আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
ত্রিংশতি অধ্যায়
তিনদিন হয়ে গেল বড়দা দুমকায় পড়ে আছেন । কি কাজে গিয়েছেন, আসছেন না কেন ইত্যাদি ভাবনাগুলো আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিল ।
ফোন করলাম। যার কন্ঠস্বর শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি ; তিনি ফোন ধরলেন না । পরিবর্তে এক ভারিক্কি গলার স্বর শুনতে পেলাম ।
তখন সবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে । গাছে গাছে পাখির কলরব স্তিমিত হয়ে গেছে। পল্লীগ্রামের যে চেহারা আগে ছিল এখনও তাই আছে । পরিবর্তন বলতে শুধু পথে বা বাড়ীতে টিমটিমে বৈদ্যুতিক আলো আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্ধকার সরিয়ে দিতে । এত কম আলোয় চোখে স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না ।
হঠাৎ গোটা গ্রামকে অন্ধকারে ডুবিয়ে শুরু হল বিদ্যুতের ঘুমঘুম খেলা । একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কোনমতে ফোন খুঁজে কল করেছি ।
এমন হাঁড়ির মত গলা - মানে - বীরেশ্বর রক্ষিত ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না ।
- ক্যা ? ( অর্থাৎ কে )
আমার অন্তরাত্মা তখন খাঁচা ছাড়া । সুড়ুৎ করে পালিয়ে যেতে পারলে যেন বেঁচে যায় । তথাপি সাহসে ভর করে বললাম - আপনি কে ?
- তোর বাপ রে ব্যাটা ! হতচ্ছাড়াকে বলছি কে - উনি আবার উল্টো প্রশ্ন করে যাচ্ছেন ! বলি, কাকে চাই ?
সেই তেজ, সেই দম্ভ । আমার মনে পড়ে গেল সেই অভিশপ্ত রাতের কথা ।
'সেক্স বুস্টার নিয়ে আয় তো ! দেখি বাঁদরটা কি করে ! '
আমার হাত পা অসাড় হয়ে গেল । মনে হল আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি । বার কয়েক গলা ঝেড়ে কিছু বলতে চেষ্টা করলাম । ডাকসাইটে কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসারের গলা বুজে মিউ মিউ করতে লাগল । লোকটা ফোনটা কেটে দিল ।
আমি আরও চিন্তায় পড়লাম। তাহলে শিকারী কি নিজেই শিকার হয়ে গেছে !
সেদিন সারা রাত গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না । ঝড় জলও কিছুই হয়নি । এরই মধ্যে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে বর্ধমান সাপ্লাই অফিসে ফোন করলাম । ওরা জানিয়ে দিল টেকনিক্যাল ফল্ট হয়েছে; রাতে বিদ্যুৎ আসবে না ।
কি মুশকিলে যে পড়লাম বলে বোঝানো যাবে না । এত বড় বাড়ী চারিদিক নিঝুম হয়ে আছে । মোবাইলের টর্চ খুলে আলো জ্বালিয়ে সদরে তালা দিলাম । তারপর আমার শোবার ঘরে কপাট বন্ধ করে বসে পড়লাম।
আরও একবার বড়দাকে ফোন করার ইচ্ছে হল । কিন্তূ সাহস হচ্ছিল না । দশ ডিজিটের নাম্বারের কয়েকটা সুইচ টিপে বারবার ভুল করে ফেলছি । ফলে সিস্টেম বলছে 'ডায়ালড নাম্বার ডাজ নট এক্জিস্ট' । যতবার করি একই উত্তর আসে ।
আমার সংশয় আরও বেড়ে যায় । বীরেশ্বরের কারিকুরি নয় তো ! শয়তানের তো অনেক কিছুই জানা থাকে । এমন সময় সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলাম। ভয়ে তখন ঘামতে শুরু করেছি ।
একা থাকার অভ্যেস নেই । কখনও সেভাবে থাকিনি । চাকুরী জীবনে একলা বেরিয়েছি কিন্তু রাতে আলো ঝলমল বাসাবাড়ীতে চাকর বাকর নিয়ে কাটিয়েছি। এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম । স্বাভাবিক ভাবেই আরও ঘাবড়ে গিয়ে বাড়ীর ভেতর থেকে ডাকলাম - কে ?
মনে হল এখনও যেন মিউ মিউ করছি ।
' আমি হে ছোকরা । আমি বাবলুদা ।'
ভয় দূর হল । বীরের মত বেরিয়ে সদর দরজার তালা খুলে দিলাম । দরজা খুলতেই দেখি কেউ কোথাও নেই । বারকয়েক ' বাবলুদা বাবলুদা ' বলে ডাকলাম । উল্টো দিকের বাড়ী থেকে জানালা খুলে কে যেন বলল - কার নাম ধরে ডাকছ পুলকদা ? ও তো আজ দুপুরে গত হয়েছে। খবর পাওনি ?
আমার এমন দশা হল যেন এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলব। বললাম - সে কি ! এই তো সকাল বেলায় ওর দোকানে চা খেয়ে এলাম।
- সে তো কোন সকালে ! দুপুরে ওর দোকানে আগুন ধরে যায় । আর পুড়ে মারা যায় ।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম ।বাবলুদার দোকানে আগুন লেগেছে, সেই আগুনে পুড়ে বাবলুদা মারা গেছে - আর আমি এ পাড়ায় থেকেও কোন খবর পেলাম না ?
মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ছুটলাম বাবলুদার বাড়ীর দিকে - ওখানেই তো ওর খাবারের দোকান। বাবলুদার মৃত্যু আমার ভিত নড়িয়ে দিয়েছে । বুকে তখন প্রচণ্ড সাহসের সৌরভ । আমি রওনা দিলাম।
গিয়ে দেখি বাবলুদা সশরীরে বিরাজমান। দিব্যি আলুর দম আর পরোটা তৈরী করছে ।
আমাকে দেখে বাবলুদা বলল - এস হে ছোকরা । রাতের খাবার চাই তো ?
আমি বললাম - বাবলুদা ! তুমি ঠিক আছো তো ?
- কেন ? আমার আবার কি হয়েছে ?
আমি তখন আমতা আমতা করছি।
- নাহ মানে রথীনকাকার বাড়ী থেকে আমাকে বলল....
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাবলুদা বলল - রথীনকাকার কথা আর বল না হে ছোকরা । ওর স্বভাবটাই এমনই। রাত-বিরেতে লোককে ভয় দেখানো ছাড়া ওর কোন কাজ নেই ।
আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল । রথীনকাকা তো গত বছর মারা গেছেন । এক বছর পর হঠাৎ তিনি আমাকে ভয় দেখাতে....
বাবলুদার মুখের দিকে চেয়ে আছি। চোখ দুটো যেন কেমন নিষ্প্রভ । বলি - শুনলাম.....
- আমি আগুনে পুড়ে মারা গেছি - তাই তো ? নাও নিজের চোখে দেখে নাও আমি বেঁচে আছি কি না । আর এই যে লুচি পরোটা ভেজে রেখেছি চাট্টি খেয়ে আমাকে উদ্ধার করে যাও ।
হঠাৎই বিজলী বাতিগুলো জ্বলে উঠল । সেই টিমটিমে আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাবলুদার ঘরবাড়ী, দোকান সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে ।
আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল । মিনিট খানেকের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম ।
জ্ঞান ফিরল ফোনের শব্দে । তড়িঘড়ি উঠে বসলাম। দেখি বড়দা ফোন করেছেন ।
- হ্যাঁ ভাই ! বড়দা বলছি । ফোন করেছিলি ?
আমার গলা থেকে কোন শব্দ বেরোচ্ছে না ।
কোনক্রমে বললাম - বড়দা ! বাবলুদা নেই !
বড়দা বললেন - হ্যাঁ রে ভাই বড় দুঃখের খবর ।
এমন ভাবে বললেন যেন এতে তিনি এক ফোঁটাও দুঃখ পাননি ।
বললাম - বড়দা ! আপনি জানেন? আড়াইশ' মাইল দূরে থেকে আপনি জানলেন অথচ দেখুন ওপাড়ায় থেকে আমি কিছুই জানি না!
বড়দা হাসলেন ।
- এটাই তো জীবনের খেলা রে ! এই আছে এই নেই। যাক ওসব নিয়ে মাথা ঘামাসনি । বাবলুর কিছু হয়নি । ওকে আমি ডেকে এনেছি দুমকায় । কিছু কাজ আছে ।
আমার নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছে । কেবলই মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি। যা সব ভুতুড়ে কাণ্ড দেখছি তাতে আর এক দণ্ডও এখানে থাকা উচিত হবে না।
আমি পালাবার জন্য প্রস্তুত হতে ঘিয়েই ঘুম ভেঙে গেল ।
চোখ মেলে দেখি সকাল হয়ে গেছে । চারিদিকে কল-কাকলিতে ছেয়ে গেছে । ঘন ঘন ট্রাক্টরের যাতায়াতের আওয়াজ পাচ্ছি । মোবাইল চার্জে বসিয়ে টয়লেটে গেলাম ।
ও: এতক্ষণ শুধু দু:স্বপ্ন দেখছিলাম ।
প্রাত:কৃত্য সেরে বাবলুদার দোকানে গিয়ে চা খেলাম। রাতের দু:স্বপ্নের কথা ওকে বলতেই হেসে হেসে গাইতে লাগল - আমার এমন দিন আর কবে বা হবে গো; ডাকব গোউর বলিয়া ।
( চলবে )
