আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
দ্বিষষ্টিতম অধ্যায়
দ্বিষষ্টিতম অধ্যায়
গোপা এবং সুনেত্রা রাত্রি এগারোটা নাগাদ মল্লিকপুরের বাড়ীতে উপস্থিত হল । গোপা রান্নাবান্না করে রেখেছে। আমরা সকলে ওদের আগমনের অপেক্ষায় ছিলাম ।
গোপা বলল - আগে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাব ।
- ওমা ! তোরা এখনও খাসনি ? এই নেত্রা শিগগির ফ্রেশ হয়ে চলে আয় । আমি টয়লেটে চললাম।
রূপা নির্দেশ দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল । বড়দা ক্যাব চালককে কিছু খাইয়ে বিদায় করলেন এবং ক্যাবের ভাড়া দিয়ে রসিদ নিলেন ।
খাবার টেবিলে বসে গোপা বলল - বোন ! কাকাই যে এমন করতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিল না । বাবার স্বভাব তো জানি। কিন্তু অবাক হচ্ছি কাকাই এরেস্ট হবার পরই বাবা কি করে অমন সংঘবদ্ধ আক্রমন করল । আমার মনে হচ্ছে ওঁরা দুজনেই যুক্তি করে সব খেলা দেখান ।
রূপা বলল - কি আর বলব দিদি ? নেত্রার সামনে বাবা জেঠাদের কুকীর্তি গাইতে সঙ্কোচ হচ্ছে যে !
আমি বললাম - এখন সঙ্কোচ দেখানোর সময় নয় রূপা । গোপা যদি বলতে পারে , তুমি কেন লজ্জা পাও ?
বড়দা বললেন - সুনেত্রা এডাল্ট এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে । ওরও জেনে যাওয়া উচিত ওঁরা কি প্রকৃতির ।
সকলে সম্মতি দিচ্ছে দেখে রূপা এবার কিছু কিছু ভেতরের কথা বলতে শুরু করল । যেমন :
রূপা বলল - বাবাকে পরিচিত রূপে দেখাটাই আমার মজ্জাগত হয়ে গেছে । তার মধ্যে যে কতবড় দানবীয় মানসিকতা আছে টের পেয়েছি সেদিন ।
আমরা উৎসুক হয়ে রূপার কথা শুনছি । গোপা ও বড়দাও তাই । রূপা বলল - জানিস দিদি ! যেদিন সত্যচরণ ঘোষাল - মানে বাবার উকিল পুলিশকে নোটিশ ধরাতে এসেছিলেন তাঁদের কথাবার্তা আমি আড়াল থেকে শুনেছি ।
ত্রিলোকেশ্বর - কই হে উকিল ! এরেস্টের উপর স্থগিতাদেশের আদেশ তো নিয়ে এসেছ ; আমার উইলটা কি রেডি করেছ ?
ঘোষাল - কোন উইলের কথা বলছেন স্যার ? সম্পত্তি হাতাবার উইল নাকি সম্পত্তি দান করার উইল ?
- দু'টোই । হাতাবার উইলটা আগে দেখাও । কেমন বয়ান লিখেছ !
ঘোষাল বাবু উইল পড়ে শোনাচ্ছেন ।
আমি শ্রী বীরেশ্বর রক্ষিত পিতা স্বর্গত ত্রৈম্বকেশ্বর রক্ষিত সাকিম ২৬/২ সূর্য্যসেন স্ট্রীট এই মর্মে ইচ্ছাপত্র প্রকাশ করিতেছি যে আমার যাবতীয় স্থাবর - অস্থাবর সম্পত্তি এবং ( কয়েকটি ব্যাঙ্কের নাম, ঠিকানা একাউন্ট নং সহ ) নগদ গচ্ছিত অর্থ আমি আমার কনিষ্ঠ যমজ ভ্রাতা শ্রীমান ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত ভাইজীবনের নামে হস্তান্তর করিয়া দিলাম । এই ইচ্ছাপত্র আদালতের সীলমোহর পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে তাহা কার্য্যকর হইবে ।
বয়ান শুনে গোপার মনে কোন আক্ষেপ দেখা গেল না । কিন্তু রূপা বলে উঠল - বাবা কেমন স্বার্থপর দেখ দিদি , বড় ভাইকে ঠকিয়ে কিভাবে সবকিছু আত্মসাৎ করে নিতে চাইছে ! আমার খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন । তোর কথা কেন তাঁর একবারও মনে হল না প্রশ্ন করে বসলাম।
বাবা আমার দিকে বাঁকা চোখে দেখলেন । গোঁফহীন মুখে কদাকার হাসির রেখা ফুটে উঠল ।
বললেন - ও তুমি সব শুনে নিয়েছ তাহলে ? তবে শুনে ফেলেছ যখন তোমাকে আজ আসল সত্যিটা বলে দিই। মল্লিকপুর থেকে যেদিন ভোর রাতে পালিয়ে আসি , বড় সুযোগ পেয়েছিলাম গোপা, জামাই আর ওই উৎসব রায়চৌধুরীকে শেষ করে দেবার । করিনি কেন জান? আমি বীরেশ্বরের মত অবুঝ নই, হিংস্র তো নয়ই । ওদের ইচ্ছে করলে মেরে ফেলতে পারতাম । মারিনি একটাই কারণ । গোপাকে আমি ভীষণ ভালবাসি । আরে পাগলি ভাবছিস গোপা আমার মেয়ের মতই - তাই তো ?
তারপর একটু থেমে বললেন - গোপা মেয়ের মতই না ; ও আমারই মেয়ে , তোর অগ্রজা ।
একে রাত্রি । এমনিতেই চারিদিক নিঝুম, নিস্তব্ধ । তথাপি এই কথার পর এক্কেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্ট হয়ে তাকিয়ে আছি আমরা সবাই ।
রূপা বলল - জেঠুমণি নাকি তোকে বাবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজের মেয়ে বলে চালিয়ে গেছে। এখনও পর্য্যন্থ তুই তি জানিস না নিশ্চয়
গোপার মুখে ভাষা নেই, চোখে দৃষ্টি নেই । আছে শুধু লঙ্কেশ্বরের গল্প-গাথা । গোপা জানে বীরেশ্বরই তার বাবা । আমরাও তাই জানি । বীরেশ্বর যে গোপাকে মনের মত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাও সকলে জানে। কিন্তু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করতে গিয়েগোপার জীবনে অন্তর্ঘাত ডেকে এনেছিলেন।
বাকরুদ্ধ গোপাকে কথা বলার চেষ্টা করছি । বারবার বুকুন প্রসঙ্গ তুলছি কিন্তু গোপা যেন নিথর হয়ে আছে। এক সযয় সুনেত্রা ' মাসী ও মাসী' বলে ঠেলে দিতেই গোপা চেয়ার থেকে ধপ করে পড়ে গেল । বড়দা বললেন - অকস্মাৎ নয়া চমকের জন্যই এমন হয়েছে । আমার কাছে ব্লটিং পেপার আছে ; পুড়িয়ে ধোঁয়া নাকের কাছে দিলেই জ্ঞান ফিরবে ।
বড়দা তাই করলেন । ধোঁয়া দিতেই গোপা জেগে উঠল ।
কিছুটা লাজুক মুখে বলল - এ কি কথা বলছিস তুই, রূপা ? এতদিন তো কেউ বলেনি !
রূপা বলল - আমিও কি জানতাম ছাই ! সেদিনের কথায় জানতে পারলাম । তোকে ফোন করে জানাবার সুযোগ পাইনি কারণ আমার এবং নেত্রার ফোন দুটোই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল । আর ল্যাণ্ডফোনটা এখনও অচল । গতকাল দুপুরে আমাদের ফোন দুটো ফেরৎ দিয়ে বাবা বলল - নে ধর ! আমি তো চললাম । আর এগুলো রেখে কি হবে !
গোপা বলল - আর দ্বিতীয় উইলটায় কি লেখা ছিল ?
- জানি না । ঘোষাল মশাই সেটা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন ' আপনি নিজের চোখে একবার চেক করে নেবেন স্যার ' । আমি তাহলে চলি ?
এরপর গোপা এবং রূপা এঁটো হাতেই পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল । সেই দেখে সুনেত্রার চোখ দুটো জলে চিকচিক করতে লাগল ।
বড়দা বললেন - এখন ওরা দু'ভাই একসাথে রয়েছেন। পুলিশের ভয়ে নিশ্চয় কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছেন। বলা যায় না, এখানে বা দুমকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারেন । আমি চাই না ওঁরা এসে কোন নতুন ছট পাকিয়ে তুলুন । ভাই! তুই বুকুনকে বলে দে ওঁরা যেন কোনমতেই ওর কাছে না আসতে পারে । আর আমরা চল এই ক'টা দিন বর্ধমান শহরে গিয়ে আশ্রয় নেই । বীরেশ্বর ও ত্রিলোকেশ্বর দু'ভাইই এখন ক্ষেপে আছে , কখন কি করে বসেন - বলা যায় না ।
বড়দার অভিজ্ঞতা আছে । অপরাধীদের কেস মোটিভ বিলক্ষণ জানেন । আমরা সকাল হতে না হতেই বর্ধমানে চলে এলাম । আমার মামার বাড়ী বর্ধমান শহরের কার্জন গেট এলাকায় ।
পথেই বুকুনের সঙ্গে দেখা । রাতের অন্ধকারে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে আমাদের নিয়ে যেতে ।
বুকুন বলল - কোথায় যাচ্ছেন সবাই একসাথে ?
আমি বললাম - বর্ধমান মামার বাড়ী ।
বুকুন বলল - না । উঠুন গাড়িতে । আপনাদের আমার কাছে নিয়ে যাব । মাসী সুনেত্রাও আছে - খুব ভালো হবে ।
বড়দা বললেন - তাই চল । আমারও তাই ইচ্ছে ।
( চলবে )
