Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

3  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

সেদিন বৃষ্টিতে শেষ পর্ব

সেদিন বৃষ্টিতে শেষ পর্ব

10 mins
691


সকাল থেকে পালা করে পাড়ার পাঁচ নম্বর বাড়ির গেটে মিউজিক বক্সে একবার সানাই, তো তার পরক্ষণেই সুরেলা রাইমস্ বাজছে..... টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল্ স্টার.... বা খোকা যাবে রথে চড়ে....

ইত্যাদি ইত্যাদি। ও আচ্ছা, পাঁচ নম্বর বাড়ির পরিচয়টাই তো দেওয়া হয় নি। এই বাড়িটা হোলো আমাদের জয়ন্বিতা মানে জয়ীর শ্বশুরবাড়ি, অর্থাৎ দেবব্রত মানে দেবুর বাড়ি। এই পাঁচ নম্বর বাড়ির কনিষ্ঠতম নতুন আগন্তুকের..... ও, পরিষ্কার হচ্ছে না বোধহয়, আগন্তুকটি হোলো দেবু-জয়ীর ছ'মাসের ছেলে জয়ব্রত, তার আজ শুভ অন্নপ্রাশন। বাড়িতে আজ উপচে পড়ছে বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার। সে জোয়ারের ঢেউ ছাই দিয়েছে নিন্দুকদের মুখে।


আহা, ভাবছেন তো কী ব্যাপার? নিন্দুকেরা আবার এখানে কেন? তাহলে আবার একটু পিছোতে হবে আমাদের, সময়ের উল্টো স্রোতে।



******



জয়ীর মেসেজ পেয়ে দেবু এক সোমবার পৌঁছে গেছে কফি হাউসের সামনে। কফি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে দেবু সেকেন্ডে বোধহয় দু-চারবার ঘড়ি দেখছে। বছর বাইশের জয়ীর জন্য অপেক্ষায় সাতাশ বছরের দেবুর মনে হোলো ঘড়িটা যেন বড্ডই আস্তে চলছে। এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, এখনো চারটে বাজছে না? আসলে দেবু তো পৌঁছে গেছে তিনটেরও মিনিট দশেক আগে, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে সোদপুর থেকে একেবারে সোজাসুজি ট্যাক্সিতে। কে জানে বাবা, ট্রেনে বাসে করে যেতে গিয়ে যদি প্রথম আনুষ্ঠানিক ডেটের দিনেই আবার লেট হয়ে যায়। সত্যি বলতে কী, ইউভার্সিটি টিমের ডাকাবুকো অলরাউন্ডার ক্রিকেট প্লেয়ার দেবুরও কিন্তু বুকটা ভারী ঢিপঢিপ করছে। কী কথা বলবে? মানে ডেটে এসে তো আর কেরিয়ার বা বেণুদার তেলেভাজা নিয়ে গল্প চলে না! ওহো হো, ভারী বিপদে ফেলে দিলো তো দেখা যাচ্ছে, জয়ীটা!

আরও বেশ অনেকবার ঘড়ি দেখার পর দেবুর মনে হোলো, কী দরকার ছিলো সেদিন জয়ীকে নিয়ে প্যারামাউন্টে শরবত খেতে যাবার? সেকেন্ড কয়েক পরই মনে হোলো, কী দরকার ছিলো পাড়ায় গলির মুখে দেখা হলেই হেসে কথা বলার? তার খানিক পর মনে হোলো, কথা হচ্ছিলো তো হচ্ছিলো, কেন যে মরতে জয়ীকে নিজের ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলো?



আরও বারদশেক ঘড়ি দেখে দেবু নিজেকে রীতিমতো দোষারোপ করতে শুরু করলো। বেশ তো জয়ী নিজের মতো নিজে ভিজে ভিজে অন্ধকারেই যাচ্ছিলো বাড়ি। কী দরকার ছিলো ওর, আগ বাড়িয়ে ছাতা ধরে টর্চ জ্বেলে জয়ীকে একেবারে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাওয়ার? জয়ীকে দেখে ভালো লেগেছিলো তো লেগেছিলো! তার জন্য এইরকম আদেখলপনা করা দেবুর নিজের একদমই উচিৎ হয় নি।



এখন এই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেবুর নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ঘড়ি থেকে চোখ তুলে সামনে তাকিয়েই একটা বড়সড় হেঁচকি তুললো দেবু। ওর একদম সামনে দু'হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে জয়ী। চোখে হাজার তারার দ্যুতি। আকাশী নীল কুর্তি আর সাদা গোলাপি ফ্লোরাল মোটিফের সালোয়ার দোপাট্টায় জয়ী যেন প্রথম বর্ষার অভিমানী মেঘ। এক্ষুণি ঝরে পড়বে বৃষ্টি হয়ে

..... টুপটুপ ঝুপঝুপ করে। শান্ত, স্নিগ্ধ, গভীর জয়ী।



দেবুর মনে হোলো কোলকাতা শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে একটা পাহাড়ী ঝর্ণা চলে এসেছে। জয়ী হাসছে..... ঝর্ণার মতো রিমঝিম তিরতির কুলকুল শব্দে। দেবুর মুখে পুরো কুলুপ।



জয়ীই মুখ খুললো প্রথম, "আমি ভেবেছিলাম সাড়ে তিনটেতে পৌঁছে যাচ্ছি, আধঘন্টা আগে। কাজেই চারটে পর্যন্ত আশেপাশের বইয়ের দোকানে গা ঢাকা দিয়ে থাকবো। ডট চারটেয় আসবো এখানে। কিন্তু বাস থেকে নেমে এগোতেই তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব মায়া হোলো.... তাই চলেই এলাম সামনে.... সময়ের আধঘন্টা আগেই।"



দেবু যেন এতক্ষণে ছন্দ ফিরে পেয়েছে জয়ীর কথায়। "খুব কথা তো দেখছি! মারবো একটা রামগাঁট্টা?" হাসতে হাসতে বললো দেবু।

ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো কথা। তারপরে আর কথা আটকায় নি কোথাও, পরের পাঁচ বছরে। এক আকাশ গান হয়েছে, এক সাগর গল্প হয়েছে, এক পাহাড় ঝগড়া হয়েছে, এক নদী কান্না হয়েছে, এক জঙ্গল অভিমান হয়েছে, তারপর এক মরুভূমি বিরহ কাটিয়ে.... আবার যে কে সেই, সেই খুনসুটি, সেই একে অপরকে চক্ষে হারানো আর একবুক না না, দু'বুক ভালোবাসাবাসি হয়েছে।



এর ফাঁকেই জয়ী বি.এড. শেষ করে এসএসসিতে চান্স করে নিতেই দু'বাড়িতেই আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়েছে দু'জনেই। যদিও দু'বাড়ির সবাইই জানতো, তবুও ওরা কখনো নিজের থেকে মুখ খোলে নি বলে, বাড়ির লোকজনও অপেক্ষাতেই ছিলো। দেবু তো অনেক আগেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি এক্সিকিউটিভ আমলা পদের চাকরিতে অধিষ্ঠিত। জয়ীর চাকরি পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো দু'জনেই। জয়ীও স্কুলে জয়েন করেছে বিয়ের সিদ্ধান্তের আগেই।



তারপর যেমন হয়, দু'বাড়ির সকলের মনে আনন্দ লহরী তুলে এক শুভদিনে শুভক্ষণে দেবু-জয়ীর চারহাত এক হোলো। ভাগ্যক্রমে দু'বাড়িই মুখার্জি.... তাই জয়ীকে আর পদবী বদলাতে হয় নি, তবে বসবাসের ঠিকানা বদলে পাড়ার আঠেরো নম্বর বাড়ি থেকে ও পাড়ারই পাঁচ নম্বর বাড়িতে এসেছে।



