আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
পঞ্চষষ্টিতম অধ্যায়
সেদিন আমাদের আর মল্লিকপুরে আসা হল না । পরিত্যক্ত স্করপিওটি পাওয়া গেলেও তার চালক বা যাত্রী কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি ।
পুলিশ স্করপিওর ওনারকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করল ।
- ওই যে গাড়িটা ওটা কি আপনার ?
- হ্যাঁ স্যার । মাসখানেক আগে ওটা কার-দেখো ডটকম থেকে ইউজড কার হিসেবে কিনেছি । এখনও তার সব ডকুমেন্ট পাইনি ।
তিনি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার, স্যাসি নং ইত্যাদি তথ্য পুলিশকে দিলেন ।
- গাড়িটা কে চালাচ্ছিল ?
- দীপক কুমার। মালুট গ্রামের বাসিন্দা। এই তো তার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি স্যার ।
- আপনি কি ওকে ক্যাজুয়ালী গাড়ি চালাতে দিয়েছেন নাকি ও আপনার পার্মানেন্ট ড্রাইভার ?
- ওকে মাসিক পনের হাজার টাকার ভিত্তিতে গাড়িটা চালাতে দিয়েছি স্যার । প্রতিদিনই এসে পাঁচশ টাকা করে দিয়ে যায়।
- আজ কখন গাড়ি বের করেছিল?
- গতকাল থেকে আমার সঙ্গে কথা হয়নি স্যার , আসেওনি । আবার ফোনের সুইচও অফ করে রেখেছে।
- আপনি থানায় রিপোর্ট করেননি?
- ভেবেছিলাম আজ সকালে ওর বাড়ী যাব । সেই ভাবে বেরিয়েও ছিলাম । মাঝপথে দেখি আমার গাড়ি বঙ্গালের পথ ধরে ছুটছে । আমিও পিছু নিলাম। কিন্তু নাগাল পাইনি বলে থানায় আসছিলাম ; পথেই তো আপনারা আমাকে ধরে আনলেন।
- আমাদের সঙ্গে চলুন মালুট গ্রামে, ওর বাড়ীটা দেখিয়ে দেবেন ।
বড়দা এগিয়ে এসে বললেন - যদি কিছু মনে না করেন অফিসার; তবে একটা কথা বলতে চাই ।
- কে আপনি ? কেনই বা কথার মাঝে কথা বলতে এসেছেন ?
বড়দা নিজের পরিচয় দিলেন ' র ' এর প্রাক্তন গোয়েন্দা অফিসার হিসাবে ।
পুলিশ অফিসারটির নাক সিঁটকে বললেন - গোয়েন্দা ? প্রাক্তন ? তায় আবার ' র ' এর ? তা' আপনাকে দেখে তো তেমন মনে হয় না । কোন ফন্দিটন্দি নেই তো ?
বড়দা বোঝাবার চেষ্টা করলেন। অফিসার বুঝতেই চান না ।
বললেন - না না । এটা একটা সিরিয়াস কেস । পুলিশের কাজ, গোয়েন্দার নয় । একজন সাধারণ নাগরিককে পুলিশের সঙ্গে নেওয়া শোভনীয় হবে না ।
- কিন্তু আমার সন্দেহ ...
- আপনার সন্দেহ আপনার কাছেই রাখুন মশাই । এখন আমার সন্দেহ নিরসন করতে দিন।
অফিসার কিছুতেই সম্মত হচ্ছেন না দেখে আমি বুকুনকে সব জানিয়ে দিতেই বুকুন বলল - ফোনটা ওনাকে দিন বাবা । আমি কথা বলছি ।
আমি অফিসারকে ফোন দিতে গেলাম। তিনি নেবেন না।
বললাম - ভি সি সাহেবের ফোন ।
অফিসারটি নিমরাজী হয়ে ফোন নিয়ে ' কে বলছেন ' বলতেই তিনি চঞ্চল হয়ে উঠলেন।
' ঠিক আছে স্যার, ওকে স্যার' বলতে বলতে তারই ফাঁকে বড়দাকে একটা লম্বা স্যালুট ঠুকে বললেন - বলবেন তো আপনি স্যারের রিলেটিভ । দেখুন দেখি অজ্ঞাতসারে কত কথা শুনিয়ে দিলাম । এক্সকিউজ মি প্লীজ ।
বড়দা কম কথার মানুষ । ' ইটস ওকে ' বলে ঘটনার যবনিকাপাত করে দিলেন ।
তার পর তিনি পুলিশের গাড়িতে উঠে গেলেন । আমাকে বললেন - ভাই তুই ওদের নিয়ে বাড়ী ফিরে যা ; আমি আসছি ।
আমি সকলকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম । ওঁরা গেলেন মালুট গ্রামে ।
গ্রামে পুলিশ এসেছে দেখে গ্রামবাসীরা ভয় পেল কিন্তু কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল ।
গাড়ির মালিক পুলিশের গাড়ি যে বাড়ীটার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল বড়দা বলে উঠলেন - আমি জানতাম এই বাড়ীটাই হবে ।
অফিসার বললেন - এটাই কি দীপকের বাড়ী ?
বড়দা বললেন - দীপক নামটি যদি আসল হয় তবে বলব এটা ওর বাড়ী নয় । আর যদি নকল হয়, তবে আমার সন্দেহই ঠিক । কারণ আমি জানি এই বাড়ীটা হাজি মস্তান নামের কারোর !
পুলিশ অফিসার ধন্দে পড়ে গেলেন । বাড়ীতে কেউ নেই । আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল - এটা হাজির বাড়ীই । ওর একটা বোন ছিল সপ্তাহ খানেক আগে একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে।
বড়দা বললেন - তার মানে হল হাজি মস্তান বীরেশ্বর এবং তাঁর ভাইকে নিয়ে দুমকা ছেড়ে পালিয়েছে।
পুলিশ অফিসার গাড়ির মালিককে গ্রেপ্তার করলেন। বড়দা বললেন - আপনার উচিত ছিল ওর লাইসেন্স ভেরিফাই করে নেওয়া । তা' তো করেননি নিশ্চয় । এবার দেখুন কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
অফিসারটি বড়দাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং কেস ডায়েরীতে নতুন তথ্য সংযোজন করলেন ।
এদিকে রক্ষিত ব্রাদার্স হাজিকে পেয়ে বেশ পুলকিত। তাঁরা হাজির সাহায্যে দেওঘর বাবাধামে এসে উপস্থিত হলেন। ত্রিলোকেশ্বর বললেন - সবই বাবার কৃপা । তাই তো এখনও বেঁচে আছি ।
বীরেশ্বরও বাবা বৈদ্যনাদকে দর্শণ করে মনে সাহস পেলেন । এখন ক'টা দিন শিমুলতলা-দেওঘর-জামতারা করেই কাটাতে হবে । তারপর সুযোগ বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে ।
একদিন বুকুন পরিকল্পনা করল বাবাধামে পূজো দিয়ে আসতে । সেইমত ছুটির দিন দেখে আমরা সদলবলে দেওঘর যাত্রা করলাম ।
বুকুন সার্কিট হাউস বুক করে সেখানেই নিয়ে তুলল । ভি আই পি ট্রিটমেন্ট একচুয়ালি কেমন হয় জীবনে এই প্রথমবার চাক্ষুষ করলাম । আমিও কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রুপ 'এ' অফিসার ছিলাম । ইন্সপেকশন বাংলোয় থেকেছি । তবু এখন মনে হল এতে আর ওতে আকাশ জমীন ফারাক ।
এখানে সবকিছুতেই যেন ডি আই পি গন্ধ । এমনকি পূজো দিতে গিয়েও বিশেষ ব্যবস্থায় নির্বিঘ্নে পূজো সেরে এলাম ।
বড়দাও পূজো-আচ্চা করলেন। যদিও তিনি এতে বিশেষ কোন আগ্রহ দেখাননি । বুকুনের অনুরোধ রাখতেই মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন ; কিন্তু সবার আগে মন্দির থেকে বেরিয়ে লোকের ভীড়ে মিশে গেলেন ।
তাঁর নজর পড়ল দু'জন ভিখারীর উপর । কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ওরা দু'জন টাকা পয়সা ভিক্ষে করছিল । বড়দা পাশ দিয়ে চলে যেতেই ওরা মুখগুলো পিছু দিকে ঘুরিয়ে নিল । বড়দা দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে গেলেন ।
একটি মুসলমান জোয়ান ছেলে তাঁকে বলল - অটো লাগবে বাবু !
বড়দা চোখ তুলে চাইলেন ।
- আরে হাজি ভাই যে !
- হাঁ বাবু । বাঙালে যা অবস্থা মনিবেরা আমাকে ছুটি দিয়ে দিলেন । বললেন যা এবার খুঁটে খা গে যা । তোর দায়িত্ব আর নিতে পারবনি । তাই পেট চালাতে এখানে এসে অটো চালাচ্ছি ।
- তা বেশ করছ । তোমার মনিবদের খবর কি ?
- জানি না বাবু ।
বড়দা বললেন - অটো ছাড়া এতটা পথ তো যেতে পারব না । চল তবে তোমার অটোতেই যাই ।
- কোথায় নিয়ে যাব বাবু ?
- সার্কিট হাউসে । ওখানেই উঠেছি তো । তুমিও দেখে নাও সার্কিট হাউসের ভেতরটা কেমন । তোমার মনিবদের বাড়ীটার চেয়েও জমকালো ।বল যদি, ওখানে তোমার একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারি । বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারবে ।
হাজি অটোটা কিছুদূর নিয়ে গেল । তারপর কি হল কি জানি অটো আর চলে না । অনেক কসরত করল হাজি । কিছুতেই অটো আর স্টার্ট নেয় না ।
বাধ্য হয়ে বড়দা বললেন - ঠিক আছে । আর অত শশব্যস্ত হতে হবে না । প্রায় চলে এসেছি । চল বাকি পথটা গল্প করতে। করতে চলে যাই ।
হাজি বলল - না বাবু । এটা ঝাড়খণ্ড। গাড়ি ফেলে গেলে আর পাব না ।
বড়দা বললেন - দেখি তবে আমি একবার চেষ্টা করি ।
বলে হ্যাণ্ডেল তুলতেই অটো ঘটঘট আওয়াজ করে স্টার্ট হয়ে গেল । হাজি বলল - বাঁচালেন স্যার ।
বড়দা বললেন - সব বাবার ইচ্ছা । বড়দা হাজির পাশেই বসলেন । বললেন - চালাও।
গাড়ি চলল । বড়দা বাঁদিকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে 'র' এর দেওয়া স্পেশ্যাল পিস্তল বের করে হাজির কপালে ঠেকিয়ে বললেন - সোজা সার্কিট হাউস । তোমার জন্য গিফ্ট রাঠা আছে ।
( চলবে )
