Sukdeb Chattopadhyay

Classics

3.5  

Sukdeb Chattopadhyay

Classics

আলোয় আঁধার

আলোয় আঁধার

6 mins
736


রাস্তার ধারে উত্তর পল্লীর এই পার্কটা এলাকার বৃদ্ধদের জন্য সংরক্ষিত। অন্যরা সচরাচর এখানে ঢোকে না, অন্ততঃ বৃদ্ধরা যতক্ষণ থাকেন। দু একটা স্থানীয় ক্লাব উদ্যোগ নিয়ে বেশ কয়েকটা বসার জায়গা বানিয়ে দিয়েছে। এই অঞ্চলের বয়স্করা কিছুটা হলেও ভাগ্যবান। বাড়িতেই যেখানে অনেকে বাতিলের খাতায় চলে গেছেন, সেখানে সমাজ যে তাঁদের বাতিল করেনি এই মানসিক শান্তিটুকু অন্ততঃ এই পার্কেতে এলে তাঁরা পান। অনেক শহরতলীতে তো বৃদ্ধদের গল্প করার জন্য রেলের প্ল্যাটফর্ম ভরসা। তাও যদি কাছাকাছি কোন রেল স্টেশন থাকে তবে। সকাল আর বিকেলে পার্কটা ভরে যায়। প্রাতঃ ভ্রমণ আর সান্ধ্য ভ্রমণের শেষে বেশ কিছুটা সময় বয়স্করা এখানে গল্প গুজব করে কাটান। এ এক নেশার মত। শরীর খুব খারাপ না হলে কামাই নেই। বেঞ্চে বসার জায়গা না পেলে ক্ষতি নেই, সঙ্গে খবরের কাগজ বা পলিথিন থাকে। মাটিতেই আসর বসে। তবে নিত্য যারা আসেন তাঁদের দল থাকে ফলে জায়গা পেতে অসুবিধে হয় না। মজলিসে মাঝে মাঝে যোগ হয় নতুন মুখ। আবার কোন চেনা মুখ হঠাৎই হারিয়ে যায়, আর কখনো ফিরে আসে না। গল্প, মস্করা,আলোচনা, বাদানুবাদ,তাস খেলা সব মিলিয়ে ওই সময় এলাকাটা সরগরম থাকে। সকালের থেকে বিকেলের আসরটা জমে বেশি। তবে মেলামেশা কিন্তু অবাধ নয়। শিক্ষা, বিত্ত, সামাজিক স্ট্যাটাস ইত্যাদির ভিত্তিতে নানা দলে ভাগ হয়ে সব আড্ডা মারেন, যদিও এর ব্যতিক্রমও কিছু থাকে।


মিস্টার বোস এই পার্কে অনেকদিন থেকেই আসছেন। এখন একদিন কোন কারণে আসতে না পারলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আগে অবশ্য ব্যাপারটা এরকম ছিল না। প্রথমদিকে পার্কে এলে একাই ঘোরাঘুরি করতেন বা বসে বইটই পড়তেন। তখন সবে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সরকারের উচ্চপদে চাকরি করতেন। অবসর নেওয়ার পরেও চালচলনে সাহেবিয়ানার রেশটা থেকে গিয়েছিল। তাই যার তার সাথে আড্ডা মারা বা বসে গল্প করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ধীরে ধীরে যে দলটার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে তাঁরা নানান পেশায় যুক্ত ছিলেন বা কেউ কেউ তখনও আছেন। প্রত্যেকেই মোটামুটি শিক্ষিত। এনাদের সাথে মিস্টার বোসের পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর প্রতিবেশী আর ওই দলের মধ্যমণি অবিনাশ রায়। কিন্তু অনিরুদ্ধর সাহেবি কেতা আর উন্নাসিক আচরণের জন্য তাঁকে তখন কেউ তেমন পছন্দ করত না। মাঝে মাঝেই অফিসে তাঁর পজিশন, পারিবারিক স্ট্যাটাস, উচ্চ শিক্ষিত আর চাকরিতে উচ্চপদে থাকা দুই ছেলের কথা ফলাও করে সকলকে শোনাতেন। চাকরিতে থাকতেই বেশ বড় একটা নজর কাড়া বাড়ি বানিয়েছেন। ঘটা করে বড় ছেলের বিয়েও দিয়েছেন। বৌমাও বেশ শিক্ষিত আর বনেদি পরিবারের মেয়ে। পার্কে প্রথম যখন তিনি আসেন তখন বিত্ত, যশ, ভরা সাজানো সংসার, সুন্দর বাড়ি, বড় মুখ করে বলার মত সবই তাঁর আছে। এসব জাহির করে বলার মধ্যে একটা তৃপ্তি আছে, বিশেষ করে সেইসব মানুষদের সামনে যাদের কাছে এগুলো স্বপ্নই থেকে গেছে। 

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ মিস্টার বোস এক অন্য মানুষ। 

অবসর নেওয়ার পর কয়েক বছর কেটে গেছে। অনিরুদ্ধর বাড়ির দোতলার দক্ষিণ দিকের ঘরটা বড়ছেলের, পূবের ঘর ছোটছেলের, আর মাঝের বড় ঘরটা তাঁদের কত্তা-গিন্নির। দক্ষিণ আর পূবের ঘরটা বেশ কিছুদিন হল ফাঁকা হয়ে গেছে। প্রথমে বড় ছেলে আর তার বছর খানেক বাদে ছোট ছেলে বিদেশে পাড়ি দিল। বড় আমেরিকায় আর ছোট অস্ট্রেলিয়ায়। বড় ছেলের বিয়ে তিনি দিয়েছিলেন। ছোটজন সে কষ্টটুকুও বাবা মাকে দেয়নি। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন বাদেই এক বিদেশিনীকে বিয়ে করেছে। তবে ছেলে খুবই দায়িত্বশীল। নিজে না আসতে পারলেও বৌ এর একটা ছবি আর তার লেখা দু লাইনের একটা চিঠি সময়মত পাঠিয়ে দিয়েছে। 

প্রথমদিকে ছেলেরা মাঝে মাঝে চিঠিপত্র লিখে বা ফোন করে বাবা মার খবরাখবর নিত। সেটা কমতে কমতে এখন প্রায় বিজয়ার নমস্কার জানানোর পর্যায়ে চলে এসেছে। মাঝে সাঝে টাকা পয়সা পাঠিয়ে বাবা মাকে ধন্য করে। অনিরুদ্ধ বোসের অর্থ সাহায্যের কোন প্রয়োজন নেই। বড় চাকরি করেছেন, অবস্থা যথেষ্ট স্বচ্ছল। প্রয়োজন ছিল আপনজনের একটু সাহচর্যের, বৃদ্ধ বয়সে যা দেয় নির্ভরতা৷ মাঝে মাঝে নিজেদের বড় অসহায় মনে হয়। যাদের কাছে একসময় আত্মপ্রচার করে তৃপ্ত হতেন সেই পার্কের মানুষগুলোকে আজ অনেক বেশি আপন মনে হয়। অনিরুদ্ধর মানসিক অবস্থা তারা বোঝে। তাই একদিন পার্কে না গেলেই বাড়ি এসে খবর নেয়। ওদের মাঝে থাকলে মনটা অনেক হাল্কা লাগে। 

নিজেদের একাকিত্ব আরো বেশি প্রকট হয়ে ওঠে অবিনাশের ভরা সংসারের দিকে তাকালে। অবিনাশ এ অঞ্চলের পুরনো বাসিন্দা। বয়স অনিরুদ্ধরই কাছাকাছি। দু বছর হল স্কুল মাস্টারি থেকে অবসর নিয়েছেন। বাড়ি ছাড়াও পৈত্রিক কিছু জমিজমা ছিল। কিছুটা প্রয়োজনে আর কিছুটা জবরদখল হওয়ার ভয়ে মেয়ের বিয়ের আগে সব বেচে দিয়েছেন। জমি বিক্রি আর অবসরের পর যা পেয়েছেন দুয়ে মিলে টাকার অঙ্কটা ভালই। সেই টাকার বেশ খানিকটা মেয়ের বিয়েতে খরচ করেছেন। তার পরেও যা আছে তা যথেষ্ট। দুঃখ একটাই। ছেলেটার লেখাপড়া হল না। মাথা তেমন ভাল নয়। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও মাধ্যমিকেই ইতি টেনেছে। তিনি নিজে শিক্ষক, তাই দুঃখটা আরো বেশি। তবে লেখাপড়ায় সুবিধে করতে না পারলেও ভালছেলে হিসেবে রাহুলের পাড়ায় সুনাম আছে। পাড়া প্রতিবেশীর যে কোন দরকারে সে ছুটে যায়। ফলে পাড়ার সকলে তাকে ভালবাসে। অবিনাশ বাড়ির নিচেই ছেলেকে একটা ষ্টেশনারী দোকান করে দিয়েছেন। খুব পরিশ্রম আর দরদ দিয়ে রাহুল দোকানটা চালায়। অবিনাশও মাঝে মাঝে দোকানে বসেন। বাবা আর ছেলের স্বভাবের গুণে দোকানে খরিদ্দারের অভাব হয় না। দোকান চালাতে চালাতে রাহুল ধীরে ধীরে ব্যবসার খুঁটিনাটি গুলো অনেকটাই রপ্ত করে ফেলেছে, ফলে আয়ও ক্রমশ বাড়ছে। দোকানটা একটু দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর অবিনাশ দেখে শুনে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। বৌটি বেশ হয়েছে। শান্ত, নম্র, স্বভাবের। মধ্যবিত্তের আদর্শ গৃহবধূ। 

পার্কটা অনিরুদ্ধ আর অবিনাশদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। একদিন সান্ধ্য আড্ডার সময় হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হল। বর্ষাকাল নয়, আকাশে তেমন মেঘও ছিল না, তাই সঙ্গে ছাতা নেই। পার্কে শেড নেই। গাছের তলাই ভরসা। বৃষ্টি সেরকম জোরে পড়ছে না তাই গাছতলায় কিছুক্ষণ না ভিজে থাকা যাবে। কিন্তু কতক্ষণ ? বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণই নেই। পেতে বসার জন্য সঙ্গে আনা একটা পলিথিনের টুকরো মাথায় দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বৃষ্টি থামছে না দেখে দুই বন্ধু আর অপেক্ষা না করে বাড়ির দিকে রওনা হল। হঠাৎ নজরে এল রাহুল একটা ছাতা নিয়ে ছুটতে ছুটতে ওদের দিকে আসছে। বাবাকে ছাতাটা দিতে গিয়ে রাহুল দেখে পাশে অনিরুদ্ধ কাকুও রয়েছে। তখন নিজের মাথায় ধরা ছাতাটাও এগিয়ে দিল। অনিরুদ্ধ অত্যন্ত সংকোচে বললেন—ওটা আমায় দিলে তো তুমি ভিজে যাবে বাবা। এইটুকু তো পথ। ছাতা আর পলিথিন ভাগাভাগি করে মাথায় দিয়ে আমরা ম্যানেজ করে নেব। তুমি অযথা ভিজো না।

কিন্তু কোন ওজর আপত্তি টিকল না। দুটো ছাতাই নিতে হল। ছাতাটা দিয়েই রাহুল দোকানের দিকে দৌড়ল। রাহুলের দায়িত্ববোধ আর আন্তরিকতায় অনিরুদ্ধ মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অবশ্য এই প্রথম নয়। পাশের বাড়ি হওয়ার ফলে তাঁদের যে কোন প্রয়োজনে রাহুল তো বটেই তার বাড়ির সকলকেই তিনি পাশে পান। এদের সঙ্গ সান্নিধ্যে অনিরুদ্ধদের, বিশেষ করে অনিরুদ্ধর স্ত্রীর একাকীত্বের জ্বালা যন্ত্রণা কিছুটা প্রশমিত হয়। রাহুলের বাচ্চাটাকে নিয়ে তো দিনের অনেকটা সময় কেটে যায়। 

দেখতে দেখতে পিকলু পাঁচ বছরে পা দিল। অবিনাশের বাড়িতে আজ ছোটখাট উৎসব। একমাত্র নাতির জন্মদিনে আত্মিয়-স্বজন, প্রতিবেশিরা ছাড়াও বেশ কিছু কচি কাঁচারা নিমন্ত্রিত। অনিরুদ্ধ আর অণিমা সকাল থেকেই রয়েছেন। তাঁরা এদের বাড়ির লোকই হয়ে গেছেন। পিকলুর নাম লেখা বড় কেক, মোমবাতি, সব এসে গেছে। খাবার ঘরের টেবিলে সব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অনিরুদ্ধই বড় দোকান থেকে সব আনিয়েছেন। তাঁর বড় নাতি প্রায় পিকলুরই সমবয়সী। বিদেশে জন্মেছে, বিদেশেই বড় হচ্ছে। আঁতের জিনিসটাকে কখনো চোখে দেখেননি। ছবি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাই পিকলুর মধ্যেই নাতিকে পাওয়ার চেষ্টা করেন। সন্ধ্যাবেলা নিমন্ত্রিতরা এক এক করে আসতে শুরু করেছে। পিকলুর বন্ধুদের কলকলানি বাড়ির বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছে। পিকলু সেজে গুজে রেডি। দাদুর সাহায্য নিয়ে অনেক কষ্টে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিবিয়েছে। এবার কেক কেটে কচি কচি হাতে দাদু ঠাকুমা, মা, বাবা সকলকে একটু একটু করে খাওয়াচ্ছে। দু এক জন ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত। হঠাৎই এক টুকরো কেক এনে পিকলু “ভাল দাদু খাও” বলে অনিরুদ্ধর মুখে ঢুকিয়ে দিল। পিকলুকে কোলে তুলে নিয়ে অনিরুদ্ধ অনেক আদর করলেন। নিজের অজান্তেই চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তাঁর স্ত্রীর মুখেও কেকের টুকরো ঢুকিয়ে দিয়ে এক ছুটে আবার টেবিলের গিয়ে মহানন্দে কেক কেটে কেটে তার বন্ধুদের মধ্যে বিলোতে লাগল। যসামনে এক তৃপ্ত পরিবারের ছবি। পরিবারের এই ছবিটা সব মানুষই চায়, কিন্তু পায় কজন?

উদাসী স্ত্রীর কানে অস্ফুট স্বরে অনিরুদ্ধ বললেন--- অণিমা, আমাদের ছেলেরা অত মেধাবী না হলেই বোধহয় ভাল হত গো। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics