি আমায় চিনতে পারলেনা গো?” এই বলেই ছেলেটি তাঁর দিকে চাইলো, মুখে একটা শান্ত, আদুরে হাসি লেগে আছে। বিনোদ বাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। একি দেখছেন তিনি? আজ থকে প্রায় ২৭-২৮ বছর আগের বিনোদ বাবুর চেহারাটা যেন হুবহু নকল করে সেজে এসেছে ছেলেটি। এও কি সম্ভব, দুজনের চেহারার এতটা মিল কি হতে পারে? তিনি আর কিছু ভেবে উঠতে পারছেন না। ছেলেটি বলে উঠল – “আমি যে সেই পলাশপুরের ছেলেবেলার তুমি। আমি যে তোমারই সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার স্বত্বা। তুমি একা পথ চিনতে পারবেনা বলেই তো আমি তোমায় পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আর তোমার থেকে আমি কিছুই চাইনা গো। শুধু সময় পেলে মাঝে সাজে এসে ঘুরে যেও আমাদের পলাশপুরে। তুমি যখনই আসবে, আমি তোমায় ঠিক খুঁজে নেব। ভালো থেকো, আমি এখন আসি তাহলে।” ভোর পাঁচটায় ঢাকের শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো বিনোদ বাবুর। আজ মহা-অষ্টমী – গতকাল রাতের স্বপ্নটার কথা ভেবে মনটা যেন অন্যরকম হয়ে গেলো বিনোদ বাবুর। মনে মনে তিনি ঠিক করলেন, পরের পুজোটা পুরোটাই তাঁর ছেলেবেলার পলাশপুরেই কাটাবেন।  


Rate this content
Log in