আত্মকথন
আত্মকথন
রোদে জ্বলা অনেকগুলো দিন পার করার পর যখন বৃষ্টি আসে, কেমন একটা প্রাণ আকুল করা গন্ধ উঠে আসে মাটির বুক থেকে, জানো তো? বন্ধ দরজা খুলে হুড়োহুড়ি করে তারে মেলা জামাকাপড় কুড়োতে যাব যেই, অমনি ধক করে বুকে এসে লাগে সেই গন্ধমেশানো হাওয়াটা। আ-আহ্! গতজন্মের স্মৃতির মতো করে সার বেঁধে সামনে এসে দাঁড়ায় এই গন্ধটার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিরা।
কবে যেন কার সঙ্গে খেলাঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাক্ষী ছিল এই সোঁদা গন্ধ। আবার কালের নিয়মে সেসব ছেলেমানুষি স্বপ্ন ধুয়ে ফেলে যবে আঁচলে বাঁধলাম আসল খেলাঘরের চাবি, সেদিনও আমায় ঘিরে ছিল এই একই গন্ধ, বৃষ্টিভেজা মাটির বাস। মজার ব্যাপার জানো, আমার প্রাণের পুতুল, আমার নাড়িছেঁড়া ধন যেদিন আমার কোলে এলো, সেদিন ছিল আষাঢ়ের প্রথম দিন, মরসুমের প্রথম বর্ষণও সেদিনই এসেছিল বাঁধ ভেঙে। ছেলের নাম রেখেছিলাম বরিষন। তাকে যখন আমার কোলে দিলো, খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসছিল মন মাতাল করা সেই ভিজে মাটির গন্ধ। সেদিনই আমার প্রথম মনে হয়েছিল, এ গন্ধ বোধহয় বাইরে থেকে আসে না, আমার ভেতরটাই বুঝি যখন এক্কেবারে শুকিয়ে যায়, তারপরেই বিধাতা কোনও না কোনও রূপে বরিষন আনেন আমার জীবনে।
আমার ছেলে পেটে যখন ছ'মাসের, ওর বাবা হারিয়ে গিয়েছিল। কেউ বলল অন্য কোথাও নতুন সংসার পেতেছে, কেউ বলল সন্ন্যাসী হয়ে গেছে, কেউ বলল কোনও মর্গে হয়তো বেওয়ারিশ লাশ হয়ে শুয়ে রয়েছে। কার কথা বিশ্বাস করবো বুঝতে পারিনি, জানো? মরুভূমির মতো ধু ধু একটা ভেতর নিয়ে নাড়ির ধনকে আগলাচ্ছিলাম দাঁতে দাঁত চেপে।
তারপর তো সে এলো, আমার বরিষন। কমবয়সী রূপসী একা মা কোলের ছেলেকে বড় করলাম ধু ধু করা অন্তর নিয়ে। ভিজে মাটির গন্ধ যে পাইনি তা নয়, আমার বরিষনকে বুকে চেপে রাত জাগা চোখে জোর করে ঘুম এনেছি, নিজেকে করে তুলেছি প্রায় তপস্বিনী। শুধু মাঝে মাঝে ভয় হতো, ছেলেটাও চলে যাবে না তো ওর বাবার মতো?
ভয় অবশ্য বৃথা হয়েছে, ছেলে আমার মানুষ হয়েছে। বিয়ে দিয়েছি তার পছন্দের মেয়ের সঙ্গে। আমার যে খুব ভালো লেগেছিল তা নয়, জাতে মেলেনি, তবে বারণ করতে ভয় পেয়েছি। যদি ছেলে চলে যায়! আজকাল আর জাতপাত কেই বা মানে! বউমা মানুষ ভালো, বুড়ি শাশুড়িকে দুচ্ছাই করেনি। আমিও অবশ্য খুব বেশি নাক গলাতে যাইনি। ছেলে-বউ যখন তাদের ঘরে দোর দিতো, আমার পাষাণ হয়ে আসা অন্তরটা কেঁপে উঠতো প্রথমদিকে। ভয় পেতাম, নজর লেগে যাবে না তো? হাজার হোক, স্বামীসোহাগ কী জিনিস ভুলেই গিয়েছি, কচি বউটাকে সে সোহাগ পেতে দেখে নজর দিয়ে ফেলব না তো? সরে এসেছি দিনে দিনে তাই।
বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধটা অনেকদিন পাইনি, জানো? সেটার কথাও ভুলতে বসেছিলাম। পেলাম আবার, যেদিন বউমা খবরটা দিলো। আমার ছেলে নাকি বাপ হবে! বউমা পোয়াতি থাকার সময়টা ছেলেটাকে কাছছাড়া করতে মন চাইতো না এক্কেবারে, বিশেষ করে শেষ দিকটায়। সে মানুষটাও তো এমন সময়েই হারিয়ে গিয়েছিল। ভয় করতো বড্ড। ছেলে বিরক্ত হতো খুব, একদিন তো বলেই ফেলল রাগের মাথায়,
"বাবাকেও এমনি করেই আঁকড়াতে নাকি মা? তাই বোধহয় সে মানুষটা... ব্যাটাছেলে আর কত সইবে?"
বউমা তাকে "চুপ করো চুপ করো, কাকে কী বলছ! মাথা খারাপ হলো নাকি তোমার?" বলে শাসন করলেও আমি জানলাম কী হয়ে গেল! এ মরুভূমিতে আর কোনওদিন যে বৃষ্টি নামবে না, বুঝে গেলাম।
তবে গন্ধটা এখনও পাই মাঝেমাঝে। আমার বরিষনের মেয়ে, ঝিরি, সে যখন আধো আধো বুলিতে তার বাবাকে ডেকে বলে, "বাবা, আমায় মা বলো!"
তখন তাকে দু'হাতে জড়িয়ে কোলে তুলে নিয়ে তার গালে গাল ঘষতে ঘষতে আমার ছেলে যখন বলে, "মা, মা গো, তুমিই তো আমার মা, আমার কাছেই এসেছ, জানি তো মা!" তখন বরিষনকে ঘিরে থাকে সেই গন্ধটা, রোদে জ্বলা অনেকগুলো দিন পার করার পর যখন বৃষ্টি আসে, তখনকার প্রাণ আকুল করা সেই ভিজে মাটির গন্ধটা।
আমার ভেতরটাও ভরে যায় সেই গন্ধে, ওরা জানতে পারে না, বোঝে না, দেখতে পায় না আমায়। আমি কিন্তু ওদের ছুঁয়ে থাকি সারাক্ষণ, ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধে।