Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Classics Inspirational

4.5  

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Classics Inspirational

আমার নিমন্ত্রণ

আমার নিমন্ত্রণ

5 mins
495


আজ আমার নেমন্তন্ন । শুধু আমার না , বাড়ির সবারই । কিন্তু কেউ যাবে না , আমাকেই যেতে হবে । না গেলে ব্যাপারটা খারাপ হয় , তাই যাওয়া । নইলে আমারও একেবারেই ইচ্ছে ছিলো না যাওয়ার । বৈশাখ মাসের তপ্ত দুপুরে কারই বা ভালো লাগে বেরোতে ! তার মধ্যে যাদের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যাচ্ছে , সেখানে এসি টেসি থাকারও কোনো সম্ভাবনা নেই ।


নেমন্তন্নটা আমার কাজের মাসির বাড়িতে । মাসির নাতনির মুখেভাত । কাল থেকেই ছুটি নিয়েছে । আসবে সেই পরশু । গত পরশু , যেদিন শেষ কাজে এলো .....বারবার বলে গেছে যাওয়ার কথা । রোববার বলে আরো জোর দিয়ে বলে গেছে । আমার স্বামীকেও বলেছে ..."দাদাবাবু , পারলি যাবেন । গেলি খুব আনন্দ পেতাম ।" ও হুঁ-হা করে কাটিয়েছে । শাশুড়িকেও বলেছে । শাশুড়িও কাটিয়েছে বয়স -গরম -হজমের সমস্যা -খাওয়ার বিধিনিষেধ এসব দেখিয়ে । অগত্যা আমি ভরসা । আমি কাটাতে পারিনি । মাসির মতো লোক এখন পাওয়া মুশকিল । যদি না গেলে রেগে গিয়ে কাজ ছেড়ে দেয় ! তাই আমি খানিকটা বাধ্য হয়েই যাচ্ছি । মাসি বারে বারে ছেলের কথাও বলেছে । আমি মনে মনে হেসেছি । তার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই ..., ওই চার বছরের ছেলেকে নিয়ে যাবো ! ...গরমের দুপুরে ।ছেলের জন্য একটা ডেয়ারি মিল্ক বা আইসক্রিম নিয়ে আসব, ফেরার পথে । ভেবে রেখেছি আমি । এটাই তো সব সংসারের কমন গল্প।


ছেলের খাওয়া আগেই শেষ । স্বামী আর শাশুড়িকে খেতে দিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম । এদের অনুষ্ঠানে বেশি না সাজলেও হয় , তার উপর যা গরম । হাল্কা রঙের একটা তাঁতের শাড়ি আর সাথে কটকী ব্লাউজ । গয়নাগাটি কিছু না । উল্টে সোনার চেন আর কানের টা খুলে রেখে গেলাম । তার বদলে হাল্কা পোড়া মাটির গয়না পরে নিলাম । বলা যায়না কে কোথা থেকে টান দেবে ...কিছু বুঝতেই পারব না হয়তো । এমনিই একা একা যাচ্ছি ।


বেরোনোর সময় শাশুড়ি বললো ..."তোমার জন্য খাবার রেখেছো তো দুপুরে খাওয়ার মতো ? ....এদের বাড়িতে কি খাওয়াবে , কখন খাওয়াবে ...তার কি কোনো ঠিক আছে !" স্বামীও বললো ..."ওদের দুপুর মানে বিকেল চারটে , গিফ্টটা দিয়ে চলে এসো । ....বাড়ি এসে খেয়ো ।"ছেলে বললো ..."মা , আমার জন্য নিয়ে এসো কিন্তু কিছু ।"

আমি বেরোলাম । ঘড়িতে তখন প্রায় দেড়টা ।


রিক্সা নিয়ে চললাম । অলি গলি রাস্তা সব । কলোনী যেমন হয় । পুরুষ -মহিলা -বাচ্চা ...অনেকেই রাস্তার কলে চান করছে । কারোর কোনো আগল নেই । বাড়ি খুঁজতে অসুবিধে হলো না । অন্নপ্রাশন আছে বলাতে একসাথে সব দেখিয়ে দিলো । দূর থেকেই গান শুনছিলাম । কাছে আসতে আরো জোরালো হলো । ড্রেনের ওপরে কাঠের পাটাতন পেতে দুটো বড়ো বড়ো বক্স রাখা হয়েছে ।সেখানে তারস্বরে 'মুন্নি বদনাম হুই' বাজছে । বক্সের মাঝে প্যান্ডেলের গেট । বাড়ির সামনে কতগুলো বাচ্চা ঝলমলে জামাকাপড় পরে লাফাচ্ছে । আমি ভাড়া মেটাতে না মেটাতেই মাসি এসে হাজির .....

"ও বৌদি , কষ্ট হয়নি তো ! ....আমি এই সবে দেখে এলাম তুমি আসছো কিনা , .....ওমা , খোকাবাবু এলো নি ? ...আর দাদাবাবু ?"

