আমি সেই শিশু
আমি সেই শিশু
আমি সেই শিশু
সুশান্ত কুমার ঘোষ
বুলেট বিদ্ধ শরীরগুলো যখন লুটিয়ে পড়ছিল মাটিতে
আমি তখন আঁতুড় ঘরে ।
স্পর্ধিত বুট-বুলেটের গর্জন আর স্বজন হারা পড়শিদের
বুক ফাটা কান্নায় আমার ভূমি স্পর্শের প্রথম ক্রন্দন
আমার জন্মদাত্রী মাও হয়তো শুনতে পান নি ।
কিম্বা জল্লাদদের বর্বর উল্লাস আর লক্ষ লক্ষ স্বজন হারার
হাহাকার ধ্বনির মাঝে আমি হয়তো কাঁদতেই ভুলে গিয়েছিলাম ।
আমি সেই শিশু- যার প্রথম প্রশ্বাসেই
ফুসফুসে প্রবেশ করছিল বারুদ মাখা বাতাস !
আমি সেই শিশু – যার প্রথম নেত্রপাতেই
ভেসে উঠেছিল দল পাকানো লাশ ,
রক্তে ভেজা মাটি আর চামুণ্ডাদের তাণ্ডব !
আমি সেই শিশু – যার কানে প্রথম প্রবিষ্ট
শব্দটাই ছিল বুট- বুলেটের গর্জন !
আমি সেই শিশু – যার জন্মক্ষণে শাঁখ বাজেনি,
মসজিদ থেকে ভেসে আসেনি আজানের ধ্বনি ,
আমাকে অভিবাদন জানিয়েছিল জল্লাদদের পৈশাচিক উল্লাস,
আর লক্ষ লক্ষ স্বজন হারার বুক ফাটা হাহাকার !
আমি সেই শিশু – যার শরীর থেকে গর্ভ ভাঙা
রক্তের ছোপ ধোয়া হয়েছিল চোখের জলে !
আমি সেই শিশু – যে মায়ের বুকের প্রথম ওমটুকু
পাওয়ার আগেই শরীর সেঁকে গিয়েছিল গোলা বারুদের আঁচে !
আমি সেই শিশু – যে স্তন নয়
পৃথিবীতে যার প্রথম পানীয় ছিল মায়ের চোখের জল !
আমি সেই শিশু- যার আঁতুড় ঘরের চতুর্দিকে
ছড়িয়েছিল প্রিয়জনের লাশ !
সেই আত্ম জনের লাশ ছড়ানো বধ্যভূমির
মধ্যখানে একচিলতে আঁতুড় ঘরে একটা
সান্ত্বনার ফুলকির মত উঠে এসেছিলাম মায়ের বুকে!
পান করেছিলাম মায়ের চোখের জল !
আমি সেই শিশু- প্রিয় জনের আদর নয় ,
জন্ম মুহূর্তেই যার শরীরে লেগেছে
বারুদের ঝাঁঝ , রক্তের ছিটে – স্বজন হারার ছোপ !
আঁতুড় ঘরের বাইরে যখন এলাম
ততদিনে ঘরে বাইরে অনেক কোলই হারিয়ে গিয়েছে !
যাদের কোলে চেপে আদরের ওম মাখতে মাখতে
নতুন ভুবনের শব্দ- স্পর্শ- গন্ধ-বর্ণের
সমারোহ দেখতে দেখতে আমার খিলখিল করে হাসার কথা ,
সেই সব কোল হারিয়ে গেছে ।
তাদের হৃদয় উপচানো আদর , ভুবন ভাসানো
স্নেহের উত্তাপ আমার আর পাওয়াই হল না ।
তারপর একদিন ঘরের উঠোন পেড়িয়ে পা বাড়ালাম পথে,
যে ক’টি ভালবাসার হাত তখনো ছিল সেই হাত ধরেই
আধো আধো বোলে “ আমার সোনার বাংলা আমি তোমাকেই ভালবাসি”
গাইতে গাইতে পৌঁছে গেলাম পাঠশালার দরজায় ।
তখন থেকেই উন্মোচিত হতে থাকল জতুগৃহের একটার পর একটা অলিন্দ !
একটা নয় দুটো নয় – ওই দহন যজ্ঞে ভস্ম হয়েছে তিরিশ লক্ষ কোল !
অনুভব করলাম জন্মক্ষণেই বিসর্জন দিয়ে এসেছি তিরিশ লক্ষ
হৃদয়ের ভালবাসা – শুভকামনা আর সাগর উপচানো আশীর্বাদ !
কেবল বদ্ধ-ভূমিতেই শেষ নয় ,
হারিয়েছি আরও কয়েক লক্ষ কোল,
যারা স্বজন হারার শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল –
মিশে গিয়েছিল বিছানায় -
সেই সব কোল আর কোনোদিন পাতা হয়নি কারোর জন্য !
আমি সেই শিশু- সেদিন সেই বদ্ধ-ভূমির বারুদ মাখা বাতাসে
ভরে আছে যার ফুসফুস ! শরীরে লেপটে আছে চাপ চাপ রক্ত !
আকাশে বাতাসে স্বজন হারানোর হাহাকার !
প্রাপ্তি শুধু একটাই -
তিরিশ লক্ষ প্রাণের মূল্যে অর্জিত উপহার:
“স্বাধীনতা”!
আমিই সেই শিশু – যাকে তিরিশ লক্ষ নিহত প্রাণের
নিবিড় বন্ধন সুরক্ষা বলয় হয়ে ঘিরে রেখেছে ,
মুক্ত আকাশ মুক্ত বাতাস মুক্ত প্রাণের অবাধ ভূমিতে
স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পারবে বলে !
আজ আমি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছি তাঁদের সেই আত্মত্যাগের
সাধন বেদীর লাল সবুজের আনন্দনিকেতনে !
তবুও বেদনা জাগে !
চেতনা বিদ্রূপ করে বারবার !
বদ্ধ-ভূমির রক্ত ভেজা মাটিতে রোপণ করা
তিরিশ লক্ষ শহীদের প্রত্যাশার বীজ আজ বৃক্ষ হয়ে উঠেছে তো !
দুমুঠো ভাত – একটা আস্তানা ,
একটু শান্তির জীবন যাপন !
যার জন্য তিরিশ লক্ষের আত্ম দান!
ওটা অপূর্ণ থেকে গেলে ওদের আত্মা যে শান্তি পাবে না !
তাই আজ জনে জনে নিতে হবে ভার
সব মুখে অন্ন চাই বস্ত্র জনে জনে ,
শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের নিবিড় বাঁধনে
ছায়াঘন শ্যমলীন শান্ত পরিবেশে
জীবন থাকবে সুখে এই বাংলায় !