আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
একত্রিংশতি অধ্যায়
বড়দা গত দু'দিন কোন খবর নিতে পারেননি - যেন তিনি কত ব্যস্ত ! বাধ্য হয়ে আমি নাম্বার লাগালাম। মনে পড়ে গেল গতকালের স্বপ্নের কথা । স্বপ্নে হলেও ফোন তো করেছি কিন্তু ফোন ধরেছেন লঙ্কেশ্বর ।
আমি এবার সতর্ক হলাম। গলার স্বর পরিবর্তন করে বললাম - আপনি কি মিঃ উৎসব রায়চৌধুরী কথা বলছেন ?
- আমার সাথে আর বাঁদরামি করতে হবে না হতচ্ছাড়া বাঁদর কোথাকার!
খুব খুশী হলাম । বড়দারই গলা । আনন্দের আতিশয্যে বলে ফেললাম - এ কি ধরণের সম্বোধন বড়দা ?
- তোর স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি রে ভাই ! আমার নাম ধরে ডাকিস ?
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম - সরি । কাল রাতে যে দু:স্বপ্ন দেখেছি সেজন্য একটু খেলা দেখালাম বাধ্য হয়ে । আপনি কিছু মনে করবেন না বড়দা । আসলে একা একা থাকতে আর ভালো লাগছে না । কবে ফিরবেন বলুন তো ?
- আরও কয়েকটা দিন লাগবে রে ভাই! এখনও কাজটা গুছিয়ে উঠতে পারিনি । তোর কি মনে আছে ; একদিন বলেছিলি ২৬/২ সূর্য্যসেন স্ট্রীটের কথা , বীরেশ্বর রক্ষিতের কথা ?
আমি বললাম - বলেছি । কেন ? বীরেশ্বর রক্ষিত কি এখনও বহাল তবিয়তে আছে নাকি হাজত বাস করছে ?
বড়দা বললেন - চুপ চুপ । আমার পাশেই বসে আছে । শুনতে পেল কি না কি জানি !
বুঝে নিলাম লঙ্কেশ্বরকে ধরিয়ে দেওয়া চারটিখানি কথা না । বললাম - আপনার পাশে বসে আছে মানে ?
- সে অনেক কথা । এখন বলা যাবে না । বুঝতেই পারছিস।
- যাক গে, কবে নাগাদ আসছেন বলুন। আর দু'টো দিন দেখব ; তারপর কিন্তু আর বাড়ীর দায়িত্ব নিতে পারব না বলে দিলাম। একলা থাকার যে কি জ্বালা - হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি তো !
বড়দা হাসতে হাসতে ফোন ছেড়ে দিলেন । আমি আরও গভীর চিন্তায় পড়লাম। কি যে ঘটছে সেখানে ! ঠিক করলাম সারাদিন বাবলুদার দোকানে কাটিয়ে রাতে বাবলুদাকে নিয়েই বাড়ী ফিরব ।
মিঃ উৎসব রায়চৌধুরীও যে পরম নিশ্চিন্তে দুমকায় পড়ে আছেন তা তো নয় । এই বীরেশ্বর রক্ষিতকে নিয়ে তাঁর মাথাব্যথার অন্ত নেই । এই বলছেন 'শুধরে নেব ' তো পরক্ষণেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে টালমাটাল করে দিচ্ছেন সব কিছু ।
গোপা দেবী বললেন - বড়দা ! এই সংসার হল কাঁচের দ্রব্য। একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া দেওয়া যায় না । আমি তো আমার বাবাকে চিনি । উনি কোনদিন শুধরাবেন না। তার চেয়ে আপনি ফিরে যান । শুধু শুধু নিজের ক্ষতি ডেকে আনবেন না ।
- তা' হয় না বউমা ! আমি এতদূর এসে আর খালি হাতে ফিরে যেতে পারব না । এ আমার জীবন মরণ পণ ।
গোপাদেবী চুপ করে গেলেন । দ্বিতীয়বার চর্বিতচর্বণ করতে তাঁর ইচ্ছে করল না ।
এমন সময় বুকুন এসে উপস্থিত হল ।
- জেঠুমণি কি মায়ের মত নিরাশ হয়ে পড়েছেন ?
তড়িৎ গতিতে বুকুনের দিকে ফিরে বড়দা বললেন - জীবনে কোনদিন নিরাশাগ্রস্ত হইনি বাবা ; আজও হব না ।
গোপাদেবী বললেন - ওনাকে জানতে তোর এখনও অনেক কিছু বাকি আছে বুকুন । আমার বাবা যত না একগুঁয়ে তার চেয়ে অনেক গুন বেশী জেদী পুরুষ উনি । চেহারা দেখে কাজের বিচার হয় না ।
বুকুন বলে - সে আমি অনেক আগেই জেনে গেছি মা । জেঠুমণি যদিও 'র' এর নিয়মিত গোয়েন্দা নন; কিন্তু মিলিটারি থেকে এখনও মাঝেমধ্যে তাঁর ডাক আসে ।
আমি জাস্ট ওনাকে এনকারেজ করতে কথাটা বলেছি ।
তারপর মিঃ রায়চৌধুরীর দিকে ফিরে বলে - প্লীজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ এলস ।
মিঃ রায়চৌধুরী বুকুনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন - ইটস ওকে ।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বুকুন অফিসে চলে যায় । বৈঠকে বসেন মিঃ রায়চৌধুরী, বীরেশ্বর এবং গোপাদেবী ।
বীরেশ্বর বলেন - কালই তবে গোপা মাকে নিয়ে কলকাতা চলে যাই ! কি বলেন মিঃ রায়চৌধুরী?
মিঃ রায়চৌধুরী গোপাদেবীর দিকে চাইতেই তাঁর নেগেটিভ ঈশারা বুঝতে পারেন ।
বলেন - মিঃ রক্ষিত ! তা' হয় না । আপনি আগে আপনার মেয়ে এবং বুকুনের সঙ্গে কথা বলুন। ওঁদের মতামত নিন। সব কিছুই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলুক ।
হাসলেন বীরেশ্বর রক্ষিত ।
- উনুনকে জিজ্ঞেস করে কাঠ দেব ? কি যে বলেন মিঃ রায়চৌধুরী?
- প্রয়োজনে কাঠ দিতেই পারেন কিন্তু অনাবশ্যক কাঠ দিলে আঁচ গনগনে হয়ে যায় ; তখন উনুনে চাপানো খাবার পুড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে ।
বীরেশ্বর সে কথা শুনে গুম হয়ে যান । কিছু পরে বলেন - আপনি ঠিকই বলেছেন । আজ রাতেই ওদের সঙ্গে কথা বলে নেব ।
- যা কিছু কথা - সব যেন আমার উপস্থিতিতে হয় ।
বীরেশ্বরের আসুরিক প্রবৃত্তির উন্মেষ ঘটে । তিনি পাশে বসা গোপা দেবীকে ধরে বলেন - এ আমাদের পারিবারিক ব্যাপার । আপনি অকারণ নাক গলাতে চাইছেন কেন ?
মিঃ রায়চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে বললেন - প্রথম কথা হল - পারিবারিক ব্যাপারটা এককালে ছিল । এখন আর নেই । বিয়াল্লিশ বছর আগেই তা শেষ করে দিয়েছেন ।
বীরেশ্বরের চোখ মুখ রাঙা হয়ে উঠল ; তাঁর মনে হল নেহাৎ অন্য প্রদেশে আছো সোনা , কলকাতা হলে এখনই প্রাণ কেড়ে নিতাম ।
নিজেকে অসম্ভব রকম ধৈর্য্যের দড়ি দিয়ে মনটাকে বেঁধে রাখতে হল । স্বমূর্তি ধরবার স্থান এটা নয় । কথাবার্তায় একটু নরম হয়ে বললেন - তবু নিজের মেয়ে তো ! দু'চার কথা শোনাতেই পারি । তা' ধরে বসে থাকলে তো চলে না।
আর আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব এতে আপনার মতামত নিতে যাব কেন ?
মৃদু হাসলেন মিঃ রায়চৌধুরী। বললেন - সম্পর্কটা যদি সেই পর্য্যায়ে থাকত ; আমার কিছু বলার ছিল না । এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। আপনার দাবী মানা বা না মানা - সবই নির্ভর করছে ওদের মা ও ছেলের উপর । আমার উপস্থিতিতে আলোচনার কথা বলেছি তারও যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ যুক্তি আছে যা আমি আপনাকে শেয়ার করতে চাই না ।
গর্জে উঠলেন বীরেশ্বর রক্ষিত।
- মিঃ রায়চৌধুরী ! আপনি কিন্তু আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন !
- সে তো আমার অধিকার ।
- অধিকার ? কোন সুবাদে ? একজন অতিথি হয়ে এসেছেন , তেমনই থাকুন ।
- এটাই তো আপনার ব্যাধি । আমি যতক্ষণ না আপনার এই ব্যাধি সারিয়ে তুলতে পারব ততক্ষণ আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি না ।
অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন বীরেশ্বর রক্ষিত ।
- হা হা হা ।
সেই গুরুগম্ভীর হাসিতে নীড়ে থাকা পাখিগুলো নড়েচড়ে বসল । কিচিরমিচির ধ্বণি তুলে বীরেশ্বরকে যেন অবজ্ঞা করল । বীরেশ্বর বললেন
- কি আমার ডাক্তারবাবুটি এসেছেন রে - আমার ব্যাধি সারানোর জন্য । বলি শুনুন মশাই । আমার শরীরে কোন রোগব্যাধি নেই আর আপনি ডাক্তারও নন ।
- ইয়েস ! আই অ্যাম নট এ ডক্টর এট অল বাট আই ক্যান ডিটেক্ট দ্য ডিজিজ ইউ হ্যাভ উইথ ইউ ।
বীরেশ্বর ইংরাজি জানেন । তিনি এর অর্থ বুঝতে পেরে বললেন - ঠিক আছে, আসুক বুকুন। আপনার সামনেই আলোচনা হবে ।
( চলবে )