---"না গো , তোমার দাদাবাবু কিসব অফিসের কাজ করছে ল্যাপটপে , ....তুমি তো দেখোই দাদাবাবু কেমন তোমার , আর ছেলেকে আনতাম , ...ও ঘুমিয়ে গেছিলো গো ।"...না তুতলিয়ে সপাটে মিথ্যেটা বলে দিলাম। উপায় নেই নিজেকে বাঁচাতে এটুকু করাই যায় - তাছাড়া আত্মরক্ষায় কোন পাপ নেই।


এবার আমাকে দেখে মাসি সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাতে লাগলো আর খুব প্রশংসা করতে লাগলো । প্রচুর মানুষ বিভিন্ন বয়সের ...আমাকে দেখছে । আপ্যায়ন করছে । আমার খুব অদ্ভূত লাগলো । এরকম নেমন্তন্ন বাড়ি কোনোদিন যায়নি অদিতি । সে ভাবলো , বোধহয় ওর বাড়িতে শাহরুখ খান কিংবা অমিতাভ বচ্চন এলেও ওরা এমন আতিথেয়তা করবে না আন্তরিকভাবে । একটা ঘরে সব বাচ্চাকাচ্চাদের বের করে দিয়ে ওকে বসালো । একটা ফ্যান চলছিলো ঘরে । কার নির্দেশে যেনো আরো একটা ফ্যান চলে এলো । একটা অল্প বয়সী বৌ একটা নতুন স্টিলের গ্লাসে কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে এলো । শুধু আমার জন্যই । মাসি বৌটাকে দেখিয়ে বললো ...."এ আমার বুনের মেয়ে গো বৌদি , ওই গেলো অঘ্রানে বে হলো নি ..., ওই যে বর জোগাড়ের কাজ করে ....মনে পচ্ছে বৌদি ?"

আমি ঘাড় নাড়লাম বটে কিন্তু মনে করতে পারলাম না । মাসি তো কতো কিছুই বলে কাজ করতে করতে , অতো শুনলে কি চলে !


আমি খেতে চাইছিলাম না । কিন্তু খেতে বসতে বাধ্য হলাম । একটা ছোটো খাওয়ার প্যান্ডেল করেছে । সেখানে তিনটে প্লাস্টিকের টেবিল রাখা । আর কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার । মাসি আর মাসির বাড়ির লোকজন একটা পরিষ্কার চেয়ার আবার পরিষ্কার করে আমাকে বসালো । মোছা টেবিল আবার মুছলো । মাসির জামাই বলে পরিচয় দিলো যাকে , সেই লোকটি ঘাড়ে করে একটা ফ্যান এনে সেট করে দিলো । এতো আন্তরিকতা আমি কোনো নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে পায়নি । অবাক লাগছে আমার । অনেক কিছুই করেছে । মাছের মাথা দিয়ে ডাল , বেগুনী , আলু পটলের তরকারি আর মুরগীর মাংস । শেষ পাতে চাটনি আর দানাদার । মাসির বাড়ির প্রত্যেকে এসে এসে আলাদা করে জিজ্ঞেস করছে রান্না কেমন হয়েছে , আমি ঠিক করে খাচ্ছি কিনা । জল খেতে যাব , আমি দে খি মাসির ছেলের বৌ হাতে মিনারেল ওয়াটারের নতুন বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আমি অবাক , এবং আপ্লুতও বটে । মাসি বললো ....."তোমরা তো মেশিনের জল খাও বৌদি , আমার বাড়ি তো মেশিন নেই ....তাই তোমাকে দেখে আমার ছেলে বাচ্চু কেনে আনলো ।" আমি আর ব্যাগ থেকে বয়ে আনা জলের বোতল টা বের করলাম না ।


মুখ ধুয়ে এবার ফিরতে হবে এটা মাসিকে জানাতে গিয়েই আমি দেখি , মাসির হাতে একটা টিফিন বক্স । সম্ভবত নতুন , স্টিলের , চকচক করছে । আমাকে টিফিন বক্সটা হাতে দিয়ে মাসি বললো ...."বৌদি , এটা খোকাবাবুর জন্যি ।"

---"এ মা কেনো গো ! ...কাজের বাড়ি , তোমরা এতো ব্যস্ত হচ্ছো মাসি আমার জন্য , ...আমার খারাপ লাগছে ...." আমি বললাম ।

---" না করবেন নি বৌদি , এটা নে যান খোকাবাবুর জন্যি ..." এবার মাসির বর বললো কথাটা । পাশে মাসির ছেলে , ছেলের বৌ , মেয়ে , জামাই , বোন ..সব এসে দাঁড়িয়েছে । তারাও যে একই কথা বলতে চায় । বুঝতে অসুবিধে হলো না আমার । টিফিন বক্সটা হাতে নিলো ।


ফিরছি আমি । ঘড়িতে তিনটে চল্লিশ । টিফিন বক্সটা খুলে দেখলাম চারটে দানাদার । ছেলে কোনোদিনও এতো কমদামের মিষ্টি খায়নি । কি করব আমি ! ফেলে দেবে ! ...না , ফেললাম না আমি মিষ্টিগুলো । আজ আর ছেলের জন্য আইসক্রিম বা ডেয়ারি মিল্ক কিছু কিনব না । এটাই দেব ও ছেলের হাতে । খাবে ছেলে এই দানাদার গুলো । মিষ্টিগুলো হয়তো কমদামী , কিন্তু এই মিষ্টিতে যে আন্তরিকতা, ভালোবাসা মিশে আছে ...সেটা কোথায় কিনব আমি । আমি টিফিন বক্সটা ব্যাগে ঢোকালাম ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract