আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
ঊননবতিতম অধ্যায়
বড়দা বললেন - সুনেত্রা ! তুমি তো একবারও জিজ্ঞেস করলে না শিউলি রায় নামের মেয়েটি এখন কেমন আছে?
বুকুন যেন অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে । কি সুন্দর ভাবে শুরুটা হয়েছিল । এখন আবার মাঝখান থেকে শিউলির কথা আনলেন কেন ! আমি ব্যাপারটা একটু উপভোগ করছি । বড়দার সঙ্গে গালগল্প করা মানেই কোথা থেকে কি উঠে আসে । তবে এটাও জানি তিনি অযথা কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন না । শিউলিদের সঙ্গে ত্রৈম্ভকেশ্বর রক্ষিতের হয়তো কোন রিলেশন রয়েছে, তাই তিনি এমন প্রসঙ্গ টেনে আনলেন ।
সুনেত্রা বলল - আপনি সে খবরও রেখেছেন মেসো ! কেমন আছে ওরা ?
- একদম ঠিক আছে । কাজে জয়েন করেছে । তবে মসলন্দপুরের বাড়ীটা বিক্রি করে দিয়ে নিউটাউনে না চিনার পার্কে কোথাও একটা ফ্ল্যাট কিনেছে।
সুনেত্রা শুনে খুশী হল । বলল - যেতে হবে একদিন।
বড়দা বললেন - হ্যাঁ - যে কথা বলছিলাম । ত্রৈম্বকেশ্বর ঠাকুর রাণীমার কোন দাসী বাঁদির সঙ্গে ... মানে তেমনই কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন । দেগ তোমারা এখন সবাই এডাল্ট, ডোন্ট থিঙ্ক মি আদারওয়াইজ এলস - সুনেত্রাও যথেষ্ট বড় হয়েছে । এবার বিয়ে দিলেই হয় !
সুনেত্রা ঝাঁঝিয়ে ওঠে - বড় মেসো ! তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ ! আমি বিয়ে করলে তো !
বড়দা বললেন - সে দেখা যাবে'খন ।
রূপা বলল - বিয়ে থা' তো করতেই হবে মা । উনি ঠিকই বলছেন ।
গোপা বলল - এমন সবাই বলে । তখন দেখব ছটফট করছিস ।
- আ: মাসী ! সুনেত্রা বিরক্ত হয় । বড়দা বলেন - থাক ও'সব । আসল কথায় আসি ।
বুকুন বলল - সেই ভালো । আই অ্যাম ভেরি মাচ ইন্টারেস্টেড ।
বড়দা বললেন - সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে ত্রৈম্বকেশ্বর ঠাকুরের এমন সম্পর্ক তৈরি হওয়াকে ঘিরে রাণীমার দাসী বাঁদিদের মধ্যে হাসাহাসি, চর্চা রাণীমার কানে যেতেই ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ত্রৈম্বকেশ্বর ঠাকুরকে কর্মচ্যুত করেন এবং উক্ত দাসীকে কাশীতে পাঠিয়ে দেন । ততদিনে ওঁর কোল জুড়ে একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেয় । ওই দাসীর ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাণীমা । যখন শুনলেন তিনি জননী হয়েছেন , লোক পাঠিয়ে ওঁদের আবার নিয়ে এলেন কলকাতায় । রাণীমার দয়ার শরীর । তাঁকে মসলন্দপুরে থিতু করে দিলেন ।
এদিকে কর্মচ্যুত ত্রৈম্বকেশ্বরকেও খবর পাঠালেন যে তিনি সন্তানের পিতা হয়েছেন । তিনি যেন তা মেনে নেন । কিন্তু ত্রৈম্বকেশ্বর আদতে ব্রাহ্মণ হলেও সমাজ তাঁকে পতিত করে । এখানেও রাণীমা সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন । তাঁর পদবী চক্রবর্তী থেকে নামিয়ে রক্ষিত উপাধি দেন কারণ ত্রৈম্বকেশ্বর রাণীমার প্রতি ভয়ে বা শ্রদ্ধায় - যাই হোক - রক্ষিত উপাধি নিয়ে রাণীমার দেওয়া সূর্য্যসেন স্ট্রীটের জমিতে বসবাস শুরু করেন ।
বুকুন বলে - তারপর ?
- এদিকে ত্রৈম্বকেশ্বরের ধর্মপত্নীও একই সময়ে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন । তাঁকে যখন ত্রৈম্বকেশ্বর তাঁর অপকর্মের কথা এবং রাণীমার নির্দেশের কথা বলেন তিনি নিতান্তই বাধ্য হয়ে দুই ছেলেকে মানুষ করতে থাকেন । সমাজে যমজ সন্তান রূপে তাঁরা প্রতিপালিত হয়ে বড় হন ।
ত্রিলোকেশ্বরের কোন সন্তানাদি নেই । তোমাদের যা বলা হয়েছে তা ভিত্তিহীন । গুলিবিদ্ধ হবার আগে পর্য্যন্ত ত্রিলোকেশ্বর চেয়েছেন আমাদের সকলকে পরপারে পাঠিয়ে দিতে । তখনই প্রশ্ন করেছিলাম গোপা এবং রূপা যে আপনার মেয়ে !
কি ভয়ঙ্কর হাসি হেসেছিলেন তিনি ।' বীরেশ্বরের মেয়ে বলে ওদের কিছু করতে পারিনি, তবে এখন সময় এসেছে ওদের খতম করার । শুধু ওদের নয়, ওদের সঙ্গে জড়িত সবাইকেই একে একে শেষ করে দিতে চাই '।
সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বসে আছে । গোপা ও রুপা বলে উঠল - যাক বাবা, আমরা তবে ওর মেয়ে নই । বীরেশ্বর রক্ষিত আমাদের বাবা !
দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল । সুনেত্রাও খুব খুশী হল । বুকুন বলল - জেঠুমণি , তারপর !
- তারপর আর কি ! ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিতের প্ররোচনায় বীরেশ্বরও হয়ে উঠলেন কুখ্যাত অপরাধী, সমাজবিরোধী। আর তার সুযোগ নিয়ে ত্রিলোকেশ্বর ব্যস্ত রইলেন নিজের আখের গোছাতে । ত্রৈম্বকেশ্বরকে দিয়ে ঘরবাড়ী নিজের নামে করে নিলেন । আর তলে তলে সুযোগ খুঁজতে লাগলেন পথের কাঁটা দূর করতে । যোগ্য সহযোগী পেয়ে গেলেন উকিল সত্যচরণ ঘোষালকে । পরে অবশ্য ঘোষালকেও নিজের হাতে সরিয়ে দিয়েছেন । সেই কেস তো এখনও চলছে ।
অথচ আশ্চর্য্য এই বড়দা সুনেত্রাকে নিয়ে একটি কথাও খরচ করলেন না। হয়তো তিনি ইচ্ছে করেই তা' গোপন করলেন ।
পরিবর্তে সুনেত্রাকে বললেন - তোমাকে কিন্তু শুধু চাকরি করলেই চলবে না । জমি সম্পত্তির যে সব দলিল বেহাত হয়ে গেছে বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে তা' উদ্ধার করতে হবে তোমাকেই ।
- মেসোমশাই ! বিষয় সম্পত্তি নিয়ে তো আমার কোন ধারণাই নেই । কি ভাবে তা' সম্ভব হবে ?
- আমরা তো রয়েছি । সব বিষয়ে তোমাকে সহযোগীতা করব । আমার জীবদ্দশায় যেন দেখে যেতে পারি তোমরা সব ফেরৎ পেয়েছ । বুকুন, তোমাকেও কিন্তু এগিয়ে আসতে হবে ।
বুকুন বলল - আমি তৈরী । বলুন কি করতে হবে ?
- এখনই কিছু করবে না । আগে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায় তা' দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ।
রূপা মন্ত্রমুগ্ধের মত বড়দার কথাগুলো শুনছিল । আমি মাঝখানে বলে ফেললাম - এই যে ম্যাডাম আমার বড়দাকে এবার চিনলে তো !
রূপা বলল - হ্যাঁ মশাই ! আপনার চেয়েও বেশী চিনেছি ।
গোপা, রূপা, সুনেত্রা, বুকুন একযোগে হেসে উঠল ।
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। বড়দা তখন আমার একটি গোপন কথা প্রকাশ করে দিলেন।
পেনশনের ফর্ম পূরণ করছিলাম নীচে ড্রয়িং রুমে বসে । প্রায় একশ পাতার ফর্ম । গ্র্যাচুইটি, পেনশন কম্যুটেশন, ইন্স্যুরেন্স, ফর্ম ফিল আপ করে সবে ফ্যামিলি ডিটেইল্স এবং নমিনেশন ফিল আপ করতে পেজ খুলেছি ।
তখন মাথায় কিছু খেয়াল ছিল না । কি লিখব । ফ্যামিলি ডিটেইল্সে বড়দার নামটুকুই লিখেছি । আর তো কেউ নেই । নমিনেশনেও তাই করব ভাবলাম। হঠাৎ সেই পরীক্ষার দিনের ঘটনার কথা মনে পড়ল । চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি হ্যাঙলা মেয়ের মুখ । জানি না সে কোথায় আছে, আদৌ আছে কি নেই, থাকলেই তাকে কি আর পাওয়া যাবে ! ইত্যাদি ভাবছি ।
বড়দা কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন ; টেরও পাইনি ।
আড়াল থেকে খুঁটিয়ে পড়ে যাচ্ছেন আমার লেখাগুলো। আমি তখন চিন্তার অতলে ডুবে গিয়েছি । লিখব কি তার নাম ? আহা যদি বেঁচে থাকে , তবে তো ফ্যামিলি পেনশনের সে-ই হকদার । বড়দাকে তো মান্যতা দেবে না । সাত পাঁচ ভেবে লিখেই দিলাম ।
বড়দা বলে উঠলেন - সাবাশ !
আমার হাত থেকে পেন খসে পড়ল । পেপারগুলো লুকোবার চেষ্টা করলাম । বড়দা বললেন - আমি জানি তুই মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছিস । তোর ফর্মটাই তার প্রমাণ । একদমই সঠিক কাজ করেছিস । তবে ভাই, তোকে কথা দিলাম - বুকুনের চিরকুটের সুত্র ধরে একদিন ঠিক আমি গোপাকে তোর সামনে হাজির করব ।
আবার একটা হাসির রোল উঠল । বড়দা যেন এখন তাদের কাছে হিরো । তুড়ি দিয়ে সব ঝড় উড়িয়ে দেন ।
আমি আবার কঠিন লজ্জায় পড়লাম; আর দেখি সেই হাসিতে বড়দাও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন । গোপা শরমে দৌড়ে পালিয়ে গেল ।
( চলবে )
