আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
চতু:পঞ্চাশৎ অধ্যায়
জানি না বড়দা এবং বাবলুদা কোথায় যাচ্ছেন । খোঁজ নেবারও সুযোগ নেই । বাড়ীর ছাদ থেকে মল্লিকপুর মোড়
স্পষ্ট দেখা যায় । ছাদে উঠলাম। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে । কৃষ্ণপক্ষ চলছে । অতএব গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া অন্য কিছুই দৃশ্যমান নয় ।
ওঁদের দেখতে পাচ্ছি না । কিন্তু আমার মনোশ্চক্ষু দেখছে সেই পাঞ্জাবি লরি চালক আর খালাসি বাব্বন সিংকে । ওরা নয় তো ! লঙ্কেশ্বরের নিকট অসম্ভব কিছু নেই । হতেও তো পারে ভিনদেশী মানুষের সহায়তা নিয়ে তিনি পালাবার পথ পরিষ্কার করে রেখেছিলেন ।
অবশ্য তেজপালকে দেখে নিখাদ ভালো মানুষ মনে হয়েছে। তারা এমন কাজ করবে কি? বিশেষত আমার ঘটনা জানা সত্বেও ! তবু না আঁচালে বিশ্বাস হবে না । কি জানি টাকাকড়ির লোভ দেখিয়ে লঙ্কেশ্বর অতিরিক্ত চালাকি করেছেন কি না ! আবার তাই যদি হয় ; তিনি সিঁধ কাটা সত্বেও গেলেন না কেন ? আমাদেরকে যদি খতমই করতে চাইতেন, সুযোগ তো অনেকটাই ছিল, তেমনও তো করেননি ।
তা'হলে আমার মত মনে অবিশ্বাস রেখে বড়দা কি অনুগত বাবলুদাকে সাথে নিয়ে তেজপালদের খোঁজে বেরোলেন !
হয়ত তিনি জানেন আজ ওরা কলকাতা আসবে অথবা কলকাতা থেকে ফিরবে ।
মাথায় অনেক চিন্তার জট পাকিয়ে গেল । মনকে আর বশে রাখা গেল না । চুপিসারে ছাদ থেকে নেমে বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে গেলাম । উদ্দেশ্য বড়দাকে ফলো করা । এদিকে গোপা আর বুকুন বাড়ীতে একাই রয়ে গেল । বড়দা আবার তা' জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবেন না । সেও আরেক জ্বালা ।
তথাপি সে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে অন্ধকারে গা ঢাকা দিলাম। তেজপালের গাড্ডির নাম্বার জানি । ওর অভ্যেস আছে মল্লিকপুর মোড়ের সামসুলের চায়ের দোকানে আসতে যেতে নেমে একবার করে চা বিরতি নেবার । বড়দাও জানেন। সেজন্যই বুঝি তাঁর এই সিদ্ধান্ত।
কিছুদূর মানে প্রায় মোড়ের কাছাকাছি এসেই থমকে গেলাম । দুজনের ফিসফিসানি কানে এল । বাবলুদার হাতে একটা টর্চ নিয়ে বেরোতে দেখেছি । তাই সাবধান হতে ধানক্ষেতের একটা মোটা আলের কাছে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে লুকিয়ে রইলাম।
কথাগুলো আবছা আবছা কানে আসছে। দুজনে তর্ক হচ্ছে।
বড়দা বলছেন - বাবলু তুই এমন করবি আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না ।
বাবলুদা বলছে - বড়দা ! আমি করতে বাধ্য হয়েছি । তুমি ভাবছ টাকা খেয়েছি ; কিন্তু এই আমি বুকে হাত দিয়ে - না না - তুমি ব্রাহ্মণ, তোমার পা ছুঁয়ে বলছি আমি কোন টাকাপয়সা ওনার কাছ থেকে নেইনি ।
- তা'হলে বল এমন কাজ করলি কেন ? আমি তো মিছিমিছি ওই পাঞ্জাবি দুটোকে সন্দেহ করেছিলাম । ছিঃ।
বাবলুদা বলছে - কি সাংঘাতিক লোক রে বাবা ! আমাকে ফোনে বলেছিল রাতের মধ্যে কাজ শেষ না হলে সপরিবারে তোর নরক যাত্রার বন্দোবস্ত করে দেব ।
- তাই যদি হয়, একবার আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করলি না ? এখানেই তো আমার সন্দেহ বেড়ে যাচ্ছে ।
বাবলুদা বলছে - সন্দেহ আমারও হয়েছিল বড়দা । তাই ভেবে দেখলাম এখনই যদি তোমাকে বলে দিই তো লোকটার পরিচয় জানতে পারব না ।
- পরিচয় ? ও যে বীরেশ্বর রক্ষিত - দেশশুদ্ধ সকলেই তা' জানে ।
- এইটাই তো গোড়াতেই গলদ হয়ে যাচ্ছে বড়দা ! লোকটা বীরেশ্বর রক্ষিত নয় । ওর আসল নাম ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত ।
- কি বলছিস তুই ! ভেবে বলছিস তো !
- আমি সিওর হয়েই বলছি বড়দা ।
- কি করে সিওর হলি ?
বাবলুদা এবার আসল কাহিনী বলতে শুরু করল ।
- খুব সাবধানে আমি সিঁধ কেটে দিলাম। ট্রায়াল দিয়ে নিজেকে ঢুকিয়ে দিলাম বাড়ীর ভেতরে । তখনই লোকটা আমার গলাটা জাপ্টে ধরল ।
- আমার পথ তো পরিস্কার করে দিলে বাছা, এবার তোমার পথটাও দেখিয়ে দিই। আমার নাম ত্রিলোকেশ্বর -- সরি -- বীরেশ্বর রক্ষিত । কখনও কোন শিকার আমার হাত থেকে ফস্কায়নি । তোমাকেই বা ছেড়ে দি কেন ? মরতে প্রস্তুত হও । বলে একটা পিস্তল আমার কপালে ঠেকিয়ে বলল - একটুও শব্দ হবে না । সাইলেন্সর লাগানো আছে ।
আমি তো ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি । তবু প্রাণে বাঁচতে বললাম ' ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করবেন স্যার । ' আমি তো এমনিতেই মরে গেছি । মড়াকে মেরে কি হবে !
দেখলাম লোকটা আমাকে ছেড়ে দিল । হয়তো ভাবল আমি কোন ভুত-টুত হয়তো । বলল - ঠিক আছে যেমন নি:শব্দে ঢুকেছ তেমনই বেরিয়ে যাও । আর শোনো কাউকে কোনদিন বলবে না আমি কে।
আমি সিঁধ বেয়ে বেরিয়ে এলাম । সেই থেকে গায়ে জ্বর নিয়ে শুয়েছিলাম। তুমি ডাকলে তাই এসেছি ।
এবার চিত্রটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে গেল । কিন্তু ধাঁধা তবু ঘুচল না । আমি পড়ি কি মরি করে বাড়ী ফিরে এলাম । গোপা আমাকে ও ভাবে ঢুকতে দেখে থতমত খেয়ে বলল - কোথায় গিয়েছিলেন ?
আমি ঠোঁটে আঙুল চেপে ওকে চুপ করিয়ে দিলাম। তারপর সোজা নিজের কামরায় এসে শুয়ে পড়লাম । বুকুন হয়তো ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিল । আমাদের সম্বন্ধে কিছু দেখতে পেল না ।
গোপাকে বললাম - তোমার বাবার নাম কি ?
অবাক করা কথা শুনে গোপা আমার গায়ে হাত রাখল । অনুভব করল গা ভীষণ গরম ।
- এ কি ? তোমার গায়ে তো জ্বর মনে হচ্ছে !
আমি বললাম - বল না, তোমার বাবার নাম কি ?
গোপা বলল - তুমিই তো বলো 'লঙ্কেশ্বর ' ।
- আরে তা' নয় । আমি জানতে চাইছি তোমার বাবার আসল নাম কি ?
গোপা বলল - দাঁড়াও। থার্মোমিটার নিয়ে আসি। মনে হচ্ছে জ্বর ১০৪ ছাড়িয়ে গেছে। তাই ভুল বকছ ।
আমি তড়াক করে উঠে বসলাম । বললাম - ও সব জ্বরটর কিছু নেই, আমি সত্যিই জানতে চাইছি তোমার বাবার আসল নাম ।
গোপা এবার বলল - কেন? বীরেশ্বর রক্ষিত !
- তার মানে যে লোকটি আমাদের এখানে ছিল তিনিই বীরেশ্বর ।
- কোন সন্দেহ আছে ? গোপা প্রশ্ন করল ।
আমি বললাম - বিলকুল ডাউট আছে । আমার মনে হয় তিনি বীরেশ্বর নন; তিনি ত্রিলোকেশ্বর মানে আমাদের পরিচিত ভদ্রজন প্রিয় কাকাবাবু।
গোপা রেগে গেল ।
- আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? কি সব উল্টোপাল্টা বকে যাচ্ছেন ?
বড়দা ঘরে প্রবেশ করলেন ।
- ভাই ঠিক কথাই বলছে বউমা । উনি বীরেশ্বর নন, ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিতই ছিলেন । যাকে আমরা এতদিন দেবতুল্য মানুষ ভাবতাম।
গোপা বাগে গজগজ করতে করতে, ' পাগলের গুষ্ঠি' বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চলে গেল ।
এতক্ষণ আমি জেরা করছিলাম, এবার আমাকেই জেরার মুখে পড়তে হল । বড়দা প্রশ্ন করলেন - তুই কেমন করে জানলি ভাই ?
আমি যে ওঁদের ফলো করে জেনেছি বাবলুদার মুখে সে কথা গোপন করে বললাম - ওঁর কথা শুনে আমার তেমনই ধারণা হয়েছিল বলে গোপাকে জিজ্ঞেস করছিলাম। কিন্তু গোপাই স্বীকার করতে পারছে না । আপনি কোথায় গেছলেন বড়দা ?
- জাহান্নমে । তুইও তো গিয়েছিলি ! তাই না ?
আমি ধরা পড়ে গেলাম দেখে চুপ করে রইলাম। বড়দা বললেন - মৌমাছির মত আমারও পিছনে এক জোড়া চোখ আছে ভাই ।
তারপর হো হো করে হাসতে লাগলেন।
( চলবে )
