Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Debabrata Mukhopadhyay

Classics

5.0  

Debabrata Mukhopadhyay

Classics

স্বপনবাবুর ডায়েরি

স্বপনবাবুর ডায়েরি

19 mins
1.0K


প্রতিদিন আমি স্বপ্ন দেখি আর সেগুলো মনেও রাখতে পারি । আমি মুখ ধোওয়ার আগে সেই স্বপ্ন লিখে রাখি ।আমি দেখেছি দাঁত ব্রাশ করার পর স্বপ্নগুলো কিছুতেই মনে করতে পারি না ।ব্রাশ করার পরই স্বপ্নগুলো মাথা থেকে কুলকুচিতে বেরিয়ে যায় । তাই ঘুম থেকে উঠেই আমি রাতের স্বপ্নটা লিখে রাখি ।প্রথম যেদিন এটা আমি শুরু করি – আমার স্ত্রী প্রতিমা ভয় পেয়ে গিয়েছিল ।ঘুম থেকে উঠেই আমি একটা ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করেছিলাম ।খুব চিন্তিত মুখে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল , ‘কি হয়েছে’ ?

-লিখে রাখছি । 

-কি?

আমি উত্তর দিইনি ।উত্তর দিতেই হবে এমন বৈবাহিক বশ্যতায় আমি অভ্যস্ত নই।

প্রতিমা আবার প্রশ্ন করেছিল, ‘কি লিখছ ? গল্প না কবিতা?’

উত্তর না দেওয়াতে আর প্রশ্ন করেনি। উত্তর দেওয়াই যেত, গল্প নয় , তবে গল্পের মত ।স্বপ্ন সততই জলপ্রপাতের মত । জলপ্রপাতের আপনি শুরুটা দেখেন নি, শেষটাও নয় ।অবিরাম মধুর শব্দ নিয়ে অফুরান জলরাশি পড়েই চলেছে ।সেইরকম খন্ডচিত্রের মতই স্বপ্ন । মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্ন ও কবিতা খুব কাছাকাছি ।কবিতা নয়, তবে কবিতা দিয়েই তৈরী । যেমন বাড়ি ইট দিয়ে তৈরী হয় , কিন্তু বাড়িটাকে ইট বলা যায় না । অথবা বলা যায় রাতের স্বপ্ন খানিকটা শিশিরের মত , রোদ্দুরে মিলিয়ে যায় , কথা বললে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না । যেন একটা কুয়াশার মধ্যে ডুবে থাকা ঘর , বাড়ি , বন, নদী, রাস্তা , তাদের রঙগুলো মায়াময় । স্মৃতিচারনের সময় কথা বলতে নেই ।শুধু ঘুম চোখে দেখতে হয় সেই ছবি ।চোখের সামনে ওরা আসে রিপ্লে হবার মত ।চলমান হয় ,কথা বলে , কিন্তু শব্দ হয় না ।আমি লিখতে থাকি সবটা ।  

ঘুম থেকে ওঠার পর একটা জড়তা থাকে । আমি দেখেছি সকালে দরজার তালা খুলতে গিয়ে তালার ভেতর চাবিকে প্রবেশ করাতে অন্যসময়ের মত তাড়াতাড়ি করতে পারিনা ।তালাটা , চাবিটা, দরজাটা তখন সবাই ঘুমোয়। তাদেরও ঘুম ভাঙতে দেরি হয় ।কিন্তু স্বপ্ন লেখার সময় কলমটা যেন ছবি আঁকে । বেশ দ্রুত লেখে ।বেশ দ্রুত ।আমার প্রথম স্বপ্নটা লিখেই বুঝতে পেরেছি প্রতিমা শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য রাখছে । আমার কলম যেন নিজে নিজে চলছে আর আমি যেন স্থিরদৃষ্টিতে সবিষ্ময়ে কলমের দৌড়োনো দেখছি ।শেষ হতেই আমার মনে হয়েছে বিষয়টা নিতান্ত ব্যক্তিগত। গোপনীয়তা দরকার।তারপর থেকে আমি সযত্নে ও গোপনে একরাশ স্বপ্ন জমিয়েছি ।

আমি প্রতিমাকে একদিন প্রশ্ন করেছি, ‘তুমি স্বপ্ন দেখো’?

-কী , প্রতিমা রুটি তৈরি করছিল । রান্নাঘরটা বেশ গরম । তার ওপর এখন মে মাস ।মে মাসের সন্ধ্যায় তপ্ত চাটুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে এমন অভাবিত প্রশ্নটা প্রতিমা আর একবার শুনতে চাইল ।

আমি ভয়ে ভয়ে আবার প্রশ্ন করি

-তুমি স্বপ্ন দেখ রাত্রে, ঘুমিয়ে ?

একটা রুটি বেশ মনমত গোল হয়ে ফুলে উঠল ।তাতে প্রতিমা মোটেই পুলকিত হল না , আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বাড়ির ঝি বৃত্তি করতে গিয়ে স্বপ্ন টপ্ন আর আসে না । যাদের কাজ কম , ওইসব কবি , সাহিত্যিকরা স্বপ্ন দেখে ।রান্না করা , বাসন মাজা , ঘর গোছানো , কাপড় কাচা এই করতেই দিন শেষ, রাত্রে যদি শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতে হয় তাহলে সকালে আর চা ও পাবে না ।স্বপ্ন চিবোতে হবে’ । আমি চুপ ।নিজেকে মনে মনে একটু তিরস্কার করলাম । অকারণ প্রশ্ন করে গোলা বারুদ আমন্ত্রণ করার কোনো মানে হয় ?প্রতিমা তখনও থামেনি । বলে যাচ্ছে ।‘পেট গরম হলে কখনো কখনো দেখি , তুমিতো সারা রাত্রি বক বক কর , ইংরাজীতেও কথা বল, চিৎকার কর ,আকাশে ঘুঁষি ছোঁড়ো । একটা করে ঘুমের ওষুধ খেয়ো তো’ ।বাপরে বাপ , একটা ছোটো প্রশ্নের কত বড় উত্তর এবং তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে । মে মাস , খুব গরম , অতএব নীরবতাই শ্রেয় । আমি চুপ করে যাই ।প্রতিমা একা বলে যায় ,ওর জীবনের স্বপ্ন কিভাবে এই সংসারে এসে শেষ হয়ে গেছে । গান নিয়ে স্বপ্ন ছিল । রাগসঙ্গীত চর্চা করেছিল । লেখাপড়াও শিখেছিল । কিন্তু একটা বিচ্ছিরি পরিবারে এসে গান, লেখাপড়া সবটা ভুলে যেতে হল । একটা কষ্ট আমি খুঁচিয়ে তোলার জন্যে নিজেকে আরো একবার দোষ দি ।তাড়াতাড়ি পূবের বারান্দায় চলে যাই ।

আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না কত স্বপ্ন জমিয়েছি আমি। অনেক অনেক ।কোনোটা খুব ছোট, কোনটা বেশ বড় ।স্বপ্নের পুঁজিতে আমি ছোটোবেলার একটা স্বপ্নের আক্ষেপ লিখে রেখেছি । একটা স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম দশ বছর বয়েসে ।আমি একটা কাকের সঙ্গে উড়ছি ।প্রথম দিকে উড়তে পারছিলাম না ।তারপর পারলাম ।কি অনাবিল আনন্দ, আমি শহরের বড় রাস্তার ওপর দিয়ে, বিপজ্জনক আনন্দ নিয়ে উড়ছি একটা সুন্দর কাকের সাথে ।বাড়ির মাথার ওপর দিয়ে, ট্রামলাইনের তারের পাশ দিয়ে উড়ছি । সবাই আমায় দেখছে ।আমি একটা পথে নামতে সবাই ছুটে এসেছে । আমি তাদের বলছি কিভাবে ওড়া যায় । উড়তে চাইলেই ওড়া যায় । শুধু নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হবে –কোনো ভয় নেই ।ওদের সাথে কথা বলেই আমি আবার লাফিয়ে উঠেছি আকাশে , আবার সেই সুন্দর কাকটা আমাকে নিয়ে বসল উঁচু চিলছাদে, সেখান থেকে টেলিফোনের তারে । ব্যাস, আমি টেলিফোনের তার ছিঁড়ে পড়ে গেলাম , ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখি, ছোটমামা ডাকছে ।

-কিরে এত বেলা অবধি ঘুমোচ্ছিস ?

আমার ভীষন আক্ষেপ ছোটোমামা আমার স্বপ্নটা মাঝপথে বিনষ্ট করে দিয়েছিল ।আমি অনেকদিন ধরে আকাশে ওড়ার সুস্পষ্ট অনুভূতি পেতাম, মনে হত আমি চেষ্টা করলেই উড়তে পারব । একবারে শেষ বিকেলে ছাদের ধারে দাঁড়িয়েছিলাম , আকাশকে বলছিলাম , দাও আমাকে আবার পাখি করে দাও ।উদ্বাহু হয়ে ছাদের প্যারাফিটের ওপর দাঁড়িয়ে ওড়ার অশিষ্ট আবেগ অনুভব করছিলাম , আর সেই মুহুর্তে ঝপ করে আমায় টেনে নিয়েছিল আমার ছোটোমামা ।আমার ওড়ার পথে একমাত্র অন্তরায় আমার এই অপ্রয়োজনীয় মোটাসোটা মাতুল ।যাহোক, কেন আমি ছাদের আলসেতে উঠেছিলাম তার যথোচিত কারন দর্শাতে না পেরে সেদিন বাবা মায়ের তিরস্কার, মারধোর, উপদেশ সবকিছুই কপালে জুটেছিল ।মামা শুধু তাকিয়েছিল , আমাকে রক্ষা করার কোনো তাগিদ দেখায় নি ।সকলের মাতুল ভাগ্যতো ভালো নয় এমনকি ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরও ভালো ছিল না ।

প্রথম স্বপ্নটা অর্থাৎ যে স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আমি লিখতে শুরু করেছিলাম সেটাকি আপনাদের বলেছি ? না , বলিনি। সে অনেকদিন আগের কথা ।দাঁড়ান , ডায়রি দেখে ডেটটা বলছি । হ্যা, উনিশশো পঁচানব্বই সালের নভেম্বর মাসের উনিশতম দিন ,অর্থাৎ ১৯/১১/১৯৯৫ ।দুপুর, একেবারে ভরদুপুর । হটাৎ দেখলাম কোথাও আগুন লেগেছে । জানলা দিয়ে আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে । আমি দৌড়োচ্ছি । সিঁড়ি দিয়ে নামছি , নেমে তাকালাম – যেটা জ্বলছে সেটা আমাদের অফিস – যে অফিসে আমি কাজ করি ।পাশে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রমহিলা কাঁদছেন ।

-কি হয়েছে ?মহিলাকে আমি প্রশ্ন করি ।ভদ্রমহিলা ফোঁপাচ্ছেন , কথা বলতে পারছেন না।

-কি হয়েছে ? আমি আবার প্রশ্ন করি ।

-আমি নামতে পারিনি, আমি মরে যাব ।

তারপর ভদ্রমহিলা আর আমার পাশে নেই । আমিও চারপাশে তাকাই , সবাই ওপরে তাকিয়ে হৈ হৈ করছে । এক ভদ্রমহিলা ধোঁওয়ার ভেতর থেকে চিৎকার করছেন , ‘আমি নামতে পারিনি , আমায় দয়া করে নামান’ ।এদিকে আমারও খুব গরম লাগছে । আগুনের তাতে আমি ঘামছি , ভদ্রমহিলা তার ফর্সা হাতটা বের করে আমাকে ডাকছেন ।স্বপ্নের ভেতরেও আগুনের তাপে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল ।এই স্বপ্নের দিন সাতেকের মধ্যে আমাদের অফিসে সত্যিই আগুন লাগে ।সে এক ভয়াবহ আগুন ।আমি অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছিলাম ।ফিরে এসে দেখি ফ্যান্সিলেনে আমাদের অফিসের তলা থেকেই গল গল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে । অফিসের সবাই প্রায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে ।সবাই বলছে আমাদের ফ্লোরের অন্য একটা অফিস ইউনিক কেমিক্যালস এর একটা স্টোরে আগুন লেগেছে ।আমাদের অফিসের সবাই নামতে পেরেছে , শুধু ইউনিক কেমিক্যালস এর একজন অ্যাকাউট্ট্যান্ট ভদ্রমহিলা অনেকক্ষন জানলা ধরে চিৎকার করছিলেন , তার কোনো খোঁজ নেই ।তিন ঘণ্টা আমি চুপ করে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসেছিলাম ।আশ্চর্য্য , স্বপ্নটা আগেই যেন আমাকে জানান দিয়েছিল ।অদ্ভুত লাগছিল । যে ঘটনা ঘটতে দেখি তা স্বপ্নে আসা সম্ভব, কিন্তু যা স্বপ্নে দেখেছি তা হুবহু পরে ঘটা রীতিমত অস্বাভাবিক । দমকলের চারটে ইঞ্জিন পাঁচ ঘণ্টাতে আগুন নিভিয়ে ফেলেছিল ।ভদ্রমহিলাকে অনেক আগেই নামান গিয়েছিল ।ধোঁওয়ায় দম বন্ধ হয়ে , অথবা হার্টফেল করে ভদ্রমহিলা মারা গিয়েছিলেন ।অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গেল ভদ্রমহিলাকে । 

কেন জানিনা আমার মনে হয়েছিল এক অলৌকিক ক্ষমতা আমি অর্জন করেছি । একটা স্বপ্ন পরবর্তীকালে ঘটতে পারে ?আমি ঘুমের মধ্যে যা দেখছি সেটা লিখে রাখতে হবে , মেলাতে হবে ।তারপর থেকে লিখছি ।লিখে ডায়েরিটা একটা গোপন জায়গায় রাখছি ।প্রতিমা আমার এইসব মুভমেন্ট দেখে খুব চিন্তিত ।আমি যে অ্যাভারেজ লোকের থেকে বোকা আর খানিকটা পাগল ইত্যাদি ব্যাপারগুলো প্রতিমা আবিস্কার করেছে । আমার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দুচারজনের সঙ্গে ও কথা বলছে ।আর এদিকে আমি লিখেই যাচ্ছি ।

এই করতে করতে আমার পাঁচ হাজার একশো একত্রিশ নম্বর স্বপ্নটা আমাকে চমকে দিয়েছিল ।দুহাজার পনেরো সালের পয়লা জানুয়ারি । রাত বারোটা হতেই চারপাশের শব্দের উৎপাত শুরু হল ।আকাশে অনেক আলো , আলোর বাজিও কম নয় ।নতুন একটা বছর আসলে কিসের এত মহা আনন্দ হয় কে জানে ! আমি বুঝতে পারলাম আজ ঘুমের ভেতর শব্দ হবে ।মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যাবে । প্রতিদিন বিশুদ্ধ ঘুম হয়না ।আর বিশুদ্ধ ঘুম হয়না বলেই হয়ত স্বপ্ন দেখে মানুষ ।কিন্তু আমি মনে করি আমার ভেতর স্বপ্ন একটা খবরের মত প্রবেশ করে । পরে যা হবে তা আমায় আগে থেকে জানায় । প্রিসাইন্সের মত ।সেদিন রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম ।একটা বাসের সঙ্গে একটা ছোটো গাড়ির ধাক্কা ।গাড়িটাকে সুস্পষ্ট দেখলাম ।ধাক্কাতে একেবারে তুবড়ে গেছে কালো গাড়িটা । সিটের ওপর ড্রাইভার আটকে গেছে স্টিয়ারিং এর সাথে ।মুখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। আমি বাস থেকে নেমে ছোটো গাড়িটার কাছে গেছি, আরে এত আমাদের চিত্ত ঘোষ । আমার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরেই থাকেন ভদ্রলোক ।

-আমাকে বাঁচান সুমনবাবু , আমাকে বের করুন , আমি এখনো বেঁচে যাব । চিত্ত ঘোষ আর্তনাদ করছেন ।

একটা পুলিশ সামনে এসে বাসের নম্বর আর গাড়ির নম্বর নিচ্ছে ।আমি চিৎকার করে উঠেছি , ‘আরে ড্যু সামথিং , লোকটা যে মরে যাবে’ !

-খবর দিয়েছি , আজ ছাব্বিশে জানুয়ারি, সব ছুটি ,অ্যাম্বুলেন্স আস্তে দেরি হবে ।

বাধ্য হয়ে আমি নিজেই হাত লাগিয়েছি । আমার সঙ্গে আশপাশের কয়েকজন চলে এসেছে । সবাই মিলে সামনের কাঁচটা ভাঙছি যাতে করে চিত্ত ঘোষকে বের করা যায় ।ব্যাস, এই পর্যন্ত । আমার স্ত্রী আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল। গেল স্বপ্নটাও ভেঙে ।

-সাড়ে সাতটা বাজে , কখন উঠবে, কখন অফিস যাবে ? প্রতিমা বলে ।

আমি উঠে পড়েছি । আমার লেখার টেবিলে গিয়ে বই-এর গভীরে সযত্নে রক্ষিত আমার ডায়েরিতে পাঁচ হাজার একশো একত্রিশ নম্বর দিয়ে পুরো স্বপ্নটা লিখে ফেলেছি ।অনেকদিন বাদে একটা চেনা মুখের মানুষ আমার স্বপ্নে এসেছে ।স্বপ্নটা আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়ে গেছে ।চিত্ত ঘোষকে ছাব্বিশে জানুয়ারি যেভাবেই হোক বাড়িতে আটকে রাখতে হবে ।অফিস থেকে ফিরেই চিত্তবাবুর বাড়িতে গেছি ।বাইরে নেমপ্লেটে লেখা চিত্তরঞ্জন ঘোষ ও জয়তি ঘোষ । বেশ সুন্দর বাড়ি । অনেকটা জায়গা নিয়ে । বড় গেটের ফাঁক দিয়ে দেখি কালো গাড়িটা গ্যারেজের ভেতর মার খাওয়া বেড়ালের মত লুকিয়ে আছে ।গাড়িটা আমাকে দেখছে যেমন ভূতে পাওয়া লোক ওঝাকে দেখে ।ভাবলাম গাড়িটাকে একটু শাসন করা উচিত কিনা!খান দুয়েক পদাঘাত করা যায় ওর দাঁত বার করা ইঞ্জিন কভারে! ইতিমধ্যে এক ভদ্রমহিলা দোতলা থেকে মুখ বার করে বললেন , ‘কাউকে খুঁজছেন’?

-হ্যা, আমি বললাম ।

-বেল বাজাবেন তো ! কোথায় থাকেন ?

-এ পাড়াতেই । চিত্তবাবু আছেন ?

-ও! আপনি কি সহেলীর বাবা?আমার চোখে চশমা নেই তো , তাই বুঝতে পারিনি ।এ হেঃ । আসুন আসুন । উনি একটু ঠাকুর ঘরে গেছেন ।আমি আসছি ।

আমি আজকাল কি কানে কম শুনছি ?চিত্ত ঘোষ তো জানি বিশুদ্ধ বামপন্থি । উনি ঠাকুর ঘরে গেছেন ! ঠাকুর দেবতাদের সঙ্গে কথা বলছেন ।আমি ঠাকুর শুনলাম না কুকুর শুনলাম ! ইতিমধ্যে ভদ্রমহিলা নিচে নেমে এসে দরজা খুলে দিলেন ।

-আসুন , আসুন সহেলী কেমন আছে , ওর গান কেমন চলছে ? 

-ভালো, আমি বললাম । তবে ওর নাম সহেলী নয় , ওর নাম সোনাই ।আর ও গান গায় না –বাথরুমেও গান গায় না । তবে অঙ্ক কষে । ওর অঙ্ক দেখলে আমার আতঙ্ক হয় ।

ভদ্রমহিলা এবার চশমাটা কাপড়ে মুছে নিয়ে বললেন , আশ্চর্য্য , সহেলীর বাবা একেবারে আপনার জেরক্স কপি ।

-তাহলে থ্রি ডাইমেনশনাল জেরক্স ।আমি ভদ্রমহিলাকে একটু হাসাবার চেষ্টা করলাম ।মোটেই কাজ হল না । ভদ্রমহিলার  সন্দেহজনক চোখ দুটো আমার পা থেকে মাথা পরিক্রমা করল । তারপর বললেন এখানে অপেক্ষা করুন । ভেতর থেকে একটা কুকুর মালকিনের সন্দেহের গন্ধ বুঝতে পেরে কুত্তিয় ভাষায় আমাকে ধমক দিল । আমি ভয়ে একটা নরম কোচে বসে পড়লাম ।নিজেকে ভীষণ বোকা লাগল ।সহেলীর বাবা হলে এতক্ষনে এক কাপ চা আর চায়ের কাপের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে দুটো বিস্কুট চলে আসতো । কি দরকার ছিল সোনাই এর বাবা হবার ।ইতিমধ্যে চিত্ত ঘোষ অর্থাৎ ভূতপূর্ব্ব বামপন্থি নেতা ভেতরে আসলেন ।

- আপনি তো সুমন মিত্র ?

- আপনি আমায় চেনেন ?  

-হ্যা, দেখুন আমরা বামপন্থি , আমাদেরতো কাজই লোক চেনা , মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ।আপনি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন , দুই মেয়ে ।

-না ! এক মেয়ে । আমি একটু হাসলাম ।বললাম, এক ছেলে এক মেয়ে ।

-চারজন ভোটার ।

মনে মনে ভাবলাম , লোকটা ভোট নিয়ে কথা শুরু করলে থামবে তো ?

-একটা কাজে এসেছিলাম , আমি বলি ।

-হ্যা, বলুন । এখন তো আমাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না , আমরা যেটা বলব সেটার উল্টো হবে ।চারপাশে কি হচ্ছে দেখছেন তো ?

আমি থামিয়ে দিলাম ।রাজনীতির নৈরাজ্যে আমি কিছুতেই ঢুকবো না।তাড়াতাড়ি বললাম,

-আপনি ছাব্বিশে জানুয়ারি কোথাও যাবেন না ।

চিত্ত ঘোষ খানিকক্ষণ আমায় দেখলেন ।তারপর গলাটা নামিয়ে বললেন , কেন? মানে আপনি হটাৎ এমন একটা উপদেশ দিচ্ছেন ! একটু ভেঙ্গে বলবেন ?

-এইটুকুই বলার ছিল ।আমি চিত্তবাবুর চোখে চোখ রেখে বলি ।

-আমার কোনো বিপদ ? 

আমি মাথা নাড়াই, যাতে বোঝা যায় আমি হ্যা বলছি ।

-একটু ডিটেলে বলা যায় না ?যেমন কি ধরনের বিপদ , কে টার্গেট করেছে , কোথা থেকে শুনলেন ? কতটা অথেন্টিসিটি । তারিখটাই বা কি ভাবে জানলেন ? 

- সবটা বলা যাবেনা , একটা দিন তো , বাড়িতে থাকুন না , আমি বলি ।

-একটু বুঝুন সুমনবাবু , ছাব্বিশ তারিখটা এড়িয়ে গেলে সাতাশ তারিখটায় বিপদ আসতে পারে !

-শুধু ছাব্বিশ তারিখ ।আমি সেন্টার টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা অকারণে টেনে নিই ।

চিত্ত ঘোষ আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন যেন আসন্ন বিপদের জন্যে আমিই দায়ী ।

-আমার ভায়রা এসিপি । অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার অব পুলিশ ।আমি ফোন করে ওকে জানাই , আপনি একটু কথা বলবেন । -না না , আপনাকে কেউ আক্রমণ করবে না ,পুলিশ ডেকে লাভ নেই । আমি এবার উঠি , অনেক কাজ আছে ।

-আপনি একটু বসুন না , চা খাবেন ? অথবা অন্য কিছু ? একটু বসে যান ।চিত্তবাবু অস্থির গলায় বললেন ।

-আমার বসার সময় নেই তা নয় , তবে আপনি ধৈর্য হারাচ্ছেন , আপনি আমাকেই সন্দেহ করছেন ।

-এসব কি বলছেন আপনি , চিত্তবাবু তাড়াতাড়ি আমার হাতটা ধরেন ।আপনি বললেন ছাব্বিশে আমার বিপদ আছে ।কিসের বিপদ জানাবেন না ?

-  দেখতে পেলাম । কখনো কখনো আগে দেখতে পাওয়া যায় ।সেক্ষেত্রে যে দেখতে পায় তার একটা দায়িত্ব এসে যায় ।

দু মিনিট নীরবতা । চিত্ত ঘোষ এবার ঠোঁট টিপে হাসছেন । হাসি দেখে বললাম, ব্যাপারটা হাল্কা করে নেবেন না । ইট উইল হ্যাপেন । ইট উইল ।

-হোয়াট উইল হ্যাপেন ? কি হবে ? আরে বলুন না কি দেখেছেন ? মানে প্রিসাইন্স । ঘটনা ঘটার আগে ঘটনা দেখেছেন , রাত্রে ? ঘুমের মধ্যে ? স্বপ্নে ?আরে বলুন না , আমি এসব বিশ্বাস করি ।

শেষ কথাটায় আমি বেশ আশ্বস্ত হলাম ।

-  হ্যা , স্বপ্নে , সুস্পষ্ট , আপনার গাড়িটার অ্যাকসিডেন্ট , আপনি ভীষণ ইঞ্জিওরড, ছাব্বিশ তারিখে , মনে রাখবেন ছব্বিশ তারিখে । আমি বলি ।

চিত্ত ঘোষ আবার হাসছেন মুখ টিপেই ।তারপর হাসতে হাসতে বললেন , ‘ ধন্যবাদ ।একটা কথা বলি , সন্ধের পর চা খাবেন না ।আপনি রাতের দিকে একটু করে খান , আমিও খাই, দু তিন পেগ । ব্যাস , ঘুমের মধ্যে এইসব হিজিবিজি ঢুকতেই পারবে না ।‘

-আমি আপনাকে সাবধান করে গেলাম ।আমার কাজ শেষ । আমি চিত্ত ঘোষের উদাসীনতায় রেগে যাই । 

হাঃ, হাঃ করে চিত্ত ঘোষ হাসতে থাকলেন । আমি দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলাম । গাড়িটাও আমায় দেখে দাঁত বার করে হাসছে ।চিত্ত ঘোষ উচ্চস্বরে বললেন , আমার গাড়ি নিয়ে আমি পঁচিশ তারিখে দীঘা যাচ্ছি । ছাব্বিশে আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে আসার সময় আপনাকে ডাকব সুমন বাবু । স্যরি , আজ থেকে আপনাকে আমি স্বপনবাবু বলব ।স্বপনবাবু , ও স্বপনবাবু , কি হোলো , চলে যাচ্ছেন কেন ?

আমি বড় গেট ঠেলে বেরিয়ে এলাম । ওনার কথার উত্তর দিলাম না । 

পরের দিন থেকে পাড়ায় আমি স্বপনবাবু হয়ে গেছি ।চিত্ত ঘোষ পাড়ার প্রতিপ্রান্তে আমাকে হাস্যকর করে তুলেছেন । মুদির দোকানের মালিক সন্তোষ বলেছে , ‘আপনি নাকি জ্যান্ত, জ্যান্ত স্বপ্ন দেখছেন , হিঃ,হিঃ ,একটা লটারির নম্বর দেখলে , কেটে নেবেন’।আমি কথার উত্তর দিই নি । ওই জন্যে বলে , “পরোপকারীকে বাঘে খায়” । মনে মনে সন্তোষকে বুনো মোষ বলে চলে আসি ।

চব্বিশ তারিখে ভোর পাঁচটায় কলিংবেল বাজল । এত সকালে কে কলিংবেল বাজাচ্ছে ? তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দেখি চিত্ত বাবু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছেন ।

-  কি হল ? আমি বিরক্ত হয়ে বলি ।

-  কিছু হয়নি , হবেতো ছাব্বিশ তারিখে ,আজ সবে চব্বিশ ।আজই দীঘা যাচ্ছি ।ছাব্বিশে ফিরব, বলে গেলাম ।

গাড়ি চলে যেতে দরজা বন্ধ করে ঘরে এসেছি । প্রতিমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে ।

-কে এসেছিল ?

- চিত্ত মহাধূর্ত ।

- তুমি ওকে ভয় দেখাতে গিয়েছিলে ?

-কি বললে ? আমি অবাক হয়ে প্রতিমার দিকে তাকাই ।

-উনি বাড়িতে এসেছিলেন দিন দশেক আগে । উনি ও ওনার স্ত্রী ।তোমাকে নিয়ে সত্যিই চিন্তায় পড়েছি।কি হয়েছে তোমার ?

আমি কথা বলিনা ।প্রতিমা বলে যেতে থাকে ।একসময় মনে হয় প্রতিমা কাঁদছে ।

-কি হল ? আমি বিষ্মিত হয়ে বলি ।প্রতিমাকে কাছে টেনে নিই ।

- তুমি একটু ডাক্তারের কাছে চল ।আমার কথা শোনো ।তোমাকে নিয়ে লোকে মজা করবে আমি সেটা সহ্য করতে পারব না ।ডাঃ বি.কে.সান্যাল খুব বড় ডাক্তার,ওনার হাতে বহু মেন্টাল পেশেন্ট ভালো হয়ে গেছে ।প্রতিমার শেষ কথাগুলো আমি আর বুঝতে পারছি না ।আবার আমার ঘুম পাচ্ছে ।আমার যখন ঘুম পায় আমার নাক দিয়ে কর্ত্তব্যরত ঢালাই মেশিনের মত শব্দ বেরোতে থাকে ।প্রতিমা একদিন রেকর্ড করে আমাকে শুনিয়েছে ।আমি বলেছি তুমি এটা অ্যামপ্লিফাই করে শোনাচ্ছ । এটা আমি নই , এটা আমি হতেই পারি না ।

পঁচিশ তারিখে দুপুরবেলা সোনাই আমায় ফোন করেছিল অফিসে ।

-বাবা , তুমি কি আমাদের পাগল করে দেবে ?

-কেন ,কি হল ? আমি প্রশ্ন করি ।সোনাই চুপ করে থাকে । পিছন থেকে ওর মা বলছে , বাড়িতে আসলে বলিস ।দূর থেকে এসব বলিস না ।

-কি হয়েছে ? আমি আবার শঙ্কিত হয়ে বলি ।

সোনাই বলতে থাকে , ওর কোনো বন্ধু নাকি ওকে বলেছে আমি সব সত্যি স্বপ্ন দেখি বলে ক্লেম করছি ।আমি বলেছি, চিত্ত জ্যেটুর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হবে , সবাই নাকি আমাকে স্বপনবাবু নাম দিয়েছে ...ইত্যাদি,ইত্যাদি।

-আমি রাখছি , বলে ফোনটা রেখে দি ।মেজাজটা শান্ত করতে প্রায় আধবোতল জল খেতে হল। না! আর কারুর ভালো মন্দে নিজেকে জড়ানো যাবে না ।অপরকে সাহায্য করতে যাওয়ার অনেক বিপদ আছে ।চিত্ত ঘোষের বাড়িতে না গিয়ে বেনামে ফোন করা যেত ,একটা বাঁহাতি লেখা চিঠি ওর লেটার বক্সে ফেলে দিলেই ও থানা পুলিশ করত । আর পুলিশের মত ভীতু সম্প্রদায় প্রায় নেই বললেই হয় । পুলিশ ওকে অন্ততঃ ছাব্বিশ তারিখে বেরোতে দিত না । এবার চিত্ত ঘোষের যদি কিছুই না হয় , ও নিশ্চই আমার বাড়িতে এসে আর একবার মুখ দেখাবে ,ওর ছেলেটা একটু গুন্ডাগোছের ।বলা যায় না কিছু সাধুভাষা শুনিয়ে দিয়ে যেতে পারে ।ভাবতে ভাবতে অফিসের কাজে অন্যমনস্ক হতে থাকি , একটা ভুল হয়ে যায় ।সামনের টেলিফোনটা তারস্বরে চিৎকার করছে , তা খেয়ালই থাকে না ।আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, ‘একটু দেখো , অন্ততঃ একটা ছোটো ম্যাটাডর দিয়ে চিত্তর ওই কালো কুচ্ছিত গাড়িটার পেছনে একটা মৃদু ধাক্কা দিও ।দেখো আস্তে করে মেরো ।পিছনে চিত্তর বৌটা বসবে। বেশ মিষ্টি টাইপের ভদ্রমহিলা । ওনার যেন কিছু না হয়’ ।ভগবান আছেন না নেই এখনও প্রমানিত হয়নি , তবে না থাকলেও তিনি শুনতে পান ।আমি তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পেলাম ।

সন্ধেবেলায় আমি বাদাম খেতে খেতে বাড়ি ফিরছি ।একটা একটা করে বাদাম খেলে অনেকটা পথ অতিক্রম করা যায় । তারপর তো সবাই বলছে আমার ব্রেনে পচন ধরেছে। অতএব বাদামের যে দাম হোক না কেন , আমি খাই । আর খেতে খেতে অ্যাডিক্ট হয়ে গেছি ।পঁচিশ তারিখেও আমি একমুঠো বাদাম নিয়ে খেতে খেতে ফিরছি । দেখি আমার বাড়ির সামনে অনেক লোকের ভিড় । প্রথমে আমার মনে হল, এটা নিশ্চই আমার বাড়ি নয় । একই রকম দেখতে অন্য কারুর বাড়ি ।তারপর সমবেত জনগণ আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল । বুঝলাম জনগণের লক্ষ আমি ,তৎসম ভাষায় যাকে ক্যালানো বলে , এরা বোধহয় তারই উদ্যোগ নিয়েছে ।কিন্তু তেমন কিছু হল না ।

-সুমনদা আপনি জিনিয়াস , একজন বললে ।

-আপনি কি করে বললেন ? একজন আমায় কথাটা বলেই জড়িয়ে ধরল ।

আমার হাত থেকে ঝুরঝুর করে দামী বাদামগুলো মাটীতে পড়ে গেল ।আমিও প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম , কিন্তু সবাই এত ঘনিষ্ট ছিল যে পড়ার যায়গাও ছিল না ।

-কি হয়েছে ? কোনোক্রমে বললাম ।

-চিত্তদার গাড়িকে একটা ময়লা ফেলার লড়ি ধাক্কা মেরেছে ।

- কিন্তু আজতো পঁচিশ , আমি বিড়বিড় করলাম ।

-বেঁচে গেছে , ছাব্বিশে মারলেতো ফটো হয়ে যেত ।এখন হাসপাতালে , মাথাটা স্টিয়ারিং এ ঠূকে গেছে ।হাতটা ভেঙ্গে গেছে ।যাহোক তেমন কিছুই হয় নি ।লোকে যেন চিত্ত ঘোষের এইটুকু ক্ষতিতে যথেষ্ট তৃপ্তি পায় নি ।জনগণ সবসময় বড় অ্যাকশান দেখতে চায় ।

-একজন ঘাসপন্থি ছেলে বলে উঠল , শালা বামপন্থিগুলো কিচ্ছু মানে না ।ভগবান মানে না , ভাগ্য মানে না , ভূতও মানে না ।

ভিড়ের মধ্যে থেকে আর একজন বলল , আপনাকে স্বপনবাবু নাম দিয়েছিল না ?বাড়ি গিয়ে বারন করে এলেন ,হিঃ হিঃ ।আমি তাকিয়ে দেখি বুনো মোষ সন্তোষ দাঁত বের করে হাসছে ।আমি একজন পুরো দস্তুর সেলিব্রিটির মত জনগণের ভিড় কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম ।আমার , ছেলে, মেয়ে , প্রতিমা সশঙ্কিত হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল ।

-  আমরা ভেবেছিলাম ওরা তোমায় .... প্রতিমা আর কথা বলতে না পেরে মুখে আঁচল চাপা দিল ।

আমার ছেলে সৌগত খুব কম কথা বলে । এবার ও মুখ খুলল ।

-ইউ নিড অ্যা ডক্টর ।চল আমরা তিন দিনের জন্যে কোথাও ঘুরে আসি ।

-পুরী , কালই চারজনে । ছুটি আছে তো । সোনাই বলল ।

-ঠিক আছে , আমি বললাম । ভেতরে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল । চিত্ত ঘোষের অ্যাকসিডেন্টটা আমাকে সঠিক প্রমাণ করেছে তাতে আমি খুশী, কিন্তু চিত্ত ঘোষের অ্যাকসিডেন্টটা আমাকে ততোধিক কষ্টও দিয়েছে ।তবে অ্যাকসিডেন্টটা আগে হল কেন ?এটাও আমি মেনে নিতে পারছি না ।হবেই যদি ছাব্বিশ তারিখেই হতে পারতো ।

যাহোক, আমরা পুরী এসেছি ।দুপুরে নোনা জলে লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে রাত্রে বেশ ভালোই ঘুম হচ্ছে ।কলকাতায় ফিরেই ডাঃ বি .কে.সান্যাল এর সঙ্গে দেখা করার কথা ।সৌগত অন লাইন অ্যাপয়ন্টমেন্ট করেছে ।ইচ্ছে না থাকলেও যেতেই হবে । ডাক্তারদের আমি সর্ব্বদাই এড়িয়ে চলি । হাসপাতালের পাতালে যে একবার প্রবেশ করেছে , সেই বুঝেছে ডাক্তাররা ডাকাতদের মতই পরিত্যাজ্য । কিন্তু সমবেত প্রয়াস ও সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা যায় না ।অতএব কলকাতায় এসেই ডাঃ সান্যালের চেম্বারে এসেছি ।প্রায় দুঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ডাঃ সান্যাল আমাকে দেখলেন ।অথচ প্রায় দেখলেন না ।চোখ বুঁজিয়ে আমার কথা শুনলেন ।তারপর প্রশ্ন করতে শুরু করলেন ।

-আপনি বলছেন একটা অদ্ভুত ক্ষমতা যেটা আপনি হটাৎ পেয়েছেন ।স্বপ্নে যা দেখছেন সেটা সত্যি ঘটছে ।এটাকে কি বলছেন আপনি । একটা আনকমন পাওয়ার ।এটা তো একটা আবিষ্কারও বলা যায় ।

-তা জানিনা । তবে এটা আনকমন ।

-নাহলে আমিও তো দেখতাম । আমি যদি দেখতে পাই যে পাশের বাড়ির ভদ্রলোক কাল একটা ছাদ থেকে পড়ে যাবেন আর আমারো যদি আপনার মত একটা ক্ষমতা থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমি তাকে সাবধান করতাম ।সে হাসাহাসি করবে আর পরের দিন ঘটনাটা ঘটলে সারা পাড়া আমার প্রত্যেকটা কথার দাম দেবে –দেবে কিনা ?

-হ্যা, সেটা তো...

-বলুন, দেবে কি দেবেনা ? বলুন ,প্রায় ধমক দেন ডাঃ সান্যাল ।আবার বলেন , হ্যা কি না?

-হ্যা ।

-গুড । কিছু একটা যেন খুঁজে পেলেন ডাঃ সান্যাল ।শান্ত গলায় বললেন,’গ্রান্ডীওজ ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার’।

-কি বললেন ?

-একটা ডিসঅর্ডার । ভুলে যান ।খুব প্রাইমারি স্টেজে আছে ।কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, পাড়া থেকে কিনবেন না । প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে আমার চেম্বারের পাশের দোকান থেকে নিয়ে যান ।ঘুম দরকার ।

-বিশুদ্ধ ঘুম । আমি মন্তব্য করি ।

-কারেক্ট , পিওর স্লিপ উইথাউট গেটিং রুইন্ড বাই নক্সাস ড্রিমস ।নিজের এই ক্ষমতাটা আপনার অক্ষমতা ভেবে নেগলেক্ট করুন ।নেভার গিভ এনি অ্যাডভাইস ট্যু এনিবডি , বিপদে পড়ে যাবেন ।যাক আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন , আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিন ।

আমি বেরিয়ে যাই । প্রতিমা শুনতে পেয়েছে কথাটা ।প্রতিমা নিজেই ঢুকে যায় ।

সোনাই আমাকে বলে , কিছু না , ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে । সবাই আজকাল ঘুমের ওষুধ খায় । তোমার তো তিনশো একটা টেনশন , তুমি ডাক্তার না দেখিয়েই খেতে পারতে ।

সৌগত বলে, হ্যা সেক্ষেত্রে এক হাজার টাকা বেঁচে যেত ।

সোনাই ওর দিকে কটকট করে তাকায় । বলে , তোরও ডাক্তার দেখানো উচিত । আমি সিওর তোকে দেখলেই ডাক্তার খান দশেক ওষুধ দেবে । সৌগত হাসে , কথা বলে না ।

অনায্য স্বপ্ন দেখার ফলে খান চারেক বিভিন্ন রঙের ট্যাবলেট বাড়িতে চলে এল ।এগুলো খেতে হবে ।

-এগুলোর মধ্যে কোনটা ঘুমের ? আমি প্রশ্ন করি ।

- বোধহয় সব কটাই । কোনোটা তোমার নার্ভ ঠান্ডা করবে , কোনোটা ঘুম পারাবে, কোনটা মোটামাথাকে ভালো মাথা করবে ।প্রতিমা বলে ।

-তাহলেতো চিরস্থায়ী নিদ্রা হবে ,আমি মজা করি।মজাটা কারুরই পছন্দ হয় না ।

-এভাবে কথা বলতে নেই, জানোতো । সব সময় ভালো চিন্তা করতে হ্য়।প্রতিমা রেগে যায়।

-কখন কোনটা খাবো লেখা আছে ?

-দেখো , তুমিতো শিক্ষিত লোক , প্রতিমা চিমটি কাটে।

-শিক্ষিত মনরোগী , বলে আমি প্রেসক্রিপশনটা দেখি। না ! বুঝতে পারছি না ।একেবারে হস্তিদলিত হস্তাক্ষর ।ফোন করলাম ডাক্তারবাবুকে । অক্লান্ত বেজে গেল ফোনটা। তুললেন না ।বললাম, তাহলে কাল থেকেই খাব ।জেনে শুনে বিষ পান করাই ভালো।বাড়ির সবাই মেনে নিল ।

আমি আজ শেষ স্বপ্ন দেখার সুযোগ পাবো। তারপর নো স্বপ্ন । শুধু বিশুদ্ধ ঘুম ।আমি ঘুমোতে গেলাম ।অনেক রাতে চাঁদের আলো বিষন্ন লাগে ।রাত্রে স্বপ্নের ভেতর আমি হাঁটছিলাম।মাথার ওপর একটা আধভাঙ্গা চাঁদ ।হাঁটতে হাঁটতে একটা জলাশয়ের ধারে ।একটা সিঁড়ি নেমে গেছে জলের ভেতর ।সিঁড়ির শেষধাপে কে একজন বসে আছে । আমি একটু নেমে তাকে দেখার চেষ্টা করতেই লোকটা মুখ ঘোরালো ।বাবা! আমার বাবা! আমি চমকে উঠি ।

-কি আশ্চর্য্য, তুমি এখানে বসে আছো । তোমাকে দেখে কি আনন্দ হচ্ছে আমার , তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না ।আমি আরো কাছে যাই ।

-আর তো আমায় দেখতে পাবি না ?

-কেন ? এসো না মাঝে মাঝে , এখানে সিঁড়িতে বসে গল্প করব।অনেক কথা জমে আছে আমার , তোমায় বলব ।

- আমারও। তোর কাছে মাঝে মাঝে আসব ভাবলাম , তা তুইতো আর আস্তে দিবি না ।ঘুমের ওষুধ খাবি , আমি আসব কি করে ?

-না , তাহলে খাব না , তুমি আসবে তো ?

- আসবো , তুই বরঞ্চ বাদামটা খাস ।তুই আর আমি দুজনে মিলে বসে বাদাম খাবো ।

-আসবে তো ? আমি বাদাম কিনে নিয়ে আসবো কিন্তু ।

-ওপরে চাঁদটা দেখছিস - কি সুন্দর ... !

আমি ওপরের দিকে তাকাই , তারপর সিঁড়ি, জলাশয় , চাঁদ সবকিছু মুছে যায়।কোথাও একটা শাঁখের শব্দ হতে থাকে ।আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় ।

আমি আবার আমার লুকিয়ে রাখা ডায়েরিটা বার করি ।লিখতে থাকি ।

-কি দেখলে, প্রতিমা পাশে এসে দাঁড়ায় ।আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসি , কথা বলি না ।আমার বুক তৃপ্তিতে ভরে গিয়েছে ।পুকুরটা আমায় খুঁজে বার করতেই হবে । যেখনে বাবা থাকে , বাবা আসে ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics