আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
একনবতিতম অধ্যায়
পুলিশ কমিশনার স্বয়ং বাছাই করা অফিসার এবং পুলিশ নিয়ে সেই বেসরকারি হাসপাতালে গেলেন । এবার কেন্দ্রীয় বাহিনী এক পাশে সরে দাঁড়াল ।
কমিশনার সাহেব সন্তু মুখার্জী এবং পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্যকে নিয়ে অষ্টমতলে লিফট বেয়ে উঠলেন । যে কেবিনে ত্রিলোকেশ্বরকে রাখা হয়েছে সেখানে পৌঁছে দেখেন মিঃ রায়চৌধুরী সপরিবারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন ।
তিনি এবং অপর দুই অফিসার আমাদের দেখলেন কিন্তু কিছু না বলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই ডক্টর ভরদ্বাজের মুখোমুখি হলেন ।
ডক্টর ভরদ্বাজ বললেন - সত্যকে চেপে রাখা যায় না স্যার । যে উড়োফোনটা নিউজ চ্যানেলে গিয়েছিল তা' আমিই করেছি ।
যদিও ফিসফিস করে কথাগুলো বলছিলেন বড়দা এগিয়ে গিয়ে বললেন - ইউ আর আণ্ডার সিসিটিভি সার্ভেইল্যান্স স্যার । অতএব যা করার ভেবেচিন্তে করবেন।
কমিশনার বললেন - ইটস নট এ ম্যাটার অফ জোক ডক্টর । আপনার মত প্রথিতযশা চিকিৎসক এমন কাজ করলেন কেন ?
- আজকের পর আমার চাকরি নট হয়ে গেল ধরে নিতেই পারেন । তথাপি এই টাকার খেলা দেখে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি । হাসপাতালের মালিক লুটপাট করছে জেনেও চুপ থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না ।
মিঃ মুখার্জী বললেন - আপনি কত খেয়েছেন ?
চমকে উঠলেন ডক্টর ভরদ্বাজ । কেউ তাঁকে এ ভাবে অপ্রস্তুত করবেন কল্পনাও করেননি । তাঁর মুখ থেকে কথা বেরোল না । তখন বড়দাকে হাল ধরতেই হল ।
- মিঃ মুখার্জী ! প্লীজ ডোন্ট কমেন্ট অন আননোন ইস্যু।
আমি ডক্টর ভরদ্বাজকে বলেছিলাম এ ভাবে গুজব ছড়িয়ে দিতে । আর সেই জন্যই আপনারা এই হাসপাতালে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন অতি সহজেই।
মিঃ মুখার্জী বললেন - সরি ! আমি ভেবেছিলাম চারদিন ধরে চুপ থেকে তিনি হঠাৎ মুখ খুললেন কেন ! হয়তো অংশীদারিত্বে গণ্ডগোল হচ্ছে তাই...
মিঃ ভট্টাচার্য্য বললেন - খুব স্বাভাবিক । আমিও তাই ভেবেছিলাম।
কমিশনার সাহেব বললেন - এখন বিতর্কের সময় নয় । ডক্টর ভরদ্বাজ ! এখনই মেডিকেল বুলেটিন ইস্যু করে দিন মিঃ রক্ষিত ইজ নো লঙ্গার এলিভ ।
- স্যার আমি বললে তো হবে না । মেডিকেল বোর্ড তৈরী করা হয়েছে । আরও দশজন ডাক্তার আছেন । তাঁরা যদি বেঁকে বসেন !
বড়দা বললেন - তাঁদের ডেকে পাঠান । আমি বন্দোবস্ত করে দেব ।
কমিশনার বললেন - এই মুহুর্তে তাঁদের সবাইকে একসাথে পাওয়া যাবে কি ?
ডক্টর ভরদ্বাজ বললেন - একদমই না । আসলে বোর্ড মানে তো ডেডবডি পাহারা দেবার জন্য । একেক জন আসেন, থেখেন, আর চলে যান । সবাই তো বিজি ।তবে আমি দেখেছি কয়েকজন এখনও আছেন । আমি যেহেতু কালপ্রিট তাই আপনারা আসছেন জেনে কাজ ফেলে চলে এসেছি ।
বড়দা বললেন - কোন সমস্যা নেই । আমি দেখছি কি করা যায় !
বলে তিনি গোপা, রূপা এবং সুনেত্রাকে বললেন - তোমরা সব শুনলে তো ! সব সাজানো ঘটনা । এখন তোমাদের বলছি একদম পাকা অভিনেত্রীর মত কান্নাকাটি করতে করতে নীচে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হও । তাঁরা যে সত্য জানবার জন্য এসেছেন তা' তোমাদেরই প্রকাশ করে দিতে হবে ।
গোপা , রূপা , সুনেত্রা রাজী হল । কিন্তু কান্না তো আসছে না বা আসবে বলে মনেও হয় না । কারণ ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিতের মত ব্যক্তিকে তারা এখন ঘৃণার চোখে দেখে ।
বড়দা ডক্টর ভরদ্বাজকে বললেন - কিছুটা গ্লিসারিন জোগাড় করে দিতে হবে স্যার । প্রয়োজন পড়েছে।
ডক্টর একজন নার্সকে তা' এনে দিতে বললেন । গ্লিসারিন লাগিয়ে ওদের চোখ জ্বালা করতে লাগল আর টসটস করে চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল । এবার নাটক উঠল জমে । হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওরা নীচে নেমে গেল । আমি আর বুকুন ওদের সামলাতে লাগলাম ।
সাংবাদিকরা তেড়ে এল । একের পর এক প্রশ্ন চলতে লাগল। আমি ও বুকুন তার উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম । লাইভ টেলিকাস্ট শুরু হয়ে গেল ।
উপরে বড়দা এবং পুলিশ দেহ বাজেয়াপ্ত করল । হাসপাতালের ওনারকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল । বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্ক শেষে হাসপাতাল মালিক দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হলেন ।
কমিশনার সাহেব তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়ে শববাহী গাড়ি আনিয়ে বাজেয়াপ্ত দেহ তাতে তুলে নিতে আদেশ দিলেন ।
যে ডাক্তারটি ত্রিলোকেশ্বরকে ' স্টিল এলিভ ' বলে পোস্টমর্টেম করতে দেননি , তাঁকেও এরেস্ট করা হল ।
কফিনে মোড়া দেহ থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছিল । ক্ষুব্ধ জনতা যাতে হাসপাতাল আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করে দেওয়া হল ।
সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণ এড়িয়ে আমরা যখন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম তখন রাত হয়ে গেছে ।
ডক্টর ভরদ্বাজ বললেন - মিঃ রায়চৌধুরী! আপনি আমাকে বিবেক দংশন থেকে বাঁচালেন। এখন যদি আমার শাস্তিও হয় , দুঃখ করব না ।
- আপনার কোন শাস্তি হবে না । তবে ওই ডাক্তারটি - যে টাকা খেয়ে মৃতকে চারদিন অযথা বাঁচিয়ে রাখলেন তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে ।
এরপর বড়দা কমিশনার সাহেবের কাছে ডক্টর ভরদ্বাজের হয়ে সওয়াল করলেন ।
- স্যার ! আপনি যেমন পাবলিক সার্ভেন্ট ডক্টর ভরদ্বাজও অনুরূপ একজন প্রাইভেট সার্ভেন্ট । আর তাঁর নেতৃত্বে যে মেডিকেল বোর্ঢ গঠন করা হয়েছিল তাঁরাও সমপর্য্যায়ের । এবার যদি প্রমাণিত হয় যে ওঁরা এই টাকার খেলায় অংশ নেননি তবে আশা করব নির্দোষিতার জন্য ওঁদের কেস মুক্ত করবেন ।
কমিশনার বললেন - তদন্ত হোক আগে ।
বড়দা ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন - তা না হলে কি ওঁদের হাজতে নিয়ে যাবেন ?
- সেটাই তো রীতি।
- গুলি মারুন আপনার রীতিতে। ঠিক আছে আপনি নিয়ে যান ; কিন্তু আমার কাছে এমন প্রমাণ আছে যা দেখালে আপনি নিজেই অবাক হয়ে যাবেন ।
- কি প্রমাণ আছে আপনার হাতে ।
- আপনারা আগে ওঁদের নিয়ে যান তারপর দেখতেই পাবেন।
কমিশনার সাহেব চমকে উঠলেন । মিঃ রায়চৌধুরী যে ছেঁদো কথা বলেন না ; বহুবার তার প্রমাণ পেয়েছেন । বললেন - ঠিক আছে । ওঁরা সম্ভ্রান্ত চিকিৎসক। কোন কালির আঁচড় দেব না । কই হে ভটচাজ, মুখুজ্যে ! ওঁদের ছেড়ে দাও ।
ওনারা মুক্ত হলেন । বড়দা বললেন হসপিটাল ওনার আর ওই ডাক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন । তখন আবার বুঝবেন আমি কখনও মিথ্যে বলি না ।
বড়দা ডক্টর ভরদ্বাজের নেতৃত্বে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সকল ডাক্তারদের নিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে গেলেন । পুলিশ লাশ নিয়ে চলে গেছে বলে কেন্দ্রীয় জোয়ানেরাও ব্যারাকে ফিরে গেছেন ।
বড়দা বললেন - এবার আপনারা সেই ভি ডি ও যা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপনারা আলোচনা করেছিলেন তা' আমাকে দেখান এবং তার একটি কপি আমাকে দিতে হবে ।
সকল ডাক্তারগণ একযোগে বললেন - কপি কেন, আসলটাই আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি ।
বড়দা বললেন - না, তা' হয় না । আমাকে কপি দিলেই চলবে । আসলটা আপনাদের কাছেই থাক । ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে ।
বড়দা হাসপাতালে গিয়ে ডিডিও দেখলেন এবং ভিডিও ক্লিপিং নিয়ে পুনরায় কমিশনারের কাছে গিয়ে তা' জমা দিয়ে এলেন ।
বললেন - কি স্যার ! এবার বিশ্বাস হল তো ? রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কোন কথা হয় না । যে দুটি দল পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিবদমান, গদীর লোভ এমনই জিনিস যে চরম শত্রুও পরম মিত্র হয়ে ওঠে । এই ভিডিও তারই জ্বলন্ত প্রমাণ ।
( চলবে )