দেবুর বদলির চাকরি হলেও এমন দূরত্বে পোস্টিং যে বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতে পারে। আর জয়ীর স্কুল ব্যারাকপুরে, সোদপুরের বাড়ি থেকেই যাতায়াতই করে রোজ ওরা। কাজেই বিয়ের পরেও দাম্পত্যে প্রেম অটুট এবং দিনে দিনে আরও জমাট বেঁধেছে। দু'বাড়ির মধ্যেও অত্যন্ত সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগে নি।



জয়ী-দেবু দু'জনেরই ভয়ানক বেড়ানোর শখ। একসাথে দু-চার দিনের ছুটি পেলেই কপোত কপোতী ডানা মেলে উড়তে বেরিয়ে পড়ে টুক করে কাছাকাছি কোথাও। দু-এক দিনের ছুটিতে বাইক অথবা গাড়ি নিয়েই। আর ছুটি লম্বা হলে বেড়ানোর দূরত্বও লম্বায় বাড়ে। স্বদেশে বা বিদেশে ইচ্ছে মতো বেড়িয়ে নেয়।



বেশ চলছে এভাবেই। একটা দুটো করে সাতটা বছর পেরিয়েছে। এখনও জয়ী-দেবু দু'জন থেকে তিনজন হয় নি বা হতে পারে নি, কিন্তু তাতে ওদের প্রেমের জোয়ারে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে নি। তবে তা হলে কী হবে? দু'বাড়ির মা-বাবাই একেবারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নাতি নাতনির মুখ দেখার জন্য।

জয়ী-দেবু অনেকদিন ধরেই কিন্তু ট্রিটমেন্টে রয়েছে। বিয়ের পর বেশ অনেকগুলো বছর পার হয়েছে। এবার তো সন্তানপ্রাপ্তির জন্য শখ হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। দু'জনের মাঝখানে একটা ছোট্ট নতুন প্রাণের অস্তিত্ব। দু'টো ছোট্ট ছোট্ট হাতের মুঠি, দু'টো ছোট্ট ছোট্ট পায়ের স্পর্শ, ছোট্ট ছোট্ট দুই ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসি-কান্না..... এসবের জন্য জয়ী-দেবু দু'জনেরই মনটা উথালপাথাল হয়।



ডাক্তারী রিপোর্টে জয়ী সম্পূর্ণ সুস্থ, কোনো সমস্যাই নেই ওর, মা হয়ে ওঠার জন্য কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয়ীর নেই। দেবু ছোট থেকেই খেলাধূলায় তুখোড় ছিলো এবং ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত নিয়মিত ক্রিকেট খেলায় যুক্ত ছিলো। আর তাতেই অসাবধানতাবশতঃ ক্রিকেট বলের আঘাত খেলার সময়, অণ্ডকোষে। অল্পবয়সে সাময়িক যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠেই নিশ্চিন্ত ছিলো, এমনকি এই আঘাতের কোনো গুরুত্বই কিশোর দেবু দেয় নি।

ফলতঃ এই আঘাতের কথা বাড়িতে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করে নি। কৈশোরের ঐ আঘাতেই দেবু নিজের ও পরিবারের অজান্তেই বাবা হবার ক্ষমতা হারিয়ে বন্ধ্যাত্বের শিকার হয়ে বসে আছে।

শারীরিক মিলনে কোনো সমস্যাই নেই, নষ্ট হয়েছে কেবল পিতৃবীজ উৎপন্ন হওয়া। এবং নিরাময়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। বজ্রপাতের মতো এ ঘটনাতেও জয়ী ধীর স্থির, অত্যন্ত শক্ত মনের মেয়ে জয়ী ভেঙে পড়তে দেয় নি দেবুকে। কাউকে জানতে পর্যন্ত দেয় নি এতো গুরুতর বিষয়টিকে। জয়ীর মতে, "নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যায় বাড়িশুদ্ধু সবাইকে টেনশনের শেকলে জড়ানোর কোনো মানেই হয় না। নিজেদের সমস্যা আমরা নিজেরাই সমাধান করবো, সামান্যতমও বিভ্রান্ত না হয়ে।"



দেবু জয়ীকে বলেছে বহুবার, ডাক্তারের পরামর্শ মতো স্পার্ম ব্যাঙ্কের ডোনারের স্পার্মের সাহায্যে আইভিএফ পদ্ধতিতে গর্ভধারণ করে সন্তানের জন্ম দিতে। অনুনয় করেছে দেবু। জয়ী কিছুতেই রাজী হয় নি। জয়ী নিজের মতে ও সিদ্ধান্তে অনড়। জয়ীর মত, "যদি দু'জনের না হয় সন্তান, তবে একজনেরও হবে না।" এব্যাপারে আলোচনা বাড়তে দিতেই নারাজ জয়ী। জয়ীর স্থির সিদ্ধান্ত, জয়ী-দেবু একটি সদ্যোজাতকে দত্তক নেবে, দু'জনে মিলে নিজেদের সবটুকু উজাড় করে তাকে বড় করবে, মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে।



দেবুর জীবনের এই সামান্য কমটুকু.... এই সামান্য অপূর্ণতাটুকুকে আরও বাড়াতে, দেবুকে দগ্ধ-বিদ্ধ-আহত করতে চায় না জয়ী কোনোমতেই। আর তা চায় না বলেই জয়ী স্পার্ম ডোনারের সাহায্য নিয়ে নিজে গর্ভধারণ করে গর্বিত মা হওয়ার পূর্ণতার স্বাদ অর্জন করতে চায় নি। শুধুমাত্র এই কারণেই, জয়ী কাকপক্ষীকেও জানতে দেয় নি নিজেদের জীবনের এই সমস্যা, দেবুর শারীরিক সমস্যার কথা । শুধু ওরা অপেক্ষায় আছে একটি মনোমত সদ্যোজাত শিশুর। বিভিন্ন অরফ্যানেজ হোম, বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সাথে যোগাযোগ করছে ওরা। আর যতদিন যাচ্ছে দেবু আরও বেশী করে জয়ীর ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। জয়ীকে প্রতি মূহুর্তে দেবু দেখে আর নতুন করে আবিষ্কার করে ভালোবাসার অর্থ, প্রেমের মহত্ত্ব, মাধুর্য্য।

জয়ী আর দেবুর দিনগুলি কাটছে পারস্পরিক নির্ভরতায়। আপাতশান্ত নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের গভীরের চোরা ঢেউ বুকে নিয়ে।



ফাল্গুনের মাঝামাঝি, সেদিন দেবুর এক অফিস কলিগের বৌভাতের নিমন্ত্রণ ছিলো, শ্রীরামপুরে।

দেবু অফিস ফেরত সোজা ওখানেই গেছে, আর জয়ীও স্কুল ফেরত ব্যারাকপুর থেকে খেয়াতে গঙ্গা পেরিয়ে শ্রীরামপুরে ঐ বৌভাতবাড়ির রিসেপশনে পৌঁছেছে। দেবুর অফিসের সব বন্ধু-বান্ধবরাই ছিলো ওখানে। কাজেই আড্ডায় গল্পে আর তার সাথে অসময়ের তুমুল বৃষ্টিতে ওদের রিসেপশন থেকে বেরোতেই বেশ দেরী হয়ে যায়। সবাই বেশ হালকা মেজাজে, কারণ পরদিন শনিবার, সবারই অফিস ছুটি, কিন্তু শনিবার জয়ীরই শুধু ছুটির দিন নয়, ওর স্কুল আছে। তাই জয়ী-দেবু বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো, তাছাড়া সঙ্গে নিজেদের গাড়িও নেই। বিয়েবাড়ি থেকে এক বন্ধু তার গাড়িতে করেই ওদের কোন্নগর খেয়াঘাটে ড্রপ করে দিলো।



ওরা খেয়াঘাটে এসে যখন পৌঁছলো তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বেশ রাত হয়েছে, যাত্রী সংখ্যা খুবই কম। সম্ভবতঃ ওটাই শেষ লঞ্চ ছিলো।

অসময়ে কয়েক পশলা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে এই ফাল্গুনের মাঝামাঝিতেও বেশ শীত শীত করছে।

খুব অল্প সময় লাগে এখানে গঙ্গা পেরোতে। পার হয়ে লঞ্চ থেকে নেমে সোদপুর সংলগ্ন পানিহাটি ঘাটের জেটিতে যখন ওরা দাঁড়ালো, তখন আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফোঁটা গঙ্গার পাগলা হাওয়ার সাথে মিশে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভাসছে। ফাল্গুনের এই বৃষ্টিতে দু'জনেরই শীত শীত করে উঠলো, কিন্তু সঙ্গে তেমন বিশেষ শীতপোশাক নেই। জয়ীর গায়ে শুধু পাতলা একটা পশমিনা শাল, জড়িয়ে নিলো ভালো করে। তাছাড়া নিমন্ত্রণবাড়ি যাবার কথা ছিলো। তাই গাড়ি বা বাইক সঙ্গে নেই। রাত হয়েছে বেশ, তায় আবার বৃষ্টি, একটা রিক্সাও পর্যন্ত পেলো না, অটো তো দূর অস্ত। শুনশান রাস্তাঘাট, অসময়ের বৃষ্টিতেই হবে। দু-চারজন যাত্রী যা ছিলো, বৃষ্টির জন্য সবাই তাড়াহুড়ো করে বাড়ির পথে। জনশূন্য ফাঁকা রাস্তা, চারিদিকে কেমন একটা নৈঃশব্দ্য।



অগত্যা ওরা হাঁটতে শুরু করেছে বাড়ির পথে। ভালোই লাগছে বহুকাল পরে এভাবে হাঁটতে। গঙ্গার পাড় ধরে যে রাস্তাটা গেছে, সেটি ধরে খানিকটা হেঁটে গেলেই মহুয়া ঘাট। মহুয়া ঘাট থাকে ডাইনে বাঁক নিলে ওদের বাড়ি যাবার শর্টকাট রাস্তা। লঞ্চ ঘাট থেকে শ-দুয়েক মিটারও হবে না মহুয়া ঘাট। দেবু-জয়ীর এক সময়কার খুব প্রিয় জায়গা এটা, শান্ত, নিরিবিলি। প্রেমপর্বে, ওরা এখানে প্রায়ই এসে বসে গল্প করতো। তবে আজ দু'জনেই নির্বাক হাঁটছে পাশাপাশি, হয়তো দু'জনের মনেই চলছে অতীতের উঁকিঝুঁকি। মহুয়া ঘাটের কাছাকাছি আসতেই কানে এলো কয়েকটা কুকুরের সমবেত চিৎকার।



আরেকটু কাছাকাছি আসতে দেখলো কুকুরের দলটা ঘাটের একপাশে কোণের দিকটায় একটা অংশ ঘিরে চিৎকার করছে। এগোলো ওরা আওয়াজের উৎসটা লক্ষ্য করে। কেউ একটা কাৎ হয়ে পড়ে আছে না? দ্রুত পায়ে এগোলো ওরা। দেবু এগিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লো, ঘাটের ল্যাম্পপোস্টের ভেপার ল্যাম্পের ঘোলাটে হয়ে যাওয়া আলোয় দেখলো এই ঘাটের পথে পথে বহুকাল ধরে ঘুরে বেড়ানো পাগলীটা, পড়ে আছে কাৎ হয়ে। চারিদিক যেন একটু বেশীই ভিজে ভিজে, গাছের ছায়া থাকা স্বত্বেও। কুকুরগুলো ওদের দেখে সামান্য দূরত্ব রেখে সরে গিয়ে গরগর করতে থাকলো। দায়িত্বশীল পদস্থ সরকারি চাকুরে দেবু প্রবল নাগরিক বোধ থেকে আরও সামনে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখতে গেলো, ওর পাশে জয়ীও। অচৈতন্য পড়ে আছে পাগলী। চারধারে লালচে তরল গড়াচ্ছে। একী? পাগলীর হাঁটুর পেছনদিকে কুঁকড়ে পড়ে আছে এক সদ্যোজাত। পাগলী একাকী ঘাটের পাশে পড়ে এক সন্তানের জন্ম দিয়েছে! নাড়ী বিচ্ছিন্ন হয় নি, কে করবে নাড়ী বিচ্ছিন্ন? পাগলীর নাকের কাছে জয়ী আঙুল দিয়ে দেখলো শ্বাস বইছে মৃদু, ধকলে জ্ঞান হারিয়েছে পাগলী। জয়ী-দেবু হতচকিত, ভেতরে ভেতরে হয়তো কাঁপছে দু'জনেই। একী কাণ্ড!



সরকারি আমলা দেবু মূহুর্তমাত্র দেরী না করে নিজের পরিচয় এবং ঘটনার বিবরণ জানিয়ে লোকাল থানায় ফোন করলো। তারপর নিজেদের বাড়িতে ফোন করে বললো যে ফিরতে ওদের আরও কয়েক ঘণ্টা দেরী হবে, বাড়িতে যাতে কেউ চিন্তা না করে।



ঘন্টাখানেক সময়কে ওদের মনে হোলো কয়েক যুগ।



পুলিশের গাড়ি আর এম্বুলেন্স এসে পৌঁছেছে। পাগলীকে তার বাচ্চাসমেত তোলা হোলো এম্বুলেন্সে, স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজটি সাবধানে করলো, পুলিশ এবং দেবুদের তদারকিতে। জয়ী উঠে বসলো এম্বুলেন্সে, পরম মমতায় নিজের গায়ের পাতলা পশমিনা শালটা দিয়ে ঢেকে দিলো পাগলীকে।



হাসপাতালে ভর্তি করা হোলো পাগলীকে, পুলিশ ও সরকারি আমলা দেবুর হস্তক্ষেপে পাগলী খুব ভালো মতোই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেলো। নাড়ী কেটে শিশুটিকে আগেই হাসপাতালের নার্সারিতে নিয়ে গেছে কর্তব্যরত হাসপাতাল কর্মীরা। পাগলীও ট্রিটমেন্ট রেসপন্স করেছে, দেখে জয়ী-দেবু পুলিশের গাড়িতেই বাড়ি ফিরেছে।



এরপর ক'দিন ধরে রোজই জয়ী-দেবু পাগলীকে দেখতে হাসপাতালে গেছে। বাচ্চাটা কী সুন্দর! কত অবহেলায় জন্ম, তাও যেন দেবশিশু, ঈশ্বরের পুত্র।

তবে নার্স ইন চার্জের মুখে শুনেছে, পাগলী নাকি বাচ্চাটাকে দেখালেই ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।



সেদিনও বিকেলে জয়ী-দেবু হাসপাতালে, গিয়েই শুনলো মর্মান্তিক খবরটা, বাচ্চাটাকে দেখেই ভয়ে চিৎকার করতে করতেই বেড থেকে লাফিয়ে নেমে পালাতে থাকে। হঠাৎ এই ঘটনায় আয়ামাসিরা আর ওয়ার্ডবয়রা ধরতে পারার আগেই এক আয়ামাসির হাতে কামড়ে দিয়ে হাত ফসকে পালায় পাগলী। আর দৌড়তে গিয়েই টাল সামলাতে না পেরে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে পড়ে যায়। মাথায় হেভি ইনজুরিতে প্রবল রক্তপাত আর দুর্বলতা তো ছিলোই। দুর্ঘটনার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাগলী মারা গেছে। পুলিশ এসে তদন্ত করে গেছে খানিকক্ষণ আগেই। বাচ্চাটিকে হয়তো হোমে পাঠানো হবে কয়েকদিনের মধ্যেই, সম্পূর্ণ সুস্থ করে।



আর পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও হয়তো দেবুদের জানাতো, দেবুর উদ্যোগের কারণেই হয়তো বাচ্চাটিকে অন্ততঃ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। তা নাহলে ঠিক কী পরিণতি হোতো কে জানে? হয়তো গঙ্গার ঘাটেই মা বাচ্চা দু'জনেই মরে পড়ে থাকতো। জয়ীর মনে হোলো শেষ রক্ষা হোলো না, পাগলীকে মেন্টাল হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো দেবুর উদ্যোগে।



জয়ীর মনে হোলো, আপাতদৃষ্টিতে পাগলীর জীবনের, বেঁচে থাকা বা মরে যাবার কোনো গুরুত্বই কারুর কাছে নেই, অথচ এই পাগলীর রক্তমাংসে গড়া নারীদেহটার কিন্তু দিব্যি দাম অবশ্যই আছে.... মানে ছিলো কোনো পুরুষের লালসার.... কামাগ্নির পরিতৃপ্তি ঘটাতে। কী অমানবিক!



যাই বা হোক, পাগলী মরে মুক্তি পেয়েছে হয়তো, শান্তি পাক পাগলীর বিদেহী আত্মা। পাগলী এখন সব বিতর্কের ঊর্দ্ধে। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাবার কথা ছিলো পাগলীর, কিন্তু চলে গেছে সুদূর কোনো দেশে। মৃত্যু তো পাগলীকে না হয় মুক্তি দিলো, কিন্তু বাচ্চাটা এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্মে কী পেলো?



জয়ী-দেবু মনঃস্থির করে ফেলেছে, সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে এবং সব সরকারি নিয়ম কানুন মেনে ওরা দত্তক নেবে সেই অমৃতের পুত্রকে। সব সরকারি বিধিনিষেধের বেড়াজাল অতিক্রম করে জয়ী-দেবু পাগলীর অবাঞ্ছিত ছেলের আইনি বাবা-মা হোলো।



জয়ী-দেবু ওদের দশদিন বয়সী "কবীর"কে কোলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরোলো.... শেষ ফাল্গুনের অকাল বৃষ্টি টুপটাপ রিমঝিম শব্দে কয়েক ফোঁটা এসে মিশে গেলো জয়ীর চোখ থেকে গড়ানো স্নেহধারায়, আনন্দাশ্রুতে.... দেবলোকের পুষ্পবৃষ্টির মতোই। জয়ী-দেবু বাড়ির পথে, কোলে কবীর, জয়ী-দেবু আজ নতুন ভূমিকায়। বড়ো শুভ দিন, সেদিন যে সেই দেবশিশুর ঘর পাবার দিন, পরিবার পাবার দিন, ঠিকানা পাবার দিন.... সত্যিই বড়ো শুভ সেদিন।জয়ী-দেবুর জীবনবৃত্ত সম্পূর্ণ হবার দিন সেদিন।



সেই কবীর অর্থাৎ জয়ব্রত মুখার্জি.... দু'বাড়ির দাদু দিদার মধ্যমণি । আজ তার শুভ অন্নপ্রাশনে আমরাও সবাই আমন্ত্রিত কিন্তু। প্রার্থণা জয়ব্রত খুব শুভ সুন্দর জীবনের অধিকারী হোক।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics