আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
দ্ব্যশীতিতম অধ্যায়
বড়দার সঙ্গে যে কথাগুলো হয়েছে তা' বোধ করি গোপা শুনেছে । আতঙ্কে শিউরে উঠে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল আমাদের কক্ষে ।
- আমি বলছি, তুমি কক্ষণও এমন কাজ করবে না । জীবনের বিয়াল্লিশটা বছর কেঁদেকেটে চলে গেছে । নতুন করে আর দুর্দিনকে স্বাগত জানাতে পারব না ।
আমি সব জেনেও না জানার ভান করে বললাম - হয়েছেটা কি ? আমি কি এমন মারাত্মক কথা বলে বসেছি যে তুমি এই ভাবে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছ ?
- বললাম তো ! পুলিশের কাজ পুলিশ করুক । তোমাদের এতে মাথাব্যথা কেন ?
আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম - সেলিম নিখুঁত ক্রিমিনাল । পুলিশে চাকরি করে শুট আউটে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে । একটা গুলিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেয় না ।
- তো সেটা পুলিশ করুক না । তুমি এবং দাদা এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ছ কেন ? নাকি নিজের বাহাদুরি দেখাতে চাইছ ? আমি তা' হতে দেব না । অনেক সাধ্য করে জীবনে প্রথম সুখ দেখতে পেয়েছি ; অকারণে হঠাৎ তা' হারিয়ে ফেলতে পারব না । আমি বুকুনকে ডেকে পাঠাচ্ছি । দরকার পড়লে সেলিমের সাথে সে যাবে কিন্তু তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না ।
আমি জানি গোপা সেই কলেজ জীবনের দেখা থেকেই আমার প্রতি অনুরক্ত। স্বচ্ছলতা বিসর্জন দিয়েও তা অন্তরে ধরে রেখেছে । ঝক্কি-ঝামেলায় আর জড়াতে চাইছে না ।ওর কথায় এটাও বুঝলাম আমার জন্য সে বুকুনকেও ছেড়ে দিতে পারে । কিন্তু আমি বুকুনকে এই মামলায় কোন পক্ষ করতে রাজী না ।
এমনকি বড়দাও এই বয়সে এমন সঙ্কটে পড়ুন তাও চাই না । যদিও বড়দাকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায় ।
বললাম - আমার কোন ক্ষতি হবে না গোপা । তুমি বুঝছ না কেন - ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত পুলিশের নাড়িনক্ষত্র জানেন । সুতরাং ছদ্মবেশে দক্ষ পুলিশ অফিসার গেলেও তিনি গন্ধ শুঁকে জেনে যাবেন ।
গোপা এত ক্ষিপ্ত হয়ে গেল যে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিল । সে কিছু বলছে না - অপেক্ষায় থেকেও কোন সাড়া দিচ্ছে না দেখে আমি নীচে নেমে সেলিমকে বিদায় জানাতে এলাম ।
সেলিম বলল - দিনক্ষণ ঠিক করে রাখুন স্যার । আমাকে ডেকে নেবেন ।
বড়দা বললেন - গতকাল রাতে আপনাকে কে ফোন করেছিল ?
সেলিম বড়দার চোখে চোখ রেখে দেখল দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং তেজোদীপ্ত । সুতরাং মিথ্যে বলে বিশ্বাস ভঙ্গ করা যায় না । বলল - ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত।
- ওঁকেই তো আপনি সদলে পাকড়াও করতে গিয়েছিলেন?
- হাঁ ।
- কে আপনাকে খবর দিয়েছিলেন? বীরেশ্বর রক্ষিত?
- হাঁ ।
- তাহলে শত্রু হয়েও ত্রিলোকেশ্বর আপনাকে আমন্ত্রণ জানালেন কেন ?
- ক্রাইম জগতে সকলে সকলের শত্রু । এখানে বিশ্বাস বলে কোন ধর্মকথা নেই স্যার ।
- বেশ বললেন তো ? আপনি কি বললেন? যাবেন ?
- আমাকে তো পাগলা কুকুরে কামড়ায়নি স্যার । ওঁকে কামড়েছে । অতএব ধরে নিন জলাতঙ্ক ওঁরই হবে ।
- খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলেন তো আপনি! ঠিক আছে। আমরা আলোচনা করে আপনাকে জানাব ।
- তবে আসি স্যার । গুড বাই ।
সেলিম চলে গেল । বড়দাকে বললাম - প্রোগ্রামে কিছু চেঞ্জ আনতে হবে ।
- আবার কি হ'ল তোর ! এত ঘনঘন প্রোগ্রাম চেঞ্জ করলে সফলতা আসবে ?
- সরি বড়দা ! কথাটা প্রোগ্রাম বলে ভুল করলাম । প্রোগ্রামের প্রশেসটা একটু চেঞ্জ করতে হবে ।
- মানে ?
- এই যেমন ধরুন, আমরা ভেবেছিলাম বিভীষণ ভেকধারীকে শেষ করতে আততায়ী নিয়োগ করতে হবে !
