আধুনিকতায় উৎশৃঙ্খলতা নয়
আধুনিকতায় উৎশৃঙ্খলতা নয়
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ না হয়েই দুতলার ব্যালকনিয়াটায় খালি পায়ে এসে খস করে একটা দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরালো মৌটুসি। মৌটুসির বয়স এখন আঠাশ। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। আজ রবিবার। তাই অফিস যাওয়ারও তাড়া নেই। কাল সন্ধ্যে থেকে শরীরটাও খারাপ হয়েছে ওর। জ্বরজ্বর মত এসেছে। কিন্তু ও ওর শরীরের খেয়াল রাখতে চায় না। এরই মধ্যে হঠাৎ করে ওর হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে এক কাপ কফি ধরিয়ে দিল মৈনাক, ওর বাল্যবন্ধু। দুবছর হল ওরা একই বাড়িতে থাকে। যাকে বলে লিভ টুগেদার। যদিও বাড়িটা মৈনাকেরই। ও একরকম জোর করেই মৌটুসিকে ওর কাছে রেখেছে।
-----"তুই সিগারেট'টা ফেললি কেন আমার হাত থেকে?"
-----"এখন তুই আমার বানানো কফি খাবি, তাই।"
-----"আমার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে না।" -
-----"তা করবে কেন! তুই তো সেই ভিন গ্রহের প্রাণী, যার সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সিগারেটে ফুঁ দিতে ইচ্ছে করে। এদিকে যে তোর শরীরটা খারাপ তার খেয়াল আছে?"
-----"তুই কি করে জানলি আমার শরীর খারাপ?"
-----"বন্ধু হয়েছি কি করতে, যে এইটুকুনি জানবো না? কাল থেকে তুই জ্বরে কষ্ট পাচ্ছিস। তুই কি ভাবিস, আমি কিছু বুঝি না?"
-----"ও আর কি!" -
-----"তা বলে তুই নিজের শরীরের সাথে এরকম গাফিলতি করিস না। যা ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি রান্না বসাচ্ছি।"
মৈনাক ছেলেটা বড়ই ভালো। শুধু বন্ধু হয়ে ও মৌটুসির খেয়াল রাখে না, এই ছেলেটা অন্যায়ের সাথে লড়াই করতে জানে, মানুষকে ভালোবাসতে জানে, কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য করতে জানে।
দুপুরবেলা বাড়িতে হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ। স্নান সেরে মৌটুসি আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছে সবে। সিগারেটটা হাতে নিয়েই ও দরজাটা খুলে দেখে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসেছে। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই ও জানতে পারলো, ভদ্রলোক মৈনাকের পূর্ব পরিচিত। দরজার বাইরে থেকেই মৈনাককে ঘরের ডাইনিং টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন-
-----"কি হোল মৈনাক, মা-বাবাকে কষ্ট দিয়ে তুমি এখানে এই মেয়েটার সাথে ভালো আছো তো?" বয়স্ক ভদ্রলোকটিকে মৈনাক কোনো কথার উত্তর দেওয়ার আগেই মৌটুসি উনাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিল।
-----"ঐ মেয়েটা মানে আপনি কাকে বোঝাতে চাইছেন কাকু, আমাকেই তো?"
-----"হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকেই। তুমি ছাড়া আর কোনো মেয়ে তো এখানে উপস্থিত আছে বলে আমার মনে হচ্ছেনা। একটা চালচুলোহীন অভদ্র মেয়ে মানুষ, আধুনিকতার জোয়ারে গা ভাসিয়েছ, সাথে একটা ভদ্র বাড়ির ছেলেকেও খারাপ করছো।"
-----"আপনি ভদ্র ভাষায় কথা বলুন। আমি তো মৈনাককে ওর মা বাবার কাছে যেতে বারণ করিনি। আর আমি নিজের ইচ্ছেতে এখানে থাকছিও না। আর আধুনিকতার উদাহরণে আমাকে যদি টানতে চান, তো আমি তাই।"
-----"তাই নাকি! তোমার মত অভদ্র মেয়ের থেকে আমি ভদ্রতা শিখব না। আর তুমি মেয়ে যে মৈনাকে কত ভালো কিছু বোঝাতে পারো, আর কতটা মেয়ে তুমি সংস্কারি তা তোমার হাতে ধরা ঐ সিগারেট'টা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মেয়ে হয়ে এই ছাইপাস গেলো লজ্জা করেনা তোমার? এটাই তো তোমাদের আধুনিকতা তাই না?"
-----হ্যাঁ কাকু। আপনার কাছে যদি মেয়েদের আধুনিকতা বলতে এই মনে হয়, তবে সেটা নয়। আমরা যেদিন নিজেদের বস্তাপচা ধ্যানধারণা বাদ দিতে পারবো সেদিন সত্যিই আধুনিকতা আসবে। আসলেই এটা একটা মানসিকতার বদল। আপনার কাছে সিগারেট খাওয়াটা লজ্জার নয়, আমি মেয়ে হয়ে কেন সিগারেটে খাব, এইটাই লজ্জার। ছেলেরা যদি সিগারেটে ফুঁ দিতে দিতে কোনো মেয়েকে খারাপ মন্তব্য করে বা মদ খেয়ে মাতলামো করে, তখন সেটা দোষের নয়? আমি তো শুধু তো একটা সিগারেটে খাচ্ছি। কোনো অসভ্যতা তো করছি
না। "
-----"শুধু সিগারেটের কথা দিয়ে বললে হবে? তুমি তো একটা ডিভোর্সী মেয়ে, তার ওপর আবার অন্য ছেলের সাথে একসাথে বসবাস করো। তোমাদের আধুনিকতার ভাষায় কি যেন বলে লিভ টু গেদার। ছিঃ ছিঃ।"
-----"শুনুন কাকু, আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে কোনো খারাপভাবে ভাষায় কথা বলবো না। কিন্তু,,,,, একটা কথা বলি, লিভ টুগেদার মানেই যে আমার সাথে মৃণালের শারীরিক সম্পর্ক আছে, তা কিন্তু নয় কাকু। যেই ভুল ধারণা আপনাদের রয়েছে। আমি আর মৃণাল খুব ভালো বন্ধু।"
-----"ইস্। কি অভদ্র ভাষা মুখে। ছিঃ জঘন্য!"
মৈনাক এতক্ষণ সব চুপ করে শুনছিল, তবে এবার আর ও মৌটুসিকে কোনো কথা বলতে দেয়নি। ও নিজেই সেই ভদ্রলোককে বলল-----"আমি দুঃখিত কাকু। কিন্তু বিশ্বাস করুন কাকু, এতে মৌটুসির কোনো দোষ নেই। আমিই ওকে আমার এই ফ্ল্যাটে থাকতে বলেছি। আর মৌটুসি আমাকে বেঁধে রাখেনি। যদিও কথাটা মৌটুসি জানে না, তবে প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন বলি, আমি মৌটুসিকে ভালোবাসি। তবে বাবা মা'র অমতে আমরা বিয়ে করবো না। তবে মৌটুসিকে বিয়ে করার ইচ্ছেটা আমারই। ও কি চায় তা আমার জানা নেই।"
-----"সবই তোমাদের ইচ্ছেতেই তো হচ্ছে। ছাড়ো তো। যত্তসব নাটক!" এইকথা বলে মৈনাক পরিচিত সেই ভদ্রলোক চলে গেলেন।
তবে মৈনাকের মুখের কথাগুলো শোনার পর মৌটুসি ওর মুখের দিকেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর দুই চোখে জল টলটল করছে। মনে পড়ছে ওর আগের জীবনটার কথা। মৌটুসি ছিল বাড়ির বড় মেয়ে। ওরা তিন বোন। বাড়ি থেকে একরকম জোর করেই মৌটুসির বিয়ে দিয়েছিল। বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়ের জন্য বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ এলে যা হয় আর কি! মৌটুসির শ্বশুরবাড়ির রকমাটা তো বেশ ভালো ছিল। কিন্তু মৌটুসির বরের যে অনেক মেয়ের সাথেই সম্পর্ক ছিল, বিয়ের পর সেটা মৌটুসির জানতে বেশি সময় লাগেনি। প্রতিবাদ করতে গেলে স্বামী আর শাশুড়ির হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছে। বাপেরবাড়িতে বলাতে তারা বলেছে, মানিয়ে নিতে, এটাই নাকি মেয়েদের ধর্ম। এত অত্যাচার মৌটুসি আর সহ্য করতে না পেরে নিজেই সাহস করে স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। থানায় অভিযোগও করেছিল। পুলিশও ওকে সাহায্য করেছে। নিজের কিছু গয়নাগাটি বেচে প্রথমে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকবে বলেই ঠিক করেছিল। তারপরে একটা চাকরি জোগাড় করবে ভেবেছি। পেটে কিছু বিদ্যে তো ছিলই। কিন্তু তখন ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল মৈনাকে। মৌটুসিকে একরকম জোর করেই ওর বাড়িতে এনে রেখেছিল মৈনাক। আর তারপর থেকে এখানেই থাকা। মৈনাকের মা বাবাও এর জন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখে না। তাদের কাছেও ছেলে নাকি আধুনিকতার জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। তারাও ছেলেকে বুঝতে চায় না।
-----"কি রে মৌ, কি ভাবছিস? তোর চোখে জল কেন? সিগারেটটা শেষ হল তোর?"
-----'"তুই এগুলো কি বললি উনাকে? তুই জানিস না, এই সমাজের চোখে আমি অপরাধী? তাও তুই আমায় ভালোবাসিস?""
-----"হ্যাঁ, তোকেই ভালোবাসি। তবে এই তোকে নয়, আগের তোকে। তুই নিজেকে অনেক পাল্টে ফেলেছিস। এখন অনেক সাহসী হয়ে গেছিস, লড়তে শিখেছিস। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুইই তো আধুনিক মেয়ে। তোকে দেখে মেয়েরা শিখবে। মনের জোর পাবে। তবে শুধু সিগারেটটা আর খাস না। আধুনিকতা মানে কিন্তু উৎশৃঙ্খলতা নয়। তোকে এটা মানায় না। এতে তোরই ক্ষতি। আর আমি চাই না তোর ক্ষতি হোক। ছেলে আর মেয়েতে আমি ফারাক দেখি না। তাই আমি একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে বলছি, ধূমপানটা মোটেও ঠিক নয়। এটা ছেড়ে দে। "
-----"তুই যা বললি, তাই হবে। আমি প্রমিস করলাম।"
এই বলে মৌটুসি মৈনাককে আঁকড়ে ধরলো। মৌটুসির চোখের জলে আজ মানিকের জামা ভিজে যাচ্ছে। মৈনাকও মৌটুসিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।