শক্তিমতী
শক্তিমতী
কি যে বলা যায় এমন সব ঘটনাটাকে,
নিশুতি রাতের অভিযান!
কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাইনা যে !
তাও আবার বাড়ির কাউকে না জানিয়ে।
আসলে তখন বোধহয় পরিবেশ পরিস্থিতি,
নির্মল ছিল এতটাই,
যে বছর দশেক বয়েস হলেও
মনটা তখনও কলুষিত হতে পারেনি।
আসেনি মনে কোনো বিপদ আপদের আশঙ্কা।
মানুষ হয়ে জন্মে যেন পেয়েছি অধিকার,
সমস্ত জগতে খুশিমতো ঘোরবার।
এ তো আর জঙ্গল নয়!
দিন হোক বা রাত তাতে কি! মানুষ যেন স্বাধীন,
এমনি এমনিই মানুষকে আবার কিসের ভয়?
এমনকি সিঁদকাঠি দিয়ে, গায়ে সর্ষের তেল মেখে,
যে চোর চুরি করে, তার প্রতিও মমতা অসীম।
ওদের অভাব যে! গরু চুরি করে,
রাতের আঁধারে যারা পাচার করে!
তারা নিশ্চয়ই গরীবের হদ্দ,
তা না হলে কি কেউ গরু চুরি করে।
শুনেছি তো কাউকে গালি দিতে "গরুচোর" বলে। মানে, চোরেদের মধ্যেও নিকৃষ্ট গরুচোরকেই বলে।
প্রতি বাড়ি থেকে একজন করে লোক মিলে,
যোগ দেয় সেই গ্রামের পাহারা দেবার দলে,
মনে মনে ভাবি, ইস! আমিও যদি হতাম বড় ছেলে, ওদের মতো রাত জেগে বেশ ঘুরতাম এলেবেলে। আর হুইসেল বাজাতাম হাতে বাঁশী পেলে।
আসলে এভাবে বাঁশী বাজিয়ে,
চোরকে করতাম সাবধান, দূরে যেতে বলে।
ছয় ব্যাটারি টর্চ জ্বালাতাম আর মনে মনে বলতাম,
এ গাঁয়ে এসোনা, ধরতে পারলে কিন্তু কেউ মানবেনা,
যে,তুমি খুব গরীব,একবেলা পেট পুরে খেতে পাওনা। সবাই রেগে গিয়ে তোমাকে ফেলতে পারে মেরেও
তফাৎ যাও তফাৎ যাও।
মামার কলেজের বন্ধু ছিলো এক মামা পোদ্দার,
শহরের নামকরা এক ক্লাবের মেম্বার।
মামা তখন পাশের একটিমাত্র হাই ইস্কুলের মাষ্টার। সেই মামার বন্ধুদের ছিল দল এক নাটকের !
গ্রামে নাটক করতে এসেছিলো দলটি সেই নাটকের।
স্কুলের মাঠে, মামা বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরের।
সন্ধের পর একটু রাতে নাটক হবে শুরু।
মনটা আমার করছিলো কেমন যেন গুরুগুরু।
নাটকের দলের সব লোকজন, ড্রাইভার-খালাসী,
খাওয়া দাওয়া করবেন ওনারা মামার বাড়িতে।
ভারী মজা ! তবে কাটা পড়বে হয়তো একটা খাসী।
কাজে কাজেই মালতী দিদির হাজার কাজ সারাদিন।
খড়ির উনুনে রান্নাটাতো দিদাই করেছিলেন,
সাথে হয়তো মা ও ছোটোমাসিও ছিলেন।
কিন্তু জোগাড় যন্ত্র তো মালতী দিদিকেই করতে হবে।
বাসন কোসন সব ধুয়ে, মশলা বেটে দিতে হবে!
অন্য কেউ যে রাত্রি বেলা নাটক দেখতে যাবে,
এমন সম্ভাবনা মোটেও নেই।
পারমিশনও দেবেনা তাও জানি খুব ভালো করেই । সুতরাং আমার একমাত্র ভরসা ঐ মালতী দিদিই !
মালতী দিদির ছিলো জোড়া ভুরু,
ও যেন তখন আমার ছোট্টো একটি গুরু,
শ্যামলা রঙের মালতী দিদি শক্তিমতী মেয়ে,
মালতী দিদির বুদ্ধি বেশী অন্যদের চেয়ে,
উনুনের পোড়া মাটি খেতে পারে, বিস্কুট মনে করে। মালতী দিদি ধুনুচি নাচও নাচতে পারে।
কেরোসিন মুখে নিয়ে দেয় আকাশে ছুড়ে,
মশাল দিয়ে সেই শুন্যেই আগুন জ্বালাতেও পারে!
কিন্তু আমার বায়না না শুনে
ওর তখন আর কোনো উপায় নেই।
সারাদিনে কয়েকশো বার একই কথা বলে বলে, বোধহয় ওর মাথাটা অর্দ্ধেক দিয়েছি খারাপ করেই,
ভালোবাসতো খুব যে আমাকেই।
রান্নার জোগাড় করা হয়ে গেলেই
দুজনে দৌড় শুরু করি কাউকে কিছু না বলেই।
পিচের মসৃন কালো রাস্তায়।
সাতটার পর কোনো গাড়ি চলেনা হোথায়,
এটা তো জানা কথা সকলেরই।
তখন রাত অন্তত নটার বেশী নিশ্চয়ই!
চারদিক একদম শুনশান।
ঝিঁঝিঁপোকা রা কিন্তু বেশ করছিলো গান,
আকাশে চাঁদ ছিল কি না তা মনে নেই ।
দৌড় দৌড় আর দৌড়।
একসময় নাটকের জায়গায় পৌঁছে গেলাম ।
ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে কিছুটা দেখলাম।
গল্পটার মাথা মুন্ডু তো বুঝিনি কিছুই,
নাটক শেষ হলো, কি নাটক ছিলো কিচ্ছু মনে নেই। ওরা সব গুছিয়ে আসবে চড়ে ওদের গাড়িতে, মামাদের বাড়িতে রাতের খাবার খেতে।
সুতরাং নষ্ট করার মতো সময় একদম নেই হাতে। এবার শুরু হলো আমাদের ফেরত আসার পালা।
কলা কুশলীরা হয়তো তখন খুলছে গাঁদার মালা।
বাড়িতে আমাদের খোঁজ শুরু হলেই মুশকিল।
আবার শুরু দৌড়, গাড়ির আগেই হবে ফিরতে,
সে আমাদের, যতই ধুকপুক করুক এই দিল।
দুজনেই ছিলাম ফ্রক পরে।
একজন একটু বড়, আরেকজন একটু ছোটো।
চলছি যেন পরীদের মতোই আকাশে উড়ে।
সামনে যেন এক বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের!
ফিরতে হবে যে আগে ওদের সবার।
কেউ যেন আমাদের কির্তী ধরতে না পারে।
বাড়িতে আমাদের খুঁজে কেউ দুশ্চিন্তা না করে।
কোত্থেকে পেয়েছিলাম এত সাহস!
না না একে বলাই ভালো দুঃসাহস।
একটা বিরাট তেঁতুল তলাও ছিলো রাস্তার পারে। মাঝখানে পুরো রাস্তার বেশীরভাগই ফাঁকা দু ধারে, দু-চারটির বেশী বাড়ি ছিলোনা রাস্তার ধারে পাশে। দাঁড়িয়ে ছিলো ওরাও যেন একা, কেমন একপেশে।
এখন ভাবতে বসলে ভেবে অবাক হই ।
আমাদের মনে ভয় ডর কি ছিলনা কিছুই!
না মানুষের ! না ভূত-প্রেত, দত্যি-দানোর,
না ষাঁড় গরু, না রাগী বেড়াল, না কুকুর টুকুরের।
ফিরে আসি রাত দশটার কিছু পরে।
অবশ্যই আগে ঐ নাটকের দলের !
গা ছমছম একটু করছিলো বটে, একটু একটু শীতে,
তবে হেমন্তের নিশুতি রাতের ভূতের ভয়ে নয় ,
বাড়ির সবার রাগ থেকে রক্ষার কথাও ভাবতে হয়।
খাওয়া - দাওয়া, লোকজনের ভিড় আর হৈ চৈ,
ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিলো কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই।
