আচার অনাচার
আচার অনাচার


আমরা ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠি আচার আচরণে নানান বিধি, নিষেধের আবহে। কোন বাড়িতে মাত্রাটা বেশী, কোথাও একটু শিথিল। এই বিধি নিষেধ গুলো তৈরি হয় মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারকে(কু) অবলম্বন করে। ধর্মযাজকেরা বিভিন্ন সময়ে নিজ প্রয়োজনমত ওইগুলি পরিবর্ধন এবং পরিবর্তন করে পরিবেশন করেন। আর আমাদের ঘরে ঘরে তা রুপায়নের দিকটি নিষ্ঠার সঙ্গে তদারকি করেন বয়স্কা মহিলারা। অণু পরিবারে শতেক সমস্যা থাকলেও এই একটা ব্যাপারে তারা তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ। অবশ্য কিছু প্রথিতযশা মাসিমা/কাকিমা আত্মীয়পরিজনএমনকি প্রতিবেশীদেরও যে কোন কাজেই, তারা চাক বা না চাক, গিয়ে হাজির হন এবং অবশ্যই কিছু বিধি নিষেধের ফিরিস্তি শুনিয়ে আসেন। দিন দুয়েক হল অভিজিৎ এর মা গত হয়েছেন। খবর পেয়েই পিসিমা চলে এসেছেন। অভিজিৎদের খুব ভালবাসেন। মহিলার সব ভাল সমস্যা একটাই, অতি মাত্রায় সংস্কারাচ্ছন্ন। অভিজিৎ ছোটবেলা থেকেই গ্যাস অম্বলে ভোগে। হবিষ্যির আতপ চাল আর ঘি কোনটাই তার সহ্য হয় না। তাই মেনুতে সামান্য বদল করে আতপের জায়গায় সিদ্ধ চাল আর ঘি এর জায়গায় মাখন খেয়েছিল। প্রথম দিন পিসি একবেলার জন্য বাড়ী গিয়েছিলেন। হবিষ্যি পর্ব নির্বিঘ্নে কেটেছে। পিসি সন্ধ্যেবেলা ফিরে এসেছেন। দ্বিতীয় দিন সকালে হবিষ্যির আইটেম দেখে পিসি আঁতকে উঠলেন। জানালেন যে অবিলম্বে আতপ চাল আর ঘিতে ফিরে না গেলে অভিজিৎ এর ইহকাল এমনকি পরকালেও বিপদের শেষ থাকবে না। শুধু তাই নয়, পুত্রের এ হেন অনাচারের জন্য তার মায়ের নাকি পরলোকে সঠিক পুনর্বাসন পেতে বেশ সমস্যা হবে। এরপর কোন কথা চলে না। অগত্যা অভিজিৎকে সেই সনাতন মেনুতেই ফিরতে হল। ফল পেতে বেশী সময় লাগেনি। দিন পনেরর মধ্যেই গ্যাস্টিকের জ্বালায় ডাক্তার ডাকতে হল।
অসুস্থ অভিজিৎকে দেখতে এসে পিসিমার খেদোক্তি– সবই করলি অথচ কেন যে বাবা ওই একদিনের জন্য নিয়মটা ভাঙলি! একটু ভুলের জন্য কত কষ্ট পাচ্ছিস বলত!
অভিজিৎ এর বলার কিছু নেই। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে ফ্যালফ্যাল করে পিসির মুখের দিকে চেয়ে রইল।
এক বৃদ্ধা মারা গেছেন। ভদ্রমহিলা শেষ জীবনটা তাঁর একমাত্র মেয়ের বাড়িতে কাটিয়েছেন। কাকিমার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শুভেন্দু এসেছে। শুভেন্দু মাঝে মাঝে এসে কাকিমার খোঁজ খবর নিত। কাকিমার মুখাগ্নি সে করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের কূল পুরোহিত বিধান দিয়েছেন যে, কয়েকমাস আগে তার আর এক নিঃসন্তান কাকিমার সে মুখাগ্নি করেছে তাই, শুভেন্দুর অশৌচ চলছে। অশৌচ অবস্থায় এই কাকিমার মুখাগ্নি করা তার চলবে না। জামাই সব কাজকর্ম করেছিল। শ্রাদ্ধের জন্য সেই পুরোহিতকেই ডাকা হয়। জামাই একসময় তাকে জিজ্ঞেস করে যে কারো বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে যদি মা মারা যায় তাহলে কি হবে? ছেলেটি মার সব কাজকর্ম করবে, না তার অশৌচ চলছে বলে মায়ের ক্রিয়াকর্মের জন্য অন্য লোক খুঁজতে হবে। পুরোহিত কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। অবশ্য লোকটা চতুর হলে আর একটা স্বরচিত বিধান দিয়ে বাবা/মায়ের ক্ষেত্রে স্পেশাল ছাড় ঘোষণা করে দিত।
ছোট থেকে দেখে আসা নিয়ম-নীতিগুলো নিজের অজান্তেই আমাদের মনে জায়গা করে নেয়। যত না বিশ্বাসে তার থেকে অনেক বেশী অভ্যাস আর লোকলজ্জার কারণে আমরা সেগুলি মানি।
ক্লাবের পিকনিক। শুনলাম, বিশুদা যাচ্ছে না কারণ, কিছুদিন আগে মা মারা গেছে আর পিকনিকের দিনেই প্রথম একাদশি। মতটা যদি পাল্টায় এই আশায় ওর বাড়িতে গেলাম। পিকনিকের কথা বলতেই মাথা নাড়িয়ে বলল- আমি তো আগেই বলেছি ওদিন একাদশী, যেতে পারব না।
বললাম- তোমার জন্য আলাদা রান্না হবে।
--না না, ওখানে সব ঠেকাঠেকি হবে। আর আমি তো সাবু, ফল মিষ্টি, এসব খাবো।
এতো মহা গেরোয় পড়লাম। বিশুদা না গেলে তো পিকনিকটাই মাটি। বিশুদা জলের লোক। জলপথেই এগোলাম।
মুখটা একটু চিন্তান্বিত করে বললাম- তুমি যাবে না আগে জানলে অতগুলো বোতল কিনতে বারণ করতাম।
--মায়ের মুখাগ্নি করেছি। একাদশীর দিনে মদ খাওয়ার কথা বলছিস কি করে?
-- চিবাস রিগাল ছাড়াও আরো কি সব দামী দামী মদ এসেছে। নষ্ট হলে গায়ে লাগবে। দেখি ওগুলোর এখন কি ব্যবস্থা করা যায়।
টোটকায় কাজ হয়েছে।
ব্র্যান্ডের নাম শুনে বিশুদার মুখটাই পাল্টে গেল। বলল— জিজ্ঞেস না করে কিনেই সমস্যা করলি। যাকগে,পাঁচকান করিস না। আমি সময়মত পৌঁছে যাব। স্পটে পৌঁছে চিবাস রিগালের জায়গায় সস্তার মাল দেখে দু পাঁচ কথা শোনালেও অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। পরিচিত একজন তার বাড়ী থেকে পাটিসাপটা এনে দিয়েছিল। সেদিন আচার আর নিষ্ঠার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বিশুদা। গ্লাসে মদের সাথে পরিমাণ মত সোডা মিশিয়ে পাটিসাপটার প্লেটের পাশে রাখল। তারপর পকেট থেকে বার করল ছোট একটা কাগজের ঠোঙা। ভাবলাম চাঁটের বাদাম বা চানাচুর। আমাদের ভুল প্রমানিত করে ঠোঙা থেকে কটা তুলসি পাতা বার করে গ্লাসে ফেলে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করল। বুঝলাম দোষ কাটাচ্ছে। তারপর গ্লাসের থেকে মিশ্রিত সুধা অল্প একটু হাতে ঢেলে তা প্লেটের চারধারে ঘুরিয়ে আচমন করে মুখে দিল। ভাবা যায় না। আর পাটিসাপটা দিয়ে পেগের পর পেগ মদ খেতে আমি দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। তবে কথা রেখেছিল। সজ্ঞানে আমিষ স্পর্শ করেনি। চার পেগের পরে অবশ্য আর কোন বিধি নিষেধ কাজ করেনি।
জাতপাত আমাদের দেশের এক ভয়ংকর ব্যাধি। সৌভাগ্যবশত পশ্চিমবঙ্গ এর প্রকোপ থেকে অনেকটাই মুক্ত। তবে আজও কুড়াওয়ালা বা মেথরকে ঘরের চেয়ারে বা সোফায় বসতে দিতে অনেকেরই একটু দ্বিধা হয়। হিন্দি বলয়ের মত অতটা না হলেও একটু পিছিয়ে গেলে আমাদের পরিচিত বলয়েও এর প্রাদুর্ভাব ছিল ঘরে ঘরে।
শ্রাবণীর তখন ছ সাত বছর বয়স। বাড়ির পাশেই মুদির দোকানে গিয়েছিল লেবু লজেন্স কিনতে। ফেরার সময় দেখে রকে একটা গোলগাল বাচ্চা বসে রয়েছে। ও বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে শুরু করল। বাচ্চাও আদর পেয়ে খিলখিল করে হাসছে। ওদিকে বিধবা ঠাকুমা তখন টুকটুক করে চলেছেন বাড়ী লাগোয়া পুকুরে স্নান করতে। নাতনির কান্ড দেখে বুড়ি আর্তনাদ করে উঠলেন—বৌমা, তোমার মেয়ে জাতধম্ম কিছু আর রাখলে নাকো।
চেঁচামেচিতে মালতী বাইরে আসতেই – দেখো, নিজের চোখে মেয়ের কান্ড দেখো। ঘরে ঢোকাবার আগে গায়ে একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিও
।বুুড়ির চেঁচামেচির কারণ শিশুটি মেথরানীর মেয়ে। ওকে বসিয়ে ওর মা আশপাশের ময়লা পরিষ্কার করছে। বুড়ি চোখের আড়াল হতেই মালতী মেয়ের থেকে কটা লজেন্স নিয়ে বাচ্চাটাকে দিয়ে একটু আদর করে ঘরে গেল।
বুড়ি যখন কাচা জামাকাপড়গুলো পাশে রেখে ঘাটে স্নান করতে নামছে, মেথরানী তখন বাড়ির পিছনের নর্দমা পরিষ্কার করছে।
ওকে দেখেই হুঁশিয়ারি—অহল্যা, জামাকাপড় গুলো যেন ছুয়ে দিস না।
--না মা তা কেন হবে?
একটু পরেই জলে কিছু পড়ার আওয়াজ হল আর “মাগো, মরে গেলাম” চিৎকার। অহল্যা ফিরে দেখে বুড়িমা আছাড় খেয়ে ঘাটে পড়ে রয়েছেন, শরীরের বেশিটাই জলের নিচে। অহল্যা ভাবছে বৌদিকে ডাকবে কিনা।
--হাঁ করে দেখছিস কিরে মুখপুড়ি, মরে গেলে তবে তুলবি।
--না মানে আমি তোমায় ছোঁব?
--ওরে মাগী, না ছুঁয়ে কি তোলা যায়?
হারু পাগলা ওদিক দিয়ে যাচ্ছিল। উদ্ধারকাজে সেও নেমে পড়ল। মাথার দিকটা হারু ধরতে যেতেই ওই অবস্থাতেও ঠাকুমা হা হা করে উঠল—অহল্যা মাথার দিকটা তুই ধর, ওর তালের ঠিক নেই, ফেলে দেবে।
মালতীও চলে এসেছে। হারু পাগলা ব্যস্ত মানুষ।পাড়া পরিক্রমায় যাওয়ার আগে বুড়ির দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠল—বলত আমার বাড়ী কোথায়? নেই তো বলবি কি? --বলত আমার জাত কি? নেই তো বলবি কি।
এই প্রশ্ন ও উত্তরের সেট জানি না কেন মাঝে মঝেই ও আওড়ায়। হয়ত সাধারণের থেকে একটু আলাদা বলে। নর্দমা পরিষ্কারের সাথে সাথে অহল্যার স্পর্শে সেদিন বুড়ির অন্তরের ময়লাও কিছুটা হলেও সাফা হয়েছিল। কারণ, বুড়ি পরে আর অতটা স্পর্শকাতর ছিল না।