- হ্যাঁ।
- সে তো পুলিশ ঠিক করে দিয়েছে ।
- হ্যাঁ ।
- বলেছিলাম ত্রিলোকেশ্বর মরবে কিন্তু আততায়ীকে পালিয়ে যেতে দেওয়া হবে ।
- তাও ঠিক ।
- না, আততায়ীকে পালাতে দেওয়া যাবে না , ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য । আর তাই আমি বা আপনি আততায়ীর সঙ্গে যেয়ে ওকে মেরে ফেলব ।
- হ্যাঁ, এতে গোলমাল কোথায় ?
- গোলমাল ছিল না । গোপা পাকিয়ে দিয়েছে । যদিও অস্বীকার করতে পারি না ওর আশঙ্কাও অমূলক নয় ।
তাই ঠিক করলাম আমরা কেউ যাব না । পুলিশই যাক । ওরাই ওদের কাজ করুক ।
- কিন্তু ওদের তো বলে দিয়েছি পুলিশ সেলিমকে যেন পালাতে সাহায্য করে !
- আপনি আবার কমিশনার সাহেবকে বলে দিন সেলিমকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না । এতে ভবিষ্যতে আইনি প্রক্রিয়ায় জড়াতে হতে পারে ; অতএব ওকে মেরে ফেলাই সঙ্গত হবে । কিন্তু আমরা এতে অংশ নিতে পারব না । ও কাজ পুলিশই করবে ।
বড়দা পড়লেন চিন্তায় । বললেন - গোপা বা রূপা কি চায় ?
- ওরা চায় আমরা যেন এতে জড়িয়ে না যাই ।
- বেশ । তবে তাই হোক ।
গোপা এবং রূপা দু'জনেই শুনল কথাগুলো । আমি দেখেছি ওরা খুশী মনে কিচেনে ঢুকে পড়ল ।
বড়দা ফোন করলেন লালবাজারে। সব পরিকল্পনা নতুন করে জানিয়ে দিলেন । ওঁরা বললেন - তাই হবে । কিন্তু আমাদেরও একটা প্ল্যান আছে। লোকজনের ভীড়ে নয়; ওঁকে ওঁর বাড়ীতেই মেরে ফেলা হবে । মারবে সেলিমই । আর আমাদের লোক মারবে সেলিমকে ।
বড়দা বললেন - আমি এগ্রি করছি । আর সেলিম যাতে শীঘ্রই ত্রিলোকেশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সে ব্যাপারেও কথা বলছি । দিন এবং সময় চূড়ান্ত করে আপনাদের জানিয়ে দেব ।
অফিসারটি বললেন - উই আর রেডি টু এক্সপিডাইট এনি ডে ।
কয়েকদিন পর সেলিম আবার আমাদের বাড়ীতে এল । তখনই ওকে জানিয়ে দেওয়া হল লালবাজার এবং এস ডি পি ও বারাসত চাইছেন আগামী দশ তারিখের মধ্যে অপারেশন শেষ করতে । আপনি কি বলেন ?
সেলিম বলল - স্যার ! বেশী কালক্ষেপ না করাই ভালো । আমি ত্রিলোকেশ্বরের সঙ্গে এখনই কথা বলে সময় চেয়ে নিচ্ছি । আপনারা রেডি থাকুন ।
বলে বাগানের দিকে চলে গেল । মিনিট কয়েক পরে ফিরে এসে বলল - কাল নাকি তিনি প্রচারে ব্যস্ত থাকবেন । তাই আগামী পরশু দুপুর সাড়ে বারোটায় যেতে বললেন । সেই সময় তিনি লাঞ্চ করতে বাড়ী আসবেন । আমাকেও ইনভাইট করেছেন ।
আমি বললাম - এত শিগগির মরে যেতে চান ! বেশ বেশ।
সেলিম বলল - স্যার! আমার উপর কোন খাঁড়া নেমে আসবে না তো !
আমি বললাম - সে জন্য তৈরী থাকতে হবে । যাতে আপনার কোন ক্ষতি না হয় সেদিকটা দেখা যে আমাদের কর্তব্য ।
বড়দা বললেন - আপনাকে একটু অভিনয় করতে হবে । আপনি বলবেন বাড়ীর সদর দরজা খুলে রাখবেন যাতে নিমেষে আমি সেঁধিয়ে যেতে পারি । দেখবেন উনি তাই করবেন । কিন্তু আপনি সদর দরজায় অন্য একজনকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে চলে যাবেন বাড়ীর পিছনে দেয়াল টপকে । তারপর ফোন করে বলবেন সামনে অনেক চেনাজানা লোক আছে , তাই পিছন দিকে এসেছি । আপনাকে যেন পিছন দিক থেকে যেতে দেওয়া হয় ।
সদর দিয়ে ঢোকা লোকটি সেই সুযোগে মহলে লুকিয়ে পড়বে । আপনার উপর কোন আঘাত এলেই সে ত্রিলোকেশ্বরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ।
( চলবে )
