আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
ষষ্ঠষষ্টিতম অধ্যায়
বড়দা ভালমতই জানেন তিনি কাউকে কিছু না বলে চলে আসায় সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়বে । সার্কিট হাউসে এসে হাজিকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। আমাকে ফোনে বললেন - তোরা সার্কিট হাউসে চলে আয় । সবার জন্য গিফ্ট এনে রেখেছি ।
আমরা চিন্তামুক্ত হয়ে সাত তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। বড়দা বললেন - ওই যুবককে দেখ সবাই । চিনতে পারছ কি না বল !
আমরা দেখলাম এক মদ্দ জোয়ান কোমরে দড়ি, হাতে পায়ে কড়া পরানো হাজিকে । সুনেত্রা তো চেঁচিয়ে উঠল - তুমি?
রূপা বলল - ঈশ্বরের অশেষ কৃপা । একে দিয়েই তো নেত্রাকে কলেজে অফিসে পাঠাতাম । ভাগ্যিস কিছু ঘটনা ঘটেনি ।
বড়দা বললেন - বুকুন ! একে কি এখানকার পুলিশকে দেব নাকি তুমি দুমকা নিয়ে যাবে ?
বুকুন বলল - কেস তো দুমকার, অতএব ..
বড়দা বললেন - ওর কাছে যে মোবাইলটা ছিল ; নিয়ে রেখেছি । এই নাও ।
বলে মোবাইল বুকুনকে হ্যাণ্ড ওভার করে দিলেন। বুকুন সেই ফোন নিয়ে হাজিকে বলল - মিঃ বীরেশ্বর এবং ত্রিলোকেশ্বর এখন কোথায় ?
হাজি নিরুত্তর । কোন মতেই ওর মুখ থেকে কথা বের করতে পারল না ।
এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল । বড়দা বুকুনের হাত থেকে ফোন নিয়ে লাউডস্পীকার অন করে হাজিকে কথা বলতে বললেন।
হাজি তাও কিছু বলছে না । ওদিকে স্পীকারে বীরেশ্বর বাজখাঁই গলায় হাজিকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করেছেন ।
বড়দা বললেন - কুইক! বুকুন । বি ভেরি কুইক । ওরা এখানেই আছে । পুলিশকে এলার্ট করে দাও । আমিও ওদের ভিক্ষে করতে দেখেছি । সন্দেহও হয়েছিল । কিন্তু ওদের কিছু না বলে হাজিকে খুঁজছিলাম। কারণ বুড়ো হাড়ে ওরা তেমন ভেল্কি দেখাতে পারবে না । কিন্তু ভয় ছিল হাজি হয়তো ওদের বা আমাদের কাউকে মেরে দিতে পারে । সবই তাঁর ইচ্ছা ।
হাজির কোন সাড়া না পেয়ে রক্ষিত ব্রাদার্স ততক্ষণে পগার পার । জামতাড়া থেকে ট্রেন ধরে কলকাতার উদ্দেশ্যে চলে গেছে।
বড়দা বললেন - ওঁদের পকেটে তেমন কিছু টাকা কড়ি নেই । নইলে বীরেশ্বরের মত লোক এত নীচে নামতে পারেন না; অন্তত ভিক্ষে চাইতে পারেন না ।
রেলপুলিশকে জানানো হল ব্যাপারটা । কিন্তু বিশেষ লাভ হল না । ওঁরা নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছে গেলেন । কিন্তু ২৬/২ এ উঠলেন না । চলে গেলেন মসলন্দপুরে শিউলি রায়ের বাড়ীতে ।
সুনেত্রার সৌজন্যে শিউলির সঙ্গে ওঁদের ভালো আলাপ আছে । শিউলি মাঝে মাঝে সুনেত্রার সঙ্গে ২৬/২ এ রাত কাটিয়েছে । সেই সুত্রে ওঁদের সঙ্গে, বিশেষ করে ছোট রক্ষিতের সঙ্গে বেশ চেনাজানা হয়ে আছে ।
মসলন্দপুরে ওঁরা যখন শিউলিদের বাড়ী খোঁজাখুঁজি করছেন; এ' গলি সে' গলি ঘুরে ঘুরে , বীরেশ্বর রক্ষিত বললেন - ঝুট-ঝামেলা ছেড়ে চল ফিরে যাই নিজের ঘরে । আমাদের এই দশায় দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না আমরা সত্যিই কে !
ত্রিলোকেশ্বর বললেন - আপনি এখানটায় বসে বিশ্রাম নিন দাদা । আমি ওই চায়ের দোকানে যেয়ে খবর নিয়ে আসি । এত কষ্ট করে যখন এসে পড়েছি একটা বেলা অন্তত বিশ্রাম নিয়ে পরের পদক্ষেপের চিন্তা করব । আমি এলাম বলে ।
ঘটনাচক্রে ওটাই শিউলি রায়ের বাড়ী । প্রবেশ পথের দরজা ছেড়ে ডান দিকের একফালি উঁচু খোলা বারান্দায় সমরেশ গুঁইয়ের চায়ের দোকান । মাসিক তিনশ' টাকার বিনিময়ে বারান্দা ভাড়া নিয়ে চায়ের দোকান দিয়েছে ।
সমরেশ আবার পুলিশের ইনফর্মার । ত্রিলোকেশ্বরকে এমন প্রশ্ন করতে শুনে বাড়ীটা দেখিয়ে দিল । হঠাৎ অপরিচিত জনের দেখা পেয়ে তার মনে সন্দেহ হল । অতএব এমন খবর পুলিশকে দিলে অনেকদিন পর কিছু উপরিপাওনা পেতে পারে ভেবে থানায় জানিয়ে দিল ।
শিউলি রায়ের বাড়ীটা দেখে ত্রিলোকেশ্বর যখন ফিরে এলেন তাঁর দাদাকে যেখানে বসিয়ে রেখেছিলেন সেই জায়গায় - দেখেন বীরেশ্বর নেই । কাল বিলম্ব না করে তিনিও সেই স্থান থেকে পালিয়ে গেলেন ।
বীরেশ্বরের খোঁজ না করে ত্রিলোকেশ্বর স্থির করলেন তিনি ২৬/২ এ ফিরে দেখে নেবেন আবহাওয়া কতটা পরিবর্তিত হয়েছে । যেমন দেখবেন তেমন ভাবেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।
এদিকে বীরেশ্বর যে কেন এবং কোথায় অন্তর্ধান করলেন সে রহস্য বোঝা গেল না , কিন্তু দুই ভাইয়ে যে আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তা' স্পষ্ট হয়ে গেল।
রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে । এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন ভোটের নির্ঘন্ট প্রকাশ করে দিল । সুযোগ বুঝে ত্রিলোকেশ্বর কেন্দ্রের শাসক দলে হাত মেলালেন এবং বীরেশ্বর গোপনে যোগাযোগ করলেন ভেঙে দেওয়া বিধান সভার শাসকদলের সুপ্রিমোর সঙ্গে ।
এ ভাবে দু'ভাই দু'টি যুযুধান রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে নিজেদের মধ্যে অলিখিত ব্যবধান বাড়িয়ে তুললেন।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্য্যালোচনা করলে দেখা যায় যে দুষ্কৃতীরাই রাজনৈতিক মহলের প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার । সুতরাং তারা অতি সহজেই কোন রাজনৈতিক দলের টিকিট পেয়ে যায় । অথচ মেধাসম্পন্ন , শিক্ষিত ভদ্রজন রাজনীতি পরাম্মুখ হয়ে পড়েন ।
ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিতের ভোটে দাঁড়ানো এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে গেল । বীরেশ্বর রক্ষিত সেই আগের মতই দলীয় তাবেদার হয়েই রইলেন । তাঁকে দলের মুখপাত্র রেখে প্রাক্তন শাসকদল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল । অথচ আশ্চর্য্য এই যে বীরেশ্বর রক্ষিত এতে কোন রকম ক্ষুব্ধ না হয়ে বরং খুশীই হলেন । দল তাঁকে বেশ কয়েকটি বুথের পর্য্যবেক্ষক হিসাবে নিয়োগ করল । যার মধ্যে তাঁর বাসস্থানের এলাকাটিও আছে ।
এদিকে ত্রিলোকেশ্বর স্বস্থান থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একে অন্যের উপর বিষোদ্গার করছেন । এমনকি তাঁর সহোদর ভাইয়ের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন । জনসভায় ভাষণ প্রসঙ্গে একদিন তো বলেই দিলেন বীরেশ্বর রক্ষিত তো একজন অসামাজিক ব্যক্তি । তাঁকে যে দল মুখপাত্র বানিয়েছি তাহলেই বুঝুন সেই দল রাজ্যের কতটুকু উপকারে আসবে । অতীতের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করবেন আর আপনাদের সুচিন্তিত মতামত ব্যালটে জানাবেন । ধন্যবাদ ।
এদিকে বীরেশ্বরও কিছু কম যান না । তিনি বলতে লাগলেন - ত্রিলোকেশ্বর যে আমার সহোদর ভাই ; সেই পরিচয় দিতেও আমার লজ্জা হয় । এতদিন তিনি আমাকে ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়েছেন । আমার পত্নী নাই, সন্তান সন্ততিও নাই । আমি কিসের জন্য, কাদের জন্য নিজের বিত্ত-বৈভব বাড়িয়ে তুলব। ভোগ করবে কে ? অতএব তিনি যা বলে বেড়াচ্ছেন তা' সর্বৈব মিথ্যাচার বই আর কিছু নয় । কেন্দ্র সরকার রাজ্যের একটি নির্বাচিত সরকারকে ৩৫৬ ধারায় অনৈতিক ভাবে বরখাস্ত করেছে । এতে বরঞ্চ আমাদের লাভই হয়েছে । আমাদের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শহীদ হয়েছেন । দল শহীদ হয়েছে । এখন বিচার করবেন জনতা । ব্যালটে প্রতিবাদের বন্যা বইয়ে দিতে হবে । দেখুন, আমার ক্ষমতা নিয়ে কোন লোভ নেই, আমি ইচ্ছে করলেই ভোটের টিকিট পেয়ে যেতাম কিন্তু নেইনি । কারণ আমি মন্ত্রী হতে চাই না । বিধায়ক হতে চাই না । উন্নয়নের ধারক এবং বাহক হতে চাই ।
উভয় পক্ষই ব্যক্তিগত আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন ।
আমরা টিভিতে সেই খবর দেখছি । বড়দা ভীষণ চিন্তিত । কি সুন্দর ভাবে দু'জন অপরাধী নিখাদ ভদ্রলোক হয়ে গেলেন । আইন আদালত পুলিশ প্রশাসন ওঁদের কিছুই করতে পারল না ।
( চলবে )
